১
ফজলু মামা খুব সাহসী মানুষ। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলো। ভুত প্রেতে বিশ্বাস নাই তার। কথায় কথায় বিজ্ঞানের উদাহরণ টেনে বুঝাতে চেষ্টা করেন -বুঝলি, এই সব হচ্ছে হ্যালুসিনেশন।
প্রতি মাসে আমাকে একবার দেশের উত্তর প্রান্তে খামারবাড়িতে যেতে হয়। মায়ের ধারণা আমি একটু ভীতু ধরণের। ভুত টুত দেখে যদি ভয় পাই তাই প্রতিবার ফজলু মামাকে সাথে দেন। আমার এতে সুবিধাই হয়। মামা আমার বছর তিনেকের বড় হলেও বন্ধুর মতো। একসাথে গান গাই এক সিগারেট ভাগ করে খাই। যাওয়া আসা করতে করতে মামা খামারের সব কিছু বুঝে নিয়েছে। এই যেমন হিসাব নিকাশ দেখা, ফসল বিক্রি, পরবর্তী ফসলের পরিকল্পনা, পুকুরের মাছ বিক্রি, কর্মচারীদের বেতন দেয়া, কর্মচারীদের কাজে মনোযোগ বাড়ানো, উৎসাহ দেয়া। এই সব কাজ এখন মামা আমার চাইতে ভালো বুঝেন।
মাস তিনেক আগের কথা। বাসার কিছু মেরামতের কাজ ছিলো। মা মামাকে ডেকে বললো -বাসার কাজটা করা দরকার। তুই এবার একা ঘুরে আয় ঠাকুরগাঁও থেকে। শুনে মামা মহা খুশী। আমি সাথে থাকলে সারাক্ষণ প্যাঁচাল পাড়ি, তার ভাব ধরতে সমস্যা হয়। কিছুদিন হলো সে কল্পবিজ্ঞানের লেখাটা শুরু করেছে। দশ পনর দিন সেখানে একা থাকলে লেখাটা দাড়িয়ে যাবে। আমি গাড়ির টিকিট করে দিলাম পর দিন মামা চলে গেলো ঠাকুরগাঁও।
২
দিনের বেলা কাজ শেষে কর্মচারীরা সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যায় শুধু অবিবাহিত শরিফুল নীচ তলায় ভিতরের একটা ঘরে ঘুমায়। আব্দুর রহিম স্ত্রী আর শিশু কন্যাকে নিয়ে থাকে খামারের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। আধা পাকা দুটি ঘর তার জন্য বরাদ্দ। খামারের সামনে দিয়ে যে মাটির রাস্তা গেছে সেই রাস্তার পাশে একটা মসজিদ করে দিয়েছি আমরা। পাঁচ বেলা আযান হয় কিন্তু জামাতে মুসুল্লি পাওয়া যায় না। হাফেজ আব্দুর রহিম মসজিদে ইমামতি করে আর খামারের গাছ পালার দেখভাল করে। ফজরের আজান দিয়ে নামাজ পড়ায় আর ভোর হলে গ্রামের শিশুদেরকে আরবি পড়ায়। আব্দুর রহিম প্রায়ই ফজরের আজান দিতে নিজের ঘর থেকে মসজিদে আসতে ভয় পায়। তার মনে হয় কে যেন তার পিছন পিছন হেটে মসজিদ পর্যন্ত যায়। খামারের ভিতরে পায়ে হাটার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই ভুট্টা খেতের ভিতর থেকে কে যেন বলে- হুজুর কই যান?
