ঘৃণার আগুনে জ্বালাই

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১৩)

মোঃ মোজাহারুল ইসলাম শাওন
  • ৪০
সমস্যাটা এতো প্রকট হল যে ,সুমন কে স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করতে হল। সুমনের দাদি বুড়ো মানুষ কিছুতেই ওকে বাগে আনতে পারেনি। মা -বাবা মরা এতিম এই বাচ্চা যে তার কাছে চিরকাল ছোটই রয়ে গেলো।
সুমন এর গ্রামের বাড়ি মানিক পটল গ্রামে। বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার মেঘাই উপজেলায় এর অবস্থান। যমুনার কূল ঘেঁষে এই মানিক পটল গ্রাম সুমনের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী এক গ্রাম। কোন কিছুর মুল্যেই সে এই গ্রাম কে হারাতে চায় নি। যদিও যমুনার ভাঙ্গনে এই গ্রামের নাম ছাড়া কোন অস্তিত্ত্ব নেই কোথাও। সুমন যখন তার মায়ের পেটে তখন ১৯৬৮ সাল। দেশের অবস্থা নাকি উত্তাল। সুমনের মা কোহিনুর বেগম আই এ পাশ করে বিয়ে হওয়া এক তরুণ নারী। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া একজন স্কুল শিক্ষক। মেঘাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি পড়ান। স্কুলে তার অনেক সুনাম। ওয়াজেদ মিয়ার বাবা চেয়েছিলেন তার একমাত্র ছেলেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক বানাবেন। সেই মত ছেলেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ৫২ সালের বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনে ইংরেজি ভাষার প্রতি কেন যেন এক খড়গ নেমে এলো এই বাংলায়। ইংরেজিতে ভালো ফলাফল করতে পারল না ওয়াজেদ মিয়া। কোনমতে ৩য় শ্রেনিতে অনার্স, মাস্টার্স পাশ করে সে এসে গ্রামের স্কুলে গ্রামের ছেলেদের ইংরেজি পড়ানোর দায়িত্ব নিল। সেও ১৯৬৪ সালে।
ওয়াজেদ মিয়া কত সংগ্রাম করে এই গ্রাম্য ছেলেদের ইংরেজি শিখিয়েছে, তার কথা বলে শেষ করা যাবে না। সিরাজগঞ্জ তখন একেবারেই এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। প্রায় বেশির ভাগ সময় বন্যায় ডুবে থাকে । সিরাজগঞ্জ শহর থেকে লঞ্চে প্রায় আধা ঘণ্টা গেলে এই গ্রামের দেখা পাওয়া যায়। মেঘাই তখন একটি ইউনিয়ন লেভেলের গ্রাম। ওয়াজেদ মিয়ার তত্ত্বাবধানে এই স্কুল থেকে অনেক ভালো ফল করে ছাত্র ছাত্রী বেরুতে থাকল। সেই গর্বে ওয়াজেদ মিয়া মাটি কামড়ে পরে থাকল মেঘাই নামক এই স্কুলেই। বাবা বৃদ্ধ মানুষ। একমাত্র সন্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। ১৯৬৮ সালে এসে এই ওয়াজেদ মিয়া সিরাজগঞ্জে যাওয়া আসা শুরু করল একটু বেশী মাত্রায়। একদিন কোহিনুর বেগম কেঁদে কেটে অস্থির। রাত ৮ টা বেজে গেছে কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া ঘরে ফেরে নি। শাশুড়ি এসে সান্ত্বনা দেয়, আসবে। সারা রাত এলনা ওয়াজেদ মিয়া। সকাল ৮ টায় এলো হাসি মুখে। কোহিনুর বেগম তখন পোয়াতির লক্ষন বুঝতে পেরেছে কিন্তু কাউকে বলেনি। বর্ষা চলছে এখন বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময়। কোহিনুর ভেবে রেখেছে বাবার বাড়ি গিয়ে একা একা এই মনভুলো মানুষকে সে আনন্দের খবর দিবে। কিন্তু মনের অজান্তে আজকাল কোহিনুরের তাই ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে।
ওয়াজেদ মিয়া কে ঘরের ভিতর কাছে পেয়ে সে তাই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ওয়াজেদ মিয়া শান্ত শিষ্ট তার এই সরলা বউএর এই বিষয়টিকে তাই বেশ উপভোগ করতে থাকল। প্রায় ৩ মিনিট পর কোহিনুরের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলে ওয়াজেদ মিয়া আস্তে করে একটি চুমু বসিয়ে দিলো কোহিনুরের কপালে। কোহিনুর ডুকরে কেঁদে উঠল। কেন সে গত রাতে ফেরেনি। কেন না জানিয়ে সে বাইরে রাত কাটায়েছে ! ওয়াজেদ মিয়া ধীর স্থির ভাবে কোহিনুরের বাঁধন থেকে বাইরে এলো। প্রিয়তম বঁধুকে ডান পাশে হাতের বাঁধনে চেপে ধরে পরম স্নেহে যা বলল, তা শুনে কিছুটা ভয় কিছুটা উত্তেজনায় কোহিনুর বেগম নিশ্চুপ মেরে গেলো।
ওয়াজেদ মিয়াঃ কোহি, (ওয়াজেদ মিয়া তার বউকে একা পেলে এই নামে আদর করে ডাকে) আমি গতকাল সিরাজগঞ্জে রাত কাটিয়েছি আমার বন্ধু সোলাইমানের বাড়ি। তুমি তো জানই এবং চেনও। সোলাইমান আমার নেংটা কালের বন্ধু। এখন মহুকুমা আদালতের খুব বড় নামকরা উকিল। এতো কাজের চাপ ওর বাবারে ! আমি অমন কাজে থাকলে মরেই যেতাম ! সে আজ দুইদিন আগে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। সিরাজগঞ্জে আওয়ামীলীগের বড় মিটিং হবে। ঢাকা থেকে বড় বড় নেতা আসবে যদি তুই আসিস ভালো লাগবে। আমি তোমাকে বলতে ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু মিটিং এ এতো লোক আর এতক্ষন চলবে বুঝিনাই। বউরে, মানুষ আর মানুষ ! হাজারে হাজার, লাখ লাখ ! কেউ উঠেনা, আরও শুনতে চায়। মানুষের মনে কি চাপা ক্ষোভ, না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না।

