৩০ নাম্বার রমেশ সেন রোড

প্রশ্ন (ডিসেম্বর ২০১৭)

মোজাম্মেল কবির
  • ৩২


সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে ডাস্টবিনে একটা নবজাতকের লাশ দেখে ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। দৃশ্যটা মায়ের কাছে খুব বেশী অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না। মায়ের মুখ দেখে মনে হয় এ যেন প্রতিদিনকার ঘটনা।
গলিটা যেখানে শহরের বড় রাস্তায় মিশেছে, গলির মুখেই ডাস্টবিন। পাশেই কাঁচা সব্জির আড়ত। বাজারের আবর্জনায় প্রতিদিন ভরে যায় ডাস্টবিন। রাতে পৌরসভার গাড়ি এসে আবর্জনা তুলে নিয়ে যায়। সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সধ্যজাত শিশুর লাশটি পলিথিনের মাঝখানে পড়ে ছিল। চার কোনা পলিথিন। বৃষ্টির খানিকটা জমাট পানিতে অর্ধেক ডুবে ছিল শিশুর শরির। দুই হাঁটু দিয়ে শিশুটি তার যৌনাঙ্গ আড়াল করে রেখেছিলো। তবুও আমি দেখতে পায়েছিলাম। সে ছিল কন্যা শিশু। পাশেই দুটি কাক ডাস্টবিনের ময়লায় ঠোকর কাটছিল আপন মনে। শিশুর মৃতদেহটার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না কাকেদের। এখনো মাঝে মাঝে মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙলে শিশুর মুখটা ভেসে উঠে চোখে।
-------------------
মিথ্যে কথা মাঝে মাঝে বেশ শক্তি নিয়ে কানে ধাক্কা দেয়। শুনতে প্রায় সত্যের কাছাকাছি মনে হয়। এবার বাসা খুঁজতে বের হয়ে তেমনই একটি পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল আমাকে। লোকটা আমার মুখের উপর বলে ফেলল -আপনি কি বেশ্যার দালালী করেন? দালাল শব্দটা পুরুষের ক্ষেত্রে খাটে, নারীর ক্ষেত্রে খাটে কি না আমার জানা নেই। সেখান থেকেই আমার পিছিয়ে আসার কথা ছিল। আমি পিছ পা হই নি। চাকরীটা করতে চাইলে আমাকে এমন একটা বাসা খুঁজে বের করতেই হবে যেখানে রাত বারোটা কিংবা একটায় গেট খুলে দিবে।
সেদিন আমি আসলে রাগ করি নি। এমন অদ্ভুত একটা চাকরীর কথা শুনে যে কারো মনে সন্ধেহ হতে পারে। লেখাপড়া জানা লোক হলেও একটা কথা ছিল। বাড়িওয়ালা লোকটাকে দেখে মনে হয় নি শিক্ষিত। তবে আমি সেদিন এমন কথা শুনে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি টের পাচ্ছিলাম আমার মুখে রক্ত জমে লাল হয়ে গেছে। কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে। আমার মুখে কথা আটকে যাচ্ছে দেখে লোকটা হয়তো ধরেই নিয়েছিলো আমি সত্যিই বেশ্যার দালাল।

আটাশ বছর বয়সী একজন অবিবাহিত মেয়ে রাত একটায় কাজ শেষে বাসায় ফিরবে এই শর্তে কোন বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে রাজী হয় না। সেই কাজ আবার ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের নিয়ে! এই নিয়ে আটত্রিশটা বাসা দেখা হয়েছে। আজ বিকেলে একটা বাসা পেলাম।
সবকিছু শোনার পর মহিলা কেন আমাকে বাসা ভাড়া দিতে রাজী হলেন আমার নিজেরই অবাক লাগছে। আমি বাড়িওয়ালা হলেও হয়তো রাজী হতাম না।