করিম পিছনে ফিরে তাকায় না। পিছনে ফিরে তাকালে সমস্যা আছে। এই সব ডাকাডাকি তোয়াক্কা না করে দোয়া কালাম পড়তে পড়তে আপন মনে মসজিদের দিকে হেটে যায় করিম। ভুতের এই সব যন্ত্রণা কতো দিন আর সহ্য হয়। সাহসের ও তো একটা সীমা আছে... সেদিন আব্দুর রহিম একা ফজরের আজান দিতে আসছিল মসজিদের দিকে। মসজিদের সামনে এসেই মনের অজান্তে চোখ চলে যায় পুকুর পাড়ের নিম গাছ গুলোর মাথায়। সে যা দেখতে পায় তাতে হাত পা অবশ হয়ে আসে। মুখ দিয়ে জোর করেও দোয়া কালাম আনতে পারছে না। সে দেখে আট দশ ফুট দূরত্বে থাকা দুটি নিম গাছের মাথা দড়ির মতো প্যাঁচিয়ে আছে। আব্দুর রহিম চোখ কচলে আবার চোখ খুলে- না, দেখার ভুল না, সে ঠিক দেখতে পাচ্ছে। অনেক কষ্টে দুয়া দুরুদ পাঠ করতে সক্ষম হয় আব্দুর রহিম। এর মধ্যেই চোখের সামনে গাছ দুটির মাথার প্যাঁচ খুলে দুই গাছের মাথা দুই দিকে হেলে দুলে নড়তে থাকে অনেকক্ষণ।
এর পর থেকে আব্দুর রহিম খামারের সাহসী কর্মচারী ফুলেশ্বর রায়কে অনুরোধ করে তাকে প্রতিদিন মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। খামারের পাশেই ফুলেশ্বরের বাড়ি। হুজুর ফজরের আযানের আগে ফুলেশ্বরের মোবাইল ফোনে মিস কল দিয়ে অজু শেষ হতে না হতেই ফুলেশ্বর টর্চ হাতে আব্দুর রহিমের দরজায় দাড়িয়ে থাকে। আব্দুর রহিম মসজিদের বারান্দা পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছালে ফুলেশ্বর বাড়ি ফিরে আবার ঘুমিয়ে পরে।
শরিফুলকে নিয়েও কিছু ঝামেলা আছে। শরিফুলের সাহস অবশ্য আব্দুর রহিমের চাইতে অনেক বেশী। নইলে সে একা খামারের মাঝখানে এই শূন্য বাড়িটায় থাকতে পারতো না। আমি কিংবা মামা ঢাকা থেকে গেলে তখনি দোতলা খোলা হয়। মাঝে মাঝে শরিফুলের মনে হয় দোতলায় কয়েকজন ছেলে মেয়ে হৈচৈ করে সারা রাত। হাসছে গল্প করছে। গভীর রাতে দোতলায় কেউ মসলা বাটছে, শীল পাটার ঘর্ষণের শব্দে শরিফুলের ঘুম ভেঙে যায় মাঝ রাতে। এই সব শব্দের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে শরিফুল মোবাইল ফোনে আট গিগা গান লোড দিয়ে এনেছে। রাতে কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। সপ্তা খানেক আগের ঘটে এক আজব ঘটনা। রাতে হিন্দি গান শুনছে হেড ফোনে। একটা গান শুরু হয়ে কিছুক্ষণ চলার পর কুকুরের ডাক বাজতে থাকে। ঘেউ ঘেউ ডাক না কুকুর কু... কু... করে ডাকছে তো ডাকছেই। শরিফুল গান পাল্টে অন্য যে গান দেয় সেই একই শব্দ কু... কু... । এই সব নিয়ে শরিফুলের তেমন গুরুতর অভিযোগ নেই। মাঝে মাঝে শুধু শরিফুলের সাথে ফুলেশ্বরকেও টানা দু চার দিন নীচ তলায় থাকতে হয়।