কোহিনুর ভয় পেয়ে যায়।
ভয়ার্ত কণ্ঠেই বলে উঠেঃ তোমার ওখানে যেয়ে কি কাজ ! তুমি তো নেতা না। আর কি করতে চায় ওই লোক গুলো?
ওয়াজেদ মিয়াঃ তুমি বুঝলে না বউ। ঢাকায় থাকতে দেখেছি পাকিস্তানিরা আমাদের আসলে ভালোবাসেনা। তারা আমাদেরকে ছোট জাতের বলে মনে করে। বাংলা ভাষা নিয়ে এতো প্রান গেলো কিন্তু তারা কি কেউ ক্ষমা চেয়েছে? কিন্তু এইটা তো আমাদের প্রানের দাবী। আমরা তো তাদের অঞ্চলের ভাষা নিয়ে কোন প্রতিবাদ করিনাই। আমরা তো বলিনাই আমাদের বাংলা ভাষা দিয়ে তোমাদের মনের কথা বলতে হবে ! তাহলে কেন উর্দু দিয়ে আমাদের মনের কথা বলাতে চায় ?
কোহিনুরঃ অ্যাঁ, বললেই হল। উর্দু দিয়ে কথা কওন লাগব ক্যা? আমরা কি ওদের বারা ভাতে ছাই দিয়েছি !
ওয়াজেদ মিয়াঃ বউএর এই মনোভাব ওয়াজেদ মিয়াকে শান্তি দিল। সে আরও একটু নীবির করে জড়িয়ে ধরে চৌকির উপর বউকে নিয়ে পরে গেলো। কিছুটা ভাব দেখাল যেন অনিচ্ছাকৃত। কোহিনুর স্বামীর এই প্রেম প্রেম খেলাকে এই মুহূর্তে উপভোগ করতে চাইলেও পারল না। কারন স্বামীর অফিসে যেতে হবে । ভাত হয়েছে, কিন্তু চুলায় তরকারি জ্বাল হচ্ছে। তাই সে বলে উঠল, ‘দুষ্টুমি রাখ, ছাড়। চুলায় তরকারি পোড়া যাচ্ছে। তুমি স্কুলে যাবে না?’
ওয়াজেদ মিয়া লাফ দিয়ে উঠে বলেঃ হায় হায়, দেরী হয়ে গেছে। আজ স্কুলে মিটিং আছে ক্লাস শুরুর আগে। কমিটির সভাপতি নুরু মিয়া আইব। মুসলিম লীগের বড় নেতা। ঢাকায় থাকে, শুধু মিটিং ফিটিং এর সময় এসে খবরদারী করে। হায় আল্লাহ্‌, বউ তাড়াতাড়ি করো !
কোহিনুর দ্রুত উঠে যায় রান্না ঘরে। স্বামিকে দেরী করান চলবে না। প্রেমিক মানুষ, এরা একটু ইমোশনাল হয়। মেজাজ ঠিক রাখতে এদের কে সমীহ দিতে হয়। এরা প্রেমের কাংগাল। প্রেম ছাড়া এদের একদণ্ড চলে না। তাই সে পিছন ফিরে আর তাকায় না। ঠিক সময়েই ওয়াজেদ মিয়া স্কুলে পৌঁছে।

স্কুলের হেড মাস্টার আসমত আলি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ কোর্সে বি এ পাশ। নুরু মিয়ার খুব কাছের লোক, দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাই স্কুলে তার একটা বেশ দাপট । তবে ওয়াজেদ মিয়া তাকে জানে সৎ ও কর্মঠ বলেই। কাউকে মনে কষ্ট দিয়ে কিছু বলেছেন এমন রেকর্ড নাই। শুধু নুরু মিয়ারে অত্যাধিক তোয়াজ করা তার স্বভাব, যা ওয়াজেদ মিয়ার পছন্দ নয়। আর এই জন্য সে স্কুলের হেড মাস্টার হয়নি। যদিও নুরু মিয়া তাকে বেশ কয়েকবার দায়িত্ব নিতে বলেছে।

নুরু মিয়া আজ সাদা মছলিনের মত পাতলা কাপরের পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। নিচের গেঞ্জিটা পুরো দেখা যাচ্ছে। পা জামাটা ভাগ্যিস অতো পাতলা না। তাইলে ভদ্রতা রক্ষা কঠিন হত। কি জানি ওয়াজেদ মিয়ার মনে হল এই লোককে যদি রোদের মধ্যে হাল্কা বাতাসের সময় নদীর পাড়ে দাঁড় করান যেত, তাহলে এই ফিনফিনে পোশাকের চরিত্র নষ্ট করা যেত ! এই যে ওয়াজেদ মিয়া, নুরু মিয়ার কণ্ঠে নিজের নাম শুনে একটু চমকে উঠল। মিয়া উপাধি তাদেরও। এক পুরুষ আগে নুরু মিয়া এবং তার দাদা এক গ্রামেই থাকত। নুরু মিয়া রাজনীতি করায় গ্রামের জমি জমা সব বর্গা দিয়ে ঢাকায় থাকে। কিন্তু মাস্টার ওয়াজেদ মিয়া আর নেতা নুরু মিয়ার মাঝে অনেক অনেক ফারাক ! তার জামাটা কোন ঈদে বানিয়েছিল মনে করতে পারছেনা। ছিঁড়ে গেছে দুই এক স্থানে, বউ যত্ন দিয়ে আরাল করেছে সেই ফাঁক। কিন্তু ওয়াজেদ মিয়ার মনে কোন ক্ষোভ নাই, নাই অনুশোচনা। সৎ পথে বেঁচে তো আছে। কত মানুষ তাকে সালাম দেয় মন থেকে, এর কি কোন মুল্য নাই?
নুরু মিয়াঃ ওয়াজেদ মিয়া, আপনি এইবার কিন্তু ছেলেদের ফল ভালো করতে পারেন নি। ৫৬ জনের মধ্যে ৪৩ জন ইংরেজিতে ফেল করেছে। কিন্তু আমরা এই ইংরেজির জন্য ভালো ফল পাচ্ছি না। আপনাকে এমন করলে কিন্তু স্কুলে রাখা যাবেনা। আজকাল আমার কাছে খবর আছে তুমি, রাজনীতি করছ। আওয়ামীলীগ করছ ! রাজনীতি করলে রাজনীতি করো, আমিও করি। কিন্তু মাস্টারি ছেড়ে রাজনীতি করতে হবে বুঝেছ !বড় নেতাদের এই এক অভ্যাস ! রাগলে, আদর করলে বা হুকুম করলে তুমিতে নেমে যায়। ওয়াজেদ মিয়া এর প্রতিবাদ করার কোন কারন খুঁজে পায় না।
ওয়াজেদ মিয়াঃ স্যার, আমি তো সারাদিন ওদের পিছনে সময় দিই। ওর বিদেশী ভাষা পড়তে চায় না।
নুরু মিয়াঃ বিদেশি ভাষা পড়তে চায়না? তাহলে আরবীতে, ধর্মে সব পাশ করল কেমনে? আরবী কি দেশি ভাষা?

ওয়াজেদ মিয়া এই সত্য বাক্যের প্রতিবাদ বা এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে পারল না। কিন্তু ইংরেজদের ভাষা যত সহজ হোক বাঙালি কঠিন করে চিন্তা করে বলেই এতো কঠিন করে ফেলে, কে বুঝাবে! গ্রামের এই সহজ সরল ছাত্রদের কাছে খুব কষ্টের এই ইংরেজি সাহিত্যকে, সে কত স্নেহ মায়া দিয়ে শিখাচ্ছে কেউ কি তা অস্বীকার করতে পারবে? ওয়াজেদ মিয়া মুখে কিছুই বলল না। নীরবে তার ব্যর্থতা বলেই স্বীকার করে নিল। ধর্মের সাথে তুলনা করে এই রাজনীতি করাকে সে অপছন্দ করে বলেও সে নীরব থেকে যায় !
নুরু মিয়া ওয়াজেদ মিয়ার এই সহজ সরল আচরণ পছন্দ করে বলেই বলে উঠলঃ সামনের বার এমন হলে কিন্তু আপনাকে চাকুরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ওয়াজেদ মিয়া হাল্কা মাথা নেড়ে আরও মাথা নিচু করে ফেলল। সভায় সকল বিষয় নিয়ে নাতী দীর্ঘ আলোচনা হল। আজ আর ক্লাস নেয়া হলো না কারো। নুরু মিয়া রাজনীতি নিয়ে দেশের হালচাল নিয়ে বিরাট বক্তৃতা দিলেন। সেখানে গত কালের সিরাজগঞ্জের মিটিং নিয়েও আলোচনা হল। পাকিস্তান ভাঙ্গার এই ষড়যন্ত্রে যেন কেউ সামিল না থাকেন, সেই ব্যাপারে সাবধান করে দিতেও ভুল করলেন না। ওয়াজেদ মিয়া নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল। সে ভাবতে লাগলো নুরু মিয়ার এই সভা কি সিরাজগঞ্জের মিটিং কে ফলো করতে আসা? মিটিঙের নামে এলে খরচাপাতি কিছুটা স্কুলের উপর দিয়েই চালানো যায়। হেড মাস্টার সাহেব স্কুলের পুকুরের বড় কাতলা মাছ দিয়ে, মুগ ডালের মুড়িঘণ্ট দিয়ে দুপুরে স্কুলের ১৮ জন সহ ৩২ জন সবাইকে খাওয়ালেন। স্কুলের লোক ছাড়া যারা খাওয়ায় উপস্থিত ছিলেন তারা নুরু মিয়ার সাথে রাজনীতি করা লোক। ওয়াজেদ মিয়ার পাশে বসা বিরাজ পাল নামের অংকের শিক্ষক নুরু মিয়ার বদান্যতায় দুপুরের এই খাওয়াকে খুব উপভোগ করলেন এবং সে জন্য বিনয়ের সাথে বিগলিত ভাষায় নুরু মিয়াকে ধন্যবাদ দিলেন। ওয়াজেদ মিয়া নিজেকে বোকা ভাবলেন এই জন্য যে, তিনি কেন এই কাজ করতে পারলেন না। খাওয়া শেষে নুরু মিয়া সকল কাগজে তার স্বাক্ষর দিলেন। এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে হেড মাস্টার ছাড়াও ওয়াজেদ মিয়া ও বিরাজ পাল উপস্থিত ছিলেন। নুরু মিয়া দেখলেন আজকের খাওয়া বাবত সেখানে ১০,০০০ টাকা পাশ করানো হয়েছে। গ্রামের এই স্কুলের অনেক সম্পত্তি থাকায় প্রচুর আয় ছিল। সেই আয়ে বৎসরে নুরু মিয়ার নামে কমপক্ষে ৩ বার এমন খানাপিনা করা হত।

