১ আমি যে একজন প্রতারক এটা বুঝতে আমার বেশ সময় লেগেছে। যতোক্ষণে বুঝলাম ততোক্ষণে তোমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। তুমি মন সপে দিয়েছো আমার হাতে। মন। সে যে সোনার চেয়ে দামী কিছু তা বুঝার ইচ্ছেই হয়তো ছিলো না তখন। একটা এক টাকার মুদ্রা হাতে চায়ের দোকানে টেবিলে বসে লাফাঙ্গা বাটপার জুয়ারি যে ভাবে নাড়াচাড়া করে। আমিও তোমার মনটা নিয়ে তাই করেছি। তোমাকে জয় করতে আমি আমার জীবনের প্রথম যে কবিতাটি কাগজে লিখে পাঠিয়ে ছিলাম মনে আছে তোমার? হয়তো মনে নেই। মনে থাকার কথা নয় চব্বিশ বছর পার হয়ে গেছে। মনে করিয়ে দেই- কষ্ট আমার এক মুঠো জল কষ্ট আমার নীলাভ নদী কষ্ট নিয়ে বেশ আছি তাই ভাগ দেবো না চাওগো যদি। কষ্ট আমার কেউ বুঝে না কেউ খুজে না... কষ্ট আমার নির্জলা ধুসর ভূমি কষ্ট আমার তুমি...
তুমি এই কবিতা পড়ে মোমের মতো গলে গেছো। পাগলের মতো ভালোবেসেছিলে। জানো সোনা? সেদিনের সেই কবিতাটি ছিলো মিথ্যে। আমি আসলে তোমার জন্য লিখিনি। লিখেছিলাম অন্য কাউকে নিয়ে। যে আমাকে বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে। ঘৃণা করেছে আমায়। আমার প্রাণের নির্যাস দিয়ে এই কবিতাটা লিখে যখন তার হাতে পৌছালাম। সে কাগজটা খুলেও দেখেনি। ছিড়ে টুকরো টুকরো করে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলো। সাবধান করে দিয়েছিলো আমি যেনো তার চোখের সামনে না পড়ি। অথচ তুমিই আমাকে সত্যিকারের ভালো বেসেছিলে। তোমার হাত ধরে শরিরে উত্তাপ সঞ্চয় হয়েছে ঠিক কিন্তু মনে মনে আমি তার ছবি দেখতাম। তোমাকে বুঝতে দেইনি। মানুষ সে নারী হোক আর পুরুষ মনের গভীরে কেউ কেউ গোপন করে বহুগামী চরিত্র। আসলে সে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য সর্বনাশা খেলায় জড়িয়ে যায়। নিজের মনটাকে পবিত্র মনে করে অথচ একই কাজ অন্যে করলে ঘৃণা করে। একজন মন্দ লোকও নিজেকে পবিত্র ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমি নিজে ছিলাম তেমনই এক দুশ্চরিত্রের প্রেমিক। ভালোবাসা শব্দটা অনেক দামী। আমি যখন এর মূল্য বুঝতে শিখলাম ততোদিনে চব্বিশ বছর কেটে গেছে। তোমার বিয়ে হলো। দেশান্তরি হলে। ব্যাস্ত জীবন। ভালোবাসা শব্দটি নিউইয়র্কের মতো ব্যাস্ত নগরীর দৈনন্দিন ব্যাস্ততা, অফিস, বাজার করা, রান্না করা, রাতে ক্লান্ত হয়ে নিদ্রা যাওয়া ছেলে মেয়ে মানুষ করা এই সবের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত সপ্তাহে তোমার ফোন পেয়ে যখন জানলাম তুমি দেশে আসছো। আমার সাথে দেখা করতে চাইছো। এক কাপ চা খেতে চাইছো ফুটপাতের বেঞ্চে বসে। তাও আবার রেল স্টেশনের সেই রমিজ চাচার চায়ের দোকানে। যেখানে আমি শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে ছিলাম তোমাকে। যেখানে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিলো। সেই দোকানেই বসতে চাইছো তুমি। তুমি হয়তো জানো না রমিজ চাচা মারা গেছে আট বছর আগে। সেই চায়ের দোকানটা এখন কফিশপ। রমিজ চাচার ছেলে চালায় দোকানটা। তবুও তুমি আসো। দেখা হওয়া খুব জরুরী। আমার অপরাধ গুলো আমি বয়ে বেড়াচ্ছি আজ দুই যুগ ধরে। তোমাকে বলার জন্য। রমিজ চাচার চায়ের দোকানে বসেই তো তুমি জানিয়ে ছিলে তোমার পরিবারে তোমার বিয়েরে