১ গোপন সিদ্ধান্তটা আল্লাহ পাকের কাছে বড়ই অপছন্দের। করিম এটা জানে। ফজরের নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে জায়নামাজটা ভাঁজ করে আলনায় রাখে। করিম হাত তুলে মোনাজাত করে না। বিষয়টা তার কাছে অন্তর্যামী স্রষ্টার সাথে হালকা ধরণের আচরণ বলে মনে হয়। আজ বিশেষ কারণে হাত তুলতে ইচ্ছে করছিলো। ভিতর থেকে লজ্জা আর জড়তা বাধা দেয়। বাড়ির সামনে একটা বেল গাছ। গাছটিকে ঘিরে ফুলের বাগান ছিলো। বড় মেয়েটা দেখভাল করতো। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে অযত্নে পড়ে আছে বাগানটি। আগাছা জন্মেছে। ভোর বেলা কোদাল হাতে নিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে করিম। নিজ হাতে আগাছা পরিষ্কার করে মনে আনন্দ পাচ্ছে। জায়গাটা একেবারে ছোট না, একসাথে চার কাতারে শপাঁচেক লোক দাড়াতে পারবে। নভেম্বর মাস। শীত বাড়ছে। ভোরে কুয়াশা পড়ে। করিম গায়ে চাঁদর জড়িয়ে গফুরের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। দশ মিনিটের পথ। গফুর প্রতিদিন এক সের করে দুধ দিয়ে যায়। গফুরের ছোট ভাই আমিনুল সম্রাট সাহেবের পি এস ছিলো। গত বছর খুন হয়েছে। কে বা কারা খুন করেছে জানা যায়নি। হাসপাতালের বারান্দায় লাশ কারা যেন ফেলে রেখে আসে। গফুর তার বাড়ির সামনে গাভী তিনটাকে গোসল করাচ্ছিলো। করিমকে দেখে এগিয়ে আসে। -আসসালামু আলাইকুম ভাইজান। -ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ গফুর মিয়া? -আছি আলহামদুলিল্লাহ্। -তোমার কয় সের দুধের টাকা পাওনা? -পনেরো সের। -এই লও তোমার সাতশ পঞ্চাশ টাকা। করিম পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে দেয়। গফুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার কিছু ভুল হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। -ভাইজান কি আমার উপ্রে অসন্তুষ্ট? দুধ খারাপ হইছে? কাইল নতুন গাভীর দুধ দিছিলাম। মনে হয় একটু পাতলা হইছে। -আরে মিয়া তেমন কিছু না। কাইল থেইক্যা আধা সের কইরা দুধ দিবা। -আইজ তো ভাইজান সতেরো তারিখ। মাসের আরো তেরো দিন বাকী। পাওনা মিটায়া দিতাছেন ক্যা? -কাইল থেইক্যা নতুন হিসাব। ভালো থাকো গফুর মিয়া। গফুরের পিঠে হাত বুলিয়ে ডান হাতে ঝুলে থাকা গায়ের চাদরটা বাম কাঁদে তুলে বাড়ির দিকে আসতে থাকে করিম। চাউলের রুটি আর কালকের রান্না করা গরুর মাংস স্বামীর জন্য নিয়ে আসে আমিনা। দুই তিন বার জ্বাল দেওয়ার কারণে মাংস বেশ নরম হয়ে গেছে। করিম ভুলে গেছে রুটি কয়টা খেয়েছে। চারটা নাকি পাঁচটা। গত মাসে নিজের ব্যাংক হিসাবে বউকে স্বাক্ষরদাতা করেছে। আমিনা একেক বার একেক রকম সই করে। এই ভাবে সই দিলে ব্যাংক টাকা দিবে না। এক মাস ধরে শিখিয়ে কিছুটা মিলাতে পারছে। আজ আবার চর্চা করাবে। চায়ের মগে চুমুক দিয়ে আমিনাকে কাছে ডাকে। -আমিনা, কলম আর কাগজ নিয়া আয়। -আমি এই সব পারুম না। আপনের টেকা আপনে তুলেন। এই সব পুরুষ মাইনষের কাম। আমিনা কাগজ কলম নিয়ে আসে। -সংসার চালাস তুই, টেকা পইসা তর হাতেই থাকা উচিত। ল, এই কাগজটার মধ্যে একশ এক বার লেখ আমিনা, আমিনা, আমিনা... আমিনার সই ঠিক হয়ে গেছে। এখন একটা সই মনে হয় আরেকটার ফটোকপি। ষ্টীল আলমারির দুইটা পাল্লা খুলে আমিনাকে কাছে ডাকে করিম। -এই ড্রয়ারে হাজার বিশেক নগদ টেকা আছে। এই ফাইলে জমির দলিল, পর্চা, খাজনার রশিদ সব আছে।
২ গন্ধর্বপুর গ্রামে দুই জন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা। একজন করিম। অন্যজন এস এম সম্রাট। একই স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়তো দুই জন। ১৯৭২ সালে মেট্রিক পরীক্ষা পাশের একটা বিশেষ সুযোগ মিলে। সম্রাট সুযোগ গ্রহন করে। করিম করে না। এস এম সম্রাট এখন অনেক বড় নেতা। করিম তার ড্রাইভার। ড্রাইভার অনেক বিশ্বস্ত মানুষ হতে হয়। সাহেব কোন রাতে কার সাথে শুবে তা জানবে, কিন্তু চুপ থাকবে। হাতে লাগা খুনের রক্ত মুছে দিবে। ঘুষের টাকার বস্তার বোঝা বইবে কিন্তু চুরি করবে না। এই সব গুন আছে করিমের। আজ ঢাকায় ফিরে সন্ধ্যার পর করিমের দুইটি শিডিউল আছে। উত্তর ঢাকার ফুটপাত ইজারার মাসিক আদায়। আর রোড কন্সট্রাকশন কনট্রাক্টর কোম্পানীর কমিশন আদায়। আরেকটা বাড়তি গুনের কথা সম্রাট তার বন্ধুদের প্রায়ই বলেন। তার ড্রাইভার গত বিশ বছরে একটা মুরগিও মারে নাই। সাহেব লেনদেনের কাজে করিমকে পাঠানোর আগে বলেন -বুঝলে করিম, দেশের সেবা করলে সামান্য কিছু না কিছু নিতে হয়। একতরফা ভালোবাসায় কি দেশ চলে? করিম কোন কথা বলে না। -করিম, লেনদেন মানে বুঝো? -না। করিম এক কথায় উত্তর দেয়। -এর মানে হলো কিছু নেন বিনিময়ে কিছু দেন। করিম চুপ থাকে।
৩ খেলা আবার জমানোর চেষ্টা চলছে। দুই হাজার নয় সালের খেলা। কিন্তু কেউ টাকা বের করতে চায় না। লুটের টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেলে কি আর ফেরত আসে! সম্রাটের একশ সাতাত্তুর কোটি লাভের টাকা চলে গেছে কুয়ালালামপুর। কার টাকা নেই এর মধ্যে। ইউ এন মিশনের টাকা। বিশ বছর ইতালিতে জাহাজ শ্রমিকের কাজ করে আনা প্রবাসীর টাকা। বৌয়ের গয়না বেচা টাকা। বাপের জমি বেচা টাকা। নয় হাজারের সূচক এখন চার হাজারে গড়িমসি করছে। আসলে গড়িমসি তো করছে খেলোয়াড়েরা। তবে পাকা খেলোয়ার জানে খেলা শুরু করার এটাই সময়। তিনশ পঞ্চাশ টাকার শেয়ার এখন ছাব্বিশ টাকা। গোপনে ঠিক জায়গাতে ক্লিক করে ঘাপটি মেরে আছে। সাহেবকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছে করিম। ফোর লেন সড়কের কাজ চলছে। আঁকা বাঁকা রাস্তা সোজা করা হচ্ছে। সব গুলো ব্লাইন্ড টার্ন মুছে ফেলা হচ্ছে। চোখ যত দূর যায় রাস্তা সোজা। ল্যান্ড ক্রুজার চলছে একশ বিশ মাইল গতিতে। এস এম সম্রাট ফোন রিসিভ করেন -হ্যালো, হ্যা লাগাও। বায়ে লাগাও দশ ডানে লাগাও দুই। ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে ধমক দেন -বাজারের চিন্তা তোমার করতে হবে না। আমি যা বলছি করো। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে। গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। গাড়ি ছয় সাত ফুট ডানে চলে যায়। বিপরিত দিক থেকে আসা ট্রাকের সামনে। টেলিভিশনের পর্দায় সদ্য প্রাপ্ত খবরে জানা যায় -মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এস এম সম্রাটের মৃত্যু... এস এম সম্রাটের জানাজা হয় সংসদ ভবনের সামনে আর করিমের জানাজা হয় তার বাড়ির সামনে বেল গাছের নীচে। ভালোবাসা আর প্রেম দুটোই পরিমাপ করা যায়। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তাজমহলের সমান। চে গুয়েভারার আদর্শ প্রেম নিজের জীবনের সমান। এস এম সম্রাট আর ড্রাইভার করিমের দেশপ্রেম যথেষ্ট রহস্যজনক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ইখতিয়াক ইবনে আহসান ইফাত
শেষটা অনেকেই বুঝবে না, আরেকটু ইংগিত পূর্ণ করা উচিত ছিলো। তারপরেও অসাধারন এ ভোট করলাম
সূর্য
"চে এর আদর্শ প্রেম নিজ জীবনের সমান" না আমরা সবকিছু পরিমাপ করতে পারি না। এও মাপতে পারি না দেশ স্বাধীন করার অদম্য বাসনায় যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিলিয়ে দেয়া মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম বেশি না করিমের দেশপ্রেম বেশি। "সময় অনেক ব্যাখ্যা বদলে দেয়"। গল্প ভালো হয়েছে, বেশ ভালো।
আগেই ধন্যবাদ জানিয়ে নিচ্ছি বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যের জন্য। আমরা সব কিছু সঠিক ভাবে পরিমাপ করতে পারিনা কারণ আমাদের মানদণ্ড আপেক্ষিক। আমরা আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকে সব কিছু বিচার করি। এই গল্পের নায়ক করিম নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভালো থাকুন।
Rumana Sobhan Porag
খুব বিপরীর মুখি দুটি জীবনের কথা জানলাম। কবির ভাই নীতি আদর্শ যে প্রয়োজনে বিক্রি হয়ে যায় তা খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছছেন। শুভেচ্ছা রইল।
আরাফাত ইসলাম
গত সংখ্যায় আপনার লেখা পড়ে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম ! সিদ্ধান্ত-টা কি বলবো ? থাক্ বলেই দেই – ”পরবর্তী সংখ্যাগুলো মিস করা যাবে না” !! মনে হয় না খুব একটা ভুল হয়েছে !!!
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।