ধরেই নিয়েছিলাম এটাও হচ্ছে না। উনার স্বামী আমার সামনেই প্রতিবাদ করেছিলো এইসব ঝামেলা বাসায় তুলে বিপদে পড়বে তুমি? মহিলা ধমকের সুরে স্বামীকে থামিয়ে দেয় -তুমি থামো তো!ছাদে যাও আমি মেয়েটার সাথে একা কথা বলছি।
পরে ফরিদ ভায়ের কাছে জেনেছি শামিমা খালার পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া এই পাঁচতলা বাড়িতে তার কথাই আইন ।
আমার বুকে এতো শক্তি আর মুখে এতো জোর কোত্থেকে এসেছিলো তাও নিজের কাছেই রহস্যজনক লাগছে। আমি গত এগারো বছর মুনিরের কাছে যে সব কথা গোপন রেখেছি, সব কথা এক ঘন্টার পরিচয়ে বলে দিলাম শামিমা খালার কাছে। তিনি শুধু হা করে তাকিয়ে শুনলেন। মাঝখানে কথা থামিয়ে আলেয়াকে ডেকে চা দিতে বললেন-আলেয়া, চা নিয়ে আয়। আলেয়া দুজনের জন্য চা নিয়ে আসলো। খালার জন্য বেশ বড় সাইজ মগে চিনি ছাড়া গ্রীন-টি আর আমার জন্য ঘন দুধের চা। সাথে টোস্ট বিস্কুট। এরই মধ্যে খালা আমাকে তুই বলে ডাকতে শুরু করেছেন। -নেরে মা, খেয়ে নে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। চা খেয়ে খালা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। ছাদের এক কোনে মাঝারী সাইজের একটা ঘর। সাথে এ্যাটাচড্ বাথরুম। মেঝেতে সাদা টাইলস লাগানো। ছোট্ট এক টুকরো বারান্দা। বারান্দার এক পাশে একটা গ্যাসের চুলা। ছাদে চার পাশে নানা ধরণের ফুল গাছ। হাফ ড্রামে চার পাঁচটি আম গাছ। দুইটি পেয়ারা গাছ। ছাদ বাগানের উত্তর পাশে সিমেন্ট এর বেঞ্চ একটা টেবিল, বসে চা খাওয়া বই পড়ার জন্য বেশ সুন্দর জায়গা।
ঘরের তালা খুলে দুজনে ভিতরে ঢুকলাম। কিছু পুরনো আসবাবপত্র রাখা আছে। ধুলো জমে সাদা হয়ে আছে। খালা বললেন -আমি আজই ফরিদকে বলে দিচ্ছি কালকের মধ্যে যেন ঘরটা পরিষ্কার করে দেয়। ফার্নিচার গুলো স্টোর রুমে নিয়ে যাবে। তোর যদি কিছু লাগে রেখে দিস।
আমি শুধু মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম। আমি আসলে সাধ্য আর প্রয়োজনের কথা ভেবে এমনই একটা ঘর খুঁজছিলাম।
ছাদে খালু ফরিদকে নিয়ে গাছে পানি দিচ্ছেন। শামিমা খালা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে গাছের পাতা গুলো ছুঁয়ে দেখছেন। আমি পাশে হাঁটছি। গাছ গুলোর সাথে যেন তাঁর আত্মার সম্পর্ক। খালা সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। গত বছর অবসরে গেছেন। এখন বই আর গাছপালা নিয়েই সময় কাটে। আমার পিঠে হাত রেখে বললেন -তোকে অগ্রিম দিতে হবে না। মাস শেষে বেতন পেয়ে তোর যা ইচ্ছে দিয়ে দিস। ভাড়া নিয়ে আমি কিছু বলবো না। শুধু এই গাছ গুলোর দিকে একটু খেয়াল রাখিস। আজ মাসের তেইশ তারিখ, চাইলে কাল কিংবা পরশু উঠতে পারিস। এই কদিনে সব গুছিয়ে নে। আগামী মাস থেকে ভাড়ার হিসাব করিস।
আমার ভিতরটা কেমন যেন গলে যেতে চাইছে। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আপনজন বলে কাউকে জানি না। আপন মানুষের আদর ভালবাসা বুঝি এমনই হয়!

