মনুশেখ এবং সে

আমি (নভেম্বর ২০১৩)

মোজাম্মেল কবির
  • ১০
  • ২৬

-চাইলেই হলো! দশ হাজার টাকা! প্যাদানী লাগাও, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। সরকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ নিয়োগ দিছে কি বা... ফালাইতে? এই মাগী গুলারে পাছার মধ্যে পিটনা দিতে বলো। মন্ত্রীকে টেলিফোনে ঝাড়ি দিচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠনের নেতা। ও পাশ থেকে মন্ত্রী বলছে -জী বস। দেখছি বস।
পুলিশ অ্যাকশনে নামে। পুলিশের লাঠি নারী পুরুষ বাছ বিচার করছে না। পুরুষ শ্রমিকের পিঠে কিংবা মাথায় আঘাত করলেও বেছে বেছে নারী শ্রমিকের ঠিক পাছায় আঘাত করছে পুলিশ। নির্দেশ পালনের পাশাপাশি এক ধরণের বিকৃত স্বাদ নিচ্ছে। পুরুষ শ্রমিকদের হাতে ইট পাটকেল লাঠি থাকলেও নারীদের হাত শুন্য। এরা গাড়ির গ্লাস ভাংতে রাস্তায় নামেনি। চোদ্দ পনর ঘণ্টা কারখানায় কাজ করে যে মজুরী পায় তাতে বারো চোদ্দ জনকে এক ঘরে ঘুমোতে হয়। দিনের পর দিন কাটে ডাল আর আলু ভর্তায়। এদের হাতে তৈরি পোশাক ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ব বিখ্যাত ব্রান্ডের শোরুমে বিক্রি হয়। কারখানার ম্যানেজার আর সুপারভাইজার শ্রমিকদের নাম ধরে খুব কমই ডাকে, শুয়োরের বাচ্চা কুত্তার বাচ্চা মাগী আর চুতমারানি শুনে শুনে কান সয়ে গেছে। গালি গালাজ নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই এটা জানে কুড়িগ্রামের মর্জিনা। এই জাতি সভ্য হতে আরো সময় লাগবে। পুলিশের ডাণ্ডা মাথায় লাগুক আর পাছায় লাগুক তাও মুখ্য না। কিন্তু ন্যায্য পাওনা মর্জিনার চাইই চাই।
নিউজটি তৈরি হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনের। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল বন্ধ। পোশাক শ্রমিকরা লাঠি হাতে সব রাস্তায় নেমে এসেছে। অনেক গাড়ি ভাংচুর হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরো বিছিয়ে আছে। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডারে দাড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে বুড়িগঙ্গা টেলিভিশনের তরুণ সংবাদ পরিবেশক আদিল সরকার। ষাটোর্ধ ক্যামেরাম্যান আজিজুল পনের বিশ ফুট দূরে ক্যামেরা সেট করে খ্যাপা শ্রমিকদের শট নিচ্ছিলো। আদিল ইশারা দিয়ে ক্যমেরামেনকে আরো ক্লোজ শট নিতে বলে। আজিজুল ক্যামেরা ক্লোজ করে আদিল সরকারের চেহারাটা স্ক্রীনে নিয়ে আসে।
-এই খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের দাবী পূরণে সরকার... রেকর্ডিং চলছে এমন সময় কয়েক জন উত্তেজিত শ্রমিক পাশের একটি কারখানার সামনে দাড়িয়ে ইট ছুড়তে থাকে। কারখানার সামনের দিকের দোতলা তিন তলা চার তলার কাঁচ ভেঙ্গে পড়তে থাকে। আজিজুল সংবাদের প্রাসঙ্গিক চিত্রটি ধারণ করতে ক্যামেরা ডান দিকে ঘুরিয়ে নেয়। সাথে সাথে আদিল সরকার মাইক্রোফোন বাম হাতে নিয়ে ছুটে গিয়ে আজিজুলের ডান গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগায়। আজিজুল অনেক নামি দামী স্টার-নির্মাতার সাথে কাজ করেছে। এমন প্রসঙ্গিক চিত্র ধারণ করে ধন্যবাদ পেয়েছেন অনেক বার। আজ থাপ্পড় জুটল কপালে।

