চার০চালা , চার বারান্দাওয়ালা বিশাল একটা কাঁচা ইটের ঘর ছিলো আমাদের ।চাল ছিলো গোলপাতার ।বাড়ির চারপাশে সুপারী পাতার কঠিণ বেড়া, যাতে রাস্তা থেকে একটা শূয়োপোকাও ঢুকতে না পারে , আমরা সাতটা ভাই বোন ছিলাম, অসম্ভব রকম হাসি খুশি ।আমাদের হাসির শব্দ রাস্তা পেরিয়ে মোল্লা বাড়ীর চৌকাঠ পেরুলে রক্ষা ছিলো না, বাবার কানে পৌঁছানো মানে, সেদিন কচার ডাল, অথবা কঞ্চি পড়া পিঠে পড়তোই ।
অথচ ঐ ঘটনার পূনরাবৃত্তি প্রায় ঘটতো ।বুঝতে শেখার আগেই আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়, বাকী ছয় ভাই বোনের হুল্লোড় আর চেচামেচিতে পাড়া পড়শির উঁচু নাক, আরও উঁচু হতো । আমাদের পড়শী ছিল আমার বড় খালাদের পরিবার এবং গ্রামের মাতবার বলে খ্যাত মোল্লা বাড়ী ।মোল্লা বাড়ীর মাতবর ছিলেন মমতাজ মোল্লা । যাকে আমরা মুনতাজ মোল্লা বলে জানতাম ।
উনি তখন আমাদের মসজিদে ইমামতী করতেন । পরিচয়ে আমাদের নানা হোতেন ।উনি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে । আমাদের সয্য করতে পারতেন না । উনার ব্যাপার টা এমন ছিলো যে উনার আধিপত্য আমাদের দুই পরিবারের প্রতি কোনোরুপ বিস্তার করতে পারতো না । আমরা ছিলাম এক প্রকার স্বাধীন । যারা গ্রাম্য শালিস বা বিচারের ধার ধারতো না ।কারো ধার ধারতো না, কারণ আমরা কারো সাতে পাঁচে থাকতাম না, কারো মোসাহেবী বা কারো নেতৃত্ব মেনে নেওয়া আমাদের ধাচে সইতো না ।
আমার বয়স তখন ৮ কিংবা ৯ হবে । খুব সম্ভব আমি ক্লাস থ্রীতে পড়ি, স্কুলের সেরা ছাত্রী হিসাবে আমার এলাকাতে প্রচুর সুনাম ।আমার সারাদিন চলতো ভব ঘুরের মত ।বড় রাস্তা সংলগ্ন পুটিমারীর বিল ।বিশাল বিল ।শীত কালে বিলের কাছে বড় রাস্তায় পা মেলে বই হাতে বসে থাকতাম আমি । পাড়ার ছেলে মেয়েরা তখন আমাকে ঘিরে বসতো । মমতাজ মোল্লার বাঁকা চোখ আরও বাঁকা করে বলতেন -এতো টুকু বয়সে ছেলেদের জড়ো করেছে । বড় হলে কি হবে ?