আমি বাসা থেকে বের হয়ে যখন রাস্তায় হাঁটছি তখন মনে অনেক জোর। সাথে শরিরেও বেশ শক্তি অনুভব করছি। এই প্রথম পৃথিবীটা আমার নিজের বলে মনে হচ্ছে। মা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনি করে গেছে আমাকে। মারা যাওয়ার পর লাভের টাকাতেই আমার মাসের খরচ চলে যায়। টাকা যে সব সময় মনের জোর বাড়াতে পারে না আজ আবার নতুন করে বুঝতে পারলাম। বেঁচে থাকার জন্য একজন কাছের মানুষ যে কতোটা প্রয়োজন তা শামিমা খালার দেখা না পেলে জানতাম না। গত এগারোটা বছর মনিরের সাথে আমার সম্পর্ক। ভালবাসা আর বন্ধুত্বের মাঝামাঝি একটা সম্পর্ক। বছর খানেক আগে যখন মনির আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন আসলে বুঝতে পারি সম্পর্কটা আগে যাই থাকুক মনের মধ্যে ভালবাসা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তার আগে ঠিক এভাবে বুঝি নি। রুটিন করে একসাথে ফুটপাত ধরে হাটা ক্যান্টিনে বসে চা কফি খাওয়া এইসব তো অনেকেই করেছে। কিন্তু মাঝ রাতে যখন নবজাতক শিশুর মুখ চোখে ভেসে উঠে তখন মনেহয় আমার জন্য ভালবাসা একটা অর্থহীন শব্দ। আজ মনিরের সাথে আমার সম্পর্কের বিষয়টা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। যদি বলি সম্পর্কটা ভালবাসার তাহলে মাঝখানে একটা স্বচ্ছ দেয়াল আছে। যাকে ঠিক পরিপূর্ণ ভালবাসা বলা যায় কি না আমি নিশ্চিত না। কারণ ভালবাসা সম্পর্কে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা একেবারে নেই বললেই চলে।

ব্যাংকের চাকরীটা মনিরের চার বছর চলছে। এর মধ্যে একটা প্রোমোশন পেয়েছে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। একটা মাত্র বোন থাকে কানাডায়। বাসা থেকে বিয়ের চাপ আছে। আমাকে পছন্দের ব্যাপারটা নাকি পরিবারের সাথে আলোচনা করেছে। ওর পছন্দে বিয়ে করতে বাবা মায়ের আপত্তি নেই। মনিরের চেষ্টায় ব্যাংকে আমার একটা চাকরীর সুযোগ হয়েছিলো। আমি এনজিওর চাকরীটা পেয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি বলে সে খুব অবাক হয়েছে।

আমি দৌড়ে নীলক্ষেতের বাসে উঠি। আমি জানি সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে সে নীলক্ষেতে মামার রেস্টুরেন্টে মনির আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি আজ মনিরের কাছে সব কিছু খুলে বলবো বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব শোনার পর সে যদি তার পরিবারকে রাজী করাতে পারে তাহলে বিয়ে করতে আপত্তি নেই আমার। আমি জানি এর পর আর আমাকে খুঁজবে না সে। আমি আসলে কি চাই তা জানি। তাকে সেটা আমি মুখে বলতে চাই না। মনিরকে আজ এগারো বছর ধরে জানি। ওর ভিতরটা সাদা। আমার হৃদয়ের কোথাও যে সে জায়গা করে নিয়েছে এটাও আমার অস্বীকার করার উপায় নেই। সে জন্যই সব খুলে বলা দরকার। হতে পারে এটাও ভালবাসার আরেকটা রুপ, তবে আমি নিশ্চিত না। আমার জীবনে ভালবাসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে এমন মনে হতে পারে।

চা খেয়ে রেস্টুরেন্টে বসতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না আমার। টেবিলে মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছি ওর হাত দুটি টেবিলের উপর রাখা। দুই হাতের মুঠোয় ওর হাত দুটি বন্দি করে চোখের দিকে তাকালাম। চশমার কাঁচের ভিতর থেকে যেন ওর চোখ দুটি বের হয়ে আসতে চাইছে। চা শেষ করে বললাম -চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। চা খেয়ে ফুটপাত ধরে যেতে থাকি। মনির পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। আমি আসলে কোত্থেকে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কিছুটা পথ নিরবেই হাঁটলাম। মাঝখানে একটা বাতির নীচে পাশাপাশি বসলাম দুজনে। রাস্তার দিকে মুখ করে ফুটপাতে বসি। মনির আরেকটা সিগারেট ধরালো। মনির নিজেই আমার কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সে জানতে চাইলো -বাসা খুঁজে পেয়েছো?
