ছোট খাসী

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

মোঃ মোজাহারুল ইসলাম শাওন
  • 0
  • ৩০
১৯৯৮ সালের কথা। ফিরছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াচাকুরি স্থল থেকে ঢাকার বাসায়। মাসে ১৫-২০ দিন পর পর আসি। এনাটমির মাস্টারসপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস। ফলে এই ভাবে ম্যানেজ করে আসতে হয়। আমি আমার কলিগেরক্লাস নিই প্রতিদিন ২টা ক্লাস নিই। তখন কলিগ থাকে ঢাকায়। আমি যখন আসি তখনকলিগ আমীন ক্লাস নেয়। আমরা এই রুটিন আগেই সেট করে নিই, সমস্যা হয় নাই। এমনমাস গেছে আমীন আর আমি ফেরিতে ক্রস করছি।

পুরোদমে যমুনাব্রিজের কাজ চলছে। নগরবাড়ি ঘাটের বাসিন্দা মানে দোকানদারদের কেমন মনমরামনমরা ভাব। আমি সব সময় নিখিল বাবুর হোটেলে খেতাম। এই হোটেল মালিক এখনসিরাজগঞ্জ মোড়ে আবারো হোটেল দিয়েছে । সে যাক সেই দিনের কথা বলি। নাইট কোচেবগুড়া থেকে উঠেছি। তখন নাইট কোচ ছাড়ত রাত ৮ টায়। নগরবাড়ি ঘাটে আসতে আসতেরাত ১০টা বেজে যেত। এরপর অপেক্ষার পালা কখন ফেরি আসবে ! প্রায়ই রাত ১টানাগাদ ফেরি আসত আরিচা থেকে আমরা ১ম বা ২য় ফেরিতে উঠতাম। এর ফাকে হাঁটাহাঁটি করে সময় পার করতাম।

