ইশ্রাতের সাথে এক রাত

রাত (মে ২০১৪)

মোঃ মোজাহারুল ইসলাম শাওন
  • ১৬
শাহেদ প্রায় ৪ বৎসর পর গ্রামের বাড়িতে ২ দিন থাকার সময় পেল। চাকুরি সংসার আর পেশাগত কাজের চাপে দেশে আসা হলেও থাকা হয় না। এবার অফিসের কাজে এসে ২ দিন থাকার সময় পাওয়ায় সে নিজেকে খুব গর্বিত মনে করছিল। দুপুর ১২ টার মধ্যে অফিসের কাজ শেষ হলে সে নিজের বাড়িতে এসে একটানা ৪ ঘণ্টার ঘুম দিয়ে গত রাতের নির্ঘুম বাস জার্নির ক্লান্তিকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলল। বিকেলে ৬ টার দিকে আসর নামাজ পরার পর থেকে মাগরিব নামাজ আদায়ের ফাঁকের এই আধাঘণ্টা সময় সে বসে প্লান করল, কিভাবে এই দুই দিন সে কাটাবে। এই সেই বগুড়া শহর যেখানে অনেকের মত সেও তার কিশোর ও যৌবনের মূল সময়গুলো পার করেছে। তারা চার বন্ধু ছিল ফজলু, আসলাম, মানিক আর সে। তারুন্যের সেই কলেজ পেরুনো ফলের অপেক্ষায় থাকা জীবনের কত রাত তারা ৪ জনে এই রেল লাইনের উপর কাটিয়েছে, তার ইয়তা নাই। কত স্বপ্ন, কত ভাবনা একত্রে থাকার কত কিনা পরিকল্পনা করেছে ,এই রেল লাইনের ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনতে গুনতে ! বিশেষ করে ভরা পূর্ণিমার উজ্জ্বল জ্যোস্না মাখা মায়াবি রাত গুলোর কথা সে এখনো মনে হলে নস্টালজিয়ায় ভোগে। এই রাত গুলো তাদের নিশাচর বানিয়েছিল এবং রাতের ভীতি কাটাতে সাহায্য করেছিল। এখনো এই পরিনত বয়সে সেই সকল রাতের কথা মনে করে তারা সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।

বাস্তব জীবনে ৪ বন্ধুর সে নিজে সহ ৩ জন ব্যস্ত ঢাকা শহরেই কাটায়। এক ফজলু থাকে এই বগুড়া শহরে। জীবন জীবিকার টানে তার সাথেও কর্ম ব্যস্ততায় দেখা হয়ে উঠে না। এবারো হল না, শুধু বার দুই মোবাইলে কথা হল এই যা ! সন্ধ্যায় যখন ফজলু জানালো যে, সে এক জরুরী কাজে সাত মাথায় চলে গেছে তখন শাহেদ একাই বাসা থেকে বেড় হলো। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে রেল লাইন ধরে হাঁটছিল আর অতীত চারণ করছিল। শুক্লা পক্ষের ৩য় রজনীর রূপ অল্প সময়েই তাকে খুব ভাবুক করে ফেলল । যদিও কিশোরের সেই গ্রামীণ আবহ আর পাওয়া যায় না। এমন কি রেল লাইনের সুন্দর পরিবেশ এখন শ্লীলতাহানীর দোষে দুষ্ট হলেও, একাকী শাহেদকে কোন এক মায়ায় কেন যেন টানছিল। বিদ্যুতের আলো আর পাশের ব্যস্ত রাস্তার গাড়ির হেড লাইট তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটালেও, সে একা একা হেঁটেই তিনমাথা রেল ঘুমটি থেকে বগুড়া রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। আধা কিলো যাওয়ার পর একটু শুনশান নীরব এলাকা পেয়ে মনে এক অজানা ভয় দেখা দিল। শাহেদ বুঝছিল যে, বয়স সামাজিক অবস্থানের কারণে তার মনে জাগা এই ভয় অমুলক নয়। সে আশেপাশে একটু তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে সন্তর্পণে পা ফেলছিল। কথায় আছে যেখানে বেশী সতর্কতা সেখানেই বিড়ম্বনার শুরু হয়। শাহেদ সেই বিড়ম্বনার কেন্দ্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো। সেই জড়িয়ে যাওয়ার ফলেই আজকের এই রাতের গল্প লেখা শুরু...