-হ্যা পেয়েছি। আমি বললাম।
-কোথায়?
-লালবাগ।
-তোমার পছন্দ হয়েছে?
-হ্যা পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা আমার চাকরীটার ব্যাপারে তোমাকে কতোটুকু বলেছিলাম মনে আছে?
-এএইচএফ নামে অ্যামেরিকান একটা এনজিওতে চাকরী, তাই তো?
-হ্যা তাই, কাজটা কি জানো?
-তা ঠিক জানি না।
-ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের মাঝে কনডম বিতরণের কাজ। আমার কথা শুনে মনির একটুও অবাক হয় নি দেখে আমার কাছে স্বাভাবিক লেগেছে। কারণ এভাবে সহজেই মেনে নেয়া তার স্বভাব। এমনটি তাকে মানায়।
-অনেক বড় কাজ, একে আমি ছোট করে দেখছি না।
-আমার আরও দুইজন সহকারী থাকছে। দুজন মেয়ে একজন ছেলে। মাঝে মাঝে শুধু মনিটরিং করতে যেতে হবে আমাকে।
মনির আমার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্বস্ত করলো -আমি যদি তোমার কাজে আসি... প্রয়োজনে আমার হেল্প নিতে পারো।
-আমি আসলে যা বলতে চাইছি তা এখনো শুরু করি নি।
-বলো আমি শুনছি।
-আচ্ছা, আমার মা বাবা ভাই বোন পরিবার... এই সব নিয়ে তুমি কখনো কোন প্রশ্ন করো নি। জানতে ইচ্ছে করে না তোমার?
-তুমি বলো নি তাই জানতে চাই নি। তুমি বললে শুনবো। তোমাকে প্রায় এক যুগ ধরে জানি। এই সময়ে যতোটুকু জেনেছি এর চাইতে বেশী আর কতোটুকু জানলে জানা হবে জানি না।
-জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের পরিবার বলতে যা বুঝায় আমি শুধু মাকেই চিনি। আমার মায়ের মুখে শুনেছি আশরাফ আলী নামে এক লোক আমার বাবা। আমি কোন দিন তার মুখ দেখি নি। এমনকি ছবিও না... আমি যে বাড়িটায় জন্মেছি সেটা ছিলো একটা দোতালা টিনের ঘর। ভিতরে বাহিরে দুই দিকে বেশ বড় বারান্দা। মা আমাকে সকালে বোরকা পড়ে স্কুলে দিয়ে আসতো আবার স্কুল ছুটি হলে দাড়িয়ে থাকতো স্কুলের গেটে। আমি মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরতাম। আমি বানান করে পড়তে শিখলাম। মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ঘরে ফিরতে হতো বাজারের ভিতর দিয়ে। পথে দুইপাশে চোখে পড়তো কাপড়ের দোকান জুয়েলারি দোকান। সাইনবোর্ডে লেখা দোকানের নাম গুলো মাকে পড়ে শুনাতাম। মা খুব আনন্দ পেতো। আর খুশী হয়ে কি বলতো জানো? মা বলতো তোকে আমি অনেক পড়াশোনা করাবো।
আমরা যে বাসায় থাকতাম দোতলার বারান্দার উপরে লেখা ছিল নাজমা কটেজ। আমার মায়ের নাম ছিল নাজমা। তাই আমার মনে হতো এই বাড়িটা আমাদের নিজেদের। আমি আর মা দুইটা ঘর নিয়ে থাকতাম। একটা ঘরে মা ঘুমাতেন আরেকটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম আমি। মায়ের ঘরটা ছিল বেশ বড়। কাঠের পাটাতনে মেঝেতে ছিল লাল কার্পেট। মাঝখানে একটা খাট। চারপাশে আসবাবপত্র, বসার কয়েকটি চেয়ার। আমার মনে পড়ে রাতে মায়ের সাথে ঘুমনোর জন্য অনেক কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু মা আমাকে আদর করে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যেতো। তখন মায়ের গায়ে থাকতো নতুন ভাঁজ ভাঙা শাড়ি। গা থেকে বের হতো তীব্র পারফিউমের গন্ধ। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় মাকে খুজতাম। পাশের ঘর থেকে পুরুষ মানুষের অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতো আমার কানে। প্রতি রাতেই ঘটতো এমন ঘটনা। আমি যখন একটু বড় হলাম মনে পড়ে ক্লাস থ্রি কি ফোর এ পড়ি, মা আমাকে বারান্দায় যেতে দিতেন না। বারান্দায় গেলে দেখতাম বড় রাস্তায় দূর দূরান্ত থেকে আসা সব্জির ট্রাক আনলোড হচ্ছে। পাইকাররা লেনদেন শেষ করে এই গলিতে ঢুকছে। গলি থকে একটু ভিতরে ঢুকলেই দুইটা গেট পেরিয়ে ভিতরে যেতে হতো। সেখানে দল বেঁধে দাড়িয়ে থাকতো বিশ ত্রিশ জন নানা বয়সী নারী। মুখে সস্তা সাদা মেকাপ ঠোটে কড়া লাল লিপস্টিক। তাদের যাকে পছন্দ হতো খদ্দের তার ঘরে চলে যেতো। আর বাকী মেয়ে গুলো নানা অশ্লীল ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করতো। এইসব আমি দেখতাম দোতলার বাহির বারান্দায় দাড়িয়ে। সন্ধ্যার পর কিছু লোক প্রতিদিন মদ খেয়ে মাতলামি করতো।
বারান্দায় দাড়ালে সামনের পুরনো দালানের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা চোখে পড়তো ফরেন লিকারের দোকান, ৩০ নাম্বার রমেশ সেন রোড। আমাদের বাসাটা যে আসলে আমাদের একার বাসা না এমনকি আমাদের নিজেদের বাসা না এটা আমি বুঝতে পারলাম। আমার মায়ের ঘরের পাশে এক লাইনে পর পর কয়েকটি ঘরে আরও কয়েকজন নারী থাকতো। সবাইকে আমি খালা ডাকতাম। তাদের ঘরেও রাতে নতুন নতুন অপরিচিত পুরুষ মানুষ আসতে দেখতাম প্রতিদিন।
নীচতলায় এক বুড়ি থাকতো। সারাদিন বুড়ির কাশির শব্দ আসতো। আমি তাকে নানী ডাকতাম। তার ঘরে দুই পাশে দুইটা খাট মাঝখানে একটা পর্দা টানানো। বুড়ির একটা মেয়ে ছিল। দেখতে কালো। উপরের দাঁত গুলো উঁচু। তার ঘরে দিনে এক দুইজন খদ্দের যেতো। কখনো সারা দিন অপেক্ষা করেও একজন খদ্দের এর দেখা মিলতো না। সেদিন বুড়ি আর তার মেয়ে দুজনেই না খেয়ে থাকতো। মা সেদিন বাটিতে ভাত আর তরকারি আমার হাতে দিয়ে বলতো বুড়ির ঘরে দিয়ে আয়। আমার হাতে খাবার দেখে মা মেয়ে দুজনের শুখনো মুখে হাসি ফুটত।

একদিন একটা ঘটনা ঘটলো মনে আছে। আমি সন্ধ্যার ঠিক আগে বুড়ি নানীর ঘরে খাবার দিয়ে ঘরে ফিরছিলাম। তখন দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। বাইরে থেকে পূজার ঢোলের শব্দ আসছিলো। বারান্দায় এক মাতাল যুবক আমার হাত ধরে ফেলে। এক হাতে আমার বাম হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরে আরেক হাতে আমার গালে হাত দিয়ে দাঁত বের করে হাসে আর বলে -এই মাগী বড় হলে খাসা একটা মাল হবে দেখছি! আমার হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা লাগছিলো। আমার কান্নার শব্দ শুনে মা একটা ছুরি হাতে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। ছুরি দেখেই আমার হাত ছেড়ে দৌড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় লোকটা। মুরগী যেমন বাচ্চাকে ডানার নিচে আড়াল করে আশ্রয় দেয় নিজের বাচ্চাকে আমার মা ঠিক তেমন করে নিরাপদে ঘরে নিয়ে যায়।

