ঘটনার সময় আমার বয়স চার বছর, অথবা কিছু বেশি বা একটু কমও হতে পারে। যতটুকু শুনেছি, সেটা ছিল ভরা বর্ষার মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ের রাত। থেকে থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটা। কখনও ভুতুড়ে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমক। আকাশে চাঁদ ছিল কী ছিল না; থাকলেও আষাঢ়ের ঘনকাল মেঘে ঢাকা ছিল বলে সেটা ছিল নিকস-কাল রাত। সেসময় নিশ্চয় আমাদের কদমডালে ফুল ফুটেছিল। ফুলগুলো বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল নিশ্চয়। সারারাত কাক-পক্ষীর ছানারা ভিজে-কুড়ে পাখা ঝাপটিয়ে তাদের মায়ের কোলে আশ্রয় খুঁজছিল। শেষ রাতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। সারারাত বাবা কোথায় ছিলেন, কে জানে? কাক ডাকা ভোর পেরিয়ে বেলা তেতে উঠতে না উঠতে পাড়া-মহল্লায় চাঁই হয়ে গেল-‘বীণার মা লাপাত্তা’।
সেই সময় প্রায়ই নারী ও শিশু পাচারকারী দলের তৎপরতার কথা শোনা যেত। যারা দেশের অরাজকতাকে বড় সমস্যা মনে করে তারা ভাবে, দিন-কাল খুব খারাপ যাচ্ছে, বীণার মা’কে হাইজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে।
আমার নানার বাড়ির গ্রামে জায়গীর থাকা এক যুবকের সাথে বিয়ের আগে মা’র নাকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, বিয়ের পরও তাকে মাঝে-সাঁঝে এ গাঁয়ে দেখা যেতো। প্রায় একই সময় যুবকটিও নিরুদ্দেশ হয়। পাড়া-মহল্লার নিন্দুকেরা খুশি হয় তাদের রসদ ভারি হয় বলে।
আবার মেঘ-বৃষ্টির রাতে জেলে মাঝিদের কেউ দড়ি কলসি নিয়ে এক নারী-মূর্তিকে নদীর ঘাটের দিকে যেতে দেখেছিল। যুবককে নিয়ে মা-বাবা-র দাম্পত্য কলহের সীমা ছিল না। গ্রামবাসীদেও কেউ কেউ ভাবলো, নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেও ভেসে যেতে পারে। হতাশাগ্রস্তদের সমবেদনার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
আর বাবা স্কুল শিক্ষক আশরাফ হেসেন?
কিছুদিন যেতেই বাবা বিয়ের জন্যে হন্যে হলেন। কিন্তু কনে দেখে নানা অজুহাতে, একের পর এক সম্বন্ধ বাতিল হয়। এসময় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বোজে উঠে। যুদ্ধপরবর্তি বিধ্বস্ত দেশের ধ্বংস-স্তুপের নিচে বাবার সব আকাংখা বোধ হয় চাপা পড়ে। তদ্দিনে বাবার ‘বিয়ে পাগোল মাস্টার’ হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়ে।
আর আমি?
আমি পরিচিত হলাম কুলটার সন্তান হিসেবে।
একসময় কেন যেন বাবার অবস্থাও অনেকটা নদীর মত ভাঙ্গা গড়া আর পলি পড়ার দশা হয়। তিনি ‘বিয়ে পাগোল মাস্টার’ থেকে ‘স্কুল পাগোল মাস্টারে’ পরিণত হন। আমি হয়ে গেলাম মা পাগোল মেয়ে।
ঈশ্বর্দী থানার রূপপুর ইউনিয়নের পাকার মোড় থেকে মিনিট দশেক দক্ষিণে গেলেই আমদের বাড়ি। একটা সাজান গ্রামে অগোছাল বাড়ি। উত্তরে আম-কাঁঠালের বাগান। দক্ষিণটায় একখানা দোচালা ঘর, প্রায় অব্যবহৃত। পশ্চিমে এলামেলো ফুলবাগান। তার মাঝে বুড়ো কদমগাছটা এখনও আছে। অনেকটা মায়ের মত। বর্ষায় এখনও তাতে ফুল ফোটে। ঠিক তার নিচে একটা চৌচালা টিনের ঘর। তার দুটি খোপের একটিতে বাবা আর একটিতে আমি থাকি। মনে হয় মায়ের আঁচলের ছায়ায় আর তার গা’য়ের গন্ধে মিশে আছি। বাগানটার আরও পশ্চিমে ফসলের মাঠ। তারপর বিগত যৌবনা পদ্মা। পূবে বাড়ির গেটে ঢুকতেই অযতেœ লালিত জবাফুলের গাছ। উঠোনের এ ধারে এক কোনায় ছোট্ট নিচু হেসেল আর গরুর গোয়াল।