শরিফুল প্রায় নিয়মিতই ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদে। মাইকে হুজুরের আজান শুনে ঘুম ভাঙ্গে শরিফুলের। মাঝে মাঝে শুধু আযান শুনতে পায় না শরিফুল। সেদিন আর ফজরের নামাজ পড়া হয় না। আব্দুর রহিম সেদিন একটু বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরে। কারণ একমাত্র মুসুল্লি বলতে শরিফুল। ফজরের জামাতে আর নামাজী আসে না কেউ। আশপাশে বসতি খুবই কম তার মধ্যে বেশীর ভাগ হিন্দু পরিবার। হুজুর আজান দিয়ে প্রায়ই বাধ্য হয়ে একা নামাজ পড়ে। যেদিন আব্দুর রহিম একা নামাজ পড়ে তার মনে হয় পিছনে অনেকেই দাড়িয়ে নামাজ পড়ছে। আব্দুর রহিমের ধারণা তার পিছনে যারা দাড়িয়ে নামাজ পড়ছে তারা সবাই জীন।
৩
ফজলু মামা বিকেলে পৌঁছে। দোতলার চাবিটা শরিফুলের হাতে দিয়ে মামা খামারে একটা চক্কর দেয়। গাড়িতে টানা দশ ঘণ্টার ভ্রমণে সিগারেট টানা যায়নি। খামারে হেটে হেটে তিন তিনটা সিগারেট টেনে প্রাণ জুড়ায় ফজলু মামা। দুই মাসের জমে থাকা ধুলা ময়লা ঘরের আসবাবপত্র বিছানা সব কিছু পরিস্কার করে লাগেজ জায়গা মতো রেখে শরিফুল মামার হাতে চাবি ফিরিয়ে দেয়।
দোতলায় উঠতে উঠতে সিঁড়িতে মামা ফোন দেয় আমাকে
-কিরে কেমন আছিস?
-ভালো আছি মামা, তুমি ঠিক মতো পৌঁছাইছ?
-পৌঁছাইছি, শোন এইবার আমি মাস খানেক থাকবো। তুই কাজ শেষ করে চলে আসিস। এক সাথে ফিরে যাবো।
-একা এতো দিন থাকতে পারবা মামা?
-পারবো না মানে। লেখাটা শেষ করতে তো একাই থাকতে হবে। তুই থাকলে সারা রাত কাটে প্যাঁচাল পাইড়া।
-ঠিক আছে মামা। সিগারেট ঠিক মতো নিয়া গেছো নাকি পাঠাইতে হইবো?
-দুই কার্টুন সিগারেট আনছি। লাগলে জানাবো।
-ঠিক আছে মামা, ভালো থাকো।
প্রথম দিনেই মামার লেখা এতো দূর এগিয়ে যাবে তা কল্পনা করেনি। লেখার শুরু ঠিক না হলে শুধু ভুল পথে হাঁটতে থাকে। লেখার জন্য চাই মনের মতো পরিবেশ। দেশী কৈ মাছ ভাঁজা আর কি কি যেন টেবিলে রেখে গেছে শরিফুল। মামা টেবিলে বসে ল্যাপটপে লিখছে। নাকে ভাঁজা মাছের কড়া গন্ধ এসে লাগছে তবুও লেখা বন্ধ করে টেবিল ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। শরিফুল বললো -মামা খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে স্বাদ পাবেন না।
রাতে খাবার খেয়ে আরো ঘণ্টা দুয়েক লিখবে বলে মামা ভাবছে। কিন্তু খাওয়ার পর ভ্রমণের ক্লান্তি বিছানার দিকে টানছে।
৪