আমি ছিলাম বিদ্রোহী , কি ঘরে , কি বাইরে । অন্যায় সয্য করতেও পারতাম না, অন্যায় দেখতেও পারতাম না ।
তাই বলে বস্তাম -নানা, আপনার চোখ ভালো না, মাথায় টুপি মেরে আমাদের মত ছোট ছোট মানুষদের সমপর্কে খারাপ কথা বলেন, ভালো হয়ে যান ।
উনি বেয়াদব বেলাল্লা বলে স্থান ত্যাগ করতেন । আমি তখন শিশুর গন্ধ ছাড়াতে পারিনি । ঘরে ফেরার আগেই বাবার কানে সংবাদ পৌঁছে যেত । আর বাবা তখন , বেত নিয়ে বসে আছেন ।বুঝতেই পারছেন , বাড়ী ফেরার সাথে সাথেই আমার অবস্থাটা ।
আমার বড় খালাদের পরিবার আর আমাদের পরিবারের সাথে ছিলো অসম্ভব রকম মিল ।প্রতিদিন বাটি চালাচালি হোতো যেমন , তেমনি সন্ধ্যার পরে সবাই গোল হোয়ে বসে ভুতের গল্প শুরু হোতো । তখন আমাদের আর এক পড়শী মায়ের মামাতো ভাইয়ের ছেলে হাসেম ভাই। যিনি তখন দস্যু বনহুরেরর একনিষ্ঠ ভক্ত ।তার কাছ থেকে শুনতাম দস্যু বনহুরেরর হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে উদয় হবার কাহিনী । হাসেম ভাই গভীর রাতে মাছ ধরতে যেতেন , মাছ ধরতে গেলে কত রকম ভুতের সামনে পড়তেন তার ইয়ত্ত্বা নেই । গলা কাটা ভুত, ঘোড়ার মাথা লাগানো ভুত ।ডিংগিয়ে খাল পার হয়া পেতনীর কাহিনী ।গাঁ শিউরে উঠতো । তারপরও জড়োসড়ো হয়ে বসতাম , সেই সব মজার মজার ভুতের গল্প শোনার জন্য ।
আমাদের বারান্দায় অধিকাংশ সময় বসতো সবাই । কারন বাবা তখন সাম বেলিং জুটে চাকুরী করতেন । বাড়ী ফিরতেন বেশ রাতে ।বাবার ফেরার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমরা বারান্দায় বসে কল্প লোকের ঘোড়ায় চড়ে কখনও ভুতের বাড়ী, কখনও দস্যবনহুরের আখড়াতে ঘুরে বেড়াতাম ।
বাব এলে সবাই যার যার মত চলে যেত । আমাদের সাত ভাইবোনের ছয়জন ছিলো নম্র এবং বিনয়ী । একমাত্র আমিই ছিলাম অভদ্র, বিদ্রোহী এবং ভালো তার্কিক ।যে তর্ক মানুষের ভিতর রোষের উদ্রেক না করে কী ভাবে তাকে তর্ক বলে আমি জানি না , তার্কিকরা তাদের এত বড় অপমান সইতে পারবেন না জানি, তবু হেরে যাওয়া তার্কিক কে একবার প্রশ্ন করে দেখবেন, জয় লাভের তৃষ্ণা তাকে কত খানি জিঘাংশা করে তোলে ।
মাই শুতে গিয়ে যখন ইতিহাস পড়ার নামে বড় বড় মানুষের জীবন ঘেটতে শুরু করতাম , বাবা ঘরে ঢুকে কিছুটা তার পরিমাপ করতে পারতেন ।
-কি পড়ছিস , নাসি ?
-সমাজ
-তোদের সমাজ, ?
- না, বাবা একটা প্রশ্ন পাচ্ছি না, তাই দাদার কাছ থেকে---
-ও আচ্ছা পড়
আমি তখন অবাক হয়ে পড়ছি কি ভাবে সম্রাট কন্যা জাহানারা এ দেশে ইংরেজদের আগমন ঘটালেন । তার দগ্ধ শরীরের ঘা সারাতে ইংরেজ ডাক্তার
গ্যাব্রিয়েল বাউটন দাবী করে বসলেন বালাশোরে ইংরেজ কুঠি নির্মাণের। পিতৃ স্নেহের কাছে পরাজয় ঘটলো পূরো ভারত বর্ষের ।