শাহেদ ঠিক যখন পুরন বগুড়ার সীমানায় পা দিলো, তখন খেয়াল করল রাতের আকাশে ভরা জ্যোস্না। সেই জ্যোস্নার আলোতে তাকে অনুসরন করছে এক বোরকাওয়ালা নারী। তাকে আসলেই অনুসরন করছে কিনা বোঝার জন্য সে থেমে গেলো, চলন্ত বোরকাও তার গতি থেমে ফেলল। এইভাবে দুই দুই বার করার পর একই ফল পেলে শাহেদ দ্রুত উলটো দিকে হাঁটা শুরু করল। এতে বোরকাওয়ালি নারী কি করবে বুঝতে না পেরে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। শাহেদ তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে স্পষ্ট শুনতে পেলো বোরকার ভিতর থেকে ভেসে আসা কথা, ‘আমাকে নিবেন? আমি একা যদি...’
শাহেদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি করবে সে... মেয়েটি একটি বাজে মেয়ে সন্দেহ নাই। তার এই সব কাজে কোন অভ্যাসও নাই। আবার মেয়েটি কি একা না দূরে তাদের কেউ ফলো করছে কিনা বুঝতেও পারছিল না। কোন চক্রে ফেঁসে গেলে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। নিজ শহরে মাঝ বয়সি তারুন্য আর কিশোর বয়সের স্মৃতি ফেরি করা শাহেদ এড়িয়ে যাওয়া আর ভয় পাওয়াকে কাপুরুষত্ব মনে করে, মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ানোর দ্রুত সিধান্ত নিলো !
সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে কিছু বললেন?’
এই সকল মেয়েদের তার জানামতে সকলেই তুই তাকারি করে কথা বলে। কিন্তু শাহেদ তাকে আপনি করে বলায় মেয়েটিও কি একটু আশ্চর্য হলো?
সে বলল, ‘সরি, আমি আপনাকে বিরক্ত করলাম কি !’
শাহেদ বলল , ‘না, ঠিক বিরক্ত করা বলব না; কিন্তু আমাকে কেন টার্গেট করলেন, বুঝলাম না। আমার এসবে অভ্যাস নাই !’
মেয়েটি বলল, ‘স্যার আমি খুব অসহায় মেয়ে বাধ্য হয়ে এই পথে। আমি বাজে মেয়ে নই !’
শাহেদ এই পথের পথিক নয় বলে বুঝতেও পারছে না যে, এই মেয়েগুলো আসলে কিভাবে কথা বলে। তবুও সে বলে উঠল, ‘তুমি আমাকে অনেকক্ষণ থেকে ফলো করছ। কারণ কি জানতে পারি !’ শাহেদ এর মনে কিছুটা রাগ এবং ক্ষোভ দানা বাঁধল বলেই আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে ফেলল।
মেয়েটি বলল, ‘স্যার, রাতে ভালো মানুষ ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে যায়। যারা সুযোগ খুঁজে তারা এই অন্ধকার রাস্তায় চলে। আমরা সেইটি জানি বলেই পিছু নেই !’
শাহেদ এইবার বুঝতে পারল যে, এই মেয়েটি তাকে খারাপ মানুষ ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েই পিছু নিয়েছে। তার অতীত স্মৃতি খোঁজার বিষয়টি এই মেয়েকে বললে ও কি বিশ্বাস করবে? মনে হয় না। শাহেদের এই মেয়েটিকে নিয়ে সময় কাটাতে ইচ্ছে হলো। সে ঐখানেই বসে পড়ল ! বসতে বসতে বলল, ‘এই মেয়ে এখানে বসো আগে, দেখি তুমি কি কি করতে চাও !’