কথাবার্তা চলছে। আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। আমার বেকার জীবনের দোহাই দিচ্ছিলাম। আসলে আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই ছিলো না তোমাকে। তার জন্য নানা ছল ছুতো খুজেছি। কেউ কেউ তোমাকে কৃষ্ণকলি বললেও আমার মনে মনে ছিলে তুমি কালো মেয়ে। নীচের পাটিতে একটা বাঁকা দাত তোমার হাসির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিলেও আমার কাছে বিশ্রী লাগতো দেখতে। বলিনি কোন দিন। বুঝতে দেইনি কোনোদিন। মাধু,আমার অপরাধ গুলো আমার পিছু ছাড়ছে না দুই যুগ ধরে। দিন রাত ধাওয়া করছে। আমাকে মুক্তি দিতে পারো একমাত্র তুমি। তোমাকে বলেছিলাম আমার জন্য মনে কিছু একটা ধারণ করে নিয়ে এসো? আমার জন্য মনে ঘৃণা ধারণ করো। তোমার ঘৃণায় আমার প্রায়শ্চিত্ত হবে। আমার ক্ষমা পাওয়া হবে। মুক্তি পাওয়া হবে। ভালো থেকো ক্ষমা করো ঘৃণা করো
চিঠিটা এভাবে শেষ করে মধু বাউল।
২ মধু বাউল একতারায় গান গাইছে-
অবোধ মন তোরে আর কি বলি... পেয়ে ধন সে ধন সব হারালি... অবোধ মন তোরে আর কি বলি... মহাজনের ধন এনে ছিটালিরে উলু বনে... কি হবে নিকাশের দিনে. সে ভাবনা কই ভাবলি...
পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশন হচ্ছে। গানটা আর শেষ পর্যন্ত গাওয়া হলো না। একতারা পাশে রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে একবার কেটে দিতে চেয়েও আবার রিসিভ করে। দেশের বাইরের নাম্বার। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ -কেমন আছো মিশু? -কে আপনি? -আমি মাধু? চিনতে পারলে না? -এই নামে তো এখন আর আমাকে কেউ চিনে না। তাই তোমাকে চিনকে ভুল হয়নি মাধু। তোমার কণ্ঠ এখনো আমার কানে বাজে। আমাকে মানুষ এখন মধু নামে চিনে। মিশু বলে। -কেমন আছো তুমি? -ভালো আছি। খুব ভালো। -কি করছো এখন? -জগৎ সংসারের নিয়ম পালন করছি মাধু। যে নিয়মে তুমি আমি সবাই আবদ্ধ। সেই নিয়মের আওতায় আছি। -আমি দেশে আসবো সেপ্টেম্বরে। তোমার সাথে দেখা হলে ভালো লাগবে। -আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলে মাধু? -তোমার ফেসবুকে। মনে পড়লো বছর সাতেক আগে একটা ফেসবুক আইডি খুলেছিলো। সব তথ্য পাবলিক করা। সেই পরিত্যাক্ত আইডি থেকে খুজে পেয়েছে মোবাইল ফোন নাম্বারটা। -রমিজ চাচার চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাবো আমরা। মাধু বলে। -রমিজ চাচার চায়ের দোকান তো নেই। সেখানে একটা কফিশপ হয়েছে। রমিজ চাচার ছেলে রাজু চালায়। সেখানে এসো। -তাহলে দেখা হচ্ছে সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ বিকেল পাঁচটায়। মনে থাকবে? -থাকবে। -তোমার জন্য কি নিয়ে আসবো বলো? -আমার জন্য? আমার জন্য লাগেজে ভরে কিছু নিয়ে আসতে হবে না। তবে একটা জিনিস দিয়ে যেতে হবে। বলো দিবে? কথা দাও। -বলো কি এমন অসাধ্য বস্তু চাও তুমি? -আমার জন্য মনে একটা কিছু ধারণ করে নিয়ে আসতে হবে। -আচ্ছা নিয়ে আসবো। আর কিছু? -না মাধু আর কিছু লাগবে না আমার।
