চৈত্রের গরম এর সাথে লু হাওয়া যোগ হয়ায় ঢাকা বাসির সাথে আমিও হাস ফাস করছিলাম চেম্বারে বসে।উপরে ঘুরণয়মান ৫৬ ইঞ্চির সিলিং ফ্যানের ক্ষমতা ৩২ ইঞ্চির ফ্যানের মত মনে হচ্ছিল ।প্রতিবার গরমে রোগী বেড়ে যায়, এবার উল্টো। এ নিয়ে মেডিকেল পেশার লোকদের মধ্যে বেশ আলোচনা। অনেকের অনেক মত সবচেয়ে বেশি আলোচিত মত মানুষের হাতে টাকা পয়সা কম। ভদ্রলোকী ভাষায় বললে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা গ্যাছে।আলোচনা যাই হোক আমাদের আয় যে কমেছে তার সাক্ষাত প্রমাণ চেম্বারের ফাকা ফাকা অবস্থান। অতি গরমে মানুষ আসলেই এত কাহীল যে বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাহির হচ্ছিলই না।
আমি ঝিমুচ্ছিলাম আর সামনের টিভিতে গোপাল ভাড় এর কার্টুন দেখছিলাম।এমন সময় হদতন্ত হয়ে আমার চেম্বারে প্রবেশ করলো এক ১৩-১৪ বৎসরের কিশোর। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে নিজেই রোগী বসার আসনে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলা শুরু করলঃ আংকেল, আমার আব্বা আসতেছে। উনার পেটে ক্যানসার হয়েছে। ডাঃ বলেছে উনার আর সময় নাই। কোন ওষুধেও কিছু হবে না। আপনাকে খুব পছন্দ করে তাই আপনাকে আব্বা দেখাতে চায়। কিন্তু আপনি তাকে কোন ওষুধ দিবেন না। তার গলায় ভীষণ আকুতি... কথা শেষ না হতেই আব্বু এসেছে বলেই দ্রুত চেম্বার ত্যাগ করল।
আমি ছেলেটির দিকে এতক্ষণে ভাল করে তাকালাম। আমাদের রহমান চৌধুরীর ছোট ছেলে।ওর বাবার বর্তমান অবস্থার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।পেটে ক্যান্সার, ছড়িয়ে পড়েছে ; ওষুধেও কিছু হবে না। তিনটি ছোট্ট বাক্যের যে বিশাল অর্থ তা আমি চিকিৎসক হিসাবে বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
আমি ভাবালুশ হয়ে পরলাম। ২৫ বৎসর আগে এই অজ মহল্লায় যখন আমি প্রাক্টিস শুরু করি সেই সময়ের আমার কাছে আসা রোগিদের একজন এই রহমান চৌধুরী। পেটে খামচে ধরেছে ব্যাথায়। উনি খাওয়ার সোডা খেয়ে উপুর হয়ে সেজদারত। অন্যদিন একমুঠো সোডা খাওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যেই ব্যাথা কমে যেত। সে দিন না কমায় পাশের ডাঃ আমাকে বাসায় কল দিয়েছেন। আসলে উনি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্যারের রোগী। আমি দেখলাম, প্রায় আধাঘন্টা পর স্যালাইন পুশ করে সাথে ব্যাথার ওষুধ দিয়ে তাকে সুস্থ্য করলাম। সকলেই আমার খুব ভক্ত বনে গেল। ভদ্রলোক ছিলেন গরীব বাস শ্রমিক। সামান্য আয়ে ৩ সন্তানের লেখা পড়া চালিয়ে সংসার চালাতে বেশ হিমসিম খান। তবুও আমাকেই দেখান যতদুর পারেন পারিতোশিক পরিশোধ করেন।মনটা খারাপ হয়ে গেল...
