আমাদের ছোট গ্রামখানি যেন শান্তির এক মায়ানীড়। আর গ্রামকে আগলে বয়ে যাওয়া নদী যেন এক শান্তিদূত। এই নদী একসময় ভীষণ উত্তাল ছিল। তবুও এতে ভরসা করেই শ্রদ্ধেয় পিতামহ গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। সম্পদের পাহাড়ও গড়েছিলেন। হ্যাঁ, জমিদার ছিলেন তিনি। তৎকালীন ব্রিটিশ মহারাণীকে সন্তষ্ট করেও নিজের ভালই থাকত। আমার পিতাও সেই পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। আর তাই সন্তানকে বিলেতে পড়াবার স্বদিচ্ছাটাও তাঁরই। কিন্তু পিতার ক্রোধ আমার জেদ অপেক্ষা অগ্রগামী না হওয়ায় পরিস্থিতি এখনও ভারসাম্যপূর্ণ।
ঠিক এরকমই এক সময়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা এই শান্তিদূত হয়ে এক পরিবার এল। পরিবার এতই ছোট যে তা পরিবারের সংজ্ঞায় পড়ে না। এক পৌঢ় পালকপিতা আর তাঁর বালিকা তনয়া। এই পালকপিতার কিঞ্চিৎ অর্থ রয়েছে যা সে মেয়েকে দীক্ষা বাবদ ব্যয় করতে ইচ্ছুক। কোথায় মেয়ের জন্য বিয়ের আয়োজনে ব্যয় করবেন! তা না, করছেন শিক্ষাদীক্ষায়। সবাই একরূপে ধরেই নিল মেয়ে বুঝি বিধবা!
জমিদারী কাজে প্রচুর জনবল প্রয়োজন, তাই ভৃত্য পরিচয় পেতে সময় ক্ষেপণ হল না। কিন্তু কর্মসংস্থান হলেও পড়লেন আর এক সমস্যায়। মেয়েকে শিক্ষিত করবেন কিন্তু গ্রামে সেই শিক্ষক কই? পুরো গ্রামে সুশিক্ষিত ব্যক্তি সর্বসাকুল্যে একজন... আর সেই অধম আমি যে জমিদারপুত্র! পালকপিতা নিরুপায় হয়ে আমার পিতার নিকট বৃত্তান্ত পেশ করলেন। শুনে পিতা আমার বেজায় চটলেন। নিচু ঘরে পুত্রের প্রবেশ যে কোনভাবে বরদাস্ত করা যায় না। কিন্তু শ্রবণপূর্বক বিষয়টা নিজজ্ঞানে অবিচার মনে হল। তাই নিজস্ব তাগিদেই পিতার সম্মতি উদ্ধার করলাম।
ঘর ওদের দৃষ্টির অন্তরাল নয়। বরং আমাদের প্রাসাদোপম বাড়ির নিকটেই ক্ষুদ্র এক কুটিরে ওদের আগমন। কিন্তু জমিদারপুত্র পড়াবেন যে, তাই কুটিরে উপযুক্ত আসন প্রস্তুত রাখা হল। ভেবেছিলাম বালিকা বুঝি কৈশোরের প্রারম্ভে, ঘরে প্রবেশোত্তর দেখে বুঝলাম ওকে আর যাই বলা হোক... বালিকা সে নয়। বরং যৌবনের প্রান্তগুলো কানায় কানায় পূর্ণ। মাস্টার মশাইয়ের ন্যায় হাঁক দিব কি, শিষ্যের ন্যায় কুঁকড়ে গেলাম। চক্ষু তুলে তাকাব কি, উজ্জ্বল গৌড়মূর্তির সামনে অবনত হলাম।
মাসদুই এমনই গেল। জ্ঞানের দীক্ষা দিলাম বটে কিন্তু রূপের দীক্ষা থেকেও বঞ্চিত হলাম না। বরং নিজের প্রনয়াবিস্ট এক চঞ্চল মূর্তি আবিষ্কার করলাম। ব্যাকরণে মেয়েটার অভাবনীয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সামান্য কর্ণাভরণ দিতেও দ্বিধা বোধ করলাম না। এমনই যখন জোর শিক্ষাপর্ব অনুষ্ঠিতব্য, যথারীতি শিক্ষাদানে কুটিরে গিয়ে শুনি সে নাকি গৃহত্যাগ করেছে। জনে জনে অনেকের কাছেই খোঁজ নিলাম, সকলেই অপারগ। একপর্যায়ে ভীষণ মনপীড়ায় আক্রান্ত হলাম। যা পরবর্তীতে ক্রোধে রূপ নিল। গুরু হিসেবে তো বটেই... ভালোবাসার অবস্থান থেকেও তা চক্রবৃদ্ধি হল। গ্রাম, নদী সব সৌন্দর্য ধীরে ধীরে মলিন হতে লাগল। মাটির মায়া কাটিয়ে পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দিতে যখন মনে মনে বদ্ধপরিকর ঠিক এমনই সময়ে তার অনুপ্রবেশ। আর যা কিনা পত্রপাঠ ব্যতীত অনুভব করা প্রায় অসম্ভব।
