একটি চিঠি ও কিছু কষ্ট

কষ্ট (জুন ২০১১)

সরল আহমেদ
  • ২৮
  • 0
রাতের শেষ ট্রেন। খুব একটা ভিড় ছিলনা। আসন খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলনা। পাশের সীটখানি খালি পড়ে রয়েছিল। ইচ্ছে করছিলোনা জানালার পাশে বসতে। আস্তে আস্তে শব্দ করে ট্রেন ছুটে চলল। জানালার অবহেলিত ফাঁক গুলো দিয়ে চাঁদের আলো খেলা করতে লাগল। চলন্ত ট্রেন থেকে চাঁদটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। জানালাটা খুলতেই পাশের সীটে আবিষ্কার করলাম একখানি কাগজের খাম। ভাবলাম হয়তো কারও কোন দরকারি কাগজ। চট করে খাম খানি খুলে পেললাম। তিন ভাঁজের একখানা চিঠি। স্পষ্ট অক্ষরের শব্দগুলোর অবস্থান বুজতে পারলাম কিন্তু আলো সল্পতার জন্য পড়ার যাচ্ছিলনা। চিঠি খানি না পড়ে থাকতে পারলাম না, নিজে গিয়েই কামরার বাতিটা জালালাম। দেখতে পেলাম আরও সাত আট জন মানুষের অবস্থান। সবার চোখে মুখে ঘুমের প্রস্তুতি। বাতিটা যে সবাইকে বিরক্ত করল তা আর বুজতে বাকি রইলনা। মুখ পুটে কেউ কিছু বললনা। চিঠির প্রাপক হল বেনু। প্রেরক এর নাম নেই, শুধু লেখা আছে “তোমারই অচেনা মানুষ যে তোমায় জানে সবচেয়ে বেশী”। তার খানিকটা নিচে আড়াআড়ি করে একটা সাক্ষর, নাম সম্ববত জয়নাল। পড়তে শুরু করলাম চিঠিখানি।

[ চিঠি ]

বেনু,

তুমি ভালো নেই আমি জানি। তোমার ভেতরটা যে আমি ছুঁতে পাই আমার হৃদয় দিয়ে। তোমার ধূসর চোখের প্রার্থনায় যে শুধু আমি ছিলাম, সে আমি ঠিকেই বুজতে পারি। এই একবিংশ শতাব্দীর ঊষা লগ্নে মনের লেনা দেনা যেখানে খুবেই সস্তা, অথচ আমরা একে অপর কে চাই, তাই বলতে পারিনি।

সেই কিশোর বয়সে নিজের অজান্তে মনের এক কোনে তোমায় নিয়ে সপ্ন বুনতে শুরু করেছে। চোখের ইশারায় আমি কিন্তু ঠিকই বুজিয়ে দিয়েছিলাম আমি তোমাকে কতখানি চাইতাম। একটা সময় পর আমি অদ্ভুত ভাবে বুজতে পারলাম, আমি যেনও তোমার অনুভুতি টুকু ছুঁতে পারি। যেদিন তুমি লাল জামা পরবে আমি কিরকম করে আগেই বুঝে ফেলতাম। তোমার মনে আছে কিনা আমি জানিনা, একদিন আমি বিশুদের পুকুর ঘাটে লিখে রেখেছিলাম আজ সে পড়বে একটা সবুজ জামা। আর তার সাথে রক্ত জবা অসম্বব মানাবে তাকে। দুটো জবা ফুলও রেখেছিলাম তার পাশে। তুমি সেদিন ঠিকেই সবুজ জামা পরেছিলে জবা ফুল গুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করে রেখেদিলে আগের জায়গায়। আমার রাখা ফুলগুলোর ঠাই হয়নি তোমার খোঁপায়। আর আমার ভাঙা তরীতে ঠাই হয়নি তোমার। তোমাকে একটি বার দেখার জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকতাম, অথচ আজ বহু দিন হল তোমায় দেখিনি। সেই কাক ডাকা ভোরটি নিশ্চয় তুমি মনে রেখেছ। সেইদিন তোমার ঐ হাসি ভোরের আলোর চেয়েও বেশী উজ্জল ছিল। সেইসব দিন আর কখন ফিরে আসবে না।

একটা সময়ে আমাদের ভালোলাগা গুলো আর মানুষের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। আমার খুব কাছের বন্ধু কায়সার কিংবা তোমার মামাতো ভাই শফিক এর হীনমন্যতা সত্যি সেইদিন অবিশ্বাস্য ছিল। জলিল, আব্বাস কিংবা আমার বড় কাকু একে একে সবাই হয়ে উঠল আমাদের পথের কাঁটা। ছামাদপুর থেকে বেলায়েত, হারুন আমাকে এসে শাসিয়ে গিয়েছিল। এইরকম আরও অনেক কিছু ঘটেছিল যা তুমি জানতেই পারনি। ভালো লাগাত আর যোগ বিয়োগ হিসেব করে হইনা। ভালো লাগা থেকে ভালবাসা। এই নির্মম সত্যটা যুগে যুগে অনেকে বুঝেনি, তারা কোনদিন বুঝবেওনা।