তার পরের গল্পটা তোমাদের জানা পৃথিবীর সাথে অনেক মিল আছে। ঢাকার আবাসিক স্কুলে মা আমাকে ভর্তি করে রেখে গেল। প্রতি মাসে একবার এসে দেখা করতো। মা চলে যাওয়ার সময় খুব কাঁদতাম। এক সময় বুঝতে পারলাম মা আমার ভালোর জন্যই সব করছে। আমি মায়ের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কোন কথা বলি নি। কারণ আমাকেও নিজের জগতের একজন বাসিন্দা করে রাখতে পারতো। কিংবা জন্মের পরই আমার জায়গা হতে পারতো ডাস্টবিনে... কিন্তু মা তা করে নি।
বড় হয়ে একবার বলেছিলাম মাকে -মা, আমার জন্মদাতার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করে। মা বলল -আশরাফ আলী তোর পিতৃত্বের স্বীকৃতি দেয় নি। সে বলে আমার সাথে অনেক পুরুষ রাত কাটায়। যে কারো বীজ নাকি আমার পেটে ধারণ করতে পারি। কিন্তু মা, আমি তো জানি কে তোর বাবা! লোকটা দেখতে ঠিক তোর মতোই। মায়ের এই কথা শুনে আর ইচ্ছে জাগেনি পিতার মুখ দেখতে। আমার কাছে এই আমার স্রষ্টা আমার মা। মা আমার কাছে কোন দিন কিছু আশা করে নি। আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার ঠিক এক বছর আগে মা মারা গেল। তোমার মনে আছে হয়তো, আমি মাস খানেক অসুস্থ ছিলাম। মায়ের মৃত্যুটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় নি। হতে পারে খুন, হতে পারে আত্মহত্যা। এই নিয়ে আমি আর কিছু ভাবতে চাই না। মা তার পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে চলে গেছে।
মনির অবাক হয়ে এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কথা গুলো আমার বলা দরকার ছিল। আমি আর কিছু বলতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে আমি আরও কিছু বলতে চাইছি। মনে মনে খুঁজছি আরও কি কিছু বলার বাকী আছে? আরও কিছু কি বলা দরকার? আরও অনেক কিছুই বলার ছিলো আমি মনেহয় গুছিয়ে বলতে পারছি না। মনির আবার সিগারেট ধরালো। -আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমার এই কথা গুলো জানা দরকার ছিল। আমি বললাম। আবার চুপ করে আছি। মনির অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল -তোমার প্রতি এতদিন আমার যে ভালবাসা ছিল আজ তার সাথে শ্রদ্ধা যোগ হল।
-তুমি কি এইসব জানার পরেও আমাকে বিয়ে করতে চাও?
-অবশ্যই চাই! মনিরের কণ্ঠে বেশ জোর সাথে তীব্র আবেগ দেখতে পেলাম। আমি জানি এই আবেগ ক্ষণস্থায়ী।
-আমি চাই এই কথা গুলো তুমি তোমার পরিবারের সাথে শেয়ার করো। তোমার মা বাবা যদি সব কিছু জেনে রাজী হয় তবেই বিয়ে করতে আমার আপত্তি থাকবে না।
-বাবা মায়ের এইসব জানা কি প্রয়োজন আছে? শ্রাবণ, আমি এগারো বছর ধরে যেই তোমাকে চিনি সেই কি যথেষ্ট না?
-যখন তাঁরা আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাইবেন তখন কি বলবে? জানতে চাইবেন তারা কোথায় থাকে কি করে? তুমি নিজেই কি আজীবন আমার অতীত লুকিয়ে রাখতে পারবে? রাখাটাকি ঠিক হবে?