জাহানারার জীবন দর্শণ অনেকের মত আমাকেও অবাক করেছিলো ওই পিচ্চি বয়সেই ।বাবার ভালোবাসার প্রতি কত টা দূর্বল না হলে স্বেচ্ছায় লোভনীয় প্রস্তাব পায়ে ঠেলে বাবার সাথে নিষ্ঠূর কারা বরন করেছিলো।
জাহানারা নিজেও একজন ভালো কবি ছিলেন, তাই তো, মনটা ছিলো অত উদার ।তাইতো তার সমাধী রচনা হয়েছিলো নিজামুদ্দন আউলিয়ার কবরের পাশে ।যা তার ইচ্ছায় ঘটেছিলো ।
কত রাত কেটে যেত নিহার রঞ্জনের কিরিটি বাবুকে মুখস্ত করে করে । অতো টূকুন আমি । কিন্তু মনের ভিতর কাজ করতো বিশাল দর্শণ ।আলোচনার জন্য ছিলো না কোন উপযুক্ত সারথী ।মনের এসব কথা তখন কেউ বুঝতো না । লোকে বলতো ইচড়ে পাকা ।
এই পাকামির জন্য উপযুক্ত শাস্তি ও পেয়েছিলাম । সে কথা এ পর্বে আর নাই বললাম ।
আমার বড় খালার দুই পুত্র এবং দুই কণ্যা ।বড় ছেলে ছিলো আমাদের সবার বড় ভাই, মেঝ ছেলে আমাদের সকলের মেঝ ভাই । বড় ছেলে আমাদের এলাকার সকলেই বড় ভাই হিসাবেই মান্য করতাম ,বড় ভাই ছিলো দুষ্টু প্রকৃতির । তার দুষ্টামী ছিলো ছোট বাচ্ছাদের পিওছনে লাগা , ছোট শিশুদের কাঁদিয়ে উনি মজা পেতেন খুব । কেউ হাটছে । উনি দার্শণিকের মত দেখতেন । তারপর তাকে ডাকতেন কাছে -এই দাঁড়া-মাথা নিছু করে দাঁড়াতো ।
উনি- চোখ বড় বড় করে বলতেন-তুই পা বাঁকিয়ে হাটছিস কেন ?
আসামী ততক্ষন কান্না শুরু করেছে । পিছনে প্যান্ট খুলে একটা বাড়ী দিয়ে ছেড়ে দিতেন ।কড়া নির্দেশ থাকতো-শব্দ করে কাঁদলে আবারও হবে ।কারোর উপায় ছিলো না শব্দ করে কাঁদবার ।
আর মেঝ ভাই , তিনি ছিলেন , আমার আদর্শ ।আমি তাকে সব থেকে বেশি ভালো জানতাম , শিশুরা যার কাছে ছিলো নিস্পাপ। ওই বয়সে যে আমাকে লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আমার মেঝ ভাই ।
ছাতা মাথায় মেঝ ভাই মাঠে ছাগল বাঁধতে যেতেন ।আমরা কিছু শিশু থাকতাম তার পিছু পিছু ।যেমন নম্র তার চলন, বলনেও তিনি ছিলেন মিষ্ট ভাষী ।তবে তিনি ছিলেন ধার্মিক। আমরা পুতুল খেলতাম । উনি আমাদের অগোচরে পুতুলের বাড়ী আমাদের ছোট্ট পুকুর যাকে অনেকেই গর্ত হিসাবে টীট করতো সেখানে ফেলে দিতেন , বলতেন, পুতুল খেলা পাপ, তোরা ওটা খেলিস না ।আমরা কেঁদে কেটে একাকার করতাম, উনি স্মিত হেসে আমাদের বুঝাতেন ।
তিনি কখনও কর্কশ হয়েছেন, একথা আমি মনে করেও বলতে পারছি না ।
উনি প্যান্ট পরতেন গোড়ালীর উপর । যা দেখে আমরা হেসে কুটি কুটি হয়ে যেতাম ।আমার ধার্মিক মেঝ ভাই একদিন চাকুরীর তাগিদে পাড়ি জমালেন পাকিস্তানে চোরাই পথে গিয়েছিলেন ।উনি আমাকে এক চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু অংশ
না লিখে পারছিনা ।
নাছি
মানুষের গায়ের পোষাকও যে এতো ভারী হতে পারে আগে জানতাম না, ছোট একটা নদী