স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে ওয়াজেদ মিয়া ভাবছিলেন, স্কুলের এই ফাণ্ড কেন নুরু মিয়ার নামে খরচ করা হল। আগামীকাল হেড মাস্টার সাহেব কে জিজ্ঞাসা করবেন। উনার আর মাত্র ১ বৎসর চাকুরি আছে, নিশ্চয় মিথ্যা বলবেন না ! পরের দিন স্কুলে গিয়ে সকাল বেলাই হেড মাস্টার সাহেবকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলেন।
হেড মাস্টারঃ নুরু মিয়াদের সম্পত্তি দিয়েই তো স্কুল চলে মশাই, একটু আধটু খরচ তো হবেই!
ওয়াজেদ মিয়াঃ তাহলে স্কুলের ১৮ জনকে শুধু খাওয়ালেই তো চলত, ৩২ জনকে কি জন্য খাওয়ানো হল?
হেড মাস্টার সাহেব এই ব্যাপারে মাথা না ঘামাতে আদেশ করলেন, বরং ছাত্রদের ফলাফল ভালো করার জন্য উদ্যোগী হতে উপদেশ দিলেন।সাথে নুরু মিয়ার সেই ঘোষণাও আবারো শুনাতে ভুল করলেন না। ওয়াজেদ মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে ক্লাসে চলে গেলেন।

এক বৎসর কঠিন সংগ্রাম করে এসএসসির ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেন। নিজের বাড়িতে পুত্র সন্তানের জম্ম হলেও তেমন খেয়াল করতে পারলেন না। ১৯৬৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডের মধ্যে ইংরেজিতে খুব ভালো ফল হল। রেজাল্ট হওয়ার ১ মাস পরে হেড মাস্টার সাহেব অবসরে গেলেন। নুরু মিয়া বিরাজ পালকে হেড মাস্টার নিয়োগ দিলেন। ওয়াজেদ মিয়া এইবার হেড মাস্টার হওয়ার আশা প্রকাশ করেও হতে পারলেন না। কিন্তু হেড মাস্টার যাওয়ার দিন তাকে আলাদা করে ডেকে বলে গেলেনঃ ‘ওয়াজেদ মিয়া, আপনি স্কুলের হাল ধরলে এই স্কুল অনেক উপড়ে উঠত। আমি আপনাকেই সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু নুরু মিয়া পাল সাহেবকেই নিয়োগ দিলেন। কি জানি স্কুলের কি হয়... ভেবে একটা কষ্ট নিয়ে অবসরে গেলাম। আল্লাহ্‌ আপনার মঙ্গল করুন !’
ওয়াজেদ মিয়া পা ছুঁয়ে হেড মাস্টারকে সালাম করলেন। কোলাকুলি করলেন। এরপর চোখ মুছতে মুছতে দুজনেই বিদায় দিলেন।

১৯৬৯ সালে বিরাজ পাল খুব স্বৈরচারী ভাবে স্কুল চালাতে লাগলেন। নুরু মিয়া যা বলে তাই তিনি অক্ষরে অক্ষরে মানতে লাগলেন। স্কুলের ফাণ্ড শুন্য হয়ে গেলো। এভাবে চলতে চলতে ১৯৭০ সালের শেষদিকে এসে স্কুলের বেতন বন্ধ হয়ে গেলো। সবাইকে বলা হল দেশের অবস্থা ভালো না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের বেতন বন্ধ থাকবে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে হেড মাস্টার বিরাজ পাল ভারতে পালিয়ে গেলেন, আর ফিরে এলেন না। নুরুমিয়া পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে লাগলেন। মে মাসে এই নিয়ে ওয়াজেদ মিয়ার সাথে গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুমুল ঝগড়া হল নুরু মিয়ার। বাড়িতে এসে কোহিনুরকে সব বলে দিলেন ওয়াজেদ মিয়া। এই ঘটনার ঠিক ৩ মাস ৩ দিন পর আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ পাট ক্ষেতের ভিতর লাশ পাওয়া গেলো ওয়াজেদ মিয়ার। আরও ২০ দিনের মাথায় নদিতে গোছল করতে গিয়ে আর ফিরল না কোহিনুর বেগম। নদীর উজানে ভাসতে থাকা পচে ফুলে যাওয়া কোহিনুর বেগমের লাশ পাওয়া গেলো। এমন লাশে ভরে উঠতে থাকল সদ্য স্বাধীন ঘোষিত বাংলাদেশের আনাচে কানাচের নদি নালা ঝোপ ঝাড়। আর পুত্র পুত্রবধু হারানোর শোকে দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫ দিন আগে ১ ডিসেম্বর মারা গেলো সুমনের দাদা।

২ বৎসরের সুমনকে নিয়ে ওর দাদি এতো পরিবর্তন দেখলেন মাত্র এক বৎসরে। যুদ্ধ তাই সুমনের কাছে অনেক গভীর ক্ষতের নাম। গভীর দুঃখের এক সাগরের নাম! সুমন বড় হতে লাগলো দাদির অকৃপণ স্নেহ ভালোবাসায়। গ্রামের মানুষের এক নীরব ভালোবাসা তার প্রাপ্তি ছিল। ১৯৮২ সালে মেঘাই উচ্চবিদ্যালয়ের ১ম রোলধারী ছাত্র সুমন স্কুল ছেড়ে প্রায় ৩-৪ মেইল দূরের কাজীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে গেলো। এই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার মুল কারন নুরু মিয়ার ছোট ভাইয়ের ছেলে করিম মিয়ার সাথে দন্দ্ব। সুমন তার দাদির কাছে ও পরবর্তীতে গ্রামবাসীর কাছে নুরু মিয়ার যুদ্ধকালিন পরিণতি শুনেছিল। ঠিক ডিসেম্বর ৭ তারিখ। সিরাজগঞ্জ তখন স্বাধীন হওয়ার দারপ্রান্তে। গ্রামের তরুণ মুক্তিযদ্ধারা নুরু মিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়ি ঘেরাও দেয়। ঝানু রাজনীতিবিদ নুরু মিয়া বুঝতে পেরে বাড়ি পিছনে পায়খানার কুপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সকালে ও সারাদিন নুরুমিয়াকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে ৩ দিনের দিন ১০ তারিখ নুরু মিয়ার বাড়ি ঘেরাও তুলে নিয়ে চলে যায়। নুরু মিয়া পায়খানার কুপ থেকে উঠে পাট ক্ষেতের ভিতর দিয়ে পালিয়ে যমুনা নদিতে ঝাপ দেয়। গ্রামবাসীদের একজন এই খবর প্রচার করলে যে নুরু মিয়াকে নদিতে ঝাপ দিতে দেখা গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা আবারো খুঁজতে শুরু করলে ততক্ষনে নুরুমিয়া হাওয়া হয়ে যায়। ৭৪ সালে নুরু মিয়াকে ঢাকায় কিছুদিন ধানমণ্ডি এলাকায় দেখা গেলেও কেউ তার টিকিটি স্পর্শ করতে পারেনি।

