আসাদ দরজাটা আলগোছে ফাঁক করে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, বাবু ঘুমিয়েছে?
নাজমা বাবুর পাশেই বসে ছিল। উঠে এলো। তার স্বরও নিচু, বলল, হ্যাঁ।
পাশের ঘরে একটু আসবে?
চল, যাচ্ছি।
নাজমা সন্তর্পণে দরজাটা টেনে দেয়। তারা দু’জন ধীরে ধীরে পাশের ঘরে গিয়ে বসে।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না। নীরবতা ভাঙতে চাইছে দু’জনই, কিন্তু কী বলে শুরু করবে দিশা পাচ্ছে না। নাজমা হাতের চুড়িগুলো মিছেই ঠিকঠাক করার চেষ্টা করলো, আসাদ বারদুয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেললো এবং আরেকটু গম্ভীর হয়ে গেল।
নীরবতা ভঙ্গ করলো আসাদই। বলল, কিছু ঠিক করলে?
নাজমা বলে, যা বলার তা তো বলেছিই। আমার আর কিছু ভাবার নেই।
একটু সময় নিলে হতো না?
সময় নিয়ে কী লাভ? তুমিও তো বলেছ, এটাই তোমার সিদ্ধান্ত।
কিন্তু, বাবু ... ...
হ্যাঁ, সে-ই একমাত্র সমস্যা।
বলেই নাজমা চুপ হয়ে যায়, মাথা নিচু করে ফেলে। মা হয়ে নিজের একমাত্র সন্তানকে “সমস্যা” বলাটা কেমন যেন বেখাপ্পা শোনায়।
আসাদ হঠাৎই যেন বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে, সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বলে, আবারো বলছি। একসাথে থাকার একটা শেষ চেষ্টা করা যায় না? আমাদের কথা বাদ দিলাম, শুধু বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
নাজমাকে দুঃখী দেখায়। চোখের কোণে কিছু একটা চিকচিক করছে তার। আলগোছে শাড়ির আঁচলের কোণায় মুছে ফেলে ভেজা কণ্ঠে বলে, যত সময় এভাবে কাটাবে, ততই তো ভার বাড়বে।
আবার নিভে যায় আসাদ। শরীরটা পেছনে, চেয়ারের গদিতে ছেড়ে দেয়। ওর স্ত্রী ঠিকই বলেছে। এত বিতৃষ্ণা, এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এক ছাদের নিচে হয়তো থাকা যায়, দিন পার করা যায়, কিন্তু বড় অসহনীয় হয়ে ওঠে। তার চেয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে ভারমুক্ত হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।
স্ত্রী? হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই তাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে, পরিচয় ভিন্ন হয়ে যাবে। এতদিনের পথ চলা মাত্র একটা কাগজে সই করেই অস্বীকার করে ফেলা হবে।
সন্তানকে আর ক’দিন কাছে পাবে? প্রশ্নটা মাথার ভেতর ওকে কুরে কুরে খেতে থাকে। আহ, আমার অস্তিত্ব, আমার স্বত্বার অংশ। সে দূরে চলে যাবে? সবসময়, ইচ্ছেমত দেখতে পাবো না, কোলে নিয়ে আদর করতে পারবো না?
নাজমা আবার বলে, রাত হয়েছে, ঘুমোতে চল।
আসাদের বুক ভেঙে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, বাবুর সাথে একটা অবিচার করতে চলেছে ওরা।
পাশের ঘরে বাবু ঘুমোয় নি। একটুখানি খোলা দরজা দিয়ে “আব্বুনি” আর “আম্মুনির” কিছু কথা কানে এসেছে। কিছুদিন ধরেই দু’জন গম্ভীর হয়ে আছে, ঠিকমতো হাসছে না, ওর সাথে খেলছে না। আব্বুনি গল্প বলছে না, আম্মুনি গান গাইছে না। যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যেন দু’জন খুব জটিল কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।
না, ডিভোর্স, বিচ্ছেদ, ভাঙা-গড়া – এসব জটিল কথার অর্থ বোঝার বয়স বাবুর এখনো হয় নি। তবুও সে তার ছোট্ট বুকটার ভেতর একটা কেমন দুরুদুরু অনুভব করে। আবছা-আবছা টের পায়, ওর স্বপ্নমাখা শৈশবের দিকে একটা ঘোর দুর্বিপাক ঘনিয়ে আসছে, যেটা ওর জন্য খারাপ হবে, খুব খারাপ।
আচ্ছা, আব্বুনি আর আম্মুনি কি আলাদা হয়ে যাবে? ধ্যাৎ, তাই হয় নাকি? দু’জনের একজনকেও তো সে ছেড়ে থাকতে পারবে না।
ইস, আব্বুনি আর আম্মুনির সাথে যদি এটা নিয়ে কথা বলা যেত, তাহলে কত্ত ভাল হতো। কিন্তু ওরা যে “বড়”। ওরা শুধু নিজের মধ্যে কথা বলে, কখনো ওকে জিজ্ঞেস করে না, তুমি কী চাও? যদি জিজ্ঞেস করতো, তাহলে অবশ্যই সে বলতো, আর যা-ই কর, এভাবে আমার শৈশব কেড়ে নিও না প্লীজ, তোমাদের পায়ে পড়ি। না, এতটা গুছিয়ে বলতে পারতো না, আধো আধো মুখে যা পারতো তা-ই না হয় বলতো।
বাবু একপাশ ফিরে বুক ফেটে আসা কান্নাটা বালিশের ওপর চেপে রাখতে চাইলো।