বাড়ির সদস্য মোটে দুই; আমি আর বাবা। আর একজন স্থায়িভাবে অস্থায়ি, খাজার মা; বাঁধা ঝি। দাদি; সদ্য স্থায়িভাবে সদস্যপদ হারিয়েছেন, আশ্রয় নিয়েছেন মাটির ঘরে। আর একজন? তার স্মৃতি আমার কাছে একেবারেই ফিকে, শূন্য বলাই ভাল। এমন কী তার একটা যেনতেন গোছের ছবিও কখনও দেখিনি। তবু সেই যেন আমার মনের ঘরে স্থায়ি বাসিন্দা।
বড় হতে হতে বাবার কাছ থেকে মায়ের কত কথাই না জানতে ইচ্ছে করত; চেয়েছিও। কিন্তু বাবা উত্তর করতেন না। অন্যমনোস্ক হয়ে জানালা দিয়ে কদম গাছটার দিকে চেয়ে থাকতেন। যেন মাকে দেখছেন। কখনও বলার মধ্যে বলতেন, বেহুদা বেশরম বেলহাজ। তখন বাবার দিকে তাকান যেত না। মুখ ফুলে যেত, গম্ভির হত। চোখ বড় বড় হত, কখনও রক্তাভ। বাবা অনেকবার গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছেন। কতবার পা’য়ে পড়েছি, বাবা কেট না।
মা’র কথা শুনেছি দাদির কাছে, শুয়ে শুয়ে গল্প শোনার ছলে। যখন বাবা থাকত না তখন। দাদী ব্যাথা এবং ঘৃণা নিয়ে বলতেন, এ কতা না যায় কওয়া না যায় সওয়া। সুংসারের মান সুন্মান সব লিয়ে গেলো, খালি তার রূপটাই তুমাক দিয়ে গেছে। মন খারাপ কইরো না বুনি যত খারাপই হোক মা মা-ই। পাড়া-প্রতিবেশি আর দাদির কাছে যা শুনেছি তার অস্পষ্ট ছবি অবসরে আমিও আঁকি। বোধ হয় আমিই একমাত্র হতভাগিনী যার মায়ের প্রতি চরম মমত্ব আর ঘৃণাবোধ রেল লাইনের মত সমান্তরাল হয়ে চলে। অথবা একইসাথে ভালবাসা আর যন্ত্রনা দু’টি বিপরীতমুখি টানায় পড়ে আমি ছিন্ন-ভিন্ন।
একে একে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের বারান্দায় তারপর ভার্সিটির চত্বরে পা রাখলাম। তারপর কর্মজীবনে। এক বর্ষায় মায়ের কাল্পনিক স্মৃতিগুলোকে পেছনে ফেলে বাড়ির গাছের একজোড়া কদমফুল হাতে নিয়ে চলে আসি নিলফামারির কিশোরগঞ্জে। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতার পদে যোগদান করি। মাত্র কয়েক দিনেই সয়ে যাওয়া পুরনো যন্ত্রনাগুলো আবার দগদগে হয়ে উঠে। নিয়মের খাঁচায় বন্দি হয়ে কেবলি ছটফট করি। যেন আমার কেউ নেই। কিছুই নেই...।
সারাদিন হাচরপাচর করে কাটিয়ে দিলেও রাত্রিগুলো এক নিঃসঙ্গ করুণ বীণার ঝংকার হয়ে উঠে। উপজেলা পরিষদের স্টাফ কোয়ার্টারের দক্ষিণের জানালায় বসে দুরের আঁধার নিস্তব্ধ গ্রাম আর ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে হয়তো খুঁজে ফিরতাম একটা কদমগাছ। কখনও একমনে চাঁদ বা তারার দিকে তাকিয়ে মায়ের ছবিটা মনে করার চেষ্টা করতাম। যখন কিছুই খুঁজে পেতাম না তখন কোন এক অস্থিরতায় মোহগ্রস্ত হয়ে চাঁদকেই লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি, মা! আমার মা! অথচ এইসব আফসোসে ভালবাসার সাথে অনেক ঘৃণা জড়িয়ে থাকত।
অফিসে মন বসে না। ঘরে দমবন্ধ হওয়া অস্থিরতা। প্রিয়জনহীন এক অনভ্যস্ত পরিবেশে অভিমানেরা দানা বেধে উঠে। সব গিয়ে জড় হয় কদম গাছটার আর বাবার উপর। তাই বাবাকে চিঠি লিখতে বার বার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছিল...।
প্রিয় বাবা,