এমন করেই সময় পার করছি। রাত ১২টা বাজল। ভাবলাম খেয়ে দেয়ে নিই। ফেরির খাবার ভালো লাগে না। যথারীতি নিখিলবাবুর হোটেলে গেলাম। আমার প্রিয় খাবার রুটি আর সবজি আর এক কাপ চা। হোটেলেভাত মাছ মাংস সব পাওয়া যায়। মালিক দোকানের ভিতরেই আলাদা করে রুটি বিক্রিকরেন। নিখিল বাবু বেশ বয়স্ক। ৫০ এর উপর তো হবেনই। আমার সাথে বেশ খাতির।
গেলেই বলবে, "ডাঃ সাহেব একটু গরম রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।"
আমিতার কাছের টেবিলে বসে পরতাম। একটু পরেই গরম গরম রুটি আর সবজি দেয়া হত আমারসাম্নে।আমি আরাম করে খেয়ে এক কাপ চা খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতাম।সেদিনও তার দোকানে গিয়ে দেখি ব্যাচারার রুটির অংশ বন্ধ।
আমি তাকে ডেকে বললাম, ' কি ব্যাপার নিখিল বাবু, রুটি কৈ?'
নিখিলবাবু হাত জোর করে বলল, " ডাঃ সাহেব, আজ মাফ করুন। ২ দিন হল খুব জ্বরেভুগছি। গতকাল তো বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি। আজ আপনে একটু ভাত খেয়ে নিন।"
আমিকিছু বলার আগেই নিখিল বাবু উনার সাধ্যমত জোরে বলে উঠলেন, " এই তোরা কেআছিস? আমার ডাঃ সাহেব কে আজ ভালো করে ভাত খাওয়া। প্লেট ভালো করে গরম পানিতেধুয়ে দিস ।"
আমি মুখ হাত ধুয়ে ভাত খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসতেই একবেয়ারা একটা প্লেট নিয়ে দৌড়ে এলো। বয়স কত হবে? বড়োজোর ১৩-১৪ বৎসর। কিশরমুখে মোলায়েম গোঁফের আভাস দেখা যাচ্ছে। খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে সেআসলে এসব করার মত ছেলে না। হয়ত বাড়ি পালান কোন ভালো পরিবারের দুষ্টু ছেলে।আমার এক ছোট্ট ভাই ছিল যে ইপিলেপ্সি রোগে ভুগতে ভুগতে এমন বয়েসে পুকুরেডুবে মারা গিয়েছিল। তখন আমি এইচ এস সি তে পড়তাম। এই বয়েসের ছেলে দেখলেআমার খুব মায়া করত।
আমি ওকে নাম জিজ্ঞাসা করলাম,' তোমার নাম কি ?'
ছেলে মুচকি দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল, " স্যার নাম দিয়ে কি হবে। পিচ্চি বলেই সবাই ডাকে। ভাতের সাথে কি খাবেন, বলেন !"
আমিও দুষ্টুমি করে বললাম, ' নাম না বললে খাব না। যাই তাহলে !'
এইবারছেলেটি চমকে উঠল এবং দ্রুত আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ''স্যার আমার নাম মোস্তাকআহমেদ। সবাই পিচ্চি ডাকতে ডাকতে আর ওই নাম কেউ জানেনা।''
আমার ছোটভাইয়ের নামও ছিল মোস্তাক আহমেদ। বাবা খুব সখ করে এই নাম রেখেছিলেন যুদ্ধেরপরের বৎসর ওর জম্ম হয়েছিল। আমি চমকে উঠলাম। এর মধ্যেই চটপটে পিচ্চি আমারজন্য ধোঁয়া উঠা ভাত এনেছে।
পিচ্চিঃ ''স্যার, তরকারি কি দিব?''
আমিঃ 'মাছ দাও, টাটকা মাছ।' ছোট ভাইয়ের নামে নাম হওয়ায় আমি তুই থেকে তুমি উঠে গেলাম।
পিচ্চিঃ ''স্যার, মাছ ভালো হবে না। বাসি মাছ। আপনে ছোট খাসির মাংস খেতে পারেন। এখনি রান্না নামছে ।''
আমিঃ 'ভালো হবেতো ?'
পিচ্চিঃ ''জী স্যার, ভালো হবে ফ্রেস ছোট খাসী !''
আমিঃ 'আন তাহলে।' বলেই আমি লবণ মাখিয়ে ভাতের সাথে দেয়া করল্লা ভাজি দিয়ে খাওয়াশুরু করলাম। মুহূর্তে ছুটন্ত ঘোড়ার বেগে পিচ্চি ধোঁয়া উরা মাংস এর এক বাটিএনে দিল। সেখানে ছোটও নয় বড়ও নয় এমন সাইজের ২ টি পিছ মাংস । মাংসের সাইজহবে ১'৫'' * ১'' * '৭৫ '' একেকটি টুকরো। সাথে টাটকা ঘন থক থকে ঝোল। জল একটুআগে নিলাম । ভাতে মেখে মুখে দিয়ে দেখলাম খারাপ না। সম্ভবত মিষ্টি কুমরদিয়ে এই গাঢ় ঝোল বানানো হয়েছে। আমি মাংস দিয়ে দুই প্লেট ভাত খেলাম। এরমধ্যে পিচ্চি একবার এলো।
আমায় জিজ্ঞাসা করল,'' স্যার, ডাল নিবেন? মাস কালাইয়ের ডাল ছিল।''
আমিঃ ' ঘন না পাতলা?'
পিচ্চিঃ '' হোটেলের ডাল ঘন কি হবে স্যার। পাতলা। তবে খারাপ না।''
আমি বুঝতে পারলাম সে আমাকে একটু হলেও ভালোবাসতে শুরু করেছে।
আমিঃ 'পিচ্চি, তোমার খাসির মাংসে তো কোন গন্ধ পাচ্ছিনা !'
পিচ্চিঃ '' স্যার, ছোট খাসী তো !''
আমিঃ 'কত ছোটরে ! দুধ ছেরেছিল তো?'
পিচ্চিঃ "না স্যার অত ছোট না, তবে ছোট খাসী তো !"
পিচ্চিএই বলে চলে গেলো অন্য কোন খদ্দের কে সামলাতে। আমি চেটে পুটেই খেয়ে উঠলাম।সাথে এক কাপ চা খেলাম। ফেরির আলো এসে পরেছে নগর বাড়ি ঘাটে। আলোকিত ঘাটেমানুষ আর মানুষ। সবাই আস্তে আস্তে নিজের গাড়ির দিকে ছুটছে। আমিও বিল দিয়েএবং মস্তাক আহমেদ ওরফে পিচ্চিকে ডেকে ওর হাতে ১০ টাকা বকশিস দিয়ে গাড়িরদিকে পথ ধরলাম। একটু এগুয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি এখনো অবিশ্বাসেরচোখে তাকিয়ে আমার পিচ্চি। হয়তো ভাবছে ৩৪ টাকার ভাত খেয়ে ১০ টাকার বকশিসদিলো , এত্ত মহান !
আমি আমার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। ১মফেরিতেই শেষের দিকে আমরা উঠলাম। ভোরে গাবতলি নামলাম কোন সমস্যা ছাড়াই। এবার২০-২১ দিন থাকব ঢাকায়। ব্রিজ ওপেন হলে তবেই যাব বগুড়ায়। এইভাবেই কলিগ ডাঃআমিনের সাথে কথা বলা আছে।
প্রথম আলো পত্রিকা তখন একটু একটু করে তারপ্রচার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। কিছুটা নতুন নতুন বিষয় এই পত্রিকায় পাওয়াযাচ্ছে। বিশেষ করে ছেলে মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ক পাতা ছাত্রদের নিকট কিছুটাজনপ্রিয় করেছে।আমি স্বখরচে রাখি আমার প্রিয় পত্রিকা তখন ছিল দৈনিক দিনকাল।শশুর মশায়ের ছোট ছেলে তখন স্কুলের শেষ ধাপে পড়ে সে পছন্দ করে প্রথম আলো।আর আমার বন্ধু কাম বউএর বড় ভাই সে রাখে দৈনিক জনকণ্ঠ। জনকণ্ঠ রাখা হয়অফিসের টাকায় বাসায়। শশুর বড় অফিসারদের একজন বলেই এমন ব্যবস্থা।
বাসারনিচে সকালে নেমেছি। আমগাছ তলায় একটু আগে পত্রিকা দিয়ে গেছে হকার। আমিদিনকাল নিয়ে বগল দাবা করলাম। বড় শ্যালিকা ৪ তালা থেকে চিৎকার করে বলছে,'' শাওন ভাই, আমাদের পেপার টা একটু আনেন তো !''
আমি তখন বাচ্চা মানুষকরার জন্য শশুর বাড়ির ২ তালায় ভাড়া থাকি। বউ স্কুল মাস্টার। ভোরে যায় আসেপ্রায় বেলা ২ টা নাগাদ। আমি প্রথম আলো ও জনকণ্ঠ সহ উপরে উঠলাম। মানে ২তালায়। খেয়াল বশত প্রথম আলো একটু উলটালাম। ৩য় বা ৫ম পাতায় গ্রামগঞ্জের খবরছাপা হয়েছে। সেই খবরের মধ্যে একটি বক্স খবর নগরবাড়ি ঘাটের 'নিখিল হোটেলেরকাণ্ড' শিরনামের প্রতি আমার চোখ আটকে গেলো। এক নিঃশ্বাসে আমি খবর পরে শেষকরলাম।