নুরু মিয়ার দুই ছেলে এক মেয়ে ছিল। বড় ছেলে ১৯৭২ সালে ১ম বিভাগে এস এস সি ও ৭৪ সালে ২য় বিভাগে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ছে। যুদ্ধের সময় তার এই ছেলে বারেক মিয়ার বয়স ছিল ১৫-১৬ বৎসর। সে রিতিমত বাবার দান হাত হিসাবেই কাজ করেছে যুদ্ধের প্রথম দিকে। মেডিকেলে সে আওয়ামীলীগের রাজনীতির ছাত্রদের সাথে মিশে যায়। টাকাওয়ালা বাবার ছেলে হওয়ায় মিশতে বেগ পেতে হয়নি। ২য় ছেলে বেশী পড়াশুনা করেনি। সে ব্যবসা করেতে শুরু করে। প্রথমে ট্রেজারি চালানের কিসব ব্যবসা করলেও ১৯৭৭ সাল থেকে আদম ব্যাপারি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। নুরু মিয়া ঢাকায় ধানমণ্ডি এলাকায় চুপচাপ থাকত। ব্যবসা করলেও তেমন বাড়ি থেকে বের হত না।

১৯৮৩ সালে জামাতে ইসলামের টিকিটে নুরু মিয়া সিরাজগঞ্জের এক আসন থেকে নির্বাচন করে হেরে যায়। ১৯৮৮, ১৯৯১ সালেও নির্বাচন করে কিন্তু জিততে পারেনাই। প্রতিটি নির্বাচনে তার বড়ছেলে বাবার জন্য প্রকাশ্যে কাজ করে। নুরু মিয়া আজ ‘ইবনে কিসা ট্রাষ্ট’ এর পরিচালক। ছোট ছেলে ব্যবসায়ীদের নেতা। বড় ছেলে চিকিৎসকদের নেতা। গ্রামের রাজনীতি দেখাশুনা করে নুরুমিয়ার আপন ছোট ভাই সুরুজমিয়া। সে বাংলাদেশ আওয়ামীলিগের রাজনীতির সাথে জড়িত। যদিও যুদ্ধের সময় এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে কিন্তু নুরুমিয়ার অন্তর্ধানের পর ২ বৎসর সুরুজ মিয়া চুপচাপ ছিল। এরপর কমিটি গঠনের সময় তাকে কাজিপাড়া এলাকার আওয়ামীলীগের নেতা হিসাবে দেখা গেলো। তার ছেলে করিম মিয়া বাবার দাপটে স্কুলে চলত। ওয়াজেদ মিয়ার মাবাবা মরা সন্তান সুমন মিয়ার এই দাপট সহ্য হত না। সুমন মিয়া আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বর মাস এলে তেমন বাড়ি থেকে বের হত না। স্কুল করেই বাসায় সোজা চলে আসত। নভেম্বর মাসের যেদিন ৮ম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিন ছিল সেদিন পরীক্ষায় না দেখানোর জন্য করিম সুমন কে বেদম মার দিল। সেই মারে সুমন পুরো এক মাস বিছানায় পরে থাকল। এরমধ্যে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। সুমন মেঘাই স্কুলে পড়বে না বলে জিদ ধরল।

এতিম নাতির ভবিষ্যৎ ভেবে দাদি তাকে কাজীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিল। জমির কিছু ধান বিক্রি করে একটি সাইকেল কিনে দিল। সুমন সেই সাইকেলে চড়ে প্রতিদিন স্কুলে যায় আসে। গ্রামের কারো সাথে মিশে না। স্কুল ১৯৮৩ সালে এস এস সি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে এবং ১৯৮৫ সালে আজিজুল হক কলেজ বগুড়া থেকে এইচ এস সি পাশ করে ১৮৮৫ -৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল। ১৯৮৯ সালে ১ম পেশাগত পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে জানল তার দাদি হটাৎ ঘুমের মাঝে মারা গেছে। সুমন বড়ই একা হয়ে গেলো। তার মা রুপি দাদিকে হারিয়ে সুমন প্রতিজ্ঞা করল যে, দাদি তাকে ডাঃ হতে প্রেরণা দিয়েছে সেই দাদির আত্মাকে শান্তি দিতে সে ভালো ডাক্তার হবে। সুমন মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় দাদি গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকার কল্যানপুরে এক টুকরো জমি কিনে টিনসেড বানিয়ে থাকত আর কিছু ভাড়া দিয়ে সংসার চালাত। ১৯৮৮ সালের বন্যায় মেঘাই এর মানিক পটল গ্রাম যমুনায় একেবারে বিলিন হয়ে যাওয়ায় সুমনের আর ইচ্ছে থাকলেও কোনদিন গ্রামে ফেরত যাওয়া হয়ে উঠেনি। উদবাস্তু সুমন পুরো দমেই একজন শহুরে মানে ঢাকা শহরের মানুষ হয়ে গেলো।

পরীক্ষার ফল বেরুতে পাক্কা দুই মাস লাগলো। এই দুই মাস একবারের জন্য সুমন কলেজে যায় নি। সুমনের ভিতর ধর্মীয় এক পরিবর্তন চলে এলো। পরীক্ষার ফল বেরুলে যেদিন সুমন কলেজে পা রাখল সেদিন সুন্দর দাড়িওয়ালা এক সুমনকে দেখে অনেক বন্ধুই তাকে চিনতে পারল না। সুমন অন্তর্মুখী চরিত্রের বলে কেউ এই বিষয় নিয়ে কথাও বলল না। শুধু ৩দিনের দিন সুমন যখন নিচ তলার ক্যান্টিনে বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিল আর ফার্মার বইটা দেখছিল এমন সময় পাশে এসে বসল এক ক্লাসমেট নারী রাফিয়া বিনতে আফসার রুমকি।
রুমকিঃ সুমন, দাড়িতে তোমাকে বেশ মানিয়েছে। এক্কেবারে সিনেমার হিরো মনে হচ্ছে !
সুমনঃ লাজুক চেহারায় আমাকে ভেংগাচ্ছ?
রুমকিঃ মাইরি, সুমন আমি মিথ্যা বলিনা।
সুমনঃ সিনেমার নায়ক বললে তা হিন্দি না বাংলা সিনেমা?
রুমকিঃ বাংলা তবে ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ নয়, উত্তমের ‘সাপমোচন’, বুঝলে?