-সেটা আমি দেখবো। চলোতো খেয়ে আসি অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। আমি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জানাচ্ছি তোমাকে।
সেদিনই রাতে একসাথে খেলাম। তিন দিন পর আমি নতুন বাসায় উঠলাম। সেই আমাদের শেষ দেখা। কয়েক সপ্তাহ পার হলেও মনিরের সিদ্ধান্ত না আসাতে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ভিতর থেকে মুক্তির স্বাদ অনুভব করি। এর পর অবশ্য মনিরের সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। সে নিজেই ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে কয়েক দিন। আস্তে আস্তে তার কণ্ঠে জোর কমে যেতে দেখলাম। এক সময় ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিলাম। তিন মাস পর জানতে পারলাম মনির বিয়ে করেছে আরেক সিনিয়র ব্যাংকারের মেয়েকে। মনে মনে আমি এটাই চাইছিলাম।

শামিমা খালার সাথে বিকেলে ছাঁদে বসে গল্প করে আমার বেশ ভালোই সময় কেটে যায়। আলেয়া ছাদে চা বানিয়ে নিয়ে যায় বিকেলে। খালা ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার সময় তার হাতে থাকা সধ্য পড়ে শেষ করা বইটা দিয়ে যায়। ফরিদ রাতে নীচতলার গার্ড রুমে আমি না ফেরা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখে অপেক্ষা করে। আমাকে দেখে গাল ভরা হাসি নিয়ে গেট খুলে দেয়। জীবনে প্রথম একটা পরিবারে বাস করার স্বাদ পেয়ে মাঝে মাঝে আপ্লুত হই আমি। মানুষের সংসার গুলো কতো সুন্দর কতো আনন্দের হয়... রাতে যখন নবজাতকের লাশটা চোখে ভাসে এবার ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম সে আজকাল মিষ্টি করে হাসে।
আজ অফিসে ঢুকতেই এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে ম্যানেজার সাহেব তাঁর রুমে আমাকে ডেকে নেন। আমাকে দেখে সামনের চেয়ারে বসতে বলেন। আমার ফাইলটা টেবিলে আমার সামনে রেখে বলেন -শ্রাবণ, এখানে আপনার পার্মানেন্ট এড্রেসটা এড করতে হবে। জায়গাটা খালি আছে। আর সাথে বর্তমান নতুন বাসার ঠিকানাটা লিখে দিন। ফাইলটা খুলে স্থায়ী ঠিকানা লিখতে কলম থেমে যায়। আমার স্থায়ী ঠিকানা আসলে কি? আমার স্থায়ী ঠিকানা আসলে গোটা পৃথিবী। পৃথিবী যার ঠিকানা তার এতোটা সংকীর্ণ চিন্তা মানায় না। আমি বেশ শক্ত হাতে কলম ধরে লিখতে থাকি ৩০ নাম্বার রমেশ সেন রোড, ময়মনসিংহ সদর, পোঃ ময়মনসিংহ-২২০০, জেলা-ময়মনসিংহ।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
%3C%21-- %3C%21-- bhasha hariye felechi. tobuo ek kothay bolchi, oshadharon!
ওয়াহিদ মামুন লাভলু কোনো লোক যদি কারো পিতা হওয়া সত্ত্বেও পিতৃত্বের স্বীকৃতি না দেয় তবে তা মেনে নেওয়া খুবই দূরূহ ব্যাপার। মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছেন। অনেক মানসম্পন্ন লেখা। কেমন আছেন আপনি? শ্রদ্ধা জানবেন। অনেক শুভকামনা রইলো। ভাল থাকবেন।
Farhana Shormin শুভকামনা রইল
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া শুভ কামনা রইল... ধন্যবাদ
শামীম খান শুভ কামনা রইল ।
শামীম খান গল্পটি সুন্দর । তবে প্রেডিকট্যাবল ছিল । কাহিনীতে গতি ছিল কম । শেষ পর্যন্ত পড়েছি তবে চেষ্টা করে । মাফ করবেন কবির ভাই । আপনার গল্পে কখনই গতির অভাব পাইনি । আমার মনে হয়েছে লেখায় আগাগোড়া যে নিষ্ঠা আপনার আজকেরটিতে সেই নিষ্ঠার অভাব ছিল ।
সাইয়িদ রফিকুল হক গল্প ভালো লেগেছে। শুভকামনা রইলো।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