'নিখিল হোটেলের কাণ্ড'
(নিজস্ব সংবাদ দাতা)
''গতকালদুপুরে একটি ভ্রাম্যমান আদালত নগরবাড়ি ঘাটের হোটেল গুলোতে আকস্মিক তল্যাসিচালায়। নিখিল হোটেল তল্যাসি করে এখান থেকে রান্না করা কুকুরের মাংস উদ্ধারকরেন। দীর্ঘদিন যাবত এই হোটেলে ছোটখাসী বলে কুকুরের মাংস খাওয়াইয়ে জনগন কেপ্রতারিত করে আসছিল। ম্যানেজার ও বাবুর্চি কে আতক করে থানায় সোপর্দ করাহয়েছে।
আমাদের প্রতিনিধি আরও উল্লেখ করে যে এমনিতেই ব্রিজ হওয়ায় এইঘাটের অবস্থা শোচনীয়। এর মধ্যে এই কুকুরের মাংস রান্না করে খাওয়ানোর ঘটনায়উপস্থিত জনগন খুব মর্মাহত হয়েছেন। সকলে এর সমুচিত শাস্তির দাবী করেছেন।ভ্রাম্যমান আদালত নিশ্চিত হয়েছে যে, হোটেল মালিক নিখিল বাবু এই কাজের সাথেসম্পৃক্ত ছিলেন না। তার হোটেলের দীর্ঘদিনের ম্যানেজার ও বাবুর্চি নিখিলবাবুর সরলতার সুযোগে এই প্রতারণার ব্যবসা করে আসছিল।
যমুনা ব্রিজেরকর্মরত কোরিও কোম্পানি হুন্দাই এর শ্রমিক গণ কুকুর নিয়মিত সেবন করে থাকেন।সেই থেকে উৎসাহিত হয়েছেন বলে ম্যানেজার জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।''