সুমন সারা জীবনে সিনেমা দেখেছে ১০ টির বেশী হবেনা । সব হলের টিভিতে । হিন্দি সে বুঝেও না। কিন্তু ‘দরদ কা রিস্তা’ সিনেমা দেখেছে হলে গিয়ে ৩ বার একাকী। কিন্তু উত্তমের কোন সিনেমা তার এখনো দেখা হয়নি। উত্তম কুমারের কিছু গল্প সে শুনেছে তার রুমমেট এর কাছ থেকে। তবুও তারুন্যের ফল্গুধারায় চানক্য যৌবন সুমনকে চমকে দেয়, রুমকির বই কেড়ে নেয়াতে।
রুমকিঃ কি এতো পড়ছ!
সুমনঃ ফার্মার লেকচার আছে না?
রুমকিঃ এতো পড়ে তুমি কি করবে?
সুমনঃ আমার তো আর কোন কাজ নাই। তাছাড়া আমি আড্ডা মারতে পারিনা।

রুমকি হটাত করেই মুখ ভেংছি দিয়ে উঠে গেলো। সুমন বুঝল না তার অপরাধে না তাঁদের ব্যাচের এক গ্রুপ ক্যান্টিনে ঢুকে পড়ল, সে জন্য রুমকি চলে গেল ! দেখতে দেখতে ২ সপ্তাহ চলে গেলো। সুমনের সাথে রুমকির দেখা হয় না। সুমন কেমন যেন খুঁজে ফেরে তাকে। এমন তো আগে কখনো হয় নি। কেন এই অবস্থা? শুধু রুমকিকে দেখার জন্য সুমন নিয়মিত সাত সকালে ক্যান্টিনে এসে নাস্তা করে । পরপর দুই কাপ চা শেষ করে তবেই উঠে। ঠিক ২১ দিনের দিন রুমকিকে দেখে শুকিয়ে যাওয়া এক লতানো গাছের মত ক্যান্টিনে ঢুকছে। সুমন প্রায় দৌড়ে যায় রুমকির কাছে !
সুমনঃ রুমকি, তুমি কৈ ছিলে ?
রুমকিঃ আমি ভীষণ অসুস্থ্য ছিলাম।
সুমনঃ কি অসুখ?
রুমকিঃ এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হইছে আমার। বেঙ্গল ক্লিনিকে, আতাই রাব্বি স্যার আব্বার খুব পরিচিত। উনি করে দিয়েছেন।
সুমনঃ কিন্তু তুমি এই খবর না দিয়ে ঠিক করনি।
রুমকিঃ কি করতে? আমার হাত ধরে বসে থাকতে? বাংলা সিনেমার নায়ক হয়ে ঘুর ঘুর করতে?
সুমনঃ জানিনা। তবে তোমাকে আমি খুব মিস করেছি, প্রতিদিন এখানে নাস্তা করে দুই কাপ চা খেয়েছি যদি তুমি আসো। এই বলে উঠে দাঁড়ালো সুমন।
রুমকিঃ রাগ করলে, সুমন?
সুমনঃ না, কোন অধিকারে রাগ করব?
রুমকির এই অধিকার শব্দ উচ্চারনে ক্যামন একটা শিহরণ বয়ে গেলো শরীরে। বলল আজ কি চা খেয়েছ? কয় কাপ?
সুমনঃ ১ কাপ খেয়েছি।
রুমকিঃ আর এক কাপ খাবে? যদি খাও আমিও খাব। বাবামা আমাকে এতদিন কিচ্ছু খাইতে দেয় নি।
সুমন আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলল খুব কষ্ট হয়েছিল?
রুমকিঃ না, স্যার এসে একটা চুমো দিল আর পেট থেকে এপেনডিক্স তা বের হয়ে গেলো!
সুমনঃ স্যারকে এমন করে বলনা,উনারা আমাদের গুরুজন !
রুমকিঃ সরি।
বয় চা দিয়ে গেলো। চুপ চাপ দুজনে চা যখন শেষ করল ততক্ষনে সকালের ফার্মার লেকচার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সুমন বলল যা, ক্লাস যে মিস করলাম ! রুমকি বলল কিচ্ছু হবে না। আমি যে ২১ দিন ক্লাস করি নাই!এরপর সুমন রুমকির একটি নতুন জুটি গড়ে উঠল ঢাকা মেডিকেল ক্যাম্পাসে। বন্ধুরা প্রথম প্রথম আর চোখে তাকালেও পড়ে সব কিছু কেমন যেন অভ্যস্থ হয়ে যায়, বন্ধু ছোটবড় সকলের কাছে এই ক্যাম্পাসে। এমনকি ৯৪ সালে পাশ করে যখন রুমকি তার বাসায় সুমনকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করে , রুমকির পরিবার সুমনকে নিয়ে কোন সমস্যা করেনি।

সুমন রুমকি দুজনেই বেশ চেষ্টা করে বিসিএস দিয়ে চাকুরি পায় ২য় বারের চেষ্টায়। দুই জনেই ২ বৎসর গ্রামে পরে থাকে। একজন যায় পাবনা জেলার সুজানগরে অন্য জন যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জে। তবুও তারুন্যের ইচ্ছাকে কেউ দমাতে পারেনি। সুমনই আগে মেডিসিনে এফ সিপিএস পাশ করে তাও ২০০৫ সালে, এরপর এমডিও শেষ করে ২০০৮ সালে। এর মধ্যে দুই দুইটি সন্তান আসে ওদের পরিবারে। ১ম টি মেয়ে, ২য় টি ছেলে। ছেলে হওয়ার পর রুমকির হাসিমাখা মুখ আজো জ্বলজ্বল করে সুমনের চোখে। সন্তান দেখতে গিয়ে রুমকি ব্যাসিক বিষয়ে পড়াশুনা করে। ফার্মাকোলজিতে এম ফিল করে ঢাকায় চাকুরি করে।

রুমকি এতদিন পর এসে দেখে সুমন কেমন যেন বিমর্ষভাবে আজকাল চলে। নির্মোহ সৎ আদর্শবান ছেলে হিসাবে রুমকি সুমনকে খুব সমীহ করে। মনে মনে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে। সুমনকে সে কখনো ঘাটায় না। কিছুটা না চাইতেই তার চেয়ে বেশী স্বাধীনতা দেয়। ফলে সত্যিকারের সুখে থাকে তারা। রুমকি ভাবে এবং সান্ত্বনা পায় এই ভেবে যে, এমন কঠিন সংগ্রাম করে জীবনের এই সাফল্য বেশীরভাগ কেউ পায় না, যা সুমন পেয়েছে। সেই কঠিন সংগ্রামী সুমনকে বিহ্বল দেখে ভিতরে ভিতরে আঁতকে উঠে রুমকি। কিন্তু এখনো কিছু বলার সময় হয় নাই ভেবে পর্যবেক্ষণে রাখে।

সরকারি পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। মেডিসিনে সুমনের চেয়ে ৬-৭ বৎসরের জুনিয়ররা যারা পোস্ট গ্রাজুয়েট করেছে এই সেদিন তারাও পদোন্নতি পেয়েছে। সুমন খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে, শুধুমাত্র সরকারি দলের প্রতি অকুণ্ঠ প্রেমকেই এদের যোগ্যতা বলে ধরা হয়েছে। সুমন ভাবে এ কেমনে হয়! ওর চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আর কে আছে? মুক্তিযুদ্ধ ওকে এক্কেবারে শেষ করে দিয়েছে। বাবার রাজনীতির জন্য বাবামা হারিয়েছে, দাদাকে হারিয়েছে। কত্ত কষ্ট করে সে আজকের এই স্থান করে নিয়েছে। এরপরেও তার ঘাটতি কৈ? সে সরকারি পদোন্নতির সকল শর্ত পুরুন করেছে, কেন তাহলে তাকে বাদ দেয়া হল? কিন্তু কাকে জিজ্ঞাসা করবে? কে এর উত্তর দিবে?