৩ ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটায় মাধু একটা সবুজ শাড়ী পড়ে আসে। ঠিক সেই জায়গাতে যেখানে দুই যুগ আগে শেষ দেখা হয়েছিলো মিশুর সাথে। সেদিনও সবুজ শাড়ী ছিলো গায়ে। চায়ের দোকানটা নেই কিন্তু নতুন কফিশপ চিনতে ভুল হয়নি। দোকানের ছেলেটা দেখতে রমিজ চাচার মতোই। তার মানে এই ছেলেটাই রমিজ চাচার ছেলে রাজু। কিন্তু মিশু থাকার কথা ছিলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। মাধু দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করে -এটাকি রমিজ চাচার ছেলের দোকান? -হ্যা আফা। -কিন্তু এখানে তো মিশু থাকার কথা ছিলো। -মিশু মানে মধু বাউল? -মধু... বাউল... বুঝতে পারলাম না। -হে তো আফা বাউল মানুষ। দেশে দেশে ঘুইরা বেড়ায়। কুষ্টিয়া লালনের আখড়ায় পইরা থাকে দিন রাইত। লম্বা চুল লম্বা দাড়ি মধু বাউলের কথাই তো আফা কইতাছেন। -হ্যা মধু... - এক দুই মাস পর পর এই ইস্টিশনে আসে। দুই তিন দিন থাকে গান বাজনা করে। আবার চইলা যায়। কোন খবর থাকে না। হঠাৎ আবার মন চাইলে আসে। -আজকে আসবে বলে কি মনে হচ্ছে তোমার? -না আফা আইজ আইবো না। পরশুদিন আইসা আপনের কথা কইয়া গেছে। আপনে আসবেন। আর একটা চিঠি দিয়া গেছে আপনে আইলে আপনের হাতে দিতে কইছে। চিঠিটা হাতে তুলে দেয়। খামটা ছিড়ে চিঠি পড়তে পড়তে বেঞ্চে বসে পড়ে মাধু। শরীরটা অবশ হয়ে আসে মুহূর্তেই। মাধু তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে মিশুর নাম্বারে একটা কল দেয়। রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না। রাজু একটা ফোন হাতে নিয়ে বলে -আফা মধু ভায়ের নাম্বারে কল আসছে। -মধুর নাম্বারে তো আমিই কল দিয়েছে। মাধু বলে। -আফা মধু ভাই পরশু দিন যাওয়ার সময় এই ফোনটা আমারে দিয়া গেছে। বলছে সে আর ফোন ব্যাবহার করবো না। আর বলছে মোবাইল ফোন নাকি দুনিয়াদারীর মায়া বাড়ায়। আমারে সিমকার্ড সহ ফোনটা গিফট করছে।
মাধু বিমর্ষ হয়ে রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। একটা ট্রেন এসে থামে রেল স্টেশনে। শতশত মানুষের ভীড় মূহুর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় প্ল্যাটফর্ম। -আফা একটা কফি দেই? রাজু বলে। -না। -চা দেই? -না। -আচ্ছা আমি আসি। -আইচ্ছা আফা। আস্লামালাইকুম। -অয়ালাইকুম সালাম। -মধু ভাই যদি আসে কিছু কইতে হইবো মধু ভাইরে? -না কিছু বলতে হবে না। প্লাটফর্মের পথ ধরে হাটতে হাটতে ফিরে যায় মাধু। নীল শাড়ীর আঁচলটা বাতাসে উড়ছিলো। মাধু তার মিশুর জন্য মনে যা ধারণ করে রেখেছিলো তা আর প্রকাশ করা হলো না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক
কবির ভাই...সুন্দর গল্প..মন ভরে গেলো....2য় পর্বের বিষয়গুলো 1ম পর্বের চিঠিতে উল্লেখ থাকতে 2য় পর্বের গুরুত্বটা কম মনে হয়েছে...তৃতীয় প্যারার পুরোটাই টুইষ্ট...অপূর্ব ...শুভকামনা..
জলধারা মোহনা
জীবন এমন অপূর্ণতায় পূর্ণ কেন? কেন এই ছায়াপথেই এত এত বিষাদের রূপকথা। আমাদের এত ছোট একটা মায়াবী জীবন, তাতে এত বিষণ্ণতা কেন? মন হারানোর গল্প... দারুণ লেগেছে। আমার গল্পে আমন্ত্রণ রইলো :)
জীবন এক অপ্রকাশিত গল্পের নাম... আমরা যতোটা ধারণ করি তার কতোটাইবা প্রকাশ করতে পারি...? এভাবেই ক্রমে ক্রমে ব্যথার ভারে ভারাক্রান্ত এই গ্রহ.. এই মহাবিশ্ব... অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা চমৎকার মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকুন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।