প্রাণাধিক,
জীবনের প্রথম পত্রে নাম সম্বোধন করিতে পারিলাম না বলিয়া আপনজনের নিকট ক্ষমা চাইব কি, আপন অনুশোচনায় আপনি দগ্ধ হইতেছি। পরিচয় প্রকাশে অদৃষ্টের কালিমা যদি জীবনে লাগিয়া যায়! তাই সামান্য এই ছলনার আশ্রয় লইতেই হইল। আপনারা পুরুষজাতি, ইহা হয়ত তুচ্ছজ্ঞান হইবে; কিন্তু এক নারীর জীবনে ইহার যে কি চরমদর্শী পরিণতি হইতে পারে, তা বোধ করি একজন নারীই আন্দাজ করিতে পারিবে। সে যাহাই হইক, সঙ্গত কারণেই পত্র পাইয়া আপনি বিস্মিত হইয়াছেন আন্দাজ করিতেছি। ভাবিতেছেন দুরন্ত রেলগাড়িতে পত্রবাহক আবির্ভূত হইল কি উপায়ে! সুস্থির হউন, বৃত্তান্ত যে বড়ই জটিল!
পত্রসম্মুখে অগ্রসর হইবার পূর্বে আশঙ্কা করিতেছি আপনি এই অভাগিনীর প্রতি অতিশয় চটিয়াছেন। আপনার তৎক্ষণাৎ প্রস্থাণ পর্যালোচনায় ইহাই বুঝিতে পারিলাম। অভিমান না হইলে, আমার আগমন সংবাদ পাওয়া মাত্রই বা কেন আপনি শহর অভিমুখে যাত্রা করিবেন! না হয় বুঝিলাম যাইতেই হইবে, তাই বলিয়া ভ্রান্ত ধারণা লইয়া যাইবেন? উপলব্ধি করিলাম, এই ভ্রান্তি আমাকেই দূর করিতে হইবে। একইসঙ্গে বাড়তি দুটো পৃষ্ঠা পড়িতে যাত্রাপথে আপনার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিবে না তাহা একরূপে ধরিয়াই নিয়াছি।
উক্ত দিবশে আপনার হইতে দীক্ষা লইয়া যেই না বাহির হইয়াছি ওমনি বাড়ি হইতে সংবাদ পৌঁছাইল স্বয়ং পালকপিতা শয্যায় কাতরাইতেছেন। জানি না কি হইল, আর থাকিতে পারিলাম না। যাত্রার উদ্যোগ করিলাম। কিন্তু ভাগ্যদেবতার কঠিন হৃদয়, এই জগৎসংসারে ভ্রমণ যে কিছুতেই নারী সহায় নহে তাহাই মজ্জায় মজ্জায় অনুভব করিলাম। অবশেষে যখন পৌঁছাইলাম তখন বস্তুত সবই সাঙ্গ হইয়াছে। দেখিলাম পালকপিতার অধর জুড়িয়া রুধির ধারা জমাট বাধিয়াছে। লোকমুখে শুনিয়াছি পেটে পিলে হইয়াছিল। অবস্থাদৃষ্টে তথায় স্থবির হইয়া বসিয়া পড়িলাম। বুঝি জ্ঞানকাণ্ড লোপ পাইয়াছিল। সেই শ্রীহীন দুর্গতি অবলোকন করিয়া গ্রামবাসীও ছাড়িল না, যদিও উহাদের সহিত কোন প্রকার রক্তের সম্পর্ক ছিল বলিয়া আমার জানা নাই। অতঃপর দুটি মাস যে কিরূপে কাটিল বলিতে পারি না। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরিয়া পাইলাম। বিশ্বচরাচরে আপনাকেই প্রথম স্মরণ হইল। আপনাকেই আপনজন পরিগণিত হইল। মনে বাজিল শুধু আপনারই কণ্ঠধ্বনি। এক্ষনে একমাত্র গন্তব্য কি তাহাও বুঝিলাম। কিন্তু হায়, ভাগ্যের মন্দা বুঝি ইহারই নাম, পৌঁছাইয়াই হইলেন আপনি দৃষ্টির অন্তরাল!