মেয়েটির বোরকার ভিতর থেকে খিল খিল করে মন সম্মোহনী হাসি বেড়িয়ে এলো। শাহেদ জীবনে এই বার নিয়ে ২য় বার এই এতো সুন্দর হাসি শুনলো। ১ম বার এমন সুন্দর হাসি শুনেছিল আজ থেকে ৩২ বৎসর আগে ট্রেনের ১ম শ্রেণীর কামড়ায় বাবার সাথে বসে থাকা বুয়েট এর প্রাক্তন এক অধ্যাপকের কিশোরী মেয়ের গলায়! শাহেদ চমকে উঠে ভাবল, সেই মেয়ে নয় তো !

রেল লাইনের ঘাসের ওপর শাহেদের প্রায় গা ঘেঁষে মেয়েটি বসল। জ্যোস্নার আলো এতক্ষনে আরও তীব্র হয়েছে। স্পষ্ট সব কিছু দেখা যাচ্ছে। ২০০ গজ দূরের আগে কোন বাড়ি নাই। আর পিছনের ব্যস্ত রাস্তার টিউব লাইটের আলোর তীব্রতা জ্যোস্নার আলোর তীব্রতাকে ম্লান করতে পারেনি। শাহেদ নিজেই আগে মেয়েটিকে বলল, ‘এই মেয়ে তোমার নাম কি?’
মেয়েটি তার কিননোর কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘ইশ্রাত, ইশ্রাত আহমেদ !’
শাহেদ বুঝে উঠতে পারল না, এইটি কি আসল নাম না নকল। এই পথে আসল নাম বলার কোন দরকার নাই। আর মেয়েটির স্বাভাবিক জড়তাহীন উত্তরে সে ভাবতে লাগলো মেয়েটি বেশ ঝানু খেলোয়াড়। শাহেদ বুঝল না এখন কিভাবে সে আলাপ চালাবে। কারণ তার তো অন্য কোন ইচ্ছা নাই।শুধু সময় কাটানো আর যদি এই রাতে কোন গল্প খুঁজে পায় সেইটিই উদ্দেশ্য!
আনাড়ি শাহেদ মিনমিন করে বলল, ‘আচ্ছা এইটি কি তোমার আসল নাম? আর আহমেদ কেন? এটি কি বাবার না স্বামীর ?’
মেয়েটি মনকাড়া সম্মোহনী হাসিতে রাতের আকাশ মাতিয়ে তুলল। শাহেদ খুব ভয় পেয়ে গেলো। ও ভাবল আসলে এই মেয়েকি ওকে কোন ফাঁদে ফেলতে চায় নাকি। তার পকেটে এখনো ১০ হাজারের উপরে টাকা আছে। দুপুরে পকেট থেকে বেড় করে রাখতে ভুলে গিয়েছিল। চুপ করে পকেটের ফুলো চাপ দিয়ে টাকার অস্তিত্ব পরখ করলো।
ভীত কণ্ঠে বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগছে, তুমি কি বোরকা খুলবে !’
ইশ্রাত আহমেদ নামের মেয়েটি দ্রুত গায়ের বোরকা খুলে ফেলল। জেনো সে এই আহবানের অপেক্ষা করছিল। শাহেদ ভাবলো মেয়েটি কি পরের গুলোও এমন দ্রুত খুলে ফেলবে নাকি! গরমের রাত হলেও এতোক্ষন শাহেদ খেয়াল করল তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে। সে পকেট থেকে রুমাল বেড় করে মুছতে যাবে এমন সময় ইশ্রাত বলল, ‘স্যার এখানে থাকবেন না বাসায় যাবেন ! ভয় নাই, বাসায় গেলে রেট বেশী নেবো না। আপনাকে দেখে আমার মনে ধরেছে। আপনি খুব নতুন মুখ । যা দিবেন, দিয়েন; তবে মাগনা হবে না !’
শাহেদ মুখ মোছা শেষ করে বলল, ‘আমার বাসায় নেয়া সম্ভব না। আমি এখানেই...’