অফিসের বড় বাবুর সাথে তর্ক করা সহজ। পাড়ার মাস্তান কিংবা ইউনিয়নের নেতার সাথে তর্কে জিতার নজির আছে। মনুশেখের ভয় শুধু একজনকে। আজকাল রাত দুপুরে খুব বিরক্ত করছে সে।
অফিসের বড় বাবু কনট্রাক্টরের বিলে সই করে প্রকাশ্যে বলে -তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন জোহরের জামাত শুরু হয়ে যাচ্ছে। ভাজ করা নোট গুলো এক নজর দেখে হাতের মুঠোয় নিলেই বুঝা যায় পরিমাণ ঠিক আছে। প্যান্টের ডান পকেটে টাকাটা ঢুকিয়ে টুপি মাথায় দিয়ে দ্রুত প্রথম কাতারে দাড়াতে হবে বড় বাবুকে। প্রথম কাতারে নামাজ পড়ায় নেকী অনেক বেশী।
কনট্রাক্টরের গাড়িতে মাল লোড দিয়ে সহকারী স্টোর কিপার আজিজুল একটা একশ টাকার নোট পেয়ে দাত বের করে তৃপ্তির হাসি দেয়। দূর থেকে স্টোর কিপার মনু শেখ আড় চোখে দেখে। এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। কেউ অন্যায় বলে মনে করে না। এভাবে উপরের দিকে উঠতে থাকলে টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। বড় বাবুর উপরের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকার পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা নেই মনু শেখের। তাদের সাথে নাকি সরকারের বড় বড় আমলা মন্ত্রীর কোটি কোটি টাকার লেনদেন আছে। যে জন্য নীচের দিকের হাজার টাকা লাখ টাকার দুর্নীতি আমলে নেয়না কেউ।
সরকারী এই প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানি করার ঘোষণা আসার পর বেশ কিছু দিন খুব নিয়মের মধ্যে চলে আসে। যারা দুই তিন দিন পর পর অফিসে এসে হাজিরা খাতায় একসাথে তিন দিনের সই করতো তারাও নয়টা পাঁচটা অফিস করা শুরু করে। যেই কর্মচারীটি দুপুরে এক ঘণ্টার জন্য এসে হাজিরা খাতায় সই করে ফিরে গিয়ে লাকড়ির দোকানদারী করতো সেও চলে আসে নিয়মের মধ্যে। এই সব কাণ্ড কারখানা সবার জানা। বড় কর্তা সারা দিন অফিসের চেয়ারে বসে থেকে যে রোজগার করে তার বরং ফাঁকি দিলে লোকসান। কিন্তু ছোট কর্মচারীদের বাড়তি কামানোর সুযোগ কম। যে টাকা বেতন দেয় সরকার তাতে বাচ্চা কাচ্চার লেখা পড়ার খরচ হয় না। খাওয়া পড়া তো দূরের কথা। তাই অফিসের বড় থেকে ছোট সবাই চুরি চামারিতে পরস্পরের জন্য সহযোগিতা করে। এক মাত্র মনু শেখ এই সবের ধার ধারেনা।
সরকার দীর্ঘ দিন ধরে বেতন বাড়ায় না। ইউনিয়নের নেতারা মন্ত্রীর সাথে দেখা করে নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা বলে। বিগত কয়েক বছরে দেশে কয়েক বার টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ফলে বাজারে জিনিষ পত্রের দাম অনেক বেশী বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ছেলে পুলে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করে না খেয়ে মরার অবস্থা। পঞ্চাশ একশ বকশিসের টাকাতো পান চুরুট খেয়েই শেষ হয়ে যায় সংসারের কাজে লাগে না। মন্ত্রীই বা কি করবে গত দেড় যুগ ধরে লোকসানে চলছে প্রতিষ্ঠান। বছর বছর সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়। বেতন বাড়ানোর সুযোগ নেই। মন্ত্রী কানে কানে ইউনিয়নের নেতাকে একটা পথ বাতলে দেয়। তার পর থেকে অনেকের মুখেই হাসি ফুটে উঠে। প্রতি মাসে ওভার টাইম আর কনভেন্স ভাউচারে সই করে বাড়তি কিছু টাকা পায় সবাই।
বেঁকে বসে মনুশেখ। মাস শেষে যখন ওভার টাইম আর কনভেন্স ভাউচারে সই করে টাকা নেয়ার জন্য ডাকা হয় তাকে, ভীষণ ক্ষেপে যায় সে। আমি আবার ওভার টাইম করলাম কখন! ট্রাফিক জ্যামে পড়ে বরং সবার মতো আমিওতো প্রায়ই দেরী করে আসি অফিসে, অফিস সময় শেষ হওয়ার আগেই সবাই চলে যায়! পর পর দুই তিন মাস এমন হবার পর উপর থেকে মনুশেখের নামে চিঠি আসে সবাই ওভার টাইম করে মনুশেখ কেন ফাঁকি দেয়? তার পর থেকে তার বিভাগের কর্মকর্তার নির্দেশে অন্য জনকে দিয়ে মনুশেখের ভাউচারে সই করে টাকা ভাগা ভাগি করে নেয় সহকর্মীরা। অন্তত ফাইলটা তো ঠিক রাখতে হবে।
মনুশেখ সৎ আর সত্যবাদী মানুষ। মিথ্যা কথা আর চুরি চামারি নিয়ে প্রায়ই তর্ক হয় সহকর্মীদের সাথে। পদবীতে ছোট হলেও বড় বাবুও একটু মেপে কথা বলে তার সাথে। বড় বাবুর ধারণা সৎ লোক বড়ই বিপদজনক আর কিছুটা পাগল প্রকৃতির হয়। এদেরকে যতটা পোষ মানিয়ে রাখা যায় ততই নিরাপদ।