সন্ধ্যায় বাড়ীর সামনে শেডের নীচে চলে চা পর্ব। রহিম, শরিফুল নানা আজগুবি গল্প বলে। কোন দিন কে কি দেখেছে, কার কানে কি শব্দ আসলো। ফুলেশ্বর কিছু বলেনা শুধু হ্যা সূচক সম্মতিতে সমর্থন জানায়। আমি আর মামা এমন ভুতের গল্প শুনতে শুনতে ভীষণ ক্লান্ত এবং বিরক্ত। মামা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করে এই সব মনের ভুল। একই গল্প বার বার শুনে আমার এতটাই বিরক্ত যে মাঝে মাঝে ধমক দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই সব নিয়ে কিছু বললে সমস্যা আছে। কারণ কর্মচারী চলে গেলে উত্তরের জেলা সদর থেকে পনর বিশ কিলোমিটার ভিতরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নতুন কর্মচারী পাওয়া খুব মুশকিল হবে। তাছাড়া এদের কেউ ভয়ে চাকরী ছেড়ে চলে গেলে শতগুণ বাড়িয়ে বানিয়ে গল্প বলবে বাইরে গিয়ে। এতে এই অঞ্চলে বাড়িটি ভুতের বাড়ি হিসাবে পরিচিত হয়ে যেতে পারে। তখন আরো বেশী মুশকিল হবে, ডাবল বেতনেও কর্মচারী পাওয়া যাবে না।
গত রাতের ঘটনাটা মামা কাউকে কিছু বলেনি। সারা দিন শুধু মনে মনে এর ব্যাখ্যা খুঁজার চেষ্টা করেছে। ঘড়িতে তখন রাত তিনটা এক মিনিট। পাশের ঘরে গ্লাস ভাঙ্গার শব্দটা কানে আসতেই বালিশ থেকে মাথা তুলে বিছানায় উঠে বসে। মামা বুঝতে চেষ্টা করে শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। হ্যা... পাশের ঘর থেকেই! টেবিল থেকে ঘরের মেঝেতে পরে কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ।
গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ শুনে টর্চ হাতে মামা শোবার ঘরের পাশের এল টাইপের ড্রইং কাম ডাইনিং রুমে প্রতিটা কোনায় খুঁজে শব্দের উৎস। কোথাও ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরো নেই। ডাইনিং টেবিলে পানি খাওয়ার দুটি কাঁচের গ্লাস আর অর্ধেক পানি ভর্তি একটি দুই লিটারের বোতল। প্রথম মনে হয়েছিলো ইঁদুর টেবিল থেকে গ্লাস ফেলে দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছে। কিন্তু তেমন কিছুর চিহ্ন নেই। জানালায় বাইরের দিকে টর্চ মেরে লাভ নেই। তা জেনেও দক্ষিন দিকের জানালার কাছে গিয়ে টর্চ মারে, আলোটা আটকে যায় পুকুর পাড়ের নিম গাছগুলোর মাথায়। পানিতে আলোটা প্রতিফলিত হয়। এই দিকে এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কোন বসতি নেই। পশ্চিমে আম বাগানের ফাঁক দিয়ে দূরের একটি বাড়ির ছনের চালে আটকে যায় টর্চের আলো। উত্তরে লিচু বাগান আর ভুট্টা খেতের উপর দিয়ে আলো পরে আব্দুর রহিমের থাকার ঘরের দেয়ালে। এই ড্রইং রুমের পূর্বে শোবার ঘর এই ঘর থেকেই শব্দটা শুনতে পায় মামা। মামা নিশ্চিত যে শব্দটা এই রুমের ডাইনিং টেবিলের দুই তিন ফুট কাছেই হয়েছে।
মামা গত সন্ধ্যায় বাসার সামনে পুকুর পাড়ে ওদের সাথে বসে ভুত প্রেত নিয়ে কথা বলেছে তাই হয়তো এমন মনে হতে পারে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় দানা বাধতে শুরু করে ঠিক একই ঘটনা যখন পরের রাতে ঘটে। তাও আবার ঘড়ি ধরে ঠিক রাত তিনটা এক মিনিটে!