ইশ্রাত মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমার আপত্তি নাই। কিন্তু পুলিশ এলে আপনার সমস্যা হবে। আমার পিঠে দুই একটি লাঠির বারি আর খুব বেশী হলে দুদুতে দুই একটি চাপ পড়বে। ওসব আমাদের সইতে হয় স্যার !’ বলেই আবার হাসতে শুরু করল। শাহেদের মনে হল এই হাসি পাশের রাস্তা পেড়িয়ে দূরে যে বড় দালান দেখা যাচ্ছে ,সেখানে আঘাত করে ফিরে আসছে নিনাদের সুরে এবং সেখানের বারান্দায় এক মহিলা সব দেখছে !

শাহেদ কি মনে করে মেয়েটির দিকে এইবার ভালো করে তাকালো। ভরা চাঁদের তীব্র জ্যোস্নার আলোতে মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছিল। এই মায়াবী আলোয় তার মনে হল মেয়েটির বয়স ৩৪-৩৫ হবে । তবে এর কম ছাড়া বেশী নয়। রূপবতী মেয়েটিকে ভালো করে দেখার পর হটাৎ করেই ওঁর মন থেকে লজ্জা ভয় ডর সব নিমিষেই উড়ে গেলো। ওর মনে হলো ৩২ বৎসর আগে দেখা সেই কিশোরীর ছায়ার শতভাগ এই মেয়ের উপর বিদ্যমান। শাহেদ সাহসের সাথে মেয়েটিকে বললো, ‘ইশ্রাত, আমি এতো দ্রুত তোমার সাথে সব কিছু করে তোমাকে বিদায় দিতে চাই না। তোমাকে আমার জানতে হবে। যদি ভালো লাগে তো সব হবে, নইলে তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব কিন্তু, বুঝেছ !’
ইশ্রাত এইবার আরও কাছে এসে বলল, ‘ তাইলে বাসায় গেলে ভালো হতো না, এখানে তো পুলিশের ভয় আছে !’
শাহেদ বলল, ‘পুলিশ কিছু বলবে না, আমি পুলিশের দুলাভাই !’ পেশাগত কাজে পুলিশের সাথে কাজ করতে হয় বলেই এই রসিকতা সে করল। কিন্তু ইশ্রাতকে একটু ভীত মনে হতে শুরু করল। তার রুপালি মুখে কেমন এক সাদা ছত্রাকের মত দাগ দেখা গেল। শাহেদের ডান হাত হটাৎ করেই ধরে এক টানে বুকের কাছে নিয়ে বলল, ‘আমাকে পুলিশে দিবেন না, পিলিজ তাহলে ও যে না খেয়ে থাকবে ! সারাদিনে কোনমতে দুই বেলা খাবার ওকে দিতে পারি, সেইটি বন্ধ হলে ও মরে যাবে যে !’
এই ঘটনায় শাহেদের মনে চাবুকের ঘা পরল। সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ফ্যাস ফ্যাস করে বলল, ‘কে? কে? কে না খেয়ে মরবে ?’
ইশ্রাত বলল, ‘আমার স্বামী। পঙ্গু হয়ে বিছানায় আজ ৩ বৎসর।’

রসময় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। শাহেদের লেখক মনে চঞ্চলতা বাসা বাঁধল। সে গল্পের পয়েন্ট পেয়ে বলল, ‘তোমার স্বামী ! তুমি স্বামীর জন্য রাতের নিশাচরী ? তুমি দেহ ব্যবসা করে স্বামীকে খাওয়াও, আমাকে এইটি বিশ্বাস করতে হবে !’
ইশ্রাত এতোক্ষন শাহেদের ডান হাত ধরেই ছিল। এইবার ছ্যাঁত করে সেইটি ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘তা বিশ্বাস করবেন ক্যান? আপনেরা পুরুষরাই সব মহামানব, পীর ,দয়ার সাগর ! আপনারাই শুধু ভালোবেসে পঙ্গু বউকে খাওয়ান, আমরা মেয়েরা শুধু ভোগ করি, দান করিনা, নাহ !’