কিরে মনু, কেমন আছস ?
-ভালা আছি। মনুশেখ বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়।
-আমার লগে মিছা কতা কস? শব্দ করে হাসে...
-কইলাম তো আমি ভালা আছি। হাসির শব্দ শুনে মনুশেখের বিরক্তি আরো বেড়ে যায়।
-তুই কি সত্যিই বিয়া শাদী করবি না ?
-আমার বিয়া নিয়া তোর এতো মাথা ব্যথা কে ?
-না মানে, বউ পোলাপান থাকলে দেখতাম চুরি চামারি না কইরা এই বেতনে তুই কেমনে চলস!
-আমি যেমন আছি তেমনি থাকতাম।
-সবার সাথে সত্যি কথা কস ঠিক আছে, আমার লগে মিছা কথা কস কে?
-তোর সাথে কি মিছা কথা কইলাম?
-তুই মাইনসের লগে গর্ব কইরা কস, এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে নারী দেহের স্বাদ পাস নাই। ইচ্ছা করলে জীবনে অনেক অনৈতিক সম্পর্কের সুযোগ নিতে পারতি, কিন্তু নেস নাই! সত্যি কি এই স্বাদ তুই পাস নাই? তুই জানস মর্জিনা এখন কেমন আছে?
মনুশেখ বিছানা থেকে উঠে বাতির সুইচটা অন করে। দেয়াল ঘড়ির ঠক ঠক শব্দ খুব বিরক্তিকর লাগছে। রাত তিনটা বাজে। দুই গ্লাস পানি খায়। সাথে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট। আজকাল দুই ট্যাবলেটে কাজ হচ্ছে না। আলো নিবিয়ে বিছানায় যায়। কিছুক্ষণ ডান বাম করে চোখে মাত্র ঘুম আসছে বলে মনে হলো মনুশেখের। আবার সেই একই বিরক্তিকর কণ্ঠ –আর একটা কথা তরে বলা হয় নাই। তোর চাইতে অনেক ভালা মানুষ অফিসের বড় বাবু! কারণ বড় বাবু প্রকাশ্যে আকাম করে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক কবির ভাই..অনেক সুন্দর একটা জীবনের গল্প...বাস্তবতার নিরিকে চমত্কার কাহিনী...ভালো লাগলো....
আপনার ভালো লাগায় আমার বুক ভরে গেলো...
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি বাস্তবতার ছাপ ফুটে উঠেছে.........লেখার ন্যাকটাও খুব ভাল লাগলো .......ভীষণ সম্ভাবনার হাতছানি রয়েছে ......অনেক ধন্যবাদ মোজাম্মেল আপনাকে..............
আপনার মন্তব্য যেন বাঁশির সুর...
এশরার লতিফ ভালো লাগলো, মানুষ মাত্রই স্ববিরোধী.
মানুষের এই স্ববিরোধী স্বভাবটা থাকে অপ্রকাশিত। ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন বাস্তবতা তুলে এনেছেন আর সেটাও সুন্দ্রভাবে। খুব ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
আমাদের বাস্তবতা দিন দিন এতটাই জটিল হয়ে উঠছে যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গল্পের উপকরণ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর একটি লেখা ।।
ভালো লিখতে না পারার দুঃখ যায় না আমার... অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
দীপঙ্কর বেরা বেশ সুন্দর লেখা তো । ভাল লাগবেই ।
মিছবাহ উদ্দিন রাজন ব্যাকগ্রাউন্ড কিছুটা হলেও যদি সত্যি হয় , তাহলে আসলেই খুব প্যাথেটিক ।
আমাদের চার পাশে লুকিয়ে আছে এমন অনেক সত্যি গল্প। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আরাফাত ইসলাম আপনার লেখা প্রথমবার পড়লাম,ভালো লাগলো।
জাকিয়া জেসমিন যূথী ভালো লাগলো গল্পটা। ভিন্ন ভাবনা। ভিন্ন বুনোট। চমৎকার লিখেছেন।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