স্বীকার করিতেছি আপনাকে না জানাইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিলাম কিছুকাল কিন্তু পালাইয়া যাইব কস্মিনকালেও ভাবিতে পারি না। তাছাড়া ফিরিয়া যে আসিলাম চিরতরে আপনারই জন্যে। ভাবিলাম বাড়িতে আশ্রয় না হউক, আত্মার হৃদয়ে ঠাঁই তো ঠিকই মিলিবে। জানি আপনাকে বহু ক্লেশ দিয়া পালকপিতার অন্বেষণে গিয়াছি। কিন্তু আপনিই বলিয়া দিন, অন্তর্যামী যাহাকে একাকী করিয়া পাঠাইয়াছেন, তাহার দুইকুলের একমাত্র পালকপিতা স্বর্গারোহণ করিলে তাহার কিরূপে শান্ত থাকা চলে? যদি ভাবিয়া থাকেন বানাইয়া বানাইয়া মিথ্যাচার করিতেছি তবে নিজ কর্ণে সত্যতা যাচাই করুন। ইহার পর মহাশয় যে প্রকার শাস্তিই ধার্য করিবেন, দেবতুল্য আদেশ বলিয়া মানিয়া লইব।
বলিতে পারি না এই পত্র আপনাকে প্রসন্ন করিয়াছে কি ক্লেশ বাড়াইয়াছে, ইহাও বলিতে পারি না এই পত্র আপনাকে ফিরাইয়া আনিতে পারিবে কি দূরে লইয়া যাইবে; তবে আপনার প্রত্যাবর্তন কালান্তরে শতাব্দী কিংবা মৃত্যুকে অতিক্রম করিলেও আমার যে ধৈর্য্যচ্যুতি হইবে না তাহা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন। ইহা ব্যতীত অনেক কথা লিখিব মনে ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু লোকটি তাগাদা দিতেছে। কালবিলম্বে রেলগাড়ি প্রস্থান করিবে যে! ফলে আপনাকেও যে হারাইতে হইবে! পত্র পৌঁছাইবার নিমিত্তে সদ্য পরিচিত লোকটিকে রাজি করাইতে বেগ পাইতে হইয়াছে বৈকি। স্বার্থ বিনা এই অবলার জন্য কে করিবে বলুন? তাই অর্থ-সম্পদ না থাকিলেও আপনা কর্তৃক যে স্বর্ণ নির্মিত কর্ণাভরণ পাইয়াছিলাম বিনিময়ে উহাই সে যথেষ্ট বলিয়া মানিয়া লইল। মনঃপীড়া লইবেন না দয়া করিয়া। যদি আপনাকেই না পাইলাম তো এই স্বর্ণের কিই বা মূল্য!
ইতি
আপনার বিশেষ ক্ষমাপ্রার্থী
পুনশ্চঃ সুগন্ধি অন্বেষণে কালবিলম্ব হইবে বিধায় সজীব কোমল গোলাপদল সংযুক্ত করিলাম।
পুনঃ পুনশ্চঃ শতচ্ছিন্ন না করিয়া পূর্ণ পত্রপাঠ করিয়াছেন বলিয়া কৃতজ্ঞ হইলাম।
০৭ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