ওর কণ্ঠে প্রতিবাদ আর ক্ষোভের আগুন। শাহেদ কি করবে বুঝতে পারছে না। তার এই দোমনা ভাব দেখে আবারো ফোঁস ফোঁস করে ইশ্রাত বলে উঠল, ‘আমার বর্তমান পরিচয় রাস্তার বেশ্যা । আমার কথা কেন বিশ্বাস করবেন ! কিন্তু স্যার, আমি আপনাকে কোনদিন এদিকে দেখিনি। আপনার বাড়ি কোথায় জানিনা। এই শহরের কিছু আপনি চিনেন কিনা জানিনা। তবুও আমি বলে যাচ্ছি। যদি না চিনেন তো আগামীকাল দিনের আলোয় চিনে নেবেন। আমি খারাপ মেয়ে হতে পারি, মিথ্যা বলিনা। চেলোপাড়া চিনেন? সেইখানে বড় এক চোখের হিন্দু ডাঃ এর হাসপাতাল আছে। আমি ইচ্ছে করেই সেই ডাঃ এর নাম বলছিনা। আপনি খুঁজে নেবেন। তার হাসপাতালের গলির ঠিক দুই বাড়ি পরে একটি বেড়ার বাড়ি আছে। আগে সেখানে অনেক বড় বাড়ি ছিল, এখন মাত্র দুই রুমের একটি বাড়ি। ঐ বাড়ির এক রুমে এক পঙ্গু মানুষ শুয়ে থাকে। তার শরীর পচে গেছে। গন্ধে আপনি তিন মিনিট টিকতে পারবেন না। সারাদিন তার সেবা করি, বাইরে বেরুতে পারিনা। রাতে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারাতে হয়। আমি তাকে রেখে এদিক সেদিক বেড়িয়ে পরি। স্যার, চাকুরি খুঁজেছি। কিন্তু দিনে চাকুরি করলে তাকে কে দেখবে ! আমাকে না দেখলে সে পাগল হয়ে যায় যে !’
শাহেদ চুপ করে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইশ্রাতের কথা শুনে যাওয়াই লাভজনক। সে বলল, ‘কিন্তু এই মানুষের কি আর কেউ নাই? মানে ওর বাবা মা ভাই বোন?’
ইশ্রাতের কণ্ঠ বেশ নরম হয়ে এলো। দীর্ঘ কথা বলে ক্লান্ত না, মনে হয় আবেগে তার কণ্ঠ ভিজে যাচ্ছে। সে বলে উঠল, ‘থাকবে না কেন? আছে। সবাই আছে ! ওরা অনেক বড় লোক। ঢাকা শহরের মগবাজারের চার ৪টি ৫ তালা বাড়ি আছে। আজ থেকে ৯ বৎসর আগে আমাকে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি। আমার বিষয় ছিল ফার্মেসী। স্যার, আপনার কি সময় হবে, তাইলে বলতে চাই। আপনি আজ আমার অহমবোধে আঘাত দিয়েছেন। রাস্তায় থাকলেই সবাই অমানুষ নয়, স্যার ! আপনেরা আমাদের এই পথে আনেন, ব্যবহার করেন, আবার আমাদের গালমন্দ করেন। ততদিনে আমাদের নেশা হয়ে যায়। এই পথে একটু আধটু গালমন্দ শুনতে বা বলতে খারাপ লাগেনা যে !’

শাহেদ বুঝল মেয়েটি তো লাইন ক্রস করছে।তাই সে তাকে বলল, ‘এসব বলার দরকার নাই। আমি এই পথের পথিক না বুঝতেই পেরেছ ! তুমি যদি কিছু না মনে কর তোমার স্বামীর গল্প শুনাও !’