৫
এই এলাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে সাত আট ঘণ্টার জন্য যায়। সন্ধ্যায় গেলে রাত দুইটা তিনটার দিকে দয়া করে আসলে আসতেও পারে। আবার মাঝে মাঝে টানা বাহাত্তুর ঘণ্টায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকে। তখন সবাই বুঝে মন্ত্রী এলাকায় আছেন। এই গ্রামে কয়েক বর্গ কলোমিটারে শুধু এই খামারেই বিদ্যুৎ, তাও আবার দুই কিলোমিটার দূর থেকে টেনে আনা হয়েছে।
আজ মন্ত্রী এলাকায় নেই। মাগরিবের পর পরই বিদ্যুৎ চলে গেছে। শুধু সোলারে তিন চারটি বাতি জ্বলছে বাড়ীর ভিতর বাহির মিলিয়ে। মামা শেডের নীচে বসে শরিফুলকে ডাকে- শরিফুল এদিকে আয়।
শরিফুল মোবাইলে মমতাজের গান শুনছিলো। গান বন্ধ করে দ্রুত ছুটে আসে।
-জি মামা।
-চা দে।
-দিচ্ছি মামা।
-রহিম কোথায় গেছে?
-বাজারে গেছে , খচ্চাপাতি আছে।(সংসারের বাজার করাকে এরা খরচ করা বলে) এক্ষুনি চলে আসবে।
চা খেতে খেতে মামার মনে কর্মচারীদের প্রতি সন্তুষ্টি জেগে উঠছে। খামারের খুব যত্ন নেয় এরা । নিজের মনে করে খাটা খাটুনি করে। কিন্তু এই সন্তুষ্টি ওদের সামনে মুখে কিংবা আচরণে প্রকাশ করার নিয়ম নেই। এতে কর্মচারীদের বেতন বছরে পাঁচ ছয় বার বাড়াতে হয়। বরং প্রতি দিন কাজে এক দুটি ভুল ধরে ধমক দাবাড় দিয়ে চাকুরী নিয়ে আতঙ্কে রাখতে হয়।
চা খেতে খেতে রহিম আর ফুলেশ্বর চলে আসে। সালাম দিয়ে মামার সামনে এসে দাড়ায়। মামা ওদেরকে কাঠের বেঞ্চে বসতে বলে। ওরা বসে গ্রামের হাল হকিকত জানায়। কার বাড়িতে কবে কি চুরি হল, কে কার বউ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো এই সব। সাধারণত আমি আর মামা দুজনেই এই সব খবর উপভোগ করি, শুনে মজা পাই। আজ মামা সে সব শুনে মজা পাচ্ছে না। আজ মামার শুনতে ইচ্ছে করছে ভুতের গল্প। রাতের আঁধারে খামারের ভিতরে কে কোন দিন কি দেখেছে, কি শব্দ শুনেছে এই সব। কিন্তু আজ নিজ থেকে কেউ কিছু বলছে না। মামা নিজ থেকে প্রসঙ্গ তুলতেও চাইছে না। ওদের সামনে বিষয়টা পাত্তা দিলে সমস্যা আছে।
রাতে শরিফুল মাগুর মাছের ঝোল তরকারি, ডাল ভর্তা, ভাত দিয়ে আসে দোতলার ডাইনিং টেবিলে। খাওয়া শেষে প্লেট বাটি নীচে নিয়ে আসে। মামার রাতের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত না ঘুমিয়ে বসে থাকে শরিফুল। এই জন্য অনেক সময় বাধ্য হয়ে একটু আগে ডিনার করতে হয়। আজও রাত নয়টার মধ্যে খেয়ে ফেললো।
রহিম বাজার থেকে প্রতি দিন কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা খিলি পান নিয়ে আসে। পানটা মুখে দিয়ে মামার কাছে মনে হল রাতটা আজ পার করা একটু কঠিন হবে। দোতলায় দুই রুম মিলিয়ে সোলারে চলা একটা মাত্র ১২ ওয়াট এনার্জি সেভিং লাইট। দিনের বেলা বাড়ীর চার পাশে দেখে দেখে বেশ কয়েকটি বাতি পরিবর্তন করেছে। বৃষ্টিতে তিন চারটি লাইট নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু লাভ কি হল! সারা