২০১০ সালের শেষ দিকে একবার সাহস করে সে সচিব, না সিনিওর সচিব এর সাথে দেখা করেছে। উনি দরখাস্ত দিয়ে যেতে বলেছেন। সুমন একটা দরখাস্ত দিয়েছে। এর খোঁজ নিতে সে যুগ্ম সচিবের কাছে গিয়েছে, যে আবার তার রোগীও। কোনদিন তাকে দেখিয়ে ভিজিট দেয় নি। সেই যুগ্ম সচিব তার প্রশ্নে রেগে গিয়েছে? সুমন প্রশ্ন করেছিল কিকি অযোগ্যতাকে তার পদোন্নতির অন্তরায় বলে তারা মনে করেছে, তা কি জানানো যাবে? অতি পরিচিত এই ব্যক্তি বেশ রুঢ় ব্যবহার করেছে। সুমন অতি কষ্টে নিজেকে চেপে রেখে বের হয়ে এসেছে। আসার সময় তাকে বলা হয়েছে যে পরেরবার তার প্রতি সম্মান করা হবে।

সুমন অনেক কষ্টে সময় পার করেছে সামনের ভালো কিছুর আশায়। তলে তলে অনেক কিছুই জানার চেষ্টা করেছে। অনৈতিক বিষয় দেখে সে আর এগুই নি। আল্লাহ্‌কে ডেকেছে। সে শুনেছে আজকাল এই পদোন্নতির তালিকা কোন এক নেতার কম্পিউটার থেকে বের হয়। সুমন খোঁজ নিয়ে দেখেছে সে তার এলাকার লোক। অনেকেই তার কাছে যাচ্ছে। সুমনকেও যেতে বলেছে অনেকেই। সম্প্রতি রুমকিও যেতে বলেছে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুমকির সাথে যে আলাপ হয়েছে তা খুব আশাপ্রদ নয়।রুমকি অনেক যুক্তি দিয়েছে। তর্ক করে বুঝিয়েছে যে তাদের সন্তানের ভবিষ্যতকে কশম দিয়ে বলেছে বলেই সুমন সেই বড় নেতার কাছে যেতে ইচ্ছে করেছে।সুমন আগামীকাল যাবে বলে রুমকিকে কথা দিয়েছে।

সুমন সকালে বসে বসে খুব ক্লান্তভাবে নাস্তা সারল। এদিকে তার ১৫ দিনের ছুটি শেষের দিকে । আর তিন দিন পর তাকে চাকুরিস্থলে যেতে হবে। তবুও ভালো যে রুমকি ঢাকায় চাকুরি করছে। সুমন সকালে প্রায় ৩ ঘণ্টা বসে থেকেও নেতার দেখা পায় নাই।তবে জেনেছে যে নেতার বাড়ি তার এলাকায়। নেতাও তার এক মেডিকেলের বড় ভাই। বিকেলে গেলে নিশ্চিত পাবে বলে জানিয়েছে এক নেতা গোছের কেউ। সুমন বাসায় ফেরেনি। হোটেলে খেয়ে সোরওয়ারদি উদ্দানে ঘুরেছে। সে অবাক হয়ে দেখেছে যে, রুমকিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সেই উদ্দান আর নাই। কেমন বখাটেদের আস্তানা হয়ে গেছে। দুপুরেরপর নেতার কাছে গিয়েছে। নেতা তাকে তার বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করেন নাই। শুধু ব্যক্তিগত কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন।
নেতাঃ তোমার বাড়ি কৈ?
সুমনঃসিরাজগঞ্জে।
নেতাঃ সিরাজগঞ্জ? কোথায়? নেতার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা।
সুমনঃ এখন আর সেই গ্রাম নাই। মানিক পটল। আপনি চিনবেন না। নদিতে ভেজ্ঞে গেছে, মেঘাই উপজেলা।
নেতাঃ কার ছেলে তুমি?
সুমনঃ ওয়াজেদ মিয়া। উনি নাই।
নেতাঃ যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গিয়েছিল?
সুমনঃ হাঁ। আপনি কি চিনেন মানিক পটল গ্রাম?
নেতাঃ তোমার আর কে কে আছে বাড়িতে? তোমার মাকি নদিতে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল না?
সুমনের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এতদিন দাদির কাছে জেনেছে যে তার মাকে হত্যা করে নদিতে ফেলা হয়েছিল । আজ নেতার কাছে শুনল যে, আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু সে আর এই কথা প্রমান করতে পারবে না।
সুমনঃ জানিনা। শুনেছি তাকে কে বা কারা হত্যা করেছে।
নেতাঃ ভ্রু কুঞ্চিত করে, তুমি কৈ থাক?
সুমনঃ কল্যানপুরে। দাদি মারা যাওয়ার আগে একটি সামান্য জমি কিনে টিনশেড বাড়ি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
নেতাঃ আচ্ছা তুমি নুরু মিয়ার নাম শুনেছ?
সুমনঃ জি শুনেছি। তিনি রাজাকার ছিলেন, দাদি বলতেন।
নেতাঃ রেগে... তুমি একটা গাধা। তাই তোমার পদোন্নতি হয় নি। তুমি এত বড় নেতাকে অসম্মান করতে পারলে? তুমি জানো উনি কে? আচ্ছা তুমি যাও। সামনে যে আদেশ হবে সেখানে দেখ তোমাকে পদোন্নতি দেয়া হয় কিনা। এসব কাজ করে মন্ত্রণালয়, আমাকে আর বিরক্ত করবে না!
সুমন এই রেগে যাওয়ার হেতু কিছুই বুঝল না। মাথা নারিয়ে নত মাথায় বের হয়ে এলো নেতার রুম থেকে।

বের হওয়ার মুখে সকালের নেতা গোছের সেই ব্যক্তি সুমনকে আলাদা করে পাশে নিয়ে গেলো। সুমনকে বলল, ‘আপনি তো আচ্ছা বোকা। নেতার বাবার খোঁজ না নিয়েই তার সাথে কথা বলতে গেলেন কেমনে? আর আপনি সত্যউত্তর দিলে কেমনে পদোন্নতি পাবেন? তেলমারা ছাড়া কি কেউ পদোন্নতি পায়, পেয়েছে?’
সুমন বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতেছি না। আমি কি ভুল করলাম। আমাদের গ্রামের নুরু মিয়াতো ঐ এলাকার বড় রাজাকারই ছিল। উনি মুসলিমলীগ করতেন।‘
নেতা গোছের ব্যক্তি এইবার হেসে দিয়ে বলল, ‘রাজাকার হতে পারে, কিন্তু তার পুত্র যদি সরকারি দল করে তাহলে কি আপনি তার বাবাকে রাজাকার বলবেন?’
সুমন বলল, ‘আমি কিন্তু কিছুই বুঝলাম না।‘

নেতা গোছের ব্যক্তি এইবার সুমন কে নিয়ে নীচে নামল। এক হোটেলে ঢুকিয়ে ফাঁকা দেখে এক টেবিলে বসাল। দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, ‘আপনি খুব ভালো মানুষ। আপনার ডাঃ হওয়া ঠিক হয়নি। আপনার মাস্টার মানে পণ্ডিত হওয়া উচিত ছিল।‘
সুমন বলল,‘আমাকে পদোন্নতি দিলে তো মাস্টারই হতাম, সাথে ডাক্তারি করতাম !’
লোকটি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার নাম নুরুজ্জামান খান। আমি সারাদিন নেতার ফেউগিরি করি। কোন ডিগ্রি নিতে পারিনি। এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়েছি; আর কত ভাই! বয়স ৪৪ বৎসর চলে। সারা জীবন কি খালি পড়ব নাকি? তবু নেতার সাথে আশায় আছি। নেন, চা খান ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।‘
সুমন কোন কথা না বলে ধীরে চা শেষ করল। খান সাহেব একটা বেন্সন সিগারেট এর প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল চলবে? সুমন অলস হাত বাড়িয়ে একটি নিল। রুমকিকে নিয়ে রিক্সায় উঠলে সে দুই একটি সিগারেট খেত। রুমকির নিষেধে এবং বিশেষ করে ছেলে হওয়ার পর থেকে আর কখনো সিগারেট খায় নি। কিন্তু আজকের দিনটি কেমন ঘোর ঘোর লাগছে । সিগারেট টান দিয়ে একসময় শেষ করে দিল, কোন কথা ছাড়াই।
খানঃ ভাই আপনার নামটা জানা হয় নি।
সুমনঃ সুমন মিয়া।
খানঃ আপনি খুব ভালো ছেলে, তাই আলাদা করে ডেকে এনেছি। শুনেন আপনার পদোন্নতি হওয়ার চান্স নাই। আপনি পারলে প্রাইভেট কোন জায়গায় চলে যান, ভালো করবেন।