ইশ্রাত বলল, ‘জি স্যার বলছি। আজ নিয়ে ২য় বার। এর আগে একজন আমার স্বামীর বন্ধুকে বলেছিলাম। উনি আমাকে স্বামীর চিকিৎসা করাবেন বলে ডাঃ চিনানোর জন্য আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে বেড় হলেন। পরে ৩ দিন তার এক বাসায় আটকে রেখে ভোগ করলেন, উধাও হয়ে গেলেন। যদিও তিনি ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, ৩ রাতের বেতন... কিন্তু আর কোন কাজ খুঁজতে ইচ্ছে করেনি বলেই, সেই থেকে আমি এই পথে স্যার !’
আমি বললাম, ‘ইশ্রাত, তুমি তোমার স্বামীর গল্প বলো ! তাকে পাওয়ার গল্প !’
ইশ্রাত বলল, ‘বলছি স্যার। আমি তখন রাবি থেকে পাশ করেছি। রুয়েট এর এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে প্রেম করতাম। গভীর প্রেম স্যার। সে বলেছিল যে সে খুব বড় লোকের ছেলে। দুই বন্ধু বাসা ভাড়া করে থাকত। ভালোবাসে সেই বাসায় অনেক দিন গিয়েছি। নিজেকে সম্পূর্ণ উজার করে দিয়েছি। চুমু খেয়েছি, শুয়েছি। তা হবেই তো ১০-১২ বার। সে পাশ করলে কুষ্টিয়ায় চাকুরিতে যোগ দিল। আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। সে আমাকে কুষ্টিয়া নিয়ে বেড়াতে চাইল। আমি রাজী হলাম। এক রাতে আমাকে এক হোটেলে রেখে সকালে নাস্তা আনতে গিয়ে সে হারিয়ে গেলো। তার ফোন নং বন্ধ, তার বন্ধুর নাম্বার বন্ধ। দুপুরে আমাকে হোটেলওয়ালা বলল যে, যাওয়ার আগে আমাকে সে বিক্রি করেছে ২৫ হাজার টাকায়। সেই জায়গা কুষ্টিয়া ছিল না, ছিল গোয়ালন্দ ঘাট ! আমি সারাদিন ঘরে বন্দী ছিলাম। রাতে ঘরে ঢুকল এক তরুণ । কেমন পাগলের মত তার মাথার চুল। দেখতে ভয়ংকর সন্ত্রাসীর মত। আমি চিৎকার দিয়ে বিছানায় পরে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি ঐ ব্যক্তি আমার চোখে মুখে পানি দিয়ে খুব ভীত চোখে তাকিয়ে। আমার চোখ খোলা দেখে আনন্দে বলল, ‘এই মেয়ে তুমি আমাকে খুব ভয় পেয়েছ না? কিন্তু আমি তো তোমাকে কিছুই করিনি, ভয় পেলে কেন?’

শাহেদ পকেট হাতিয়ে একটি সিগারেট বেড় করলো। সারাদিনে সে ৩ টি সিগারেট খায়। ওষুধ খাওয়ার মত নিয়মিত ৩ বেলা খাবার পর পর। গত ২৬ বৎসর এই নিয়মের ব্যতিক্রম করেনি। আজ রাতে খাবারের পর খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পারলো না। সত্য না মিথ্যা বড় কথা না। ঘটনাটি যেভাবে বর্ণনা করছিল, তাকে না শুনে উপেক্ষা করা সম্ভব না। সিগারেট ধরানো দেখে ইশ্রাত একটু পিছে সরে গেলো। সম্ভবতঃ সিগারেটের ধোয়া সে সহ্য করতে পারেনা। আকাশের দিকে মুখ তুলে সিগারেটে কষে একটি টান দিলো। এরপর শাহেদ বলল, ‘তারপর?’
ইশ্রাত বলল, ‘আমাকে নাকি এখানে বিক্রি করে গেছে। এইটি কি সম্ভব? মানুষ কি বিক্রি হয় নাকি? আমি কি করবো বলুন তো !’
