স্বপ্ন কেদারা

ঝড় (এপ্রিল ২০১৯)

মাসুম বিল্লাহ
  • ৩১
তখন ভোর ৫ টা। সূর্যি মামা সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠছেন। অন্ধকার পথ ঘাট আলোয় আলোয় পরিষ্কার হবে হবে ভাব কিন্তু হচ্ছে না। ঠিক তেমনি ভাবে ঈষৎ আলোয় আলোকিত হয়েছিলো সহানের ঘর। ১৩ তালায় একটি এপার্টমেন্টে থাকে সে। বাসাটার আভ্যন্তরীণ সাজগোজ সে নিজের মত করে করেছে। ফ্লোর থেকে ছাদ অবধি বিশাল বিশাল জানালা। কোন গ্রিল নেই শুধু কাঁচ। একে জানালা না বলে কাঁচের দেয়াল বলাই যুক্তিযুক্ত। দুটো ঘরের জায়গা নিয়ে সে একটি ঘর বানিয়েছে। ইদানিং মানুষ খুব ছোট ছোট বাসা বানানো শুরু করেছে। এত ছোট ঘর যে সেখানে নড়াচড়া করাই মুস্কিল। কিন্তু সহানের ছোট ঘর সহ্য হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই এ ব্যবস্থা। ঘর বড় করায় একটা সুবিধা হয়েছে, পূর্ব পশ্চিম আর দক্ষিন দিক তার জন্য খোলা। এই তিনদিকেই সে কাঁচ দিয়ে অমন দেয়াল করেছে। ধব ধবে সাদা পরদা দিয়ে ঢেকে রাখে। পর্দাগুলো সরিয়ে দিলে কেও বুঝতেই পারবে না যে এখানে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে। এই ঘরে বসেই সে সকালের সূর্যোদয়, সন্ধ্যার সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য থেকে সে কোনভাবেই বঞ্চিত হতে চায় না। তাইতো দক্ষিণা বাতাশের সময়, মুশলধারে বৃষ্টির সময়, কুয়াশামোড়া শীতের সকালে সে তিনদিকের পর্দা সরিয়ে আরামকেদারায় বসে বসে দোল খায়। আজ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি। ঘর একটা হিম হিম ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। বৃষ্টির আওয়াজ ঘরের ভেতর ঢুকেনি কেননা সে ঘুমুবার আগেই ওয়েদার আপডেটে দেখেছে বৃষ্টি হতে পারে এজন্য জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু পর্দা সরানো ছিল। গতকাল সন্ধ্যা ৬ টা থেকে হচ্ছে এ বৃষ্টি। সহানের অভ্যাস রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুমানোর, সে আকাশে তারাই থাকুক আর মেঘ। ঘুম ভাঙ্গার কারণ সে চোখ খোলার সাথে সাথেই বুঝতে পারলো। বাইরে বেশ জোরে জোরে বাজ পড়ছে সাথে চোখ ধাঁধানো আলো। এই বাজের শব্দ আর আলোতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। উঠে বসে সে। আজ ৭ তার ভেতরেই অফিসে চলে যাবে। বিছানায় বসে দু হাত দুপাশে রেখে পা দোলাতে দোলাতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকে। বিদ্যুতের আলোয় আলোয় স্পষ্ট হতে থাকে তার সাদা রঙের ঘরের ভেতর সাদা রঙের বিছানায় সে একটি সাদা ঘুমুবার পোশাক পড়ে বসে আছে। পেছনের দেয়ালে তিনটি বড় বড় কালো কাঠের দরজার। প্রতিটি দরজার দুপাশে দুটি করে গাছ। আর বাকি তিন কাঁচের দেয়ালের নিচে ফ্লোর থেকে একটু উচু করে লম্বা টবে ছোট ছোট ফুল গাছ। বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ তার পাশের পড়ার ঘর থেকে বড় পেন্ডুলাম ঘড়িটা বেজে উঠল। “তার মানে ৬ টা বেজে গেছে। আর বসে থাকা ঠিক হবে না” বলেই সে উঠে পড়লো। উঠে গিয়ে মাঝখানের দরজা খুলল। খুলতেই দেখা গেলো দরজার ভেতরটা আয়না আর দেয়ালের সাথে সংযুক্ত ক্যাবিনেট। একদম উপরের ড্রয়ারে বিভিন্ন রকমের টুপি। এর পরের গুলায় যথাক্রমে