এমন সময় রহমান চৌধুরীর এক বোন এসে একই অনুরোধ রাখল, যেন আমি তাকে দেখে কোন ওষুধ না দেই। উপরন্ত তাকে বলি উনি এখন যাকে দেখাচ্ছেন সেই চিকিৎসকের নিকট যেতে বলি....
আমি চেম্বারে বসে থাকা অবস্থায় রহমান চৌধুরীর গলার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। উনার বোন বলল যে উনি বাইরে এসে পরেছেন। দাঁড়িয়ে দেখি চেম্বারের বাইরে হুইল চেয়ারে বসে আমাকে ডাকছেন। নাকে নল, পেশাবের রাস্তায় নল, বাম হাতে ক্যানুলা পরানো। ক্ষয়ে যাওয়া হাড্ডিসার রক্তশুন্য দেহের চৌধুরী সাহেব কে দেখে বোঝা যাচ্ছিলঃ সময় বেশি নাই। পরপারের ডাকের অপেক্ষায়...
উনি আমাকে দেখেই স্বভাব সুলভ হাসিতে আমাকে অভ্যার্থনা জানালেন। আমাকে বললেনঃ শাওন ভাই, ওরা কোন ডাক্তার দেখাচ্ছে, তার ওষুধে আমি তো চোখে দেখতে পাচ্ছিনা। আপনি আমার পুরোনো ডাক্তার , একটা চোখের ড্রপ দেন।আপনি ওষুধ দিলেই আমার চোখ ভাল হয়ে যাবে।
মৃত্যু পথ যাত্রি এই মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করতে মন সায় দিচ্ছিল না। রক্তচাপ মাপলাম, পালস দেখলাম, আলোতে চোখ দেখলাম সব স্বাভাবিক।আমার এই রোগী দেখার চেষ্টায় তার মুখে প্রাণ খোলা হাসি। তার চোখের ভাষায় দৃঢ়তার শক্তি.... আমাকে বলতে শুরু করলেনঃ দেন, আমাকে ড্রপ দেন....
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে তার আত্মিয়রা বাসার দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। রহমান চৌধুরী তখনো বেশ জোরেই বলে যাচ্ছেনঃ এই শাওন ভাইকে ভিজিট দে, ভিজিট দে তার বোন বলে যাচ্ছেঃ নেবে না, নেবে না। . . আমি চেম্বারে ফিরলাম। অতীত এসে মনকে নষ্টালজিক করে দিচ্ছিল। রহমান চৌধুরীর সাথে আমার ঘটে যাওয়া সব ঘটনার স্মৃতি গুলোর ভিডিও আমার মনে ভীর করছিল।সব কিছু ছাপিয়ে তার পরিবারের আচরন আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। যে ব্যক্তি রক্তে ক্যান্সারের ভ্রুণনিয়ে সংসারের ঘানি টেনে টেনে মৃত্যুর বার্তাকে আলিংগন করলেন, কিন্তু সেই ক্যান্সারের কারনেই তাকে সবাই বোঝা ভাবতে শুরু করল? কিভাবে এমন বদলে যেতে পারে উত্তর প্রজম্মের প্রতিনিধি? এক্টি চোখের ড্রপ আমি তাকে হয়ত তার মানসিক প্রশান্তির জন্য দিতে পারতাম, যাতে তার কোন আরোগ্য হত না; কিন্তু আমাদের দুইজনেরই মন প্রফুল্ল থাকত। পরিবারের সদস্যদের একচোখা একগুয়েমির কাছে দুইজনেই পরাজিত হলাম।
উত্তর আর পুর্বের মাঝে এই হল ফারাক, কি প্রেমে কি অপ্রেমে ! রহমান চৌধুরী এই ঘটনার তিন দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কেতকী
রোগের বয়স বেশি দিন হলে রোগীকে পরিবারের মানুষ বোঝাই মনে করে যদি সে বেশি বয়সী রোগী হয়। ব্যাপারটা দুঃখজনক। গল্পে ভোট রইল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।