তরুণ বলল, ‘ তুমি কে জানিনা ! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব শিক্ষিত, কিন্তু বোকা। তবে তোমার ভালোবাসা খুব সহজ সরল। ঐ ব্যাটা কেন তোমার ভালোবাসা বোঝেনি আমি জানিনা। তবে তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে, সত্য। আমি তোমার ১ম খদ্দের !’
ইশ্রাতের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেইদিন তার অবস্থা কি ছিল। সে বলে চলল, ‘আমি ছেলেটির পা ধরে বললাম যে আপনি আমার ভাইয়া। আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে আমার বাসায় পৌঁছে দিন, পিলিজ !
ছেলেটি খুব জোরে হাসল। তার হাসির শব্দে আমার মনে হলো যেন ঘরের বাতি গুলো কাঁপতে লাগল। সে বলল যে, ‘আমি তোমাকে উদ্ধার করবো ২ টি শর্তে। যদি রাজী হও, আমি এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে যাব। আর যদি রাজী না হও তো আমি এক্ষুনি ভোগ না করেই চলে যাব, কারণ তুমি আমাকে ভাইয়া ডেকেছ !’
ইশ্রাত বলছিল, ‘আমার তখন বেড় হওয়ার ভিন্ন অন্য কোন কিছুই মাথায় আসছিল না। আমি সাথে সাথে উঠে বসলাম। তারপর তার চোখের দিকে চোখ রেখে বললাম কি শর্ত আমি জানিনা। আমি জানতেও চাইনা। আপনি যদি আমাকে ছিঁড়ে কুড়ে খেয়েও ফেলেন, আমি কিচ্ছু বলব না। পিলিজ, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন!’

ইশ্রাত দম নিবার জন্য একটু থামলো। আবার শুরু করলো, ‘এরপর উনি মোবাইলে কয়েকটি ফোন করলেন। এক ঘণ্টা পর আমাকে নিয়ে ঘরের বাহির হলেন। আমাকে কিছুই বললেন না। বাইরের খোলা আকাশ দেখে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। উনি আমাকে নিয়ে হোটেলে ঢুকলেন। দুজনে খেলাম কোন কথা হলো না। আমাকে নিয়ে পরেরদিন মগবাজার এলেন। উনার মা বাবা আমাদের বাসায় ঢুকতেই দিলেন না। উনি বারবার বোঝাতে চাইলেন যে, আমার সাথে তার কোন রিলেশন হয় নাই। বাসায় নিয়ে মেয়েটি ফ্রেশ হলে ঠিকানা নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিবেন। কেউ তার কথা শুনলেন না। উনি আমাকে নিয়ে আবার বাহির হলেন। বগুড়ায় এলেন রাতেই। এখানে এক বন্ধুর বাসায় উঠলেন।
রাতে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাকে বগুড়ায় কেন আনলেন? আমার বাসা তো ঢাকায়, ওখানে পৌঁছে দিলেন না কেন?
উনি বললেন যে, ‘এই মেয়ে, আমি এক থাপ্পরে তোমার সব কয়টি দাঁত ফেলে দিব। ঢাকায় থাকতে এই কথা বললে না কেন?’
আমি বললাম, ‘আপনার শর্ত ২ টি তো শুনা হয়নি তাই !’
যেমন গম্ভীর গলায় থাপ্পর দিতে চাইলেন তার ঠিক উলটো প্রেমময় গলায় হেসে উঠে বললেন যে, ‘আরে তাই তো ! শর্তগুলো তো বলা হয়নি !; বলেই খুব সহজ করে বললেন যে, ‘গতকাল ভেবেছিলাম যে দুই শর্ত, তা আজ বাদ দিয়েছি। আমার এই মুহূর্তের শর্ত হলোঃ
এক) তুমি আমাকে আমার মৃত্যুর আগে ছেড়ে যাবে না।
দুই) আমাকে বিয়ে করবে, সুখ দেবে !
আমি ৩ মিনিট চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমি রাজী !’