চশমা, টাই, হাতঘড়ি, ব্রেসলেট, শার্ট, প্যান্ট, বেল্ট, মোজা ও জুতো। পর্যায়ক্রমে সাজানো। সহান যথেষ্ট সৌখিন। তার সৌখিনতার পরিচয় আর এই সংগ্রহ দেখলেই বুঝা যায়। সেখান থেকে আজ কি কি পড়বে সেগুলো সে বের করে বিছানার উপর রেখে বাঁ পাশের দরজা খুলল। এটা ওয়াশরুম। তার ওয়াশরুম ও বেশ বড় ও পরিপাটি করে সাজানো। ভেতরে ঢুকেই সে তার বেসিনের সামনে দাঁড়ালো। বেসিনের পাশে ছোট ক্যাবিনেটে তার সব ওয়াশরুম সরঞ্জাম রাখা। সেদিকে হাত দিল না। তার ঘুম এখনো কাটেনি ঠিক মত। পানি ছেড়ে সে চোখে মুখে পানি দিতে লাগলো। ঘুম যেন আরও জেঁকে বসতে চাইছে। সে আরও বেশি করে পানি দিতে লাগলো।
চোখ খুলল সহান। ভাঙ্গা জানালার ফাঁকা দিয়ে হেঁচে ছেচে পানি এসে পড়ছে আর চোখে। চোখের উপর পানি ঘেঁচে এসে পড়ায় তার ঘুম ভাঙ্গে গেছে। উঠতে গিয়ে প্রথমে উঠতে পারলো না। তার উপর আর ছোট দুই ভাই হাত পা উঠিয়ে ঘুমাচ্ছে। একজনের খাটে তিন জন ঘুমালে এভাবেই ঘুমাতে হয়। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। সাবধানে তাদের হাত পা সরিয়ে উঠে পড়লো। সাবধানে সরাল কারণ ঘুম ভেংগে যাবে এই জন্য নয়, খাট থেকে পড়ে যেতে পারে এই জন্য। বালিশের নিচ থেকে একটি রঙ চড়া কেসিও ঘড়ি বের করলো সে। তার পকেটমার বন্ধুর কাছ থেকে ২০ টাকা দিয়ে কিনেছিল এই ঘড়িটি। তার ঘড়ির অনেক সখ। “গরিব মানুষের আবার সখ” মনে মনে ভাবে সে। দেখল ৬ টা বাজে। সে পেপার বিলির কাজ করে সকালে। ৭ টার মধ্যে না গেলে বেতন থেকে টাকা কেটে রাখবে। তারাতারি উঠে পড়ে। তার একটাই মাত্র ভাল প্যান্ট আর শার্ট তাও এক বছরের পুরনো। সেটাকেও আবার মাঝে মাঝে ছোট ভাই দের সাথে ভাগ ভাগী ভাগি করতে হয়। বাঁশের খুঁটিতে একটি পেরেক মেরে সেখানে ঝুলানো ছিল। তারাতারি কাপড় পড়ে নিল। “যেতে যেতে বৃষ্টির পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিব। এখন সময় নেই” বলেই সে দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলল। সাথে সাথে ঠাণ্ডা পরিষ্কার বাতাসের ঝাপটা ঘরের ভেতর ঢুকল। এতক্ষণ দরজা জানালা বন্ধ থাকায় ঘরের ভেতরে একটা আবদ্ধ আবদ্ধ ভাব চলে এসেছিল। দরজা খুলতেই বাইরের আলোয় ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। জং ধরা টিনের ঘর। ছোট্ট একটা ভাঙ্গা জানালা। কোনরকমে লেগে আছে। দেয়ালের সাথে। ছোট্ট একটা চৌকিতে সহানের দুই ভাই ঘুমাচ্ছে। দরজা খুলায় দুজনি একটু নড়ে চড়ে উঠল। খাটের নিচে কিছু ট্যাঙ্ক আর পাতিল। সব কিছুই ইটের উপর রেখে উচু করী। খাটের দুপাশ ঘেঁষেই দেয়াল। ভেতরে কিছু রাখলে আর হাঁটা চলার জায়গা থাকবে না। এত ছোট ঘর সহানের পছন্দ নয় কিন্তু কিছু করার নেই। অভাবের সংসারে এটাই স্বর্গ। সারা ঘর পানিতে ভেসে আচ্ছে। জানালা দিয়েই পানি ঢুকছে। সে পানি এসে বের হয়ে যাচ্ছে দরজার এদিক দিয়ে। দরজা খুলতেই সামনে এক সারি টিনের ঘর। তাদেরটিও আরেক সারির ভেতর। মাঝখান দিয়ে কোন রকম চলার জন্য একটু ফাঁকা জায়গা। পাশের ঘরে সহানের বাবা মা আর ছোট বোন থাকে। সে ঘরটা অবশ্য সামান্য একটু বড়। তার মা পাশের ঘর থেকে হাঁক দিল
ঃ কিরে সহান এখনো যাসনি? : এই যাই। বাইরের বৃষ্টি দেখস? কিছুক্ষণ কেও কিছু বলে না। একটু পড়ে সহান আবার বলে উঠে
ঃ আব্বার ছাতাটা কই?