তুমি কেমন আছো এখন ? আমাকে কি মনে পড়ে তোমার ? যদি ভুলে যাও তাতেও কোন আক্ষেপ নেই। যেভাবে যেমন থাকনা কেন ভালো থেকো। আর আমার কথা, নাইবা জানলে কেমন আছি। কি হবে আর জেনে।

ইতি,
তোমারই অচেনা মানুষ
যে তোমায় জানে সবচেয়ে বেশী

------০------০-------০-------

সারাপথ শুধু বেনু আর জয়নাল এর কথাই ভাবলাম। বেনু কেমন আছে জয়নালও বা কোথায় আছে এখন ? চিঠিটা বেনুকি পেয়েছিল, নাকি পেয়েও অবেহেলিত করে ফেলল। এরই মাঝে পার হয়ে গেলো দুটো ষ্টেশন, সামনেই নেমে পড়ব আমি। হটাৎ মনে হল ট্রেন এর কামরায় কোথাও নেইত বেনু কিংবা জয়নাল। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম বেনু কেন কোন নারীর অবস্থান টুকু নেই, আর জয়নাল কি করে চিনব তাকে।

জীবন চলছিল জীবনের নিয়ম মেনে। মাঝে মাঝে তিন ভাঁজের চিঠিখানি পড়ি, আর ভাবি বেনু আর জয়নালকে নিয়ে। একবার ভেবেছিলাম ছামাদপুর এর খোঁজ করব, যাব সেখানে। বেলায়েত কিংবা হারুন এর যদি কোন সন্ধান মিলে। সময় সুযোগ আর হয়ে উঠলনা। প্রায় চার বছর পর গিয়েছিলাম এক তৈরি পোশাক কারখানার নিরীক্ষা প্রতিবেদন এর কাজে। কাগজ পত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ লাইন সুপারভাইসার এর সাক্ষর দেখে চমকে উঠলাম। বেগের ভেতর থেকে চিঠিখানি বের করে মিলিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, এইত সেই জয়নাল। জয়নাল এর সন্ধান মিলল। কারখানার পেছনের দিকে এক কোনে একচালা ঘরে জয়নাল এর বসত। দেখা করতে গেলাম তার সাথে। আমাকে দেখে খুব সাধারন একজনের মত করে উঠে দাড়িয়ে সালাম করল। চেয়ারটা টেনে বসলাম তাকেও বসার জন্য ইশারা করলাম। শুরুতে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে বেনু।
- কোন বেনু ?
চিঠিটা খুলে দেখালাম।
- আপনে ওকে বেনু বলে ডাকবেন না। ওর নাম বিনা।
- ও তাই। কেমন আছে বিনা।
- কেন জানতে চান আপনি ?
- আমি কি জানতে পারিনা ?
- না।
- বিনাকি চিঠিখানি পেয়েছিল ?
- জানিনা।
- আপনি কি বিরক্ত বোধ করছেন ?
- কেন জানতে চাইছেন ? কি হবে জেনে ? যদি বলি আমি কিছুই জানিনা।

আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমি ঊঠে পড়লাম। সারারাত ভাবলাম জয়নাল এর কথা গুলো। সকালবেলা গিয়ে জয়নাল সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। গত ছয় বছর যাবত চাকরি করছে। শ্রমিক থেকে শুরু করে আজ সুপারভাইসর। খবর নিয়ে জানলাম জয়নাল বিবাহিত। কুমিল্লার কংস নগরে গাঁয়ের বাড়িতে থাকে তার মা-বাবা, স্ত্রী। জয়নাল হাতে লিখা কিছু কাগজ দেখলাম। চিঠির লিখার সাথে কোন মিল নেই। মনে খটকা লাগল। চিঠির অনুভূতিটুকু কি জয়নালের নাকি শুধু বাকা সাক্ষরটাই শুধু জয়নালের ? আবার দেখা করতে গেলাম জয়নালের সাথে। আজ তাকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হল। সালাম দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করল।
- আছি ভালো। আপনি ?
- জী, ভালো আছি।
- আপনি খুব বিরক্ত না হলে কয়টা প্রশ্ন করতে পারি ?
- জী, করুন।
- চিঠির হাতের লিখাতো আপনার না।
- না, আমার নয়।
- আনুভুতি গুলোকি আপনার ?
- (অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি দিল) কি লাভ আপনের এইসব জেনে ? আপনি কি পারবেন বেনুর অচেনা মানুষকে ফিরিয়ে দিতে তার বেনুকে। আমাকে এইসব জিজ্ঞেস করে কোন লাভ নেই। আপনার মত বেনু আমার কাছেও এক অচেনা মানুষ।