রাত বিদ্যুৎ আসার কোন লক্ষণ নাই। ঝড়ে গাছ ভেঙ্গে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। বিদ্যুৎ থাকলে ল্যাপটপে গান শুনে, ফেইস বুকে আড্ডা দিয়ে, ব্লগে সময় কাটিয়ে রাত পার করে দেয়া যেতো। কিন্তু ল্যাপটপে বিশ পঁচিশ মিনিটের বেশী সময় ব্যাকআপ নেই ব্যাটারিতে। বই পড়ে যে রাত কাটাবে সে উপায়ও নেই। কারণ ১২ ওয়াটের লাইট বই পড়ার মতো যথেষ্ট আলো দেয় না।
কল্প বিজ্ঞানের গল্পটা সেখানেই থেমে গেছে। মামার মাথার মধ্যে এখন ভুতের গল্প কিলবিল করছে। কিছুই কাজ নেই বলে মামার মাথায় আজব আজব চিন্তা আসতে থাকলো। এর একটি এমন -তার মনে হলো দোতলায় কয়টি কাঁচের গ্লাস আর জগ আছে তা একটু গুনে দেখা দরকার।
গত মাসে ঢাকা থেকে মামার কজন বন্ধু বেড়াতে আসার কথা ছিল বলে এক ডজন নতুন গ্লাস আর একটি নতুন কাঁচের জগ কিনে আনা হয়েছিলো। পরে তারা আর আসেনি বলে নতুন জগ গ্লাস আর প্যাকেট থেকে বের করা হয় নি। এর মধ্যে মাত্র দুটি গ্লাস ডাইনিং টেবিলে আর বাকী দশটি গ্লাস আর নতুন কেনা জগটি দোতলার অব্যবহৃত কিচেনের সেলফে বক্সের মধ্যে রাখা আছে। মামা ডাইনিং টেবিল থেকে দুটি গ্লাস নিয়ে বক্সে রেখে ডজন পুরা করে রাখে। এতেও যদি রাতে গ্লাস ভাঙ্গা বন্ধ হয়।
হাতের কাছে দুই লিটারের পানির বোতলটি রাখে শুধু পানি খাওয়ার জন্য। এই সব করে রাত বারোটা বেজে গেলো- মনে অস্থিরতা, শরীর শুধু শুধু ক্লান্ত, প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা কিন্তু সে জানে ইচ্ছে করলেও এখন ঘুমাতে পারবে না। অথচ এই মুহূর্তে ঘুম খুব দরকার। ব্যাগ থেকে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট এক সাথে খেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে।
দশ মিনিট পর আবার বিছানা থেকে উঠে আসে মামা। মনে হলো দরজা জানালা সব ঠিক মতো লক করা হয়েছে কি না তা দেখা দরকার। টর্চ লাইট হাতে নিয়ে আবার উঠে সব গুলো দরজা জানালা পরিক্ষা করে দেখে ঠিক মতোই লাগানো আছে। এই নিয়ে একাধিক বার পরিক্ষা করা হলো দরজা জানালা গুলো। অপ্রয়োজনে টর্চ লাইট ব্যবহার করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। দিনের বেলা চার্জ দেয়া যায়নি। মাঝ রাতে চার্জ শেষ হয়ে যেতে পারে আর তখন প্রয়োজন হলে বিপদে পরতে হবে।
মামা ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এটা সে বুঝতে পারছে আসলে সে ঘুমাচ্ছে না। কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে। কি সেটা? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেটাই যেন ভাবছে মামা। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হলো। সে শুনতে পাচ্ছে কিছু একটা। শব্দটা শুনার সাথে সাথে ঘুম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেলো। শব্দটা গত দুই রাতের কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ না। কেউ যেন দুই হাতে পাট শোলার আঁটি ভাংছে। চার পাঁচটি পাট শোলায় আঁটি বানিয়ে দুই হাতে দুই পাশে ধরে মাঝ খানে ভাংলে যে শব্দ হয় তেমন। শব্দ আসছে পাশের রুম থেকেই। মনের ভুল ভেবে নিজের হাতের পিঠে চিমটি কাটে মামা। না, শব্দ থামছেনা! বালিশের পাশ থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাটনে চাপ দিয়ে সময় দেখে। তিনটা বাজে। সে মনে করার চেষ্টা করছে ফার্মের ভিতরে কোথাও সে পাট শোলা দেখেছে কি না। না! এমন কি এই গ্রামে পাট শোলার চাষ হতে দেখেনি সে। আলু চাষ হয় ভুট্টা হয়, পাট হয় না। পাট শোলা ভাংছেই তখনো। টানা এক মিনিট ধরে পাট শোলা ভাঙ্গার পর হঠাৎ কাঁচের গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ। ঘড়িতে তখন তিনটা এক মিনিট।
সাথে সাথে টর্চ লাইট হাতে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে যায় মামা। এবার পাওয়া গেলো! কমন বাথ রুমের দরজার সামনে একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে পরে আছে। কিচেনে বক্সে রাখা গ্লাস গুলোর একটি। কিন্তু মামা যখন কিচেনে গিয়ে বক্সটি চেক করে তার শরীর সত্যি সত্যিই শীতল হয়ে আসে। সেখানে বারটি কাঁচের গ্লাস এবং একটি জগ অক্ষত আছে। আরও নিশ্চিত হতে সেখান থেকে একটি গ্লাস এনে ভাঙ্গা টুকরো গুলো এক করে মিলিয়ে দেখে কোন পার্থক্য নেই। টর্চ জ্বেলে দেখে একই কোম্পানির তৈরি, মেইড ইন চায়না। তাহলে এই তের নাম্বার গ্লাস কোথা থেকে আসলো!
হঠাৎ খামারের সব গুলো বাতি জ্বলে উঠে। বিদ্যুৎ চলে এসেছে। ল্যাপটপ অন করে ফেইস বুকে লগইন করে দেখে সুইডেনে বন্ধু জুয়েল অনলাইনে আছে। চ্যাট করে অনেকটা সময় কাটে। এরই মধ্যে আব্দুর রহিম মাইকে ফজরের আজান দেয়।
৬
দুপুর বারোটায় শরিফুলের মোবাইল ফোন থেকে কল আসে। গভীর ঘুম থেকে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে জেগে ফোনটা হাতে নেয় মামা, এরা দরজায় টোকা না দিয়ে কলিং বেল না চেপে দরজার কাছে দাড়িয়ে ফোনে কল করে! সাথে সাথেই মনে পরে ভোরে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে শরিফুলকে রুহিয়া বাজারে হানিফ এন্টারপ্রাইজ কাউন্টার থেকে আজ রাতে ঢাকা ফেরার টিকিট আনতে বলেছিল মামা।
- হ্যালো, বল শরিফুল।
- স্লামালিকুম মামা।
- ওয়ালাইকুমস্লাম।
- মামা রাত নয়টার গাড়ীর টিকিট নাই। দশটার গাড়ীতে একেবারে পিছনে একটা মাত্র সিট খালি আছে। নিবো?
- নিয়ে আয়।
মাস খানেক সময় থাকার ইচ্ছে থাকলেও কল্পবিজ্ঞানের লেখা অসমাপ্ত রেখেই তিন দিন পর মামা ঢাকায় ফিরে আসে। তার ধারণা সে ঢাকায় বসে চমৎকার একটি ভুতের গল্প লিখতে পারবে। পর দিন সন্ধায় মামা ভুতের গল্প লিখতে টেবিলে বসে। কিন্তু এই গল্পটিও শেষ করতে পারার সম্ভাবনা নেই। কারণ পরিবারের সবাই মামার বিয়ে নিয়ে বেশ তোরজোড় চালাচ্ছে। মামার মাথায় নতুন করে এখন প্রেমের গল্প লেখার ভুত চেপেছে।
২৫ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