ঃ ছাতা লাগব আবার? গামছা মাথায় দিয়া যা। ও যে বৃষ্টি গামছায় হব না। ছাতাটা কই কউ না।
ঃ দরজার কোনায় আছে দেখ। তারা তারি আইসে পরিস নইলে তোর আব্বারে আবার ভিজা ভিজা বের হইতে হব।
সহান কিছু বলে না। দুই ঘরের মাঝখানের দরজা দিয়ে গিয়ে সে ছাতাটা নিয়ে আসে। এর পরে আবার সে দরজার সামনে এসে দাড়ায়। বাড়ির সামনে ১৫ তালা বিল্ডিঙটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে হতাশ দৃষ্টিতে। এর পরে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। বাইরে এখনো বৃষ্টি পরছেই, সেই সাথে আবার বজ্রপাত। একটু বৃষ্টি কমার জন্য সে অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ উপরের চালের ছিদ্র থেকে কয়েক ফোঁটা পানি এসে পরে তার ঘাড়ে। সাথে সাথে উপরে তাকায়। এমন সময় বিদ্যুতের ঝলকানিতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। আর সে শুনতে পায় প্রচণ্ড জোরে একটি বাজ পড়ার শব্দ।
প্রচণ্ড শব্দে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে সহান। সামনে জানালা খোলা। পড়ার টেবিলে বসে আছে সে। সামনে একটি বই খোলা। ডান দিকে একটি খাতা আর কলম। আকাশে ঘন মেঘ করেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জানালা নিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। হঠাৎ করে জানালার একটি পাল্লা এসে আবার বাড়ি খেল ধুম করে। ভেতর থেকে তার মা চিৎকার করে উঠল
ঃ কিরে এখনো জানালা আটকাসনি? কতক্ষণ হল বলছি জানালা আটকানোর কথা? বসে বসে ঘুমাচ্ছিস নাকি? সহান কিছুই বুঝতে পারছে না আসলে কি হচ্ছে? সামনের টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকাল। ৬ টা বাজে। সামনে একটি পরিক্ষার রুটিন রাখা। সেখানে গোল করে দাগানো কাল সকাল ৭ টায় তার পদার্থ বিজ্ঞান পরিক্ষা। পড়তে বসে ঘুমিয়ে পরেছিল মনে হচ্ছে। এখনি বৃষ্টি নামবে। জানালা না আটকালে ঘরে পানি ঢুকবে। জানালা আটকাতে যেই উঠেছে অমনি পাল্লাটা আবার বাড়ি খেল। ভেতর থেকে তার মা আবার বলে উঠল
ঃ কি আমাকেই আস্তে হবে নাকি?
ঃ না মা। এই হয়ে গেছে।
জানালা আটকাতে আটকাতেই ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো আর সাথে সাথে বিদ্যুৎ ও চলে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে সাথে সাথে। এই প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর সহনি অনুভব করছে কখনো সে পড়ার টেবিলে বসে আছে কখনো সে ভাইদের সাথে ভাগাভাগি করা খাটের ছোট্ট একটু জায়গায় বসে পা দোলাচ্ছে কখনো বাঁ আরামকেদারায় বসে বৃষ্টি উপভগ করছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Ahad Adnan অনেক শুভকামনা রইল
Ms Ahmad ভালই হয়েছে।
বাসু দেব নাথ ভৌতিক কিছু নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সম্ভবত। মূল বিষয়টি আরো বিশ্লেষন করতে পারতেন।ভালো লাগলো।
বিষয়টা আসলে ভৌতিক না। মনস্তাত্ত্বিক।
রণতূর্য ২ গল্পটি খুব ভালো লাগল।এখানে কি প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বোঝানো হয়েছে? একটু বুঝিয়ে বলবেন। ভোট ও শুভ কামনা।
এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ছোট গল্প। শেষটা কি সেটার উপর পাঠকের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া আছে।
জ্বি বুঝতে পেরেছি।আমার কবিতায় আমন্ত্রণ।মন্তব্য করলে অনুপ্রাণিত হবো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এবারের বিষয় ঝড়। যদিও আমার গল্পটা স্বপ্ন নিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ গল্পে ঝড় বৃষ্টির একটা প্রভাব রয়েছে।

২৭ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