চুপ করে রইলাম আমি। মাথাটা যেন শূন্য হয়ে গেল। জয়নালকে শেষ একটা প্রশ্ন করলাম। বেনু বলে কি আসলেই কেউ আছে ? উত্তরে জয়নাল বলল হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।

এইবার সত্যিকার অর্থে দ্বিধাবোধ জাগ্রত হল। বেনু বলে কি আসলে কেউ আছে ? আর যদি থেকেই থাকে সে কি জয়নালের বেনু নয় ? অনেকগুলো প্রশ্ন বাসা বাধল মনের ভেতর। বেনুর সত্যটা জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলাম। নিজের ভেতরে বেনুর জন্য ধীরে ধীরে কিছুটা কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। সত্যটা জানার জন্য ছুটে গেলাম জয়নালের গ্রামের বাড়ি। জয়নালের উদ্ভুত আচরণে যতটানা অবাক হলাম, তার চেয়ে বেশী অবাক হলাম তার বাড়ি গিয়ে। ঠিকানা মত সবার দেখা মিলল জয়নালের বাবা-মা, বউ-সন্তান এবং জয়নালের। কিন্তু এই এক অন্য জয়নাল। গাঁয়ের হাটের মুদি দোকানদার বউ-সন্তান নিয়ে সুখে থাকা এক অন্য জয়নাল। আমার জানা জয়নালের কোন হদিস কেউ দিতে পারেনি। অনেক খোঁজ করে বেনু কিংবা বিনার কোন অস্তিত্ব মিলল না। খুজে পাইনি কাইসার, সফিক, আব্বাস, জলিল নামের কোন চরিত্র। নতুন এক অন্ধকারের মুখোমুখি হলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম বিশুদের পুকুর ঘাট, যে একমাত্র সাক্ষী কিন্তু কিছুই বলতে পারবে না। তাহলে কে সেই জয়নাল। সে কি আসলেই বেনুর অচেনা মানুষটি ? বেনুকে খুঁজে পাওয়ার আর কোন উপায় আমার জানা নেই। একবার ভাবলাম জয়নালের মুখোমুখি হব আবার। পরে ভাবলাম কি লাভ, থাক জয়নাল তার নিজের মত করে এক অদ্ভুত অচেনা মানুষ হয়ে। আমিতো আর পারবনা বেনুর অচেনা মানুষকে ফিরিয়ে দিতে তার বেনুকে। আমার সঙ্গী হয়ে রইল তিন ভাঁজের একখানা চিঠি আর সত্যিকারের বেনু কিংবা বিনাকে না জানার কষ্টটুকু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সরল আহমেদ @ আখতার ভাই ~ জয়নাল কে নিয়ে লিখক নিজেই ধাঁধার মধ্যে আছে, আর এইটাও গল্পের একটা অংশ।
সরল আহমেদ ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য আর বানান ভুলের জন্য ক্ষমা চাই
AMINA ভালই লাগল।বানান অনেক ভুল।
খোরশেদুল আলম আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগলো, সেই সাথে শুভ কামনা।
মোঃ আক্তারুজ্জামান লেখক সিদ্ধ হস্ত! কিন্তু আমি জয়নাল কে নিয়ে গোলক ধাধায় পড়ে রইলাম..
সরল আহমেদ @ ঝরা ~ আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সরল আহমেদ @ ফয়সাল ভাই ~ গল্পের রহস্য সমাধানের উপায় আছে, লিখক শেষটুকু না জানার কষ্টটুকু নিজের ভেতর রেখে দিলেন। পাঠক নিজের মত করে রহস্য বের করবে কিংবা কষ্টটাই বেছে নিবে।
ঝরা অন্যরকম sundor
আবু ফয়সাল আহমেদ ছোট গল্পে রহস্য ভালো লাগে কিন্তু এমন রহস্য যেটা পাঠক ভেবে নিতে পারবে একটা সমাধান.কিন্তু নিশ্চিত না এমন কিছু. এই গল্পে রহস্য তা একটু বেশি হয়ে গেছে
সরল আহমেদ শিশির ও গমেজ ভাই, পাঠকের এই দুর্দিনের সময়ে আপনাদের ভাল মন্তব্য এর জন্য ধন্যবাদ। গল্পের পাঠকের যে এত সঙ্কট জানা ছিল না। নাকি আমার গল্পটাই ভাল হয়নি।

০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