পার হয়েই পাকিস্তানের সীমানা, নদীটি রাতের আঁধারেই পার হতে হবে , সাঁতরে নদী পার হয়ে যখন তীরে পৌঁছোলাম , আমি ছেড়া প্যান্ট শার্ট সব খুলে ছুড়ে দিলাম দূরে, এতো ভারী মনে হচ্ছিলো শরীরের পোষাকও যে মনে হচ্ছিল এতো ওজনওয়ালা কিছু আমাকে কখনো বহন করতে হয়নি । হাতের কলমটাও খুব ভারী ছিলো, পরনে তখন শুধু জাঙ্গিয়াটা ।
আমার শৈশব থেকে আদর্শনীয় একজন ব্যক্তিত্ব বেকারত্বের অভিশাপ মুক্ত হতে চলে গেলেন, সুদুর পাকিস্তান ।
শৈশব কারো খুব আনন্দের আর কারো কষ্টের । আমার শৈশব ছিলো শুধুই শেখার, বড় হতে হতে শুনেছি আমি নাকি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলাম , বাবা তখন নারায়নঙ্গঞ্জ , আমাদের বাসা ছিলো শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের তুলোপট্রিতে, অনেক চাকচিক্যময় পরিবেশে আমার জন্ম হয়েছিলো ,কিন্তু পরবর্তী জীবন ছিলো খুবই কষ্টের । মায়ের কোল জুড়ে আমরা ছিলাম সাতটা ভাইবোন ।অনেক খরচ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭/৭৮ সালগুলো বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল ।আমাদেরটাও বাদ যায়নি ।বুঝতে শিখেই শিখেছি ভাগ করে খেতে, বড় আপার জামা মেঝ আপা, আর মেঝ আপার জামা আমি , এভাবেই দিনগুলি কেটেছে, সাত ভাই বোন বারান্দায় লাইন দিয়ে বসতাম পড়তে , গ্রামের মানুষ গুলো আমাদের মেধা দেখে বলতো আমার মায়ের পেট নাকি সোনা দিয়ে বাঁধানো ।সোনা রুপা যায় হোক জীবনের সব কষ্ট গুলো বাল্যকালেই ভাইবোনের মাঝে শেয়ার করে নিতাম । আমাদের হাসি দেখে পাড়ার লোকে বলতো পেটে নেই ভাত ব্রাশ দিয়ে মাজে দাঁত ।
ছোটবেলায় যখন পড়িনা তখন আমার বড় আপার বিয়ে দিয়ে দিলেন, রূপের কদরে অনেক ধনী ঘর এবং বর দুটোই ছিলো চমৎকার ।আমরা ছয় ভাইবোন তখন বাড়ীতে বাড়ীর শোভা বর্ধণ করছি ।
আমার মেঝবোন ছিলো একটু পেট তান্ত্রিক । লুকিয়ে ছাপিয়ে ভাগের থেকে বেশি নিতেন, কারনও ছিলো, বাবা বাজার থেকে খাবার কিনে আনলে মেঝো আপাকেই ভাগ করতে বলতেন । রোজার মাসে ইফতারি সাজানোর দ্বায়িত্বও মেঝোয়াপার ছিলো , সে সব সময় পদে পদে খাবার থেকে কিছুটা উঠিয়ে আলাদা সেরে রাখতো । একদিন ইফতারির কিছু অংশ আলমারীর নীচে সেরে রেখে পরে যখন অন্ধকারে খেতে বসলো, বাবারে মাগোরে বলে কাঁদতে লাগলো । সবাই আলো নিয়ে এসে কারন জানতে চাইলে কেঁদে ফেলে বললো-ইফতারিতে পিঁপড়ে লেগেছে , আমি আলমারীর নীচে সেরে রেখেছিলাম ,ওখান থেকে পিঁপড়ে ধরেছে ,
বাড়ীর সবাই তো হেসেই খুন ।
এরকম কত হাসি কান্নায় আমার বাল্যকাল অতিবাহীত, কত ভাবে যে জীবনের কত কি শিখেছি !!!! আজ সবই স্বপ্নের মত মনে হয় ।