সুমনের কি হল বুঝা গেলো না। নীরবে কিছু না বলে উঠে চলে এলো। নুরুজ্জামান খান তার এই নীরবে উঠে যাওয়াকে সমর্থন করে চুপচাপ নিজেও উঠে পড়ল। মনে মনে স্যালুট দিলো চলে যাওয়ারত সুমুন মিয়াকে। মনে মনে ভাবতে থাকল এই যে, সে নিজেও ধান্দাবাজি নিয়ে এসেছে। তার নিজেরও খারাপ লাগে এমন রাজাকার পুত্রের সনদে পোস্টিং বা পদোন্নতি নিতে। কিন্তু কি করার। আগে একটা কিছু নিয়ে নিই তারপর আর না আসলেও চলবে।
সুমন কল্যানপুরের কথা বলে একটা সিএনজি বাহনে উঠল। ধানমণ্ডি এসে দেখে রাস্তা জমাট পাথরের জ্যাম। কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছেনা। ড্রাইভার বলল, আজ কি বার স্যার?
সুমন আজ সোমবার।
ড্রাইভারঃ আজ কয় তারিখ?
সুমনের হটাত মনে হল না আজ আসলে কয় তারিখ! ৩০ সেকেন্ড ভাবল কিন্তু মনে পড়ছে না। সে মোবাইলে ক্যালেন্ডার বের করে দেখে আজ ১০ জানুয়ারি।
সুমনঃ ১০ জানুয়ারি।
ড্রাইভারঃ সব্বাই ৩২ নম্বর বার যায়। স্যার আজ কি জন্য বিখ্যাত জানেন?
সুমনের মনে পরল আজ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনদেশে ফেরার দিন। লন্ডন থকে ফিরেছিল না ভারত থকে ফিরেছিল মনে করার চেষ্টা করল, পারল না। হটাৎ করেই সিএনজির ভাড়া দিয়ে নেমে পড়ল।সামনের মিছিলে মিশে গেলো। একসময় বঙ্গবন্ধুর বিরাট ছবির সামনে নিজেকে আবিস্কার করল। মনে মনে দোয়া করল এই বলে যে,‘হে আল্লাহ্‌ ! তুমি এই ব্যক্তিকে রাজাকারের ছায়া থেকে মুক্তি দাও।‘ কেন তার অন্তরে এই কথা উদয় হল সে জানে না। আজ তার কারন ছাড়াই সব কিছু করতে ইচ্ছে করছে যে !

সুমন বাসায় এসে চুপ করে রাতের খাবার খেল। রুমকির আগামীকাল সকাল ৮ টায় লেকচার ক্লাস আছে বিধায় সুমনকে আর কোন কিছু জিজ্ঞাসা করল না। কারন রুমকি এখন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছে গত ডিপি সিতে। এই ঘটনার পর সুমন যেন আরও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। জীবনের প্রয়োজনে সুমন আসতে আসতে অফিসে যাওয়া আসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে আবারো ১ বৎসর পার হয়ে গেলো। সুমন শুনছিল যে, খুব অচিরেই আবারো এই সরকারের শেষ ডিপিসি হবে। আশায় বুক বেঁধে আবারো সুমন দিন কাটায়। এইবার সে আবারো বদলি হয়ে যাওয়া সেই রোগী অতিরিক্ত সচিবের বন্ধুর দ্বারা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে নিজের ব্যাপারেও যোগাযোগ করে। উনি খুব আন্তরিকতার সাথে তাঁর সাথে ব্যবহার করেছেন। সুমন খুব খুশি হয়।

সুমন চ্যাম্বারে বসে রোগী দেখছিল। এমন সময় এক ছোট ভাই হাসানের ফোন পেলো সুমন। সুমন ফোন ধরতেই হাসান তাকে জানালো যে আজ সেই কাংখিত ডিপিসি হয়েছে। সুমন তাড়াতাড়ি চ্যাম্বার শেষ করে বাসায় এলো। রুমকি পরীক্ষার খাতা দেখছিল ড্রইং রুমে খুব মনোযোগ দিয়ে। সে তেমন কিছু খেয়াল করল না। সুমন এসেই খেতে বসল। রুমকি পুরে খাবে বোলায় সুমন চুপচাপ একাই খাওয়া শেষ করল। এরপর রুমে ঢুকে ভয়ে ভয়ে ল্যাপটপ খুলে নেটে ঢুকল। স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের ওয়েব সাইট খুলে সহকারি অধ্যাপক এর মেডিসিন বিষয় দেখতে শুরু করল। অনেক গুলো নাম আছে, প্রায় ২৫ টি নাম সেখানে চকচক করছে। কিন্তু সুমন মিয়ার নাম নাই। আবারো দেখল, আবারো। না নাই, তার নাম নাই !

কি করবে, সুমন !এই দুনিয়াতার কাছে অর্থহীন মনে হল। জীবন খুব হাল্কা হয়ে গেলো। তার মনে পড়ল না এইটা তাঁর বাড়ি, এই বাড়িতে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী, পুত্র কন্যা আছে।ফেসবুক ওপেন করল সুমন। একটি স্ট্যাটাস লিখবে সে। এমন সময় তাঁর কলেজের ৫ ব্যাচ পরের এক ছোটভাই রাজিব ইনবক্স করেছে। সে দেখে সেখানে সে লিখেছে, ‘ভাই দুঃখ করবেন না। এইটা ডিপিসি না ভাই। এইটা আরপিপিসি !’
সুমন ইনবক্সে লিখল রাজিবকে ‘আরপিপিসি’ কি ভাই বুঝলাম না !
রাজিব লিখলঃ ‘ভাই, আপনি আসলেই কোন খবর রাখলেন না। দুনিয়া কেমনে চলে। এইটা হল রাজাকার পুত্র পদোন্নতি কমিটি(আরপিপিসি), বুঝলেন !’
সুমন শুধু একটি শব্দ লিখল, ‘বলো কি !’