ইশ্রাত বলেই চলছিল, ‘স্যার, আমার স্বামীর নাম জামান আহমেদ। সেই থেকে আমি ইশ্রাত আহমেদ, যদিও আমার বাবার নাম জুলফিকার আহমেদ। জামান এরপর বাসের ড্রাইভারগীরি করা শুরু করল। অনেক কষ্ট করলো আমার জন্য। শুধু আমার জন্য তার মত বড়লোকের সব কিছু ত্যাগ করে চলে আসতে হলো। সে হাসি মুখে তার এই অবস্থা মেনে নিলো। ১৫ দিন পর আমাকে আরও একটি শর্ত দিল যে, আমি যেন কোন দিন তার আত্মীয়দের কাছে না দাঁড়াই। কিন্তু স্যার, ৪ বৎসরে আমাদের কোন সন্তান হল না। ওর খুব ইচ্ছে ছিল সন্তান নেবার, কিন্তু আমার দোষে হলো না। ৩ বৎসর আগে সে এক এক্সিডেন্টে করে নিচের অংশ পুরো পঙ্গু হলো। প্রথম প্রথম বন্ধু বান্ধব অনেক সাহায্য করেছে। আর কত ! ও ওর পরিবার ছেড়ে দিলো বলে আমিও আমার পরিবারের খবর নিলাম না। দুইজনে গোপনেই বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওর মত মানুষকে ভালোবাসা ছোয়াবের কাজ, স্যার। একসময় আমার ঘরে আর কোন খাবার নাই । আমি দিশেহারা। এমন সময় ওর সেই বন্ধুর অকাম আমাকে এই পথে আসতে বাধ্য করল। আমি এখন রাতে আপনাদের কাছে থাকি। দিনে ওর মানে জামানের কাছে থাকি। যে কাজের হাত থেকে বাঁচিয়ে জামান আমার ভালোবাসা জয় করে নিলো, সেই কাম করেই আমি জামানের ভালোবাসার ঋণ শোধ দিচ্ছি। সব আল্লাহ্‌র ইচ্ছা, স্যার ! আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ! ’

রাত বাড়ার সাথে সাথে চাঁদের আলোর তীক্ষ্ণতা বেড়েছে। এই পবিত্র আলোয় আমার দিকে তাকিয়ে ইশ্রাত আহমেদ শাহেদকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘জামানকে দেয়া দুই শর্ত মানা আমার জন্য ফরজ নয় কি, স্যার ?’
এই প্রশ্ন শুনে শাহেদের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুল না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকার বাণ্ডিল হাতে নিয়ে গুণে ৫০০ টাকার ১০ টি নোট মেয়েটির হাতে দিল।
ইশ্রাত টাকা হাতে নিলেও একটি রেখে বাকি ৯ টি নোট ফেরত দিল, নিলো না। দাঁড়িয়ে দ্রুত বোরকা পরে কিছুই না বলে পাশের ব্যস্ত রাস্তার দিকে হাঁটা ধরলো ! শাহেদ মুগ্ধ নয়নে মেয়েটির পথ পানে চেয়ে থাকল এবং জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে ফিল্টারের আগুন হাতে লাগায়, দ্রুত সিগারেট ফেলে দিয়ে সেও নিজের বাড়ির দিকে পথ ধরলো !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ পুরো গল্পটা পড়লাম এক নিঃশ্বাসে। দুর্দান্ত লিখেছেন। সমাজের খুব করুণ এবং অভিশপ্ত চিত্র আপনি এঁকেছেন দারুণ নিপূণতায়। খুব ভালো লেগেছে আপনার গল্প।
মনের গহিন থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু দুঃখজনক কঠিন বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে একজন মেয়ে কিভাবে খারাপ পথ বেছে নেয় তার জলন্ত ছবি এঁকেছেন। স্বামীর প্রতি একজন মেয়ে কতটা কর্তব্য পরায়ণ হতে পারে এবং উপকারের প্রতিদান কিভাবে দেয় তা গল্পে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। খুব ভাল লাগল। ভাল থাকবেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
এফ, আই , জুয়েল # বেশ ভালো । অন্যরকম একটি গল্প ।।

২৯ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী