নিকষ আঁধার

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

আহমেদ রিফাত বাঁধন
  • 0
নিকষ আঁধার। কাপ্তাই লেকের ধারের সবচেয়ে উঁচু টিলার বসে জীবনের চূড়ান্ত একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আদনান। আর একধাপ পেরুলেই সে মুক্ত সকল বাঁধা হতে, কষ্ট হতে, সকল অপূর্ণতার হাত থেকে। অনেকদিন থেকেই সে এইদিনের এই মুহূর্তের অপেক্ষা করে এসেছে। অথচ কেন জানিনা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বৃদ্ধ বাবা মা আর বড় বোনের সিক্ত নয়ন যা ঠিক টিলার অন্ধকারের মত কালো আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ সবই তার কাছে অর্থহীন, অসম্পূর্ণ। নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে এগিয়ে যায় আলোর প্রত্যাশায়। আদৌ কি সে পেয়েছিল তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তি? কেন আজ তার জীবন টিলার এই আঁধারে হারিয়ে যেতে চাইছে? জানতে একটু পিছে ফিরে দেখতে হবে।
কুমিল্লায় বড় হওয়া সন্তান আদনান। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি খুব ঝোঁক। সরকারী ছাপোষা বেতনের কর্মচারী বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। বিনা চিকিৎসায় তার হত দরিদ্র মা যখন মারা গিয়েছিলেন তখনই তিনি মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, নিজের সন্তানকে ডাক্তার বানিয়ে মানুষের সেবা করাবেন। যাতে আর কোন ছেলেকে টাকার অভাবে নিজের মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখতে না হয়।কিন্তু জীবন কি সব আশা পূরণের সামর্থ্য মানুষকে দেয়? স্বপ্ন তো সবাই দেখে, কয়জন পারে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে?
বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই আদনান এসেছিলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। চোখে চিরচেনা গোল চশমায় যখন প্রথম সে প্রবেশ করেছিলো কলেজ ক্যাম্পাসে তখন তার আনন্দের হিমেল হাওয়ায় ভরে উঠেছিলো। কিন্তু কে না জানে বসন্তের হিমেল হাওয়ার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে কাল বৈশাখী।
কলেজের প্রথম কয়টা মাস ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। গানের সাথে তার যে আত্মিক সম্পর্ক সেখান থেকেই পরিচয় হয় নতুন কারো সাথে। যার মাঝে নিজেকে খুঁজতে গিয়েই সে হারিয়ে যায় রহস্যময়ী এক অতল আঁধারে।
১৬/০৪/২০০৮
সকালের অ্যানাটমি ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে নিয়ে বসে আছে ক্যাম্পাসের বটগাছের নিচে। আর অবসর আড্ডায় ওর গান হবেনা তা কি করে হয়। তাই সবার আবদারে গান গাইতে হল। গান শেষে সুমিত, শামীম, হিমেল একসাথে বলল, শালা তুই বস, এইসব বাদ দিয়া গান গাইলেই তো পারিস। হটাত একটা কণ্ঠ তাকে হারিয়ে নিয়ে গেলো নিজের জীবন থেকে ঠিক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। বাক্যটা ছিল, অসাধরণ, আপনি তো খুবই চমৎকার গান। আর একটা গান শোনাতে পারবেন? কোন কথা ব্যতিরেকে কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে থাকা, যেন এক অজানা রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া, বাস্তবতায় ফিরে গাইতে শুরু করলো মিফতাহ জামানের গান-
“চলেছি পথে অন্তহীন, শুধু এই আশায়,/ পথের শেষে রবে তুমি/ আমারই প্রতীক্ষায়।
দেখবে তোমাকে আমার দু’নয়ন/ক্লান্ত এ জীবন জুড়াবে তখন।
রাঙাবে তুমি ধূসর ভুবন/ কৃষ্ণচূড়ার ছোঁয়ায়।
গান শেষে সে বলল - আজ উঠি পরে আর একদিন আপনার গান শোনা হবে। By the way, I’m Adhora. 1st year. আসলে পরীক্ষার পর বাইরে গিয়েছিলাম বাপির surprise trip এ. তাই এতদিন পরে আসলাম কলেজে। ok, bye then. বলেই পিছু ফিরে হাটা ধরল। কিছুদূর এগিয়ে জিহ্বা কামড়ে ধরে পিছনে ফিরে বলল – sorry, আপনার নামটা তো জিজ্ঞাসাই করা হল না। Dont mind please. আদনাদ হাসতে হাসতে বলল। নাহ! mind করার কি আছে। আমি আদনাদ। ঐ একি মানে 1st year। এইতো আমার পরিচয়। আর দুজনেই 1st year তাই আপনি আপনি করাটা ঠিক মানাচ্ছে না, তো যদি তোমার সমস্যা না থাকে তাহলে তুমি চলতে পারে।
অধরা – oh! sure, why not. তাহলে চলবে না শুধু দৌড়বে। ok, আজ উঠি bye.
আদনান নিস্পলক ওর চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি সুন্দর ধুলোর আস্তরণে মৃদু ছন্দে পা ফেলে সবাইকে সম্মোহিত করে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। হয়তো ঐ কথাটাই ঠিক যারা সুন্দর তাদের সব কিছুই সুন্দর। শামীমের অট্টহাসি আর হিমেলের খোঁচায় ধ্যান ভাঙ্গে- কি মামা? বোমা ফাটা কিয়া? এর অর্থ আদনান ঠিকই বুঝেছে কিন্তু মুখে বলল – নাহ। আরে ধুর, বোম টোম কিছু না। মেয়েটা অনেক ধনী। কিন্তু দেখ কতো সহজে আমাদের সাথে বসে কথা বলল, মিশলো। মনেই করলো না আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাশ থেকে সুমিত বলল - আরে ধ্যাত! এই মেয়ের কথা মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় কর। অধরা তোর জীবনের আজীবন অধরাই থেকে যাবে। কখনো ওকে পাবিনা খামাখা সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আদনান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কষ্ট পেলেও এই আগুন নিয়েই যে তাকে খেলতে হবে, হতে হবে খিলাড়ি।
হায়! যদি সেদিনের সুমিতের কথাটা বুঝত তাহলে হয়তো তার বাবার স্বপ্নটাও আজ বেছে থাকতো, তার গানে গানে চারপাশ মুখরিত করে রাখত তার মিষ্টি গানের সুরগুলো। “নিয়তির পরিহাস” হয়তো একথাটা এজন্যই যে তার জন্য এটাই অনিবার্য ছিল।
যাই হোক মূল কথায় ফিরি, এভাবে প্রতিদিন কাটতে থাকে হাসি, কথা , গান আর আনন্দে। অধরার সাথে ওর গড়ে উঠা সম্পর্কের ধারা দেখে আদনানের কাছে সুমিতের কথাগুলো অর্থহীন মনে হয়েছিলো। আর তাই যখন দ্বিতীয়বার একি কথা সুমিত উচ্চারণ করেছিলো, ওকে দু’কথা শোনাতে বাঁধেনি আদনানের। অধরা সম্পর্কে কোন কথাই সে গ্রাহ্য করত না। মানতে চাইত না তার আর অধরার মাঝে রয়ে যাওয়া দেওয়ালটা। এভাবেই এক বছর কেটে গেলো। আদনান ঠিক করেছিলো প্রথম যেদিন তারা মিলেছিল সেদিনই সে অধরাকে তার মনের কথা বলবে, এতে যদি সে মেনে নিলো তো ভালো, আর না মানলে সে তার জীবন থেকে দূরে সরে যাবে, চিরদিনের জন্য।

১৬/০৪/২০০৯

অধরাকে আগে থেকেই ঐ বটগাছটার নিচে আসতে বলে আদনান। ঠিক ১১টায় অধরা এসে পৌছায়। অধরা এসেই ওকে জিজ্ঞাসা করে কেন হটাত এভাবে ডাকলো? আর পিছে যে হাতে লাল রঙের গোলাপটা লুকানো ছিল
সেটা দেখতে জোরাজুরি করে। অবশেষে আদনান ওকে লাল গোলাপটা ধরিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। জড়ানো কণ্ঠে বলে , “ অধরা তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল, কিন্তু কি করে বলব ঠিক বুঝতে পারছিনা।” অনেকটা বাংলা ছবির নায়কের মত অবস্থা। তখন অধরা বলে উঠে, “ যা বলতে চাও বল, না বলতে চাইলেও সমস্যা নেই। আজ আমি তোমাকে একটা গিফট দিবো। আজকেই প্রথম তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো না? সেই জন্য। নাও, একটা ডাইরি তোমার নিজের গানগুলো লেখার জন্য। আর হ্যাঁ একটা চিঠি আছে, কিন্তু শর্ত হল, আমাকে ভুল বুঝা যাবে না, আর আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করা যাবেনা। ” এই নাও বলে এগিয়ে দেয়। আদনান আস্তে করে হাত বাড়িয়ে নেয় ডাইরিটা অনেক সুন্দর আর অনেক দামী একটা ডাইরি, খুলতে গেলেই অধরা বাঁধা দিয়ে বলে, “ এখন না। আগে আমি চলে যাবো তারপর খুলে দেখবে। আর হ্যাঁ , প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝোনা। যাই হোক আমার সাথে থেকো, বন্ধু হয়ে, প্লিজ।” আসি বাই। বলেই উল্টা ঘুরে হাটা দেয় অধরা। ডাইরির প্রথম পাতাতেই একটি চিঠি পায় আদনান। অজানা ভয় আর শঙ্কা কাজ করে ওর ভিতরে না জানি কি আছে এই চিঠিতে। অধরার এভাবে চলে যাওয়া ঠিক বুঝতে পারছেনা কিসের জন্য কি লেখা আছে এতে? হিমেল বলল, “আরে ! মামা এতো চিন্তার কি আছে খোল না?” অনেক সাহস নিয়ে প্রথম ভাজটা খুলেই, চিঠিটা ছুড়ে ফেলে দিলো আদনান। তাতে লেখা ছিল,
আদনান,
সরি। তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো অসাধারণ ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে এই বন্ধুত্বটাকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, ক্ষমা করে দিও প্লিজ,.....................................
বাকিটা দেখার আর সাহস হয়নি তার। কিন্তু হিমেল লাফিয়ে গিয়ে চিঠিটা তুলে নেয়, নিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেলে পড়া শেষে, হা করে তাকিয়ে থাকে আদনানের দিকে। এই দেখে সুমিত বলে , “কিরে ? কি হইলো হা কইরা আসিস কেন? কিছু তো বল কি লেখা? ” কোন কথা না বলে চিঠিটা এগিয়ে দেয় সুমিতের দিকে হিমেল, এখনো যেন ওর ঘোর কাটছে না। একে একে সুমিত শামীম সবাই পড়ে চিঠিটা, তারপর শামীম আদনানকে বলে, “দোস্ত আগে পুরোটা তো পড় তারপর না হয় শোক করিস। তোর কপালে আসলেই দুঃখ আছে রে।” আদনান চমকে উঠে বলে, “মানে কি? ফাজলামি করিস না মনটাই খারাপ হয়ে গেছে।” শামীম বলে, “ধুর! গাধা ধর পুরোটা পড় মন এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে দেখিস।” বলেই মুচকি হাসতে থাকে। আদনান ছোঁ মেরে চিঠিটা ওর হাত থেকে নেয়, তারপর পড়তে শুরু করে,

আদনান,
সরি। তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো অসাধারণ ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে এই বন্ধুত্বটাকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
আমি জানি না কখন? কিভাবে? কেন এমন হল? আমি জানিনা কি করে আমি এই বিপদে পড়লাম? আমি জানিনা আমি কি দেখে কি বিচার করে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম? আসলে বিচারের প্রশ্নই বা আসছে কেন? ভালোবাসা তো হয় মন দিয়ে তাই না? হুম! তাই। আর আমার এই মনটা তোমাকে কি করে যেন ভালোবেসে ফেলেছে। আমার কি দোষ বল, আমি না হয়, চোখের পাতা বন্ধ করে, তোমাকে না দেখে থাকতে পারি, কানে তুলো দিয়ে তোমার কথা শোনা থেকে বিরত থাকতে পারি। মুখ দিয়ে তোমার কথা উচ্চারণ না করেও থাকতে পারি। কিন্তু মন? মন যে সারাক্ষণ শুধু তোমাকেই দেখে, মনের চোখে তো আর আমার হাত নেই। তাই ভুলতে পারিনা। আমার মন সারাক্ষণ তোমার গাওয়া গান গুনগুন করে গায়। আমি থামাতে পারি না। ওখানে যে আমার কোন ক্ষমতাই কাজ করে না। বল আমার কি দোষ? সব দোষ তোমার এইজন্যই আজ আমার এই বেহাল দশা। তোমারও কি একি অবস্থা? আমি জানিনা। কখনো কখনো তোমার চোখে ঐ জিনিসটা দেখলেও তাকে স্থায়ী হতে দেখিনি। তাই আজ ভয়ে ভয়েই এই চিঠিটা লিখলাম। প্লিজ রাগ করোনা। তুমি যদি আমাকে ভালো না বাস কোনই সমস্যা নেই। আমরা আগের মতোই বন্ধু হয়েই থাকবো সারাজীবন। শুধু তুমি আমার পাশ থেকে জীবনের জন্য চলে যেও না। অন্তত বন্ধু হয়ে থেকো।
আর আমি জানি তুমি কি ভাবছ? তোমার আর আমার মাঝের এই তফাৎ? তাই না? তবুও আদনান আমি তোমার সাথে জীবন পথে চলতে রাজি। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কোথা থেকে এসেছ? তোমার অতীত কি তা তো আমার দেখার নেই। আমি মানুষ আদনানকে দেখছি। চিনেছি। ভালোবেসেছি। তাই, বাকি জীবনটা তোমার সাথে চলতে আমার কোনই আপত্তি নেই। শুধু আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি চাই, তাহলেই আমার জীবনটা সার্থক হবে, আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।
আর আমাকে যদি সত্যি ভালো না বাসো ঐ যে বললাম প্লিজ বন্ধু হয়ে থেকো। আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি খুবই প্রয়োজন। তাই প্লিজ ভুল বুঝোনা।

তোমার
অধরা

অন্তত ১০বারের মত পড়া শেষে ছুটতে ছুটতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ক্যাম্পাসের খোলা মাঠের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ফোন করলো অধরাকে। কি বলবে ঠিক করে উঠতে পারছেনা। ওদিকে অধরাও ফোন ধরে নিশ্চুপ হয়ে আছে। কিছু সময়ের নীরবতা। অবশেষে মৌনতার অদৃশ্য দেওয়ালটা আদনানই ভাঙল। বলল, “ সরি, অধরা, আমি পারবোনা। আমি আসলেই পারবো না তোমাকে ছেড়ে বাঁচতে। কিন্তু ভয় ছিল যদি চিরতরে তোমাকে হারাই তাই বলতে পারিনি। আজ তুমি সব কত সহজে করে দিলে। I love you, Adhora, I love you, more than my life...”

তারপর???????
ভালোবাসা বাসি, কল্পনার জ্বাল বোনা। আর দিবানিশি স্বপনে বিভোর হয়ে সময়গুলো কি করে যে কেটে যাচ্ছিলো আদনান টেরই পেল না। অবশেষে এলো সেই দিন, ১বছর পূর্তি উপলক্ষে ঐ বটগাছটার নিচেই অপেক্ষা করছে আদনান, অধরা আসবে। আকাশটা সকাল থেকেই গোমড়া হয়ে আছে। তারিখ ১৬/৪/২০১০। মিনিট দশেক পর অধরা এলো। আজও সে একটা গিফট ধরিয়ে দিলো, একটা চকলেট বক্স। তারপর একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল, “পড়, তারপর আমার গাড়ির সামনে এসো। যদি কিছু প্রশ্ন করার থাকে।” আদনান, হতবাক হয়ে গেলো, আজিব মেয়ে না জানি কি আছে। আবার নিশ্চয়ই ভড়কে দিতেই এই কাজটা করেছে। চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো,

আদনান,
আমি জানি তুমি আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু আমি সরি। আমার কিছুই করার ছিল না। আমি জানি আমি তোমার জীবন আর তোমাকে নিয়ে অনেক খারাপ একটা কাজ করেছি এবং এ জন্য তুমি আমাকে সারা জীবন অভিশাপ দিবে। তাতেও আমার আপত্তি নেই। শুধু এটুকু তোমার কাছে দাবী তুমি সব কিছু ভুলে যাও। এতদিন আমি যা করেছি সবই অভিনয় ছিল। একটা চ্যালেঞ্জ বলতে পারো। আর আমি জিতেছি। আমি জানিনা তোমার কোন শত্রু আছে কিনা? তবে কেউ একজন আছে যে আমাকে দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিলো। ভালো থেকো আমি জানি তুমি অনেক ভালো ছেলে, তোমার বাবারও তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করো। ভালো থেকো। আর আমার সাথে কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না, প্লিজ, এটা তোমার ভালোর জন্যই।

বাই,
অধরা।
P.S. : (তুমি গান অসাধারণ গাও, কোন একদিন হয়তো তোমার গান শুনতে হবে, না চাইলেও। তবে আমি জানি আমি চাইলেও শুনাবে না। কিন্তু একটা শেষ অনুরোধ যদি কখনো কোনদিন তোমাকে অনুরোধ করতে হয়, প্লিজ একটা গান শুনিও। আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, কিন্তু তোমার গানগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছি। ভালো থেকো।)

এটা কি কোন ফাজলামি ? তাছাড়া আর কি হবে? হুম! আমাকে ভড়কে দিতে চাইছে। হাসতে হাসতে অধরার গাড়ির সামনে গেলো আদনান। এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। অধরা গাড়িতে ঢুকে বসলো। আদনানকে দেখে বলল, “ আর কি জানতে চাও? সব তো লিখেই দিয়েছি। আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, ভালোবাসি না আর কখনো বাসব বলেও মনে হয় না। এটা শুধুই একটা অভিনয় ছিল আর কিছুই না। একটা চ্যালেঞ্জ। আমি জিতে গেছি। থ্যাঙ্ক ইউ। বাই।” আদনান এবার ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ওকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, “মানে কি? এতদিন এতো কথা, এতো কিছু সব নিছক অভিনয়? মিথ্যা অনেক বলেছ। অনেক ফাজলামি হইছে। এখন আমার সত্যি খারাপ লাগছে। আর সহ্য হচ্ছে না এই ফাজলামি।” অধরা হেসে উঠলো, বলল, “ আরে পাগল, আমি কোন ফাজলামি করিনি, করছিও না। যা বলেছি এবং লিখেছি তার সবটাই সত্যি। ভালো থেকো।” বলেই ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলল, অধরা।

আজ খুব কাঁদতে মন চাইছে হাউ মাউ করে। কিন্তু সে পারছে না। আদনান চাইছে ওর চোখের জল দেখুক সবাই। সবাই জানুক ওর ভালোবাসা মিথ্যে নয়। অধরা এই চোখের জল দেখে হলেও যেন ফিরে আসে। কিন্তু না। বৃষ্টির পানি তা হতে দিলো না। ওর হৃদয়ের আঘাতে মুখে কোন শব্দ ফুটে উঠলো না। শুধুই কেঁদে গেলো কিন্তু কেউ জানল না কেন এই কান্না? কেন আজ এভাবে কষ্টে বেঁচে থাকা। মনে হয় এই লাফ ঐ কাপ্তাই লেকের উপর থেকে, ব্যস সব যন্ত্রণার অবসান। কিন্তু পারে না। মুখের সামনে ভেসে উঠে মা, বাবা আর ছোট বোনটার কথা। পারে না। বারবার চেষ্টা করেও পারেনা। ফিরে আসে সে। নিজেকে শক্ত করে। মনকে বোঝায় বাঁচতে হবে, বাবার জন্য, মায়ের জন্য তার আদরের ছোট বোনটার জন্য। কিন্তু হয়ে উঠে না।অধরার সাথে প্রত্যহ দেখা, আর সকলের টিটকারি আর কথা ভারে ঠিক থাকতে পারেনা আদনান। বার বার কানে বাজে অধরার শেষ কথাগুলো, “ আরে পাগল, আমি কোন ফাজলামি করিনি, করছিও না, যা বলেছি এবং লিখেছি সবটাই সত্যি।” প্রতিটি বার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে, তাড়িয়ে বেড়ায় একবার নয় বার বার।

০৪/১১/২০১০

কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপস্থাপনায় ছিল অধরা। আচমকাই, বিনা কোন, প্রস্তুতিতেই সে আদনানকে অনুরোধ করে একটা গান গাইবার জন্য। আদনান মঞ্চে উঠতে যাছে তখন ওর বন্ধুরা ওর হাত ধরে মানা করলে সে বলে, “ কথা দিয়েছিলাম, শেষ একটা গান শোনানোর অনুরোধটা রাখবো। তাই যেতেই হবে দোস্ত।” বলেই উঠে যায়, মঞ্চে। একটা গীটার চেয়ে নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে। তারপর বলে,
“উপস্থিত, ভাই বোন, বড় ছোট, আর সকল সহপাঠীরা, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের, আজ আমি যে গানটি গাইবো তা আমি মিস অধরাকে উৎসর্গ করলাম, তার সাথে দেখা না হলে হয়তো এই গানটার মর্মই বুঝতাম না। আর গানটি আমার জীবনের সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। আসলে সব মিস অধরারই কৃতিত্ব। আসলে আমি জানতাম অধরা আমার জীবনে অধরাই থাকবে, তবুও ছুটেছি, অচেনা আলেয়ার পিছে, মরীচিকার দেখে সত্যি ভেবেছি। তাকে আমি কোনই দোষারোপ করবো না। সব আমার দোষ , কারণ ভালো আমিই তাকে বেসেছি সে আমাকে নয়। তাই কষ্ট পেলেও তার দোষ নেই, খাল কেটে কুমিরটা আমিই এনেছি, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি। আজ যন্ত্রণাটাও আমাকেই সইতে হবে। যে যাক গে, গান গাইবো তবে তার আগে একটি ছোট্ট অনুরোধ, অধরাকে,” অধরার দিকে ফিরে বলে, তোমার অনুরোধ রাখলাম, আমার শেষ অনুরোধটা কি রাখবে ? আমি যখন গাইবো বরাবরের মতোই আমার পাশে এসে বসবে কি, প্লিজ?” অধরা এসে বসতেই গাইতে শুরু করলো-

অন্ধকার ঘরে কাগজের টুকরো ছিঁড়ে, কেটে যায় আমার সময়,
তুমি গেছ চলে, যাওনি বিস্মৃতির অতলে,যেমন শুকনো ফুল বইয়ের মাঝে রয়ে যায়।
রেখেছিলাম তোমায় আমার হৃদয় গভীরে, তবু চলে গেলে এই সাজানো বাগান ছেড়ে
আমি রয়েছি তোমার অপেক্ষায়।

নিকষ কালো এই আঁধারে, স্মৃতিরা সব খেলা করে,
রয় শুধু নির্জনতা, নির্জনতায় আমি একা।
একবার শুধু চোখ মেলো, দেখ আজ কত জ্বালি আলো
তুমি আবার আসবে ফিরে, বিশ্বাসটুকু দু’হাতে আঁকড়ে ধরে।

কিছু পুরনো গান, কিছু পুরনো ছবির অ্যালবাম,এসবই আমার সাথী হয়ে রয়,
কাক ডাকা ভোরে যখন সূর্য ঢোকে এ ঘরে, কালো পর্দায় বাঁধা পেয়ে সরে যায়।
আমার এই জগত বড় আগলে রাখে আমায়, তবু মাঝে মাঝে মনে হয়,
মৃত্যুই কি শ্রেয় নয় ? আমি রয়েছি তোমার অপেক্ষায়।

আমার সত্ত্বা আজ ধুলোয় মিশে যেতে চায়, অস্তিত্বের প্রয়োজনে
চাই তোমাকে এখানে, আমি রয়েছি তোমার অপেক্ষায়....................।

গান শেষে মাইকটা অফ করে, অধরাকে বলল, আদনান, “ অধরা, আমি আজও তোমার অপেক্ষায় আছি, জানি তুমি ফিরে আসবেই একদিন আর আমি অপেক্ষায় থাকবো, হয়তো মৃত্যুর পরেও ঐ স্বর্গদ্বারে তোমায় বরণ করার জন্য। এখনো আছি, তখনো থাকবো সবসময়ের জন্যই।” কিন্তু অধরার মুখের অভিব্যক্তি আর চোখের মাঝে এমন কিছু ছিল যা আদনানকে শেষবারের মত আশাহত করলো। সে মঞ্চ থেকে নেমে সোজা হাটা ধরল, তমসাচ্ছন্ন তিমির রাতের নিকষ আঁধারে। এরপর আর কেউ তার গান শোনেনি আর কেউ দেখেনি তার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। যখন সে ফিরে এসেছিলো তখন সে ছিল শুধুই অতীত। অধরা অতীত যা কখনোই ধরা যায়না।


০৪/১১/২০১০
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের দীপ্ত আকাশ থেকে খসে পড়লো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অথচ এতো দ্রুতই তার ঝরে পরার কথা ছিল না। এরপরেও কি অধরা বা অধরা নাম্নী মেয়েগুলোর হৃদয়ে কোন অনুভূতি নাড়া দেয়? জাগে কি কোন অপরাধ বোধ? উত্তরটা খুবই সহজ, হয়তো বা? নয়তো না। তাহলে শুধু শুধু কেন এই ছেলেগুলোর কাছে এই মেয়ে গুলোই প্রাধান্য পায়? কেন তাদের মনে এতটুকু প্রশ্ন জাগে না, যে পিতা তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করিয়েছেন। কাঁধে চড়িয়ে দেখিয়ে এনেছেন শক্রোশ দূরের মঠের মেলা, বিনা ক্লান্তিতে, কি করে তিনি আজ এই বৃদ্ধ বয়সে সেই কাঁধেই বইবেন তার সন্তানের খাটিয়ার ভার? যে মা ছোটবেলা থেকে খাইয়ে নাইয়ে বড় করেছেন কিকরে তিনি সেদিন চুলোয় আগুন জ্বালাবেন সেই সন্তানের শেষ গোসলের বড়ই পাতার পানি তৈরি করতে? কি করে? কোন উত্তর আছে কি??

দোষ তাদের একারই বা দেই কি করে? ভালোবাসা মহান, ভালোবেসে জীবন দেয়া মহান কর্ম। এই ধরণের সস্তা আর বস্তা পচা কথাগুলোর দ্বারাই যে এই যুব সমাজের মাথা নষ্ট করা হচ্ছে, তা কি কেউ বুঝতে পারছেন না??? ভালোবাসা মহান, অবশ্যই, তবে ভালোবাসার মত ভালোবাসা, সত্যিকারের ভালোবাসা। আর এই অধরাদের ভালোবাসার জন্য একটি কথাই ঠিক,
“চলে গেছ তাতে কি, নতুন একটা পেয়েছি,
তোমার চেয়ে অনেক সুন্দরী”

আমি জানি এই লেখা নিয়ে অনেক কাটা ছেড়া হবে। হবে পক্ষে বিপক্ষের অসংখ্য মন্তব্য। কিছু কিছু প্রেমিক প্রবর ও প্রেমিক যুগল আমাকে গালি দিয়েই “রাম নাম সাত্যে” করে ফেলবেন। তবে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন? আপনার বাবা হয়তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে পছন্দের জিনিসটি এনে দিতে পারেন নি, আমার মাও তেমনি হয়তো দু’বেলা দু’মুঠো পছন্দের খাবার পেট পুরে খেতে দিতে পারেন নি। তবুও জন্মের পরের সেই অসহায়ত্ব থেকে আজকের এই সবল আপনি পর্যন্ত কি আপনাকে ভালোবাসার ডোরে বেধে রাখেননি? আপনাকে জীবনের চেয়ে বেশী ভালোবেসে বড় করে তুলেছেন, গড়েছেন আপনাকে আজকের এই আপনিতে। তবে কি তাদের ভালোবাসা মহান না? উদার না? মহৎ না?
প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে যতবার এই সমাজের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছি, ততবারই চোখের সামনে নিকষ আঁধারে হারিয়ে যেতে দেখেছি আদনানের মত কিছু চেনা অচেনা মুখ, আর মস্তিষ্কের অক্সিজেনের প্রাচুর্যতায় আমার শরীর থেকে বের হয়েছে কেবলই কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ একটি কষ্টার্জিত দীর্ঘশ্বাস।

( গল্পে ব্যবহারিত গানটি পেপার রাইম ব্যান্ডের “ অন্ধকার ঘরে” শীর্ষক অ্যালবামের শীর্ষ সংগীত। আর গল্পটি একটি সত্য ঘটনার অবলম্বনে লেখা। আমার এক আপু যিনি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়েন তার এক সহপাঠীর জীবনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। )
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান বেশ আবেগ মাখানো কথামালা, ভাল লাগলো।
সূর্য "যখন সে ফিরে এসেছিলো তখন সে ছিল শুধুই অতীত। অধরা অতীত যা কখনোই ধরা যায়না" গল্পটা এখানেই শেষ করে দেয়া উচিৎ ছিল। সমাপ্তী টানায় সেটা লেখকের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করে। লেখককে এ থেকে মুক্ত হতে হয় । গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে।
এশরার লতিফ বেশ লাগলো। শুভেচ্ছা রইলো।
সালেহ মাহমুদ UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# গতানুগতিক গল্প। গল্প শেষে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অপ্রয়োজনীয়। তারপরও ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।

১১ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