রাত অনেক গভীর হল। সুমন এপাশ ওপাশ করছে। রুমকিকে ডাকতে তার ইচ্ছা করল না। ঘুম আসছে না। পাশের ঘরে সন্তানরা ঘুমিয়ে। রুমকি কি খাতা দেখছে, না সন্তানের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে ! ওর মনে হল না এই দেশে আর সে থাকবে না। আর বেঁচে থেকে কি লাভ! বড়ই শুন্যতায় তার মাথা চক্কর দিতে লাগল। হটাৎ রুমকির ওড়নাটা ওর নজতে এলো। ফ্যানটি বন্ধ করে দিল। ওড়নাকে ফ্যানের উপর দিয়ে প্যাচিয়ে গলায় প্যাঁচ দিল। একবার ওড়নাটিকে টেনে দেখল শক্তভাবে ফ্যানে আটকিয়েছে কিনা? টানটি মনে হয় খুব জোরে হয়েছিল। একটি শব্দ বেড় হয়ে গেলো। গভীর রাতে এই শব্দে রুমকি খাতা দেখতে দেখতে বেশ ভালো করেই শুনতে পারল। দৌড়ে এসে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল।

সুমনের গলায় জড়িয়ে তার নিজের ওড়না। রুমকির বুঝতে কষ্ট হলনা। চিৎকার দিয়ে সুমনের নেতিয়ে পড়া দেহ ধরে নামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষনে সুমনের দেহ নিথর হয়ে নেতিয়ে পড়ল রুমকির গায়ে। রুমকি খুব চিৎকার করতে শুরু করল। কিন্তু কেউ রুমকির চিৎকারে সারা দিতে পারল না। কারন বাড়ির মুল দরোজা বন্ধ ছিল। মেয়ে উঠে দরোজা খুলে ফেলল। বাড়ির অন্য ফ্লাটের অনেকেই এসে সুমনের দেহ নামাল। কিন্তু সুমনের দেহ চলে গেছে অন্য জগতে ! কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পরছিল রুমকি ও ওর সন্তানেরা। সাথে পড়শিরাও ।

রাত শেষ হল। পরেরদিন সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সুমন মিয়ার ময়নাতদন্ত শেষ হল। অধ্যক্ষের অক্লান্ত চেষ্টায় কলেজ ক্যাম্পাসে জানাজা হল। নেতাও এলো সেই জানাজায়। রুমকিকে বুকে চেপে ধরল নেতা। নেতা জানালেন যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় এই মেধাবি ডাঃ এর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, রুমকিকেওতা জানানো হল। রুমকি কোন শব্ধ উচ্চারণ করতে পারল না। ও এখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না, কি এমন হল সুমনের, কেন সে এই চরম সিদ্ধান্ত নিল ? সে কেন খাতা দেখায় এতো মনোযোগ দিল?

সারাদিন কিভাবে শেষ হল, রুমকি জানেনা। রাতে তার বাসায় তার মায়ের বাড়ির অনেক লোক এসে থাকল। পুলিশ সকালে সুমনের ঘর বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল। রাতে থানা থেকে এসে চাবিও দিয়ে গিয়েছিল রুমকিকে।

গভীর রাত।
রুমকি ধীর পায়ে সুমনের রুমের সামনে এসে দরোজা খুলে ফেলল। ল্যাপটপ সেখানে এখনো পরে আছে। সে আবারো সেই ল্যাপটপ চালু করল। সেখানে সুমনের পেজটি ওপেন হল। ইনবক্সে এখনো হাসানের সেই উক্তি দেখতে পেল ! ‘ভাই, আপনি আসলেই কোন খবর রাখলেন না। দুনিয়া কেমনে চলে। এইটা হল রাজাকার পুত্র পদোন্নতি কমিটি(আরপিপিসি), বুঝলেন !’ এই শব্দে বুঝতে পারল সুমনের দুঃখ ! সুমনের নিজের লেখা শব্দটি আর রুমকির চোখে পড়ল না।

সে ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে করে বলতে লাগল, ‘হে আল্লাহ্‌, তুমি এতো নিষ্ঠুর হলে কেন? যে সরকার রাজাকারের বিচার করে, সেই সরকারে রাজাকার পুত্রের নির্দয় আচরণে কেন আমার স্বামিকে হারাতে হয় ! হে আল্লাহ্‌, তুমি কি ভুলে গেছ আমার স্বামী একজন মুক্তিযদ্ধার সন্তান ! এই কি দেশ প্রেমের মুল্য ! যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ চালাবে বলে; আবার মুক্তিযুদ্ধের সন্তানকে আত্মহত্যায় প্ররোচরিত করে? আমি বড়ই অসহায় এক নারী, আল্লাহ্‌! তুমি এর বিচার কর !’ রুমকির কান্না আর আল্লাহ্‌র কাছে বিচার চাওয়া চলতেই থাকে, চলতেই থাকে !
বাড়ির ভিতর জমা হওয়া আত্মীয় পরশিরা রুমকিকে সান্ত্বনা দিতে পারেনা। সকলের মনে এক ঘৃণার দাবদাহ এবং সেই অন্তরের জ্বালা নিবানোর জন্য রুমকির সাথে সাথে সকলের দুই চোখ বেয়ে চলমান সাত সাগরের জল... সকলের মনে এক প্রশ্ন কেউ কি নাই ... কেউ কি নাই... কেউ কি নাই, এই অনাচার দেখার !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মহিউদ্দীন সান্‌তু চমৎকার একটা গল্প, বেশ ভালো লেগেছে, অনেক ধন্যবাদ লেখককে।
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩
অনেক অনেক ধন্যবাদ। এতো বড় গল্পটি কষ্ট করে পড়ার জন্য । সান্তু সান্তু, কষ্ট করে এতো বড় গল্প তা পড়েছ, সে জন্য।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩
সুমন দারুন গল্প, ভাল লাগল।
মিলন বনিক শাওন ভাই....দীর্ঘ কাহিনী...বাস্তবতাগুলো একটার সাথে একটা ভিন্ন সুত্রে গাঁথা...দীর্ঘসুত্রিতার কারণে মাঝে মাধ্যে ধের্যচ্যুতি ঘঠলেও নাটকীয় কায়দায় সহজ সরল কাহিনীর বুনন বেশ ভালো লেগেছে....অনেক অনেক শুভকামনা...
আসলে আমি বড় গল্প কম লিখি বলে একটা দোষ আছে, সেই দোষ খণ্ডনের চেষ্টা। কষ্ট করে পড়েছেন বলে ধন্যবাদ জানাই।
ভালো লাগেনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩
সূর্য আমাদের ভেতরে একটা মানদন্ড তৈরি হয়ে গেছে বা এটা আমরা ডিএনএ তেই বহন করছি যার কারণে বাস্তবে না হলেও গল্প, নাটক, সিনেমায় নায়কদের হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারি না। গল্পের অনেক কিছুই বাস্তবে হচ্ছে, হবে। তবে ঐযে মানদন্ডটা! পাঠক আমির দাবীই থাকবে এই সব অসৎদের বিরুদ্ধে নায়ক কোন না কোন একটা পথ বের করে জয়ী হবে, অন্যায় রুখে দেবে, সরিয়ে দেবে যতসব অনাচারীদের.... আপনার বাক্য বুনন ভালো লেগেছে। ছোট গল্পের চেয়েও বেশি বড় প্লট দাবী এ গল্পের আর তাই হয়তো ঘটনা যত দ্রুত ঘটেছে তার সাথে সমান তালে কাহিনী বিন্যস্ত হয়নি। ভালো লাগলো গল্প।
ধন্যবাদ, ভাই। এখন নায়কেরা আর যুদ্ধে জয়ি হচ্ছে না। চাটুকার, দালালগণ নায়কের স্থানে ভেজালের পশ্রা সাজিয়েছে। নায়কের শুদ্ধতা তাই এইভাবেই মার খাচ্ছে। কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।
এফ, আই , জুয়েল # একটু বড় হলেও অনেক সুন্দর গল্প ।।
ধন্যবাদ, জুয়েল ভাই। কষ্ট করে পড়েছেন, সেই জন্য !
মিছবাহ উদ্দিন রাজন নিষ্টুর সুন্দর গল্প ।
ভয়ংকর কঠিন মন্তব্য। ধন্যবাদ রাজন।
আরাফাত ইসলাম সত্য প্রকাশের ক্ষমতা সকলের থাকে না, যেটি আপনার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন ! নিসন্দেহে ভালো লিখেছেন !! আমার-টি পড়েছেন তো ?
পড়েছি মানে, প্রথমেই পড়েছি।সর্বচ্চ মার্ক দিয়েছি। তুমি ভোট দিয়েছ তো?

২৯ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