আমি চোখ কচলে আবার দেখলাম। আবারো , আবারো।
পিচ্চিরকথা গুলো কানে বাজছিল, " স্যার, মাছ ভালো হবে না, বাসি। তবে টাটকা ছোটখাসির মাংস হবে , এক্কেবারে গরম গরম। বা ছোট খাসির মাংস তো স্যার গন্ধ একটুকমই হবে !"
আমি কি করব ভেবে পেলাম না। বমিও এলো না ৭ দিন আগের খাওয়াছোট খাসির মাংসতো এতো দিনে আমার ল্যাট্রিন ক্রস করে সিটি কর্পোরেশনের বড়পাইপে চলে গ্যাছে। মনকে বিষণ্ণতায় ভুগা থেকে রক্ষা করতে খুব মজাদার করেপরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিলাম।

দুপুরে বউ বাসায় এলো। ক্লান্তও ক্ষুধার্তও বটে। আমি তার খাওয়া পর্ব শেষ হলে খুব রসিয়ে রসিয়ে ছোট খাসীখাওয়ার গল্প করলাম। বউ কিছু বুঝতে পারল না। আমি ৪ তালা থেকে প্রথম আলোআনিয়ে খবরটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম। বউ অনিচ্ছা নিয়েই পড়তে লাগলো। পড়াশেষ করে আমার দিকে কেমন ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে উঠল,'' তার মানে তুমি সেদিন আসলে কুত্তার মাংস খাইছ !''
আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় আমাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়ে বউ আমার শরীর ভোরে সদ্য খাওয়া সব খাবার বমি করে ছেড়ে দিল !
আমি প্রিয়তমা বধুর এই স্বাভাবিক অতি তড়িৎ জনিত কর্মরোধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারলাম না।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে শুধু তার পরে যাওয়া থেকে উদ্ধার করলাম।

পাদটীকাঃ
এইগল্পের শেষ হলেও আমার নজর পত্রিকায় আটকে যেত ।প্রায় ৫ -৬ বৎসর পর একদিনদেখলাম নিখিল হোটেলের ম্যানেজার আর বাবুর্চির ৫ বৎসরের করে শাস্তি ও ১ লক্ষটাকাকরে জরিমানা হয়েছে। প্রতারকদের শাস্তি হয়না এই বিশ্বাস আমার ভেঙ্গেছে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এই ঘটনার পর থেকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোজাহারুল ইসলাম শাওন পড়া এবং মন্তব্য করায় ধন্যবাদ, নাসিমা খান
Nasima Khan ভালো লাগল ।

২৯ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