তুমি একটা পাষাণ। তোমার সাথে কথাও বলবো না, চিঠিও লিখবো না। আমার মা নেই, কেউ নেই। আজ মা থাকলে কী আর আমার এমন অবস্থা হয়? তুমি অন্তত খাজার মাকে দিয়ে যেয়ো। রাত্রে অবশ্যই একটু দুধভাত খেও।
ইতি,
বীণা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আমার টেবিলে ফুলদানিতে একগোছা কদমফুল শোভা পাচ্ছিল। যেন মা আমার সাথে। অফিসে কাজের শেষ নেই। পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম আর মাঠকর্মীদের প্রশাসনিক কাজ। এসব কাজেও অভিমান অনুযোগ দানা বাঁধে। দেশের গলাবাজ রাজনীতিবিদরা স্বীকার করতে চায় না তাদের ব্যর্থতার দায়। সমাজ দিতে চায় না প্রেম-ভালবাসার স্বীকৃতি। এদেশে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাতৃমৃত্যু হার বা শিশুমৃত্যু হারের এমন কিছুই এসে যেত না যদি আতুর ঘরে মা মরে যেত অথবা আমি। অথবা আমার চোখের সামনে মা-র অস্বাভাবিক মৃত্যুর শোক একদিন চোখের পানি ক্ষয়ে ক্ষয়ে স্বাভাবিক করে নিতাম। এসব ভাবছি আর মাসিক অগ্রিম ভ্রমন কর্মসূচিটা দেখছি। চোখে পড়ে এক এনজিও ‘জাগ্রত মা’ এর নাম। ‘জাগ্রত মা’? মনের ভিতর মা’র একটা অচেনা ছবি ভেসে উঠে। ভেতরটা মুষরে উঠে। এতদিন পরে কোটি মানুষের মাঝে কোথায় আছে আমার মা? আজও খবরের কাগজ হাতে নিলে নিজের অজান্তেই কী যেন খুঁজি। কোথাও বেওয়রিশ মৃত নারী দেহ পাওয়া গেলে বুকটা খালি খালি লাগে। কেন কোন মায়ের দিকে চোখ পড়লে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে?
পুরনো অিিফস পিওন ফজর আলিকে ডেকে বললাম, ‘জাগ্রত মা’ এনজিও-টা কোন দিকে, এখনই আমাকে নিয়ে চল।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার শহরতলিতে সবুজ গাছ-পালায় ঘেরা বড় বড় কয়েকটা জীর্ণ ছাপরা ঘর ‘জাগ্রত মা’র কার্যালয়। মাঝে বড় একটা উঠোন, বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার। অবাক হলাম তার ঠিক মাঝে একটা কদমগাছ, তখনও ফুল ফুটে আছে। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা সেলায় মেশিনে কাপড় সেলায় করছে, কেউ নকশি কাঁথা সেলায় করছে, কেউ রঙিন কাপড় আর কাগজ কেটে ফুল বানাচ্ছে, পাটের আঁশ দিয়ে ফেন্সি ব্যাগ বানাচ্ছে, মাটির খেলনা পুতুল বানাচ্ছে আর শুকনোগুলোয় রঙ দিচ্ছে। এক কোনায় ছাপরায় বয়ষ্ক মেয়েরা শিশু শিক্ষা বই পড়ছে, কেউ কেউ লিখছে। অন্য একদিক শিশুরা লেখা-পড়া করছে। গাছে কদমফুল দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, সেখান থেকে পঁয়তাল্লিশের বেশি কাকলাশগোছের এক মহিলা ছুটে এলো, আমাকে বসতে দিল কদমগাছটার ছায়ায়। তার গা-য়ে হালকা প্রিন্টের কুঁচি দেয়া শাড়ি। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। মুখটা পোড়ামাটির রঙের। সে মুখে টেকটোনিক প্লেটে ঘর্ষণের ভুমিকম্প, নুহের প্লাবন অথবা ছিয়াত্তরের মনন্তরের ছাপ স্পষ্ট। ফ্যাল ফ্যাল করে একবার আমার দিক, একবার ফজর আলির দিক তাকায়। ভরাট মুখে ভাসা ভাসা বড় বড় চোখের নিচে কালি। তবুও মনে হয় সে চোখে ইলা মিত্রের অথবা বায়ান্ন বা একাত্তরের কী অদম্য উৎসাহ আর প্রত্যয়...।
মহিলার কঠোর-কোমল মুখে চাঁদের হাসি ছলকায়, বলি আসপেন না বাহে, সরি ম্যাডাম। সামনে কী দেই কন তো এলা? একটু পর নাড়– মুড়ি এলো। খেতে খেতে কথা হয়, উপজেলা অফিসোত নতুন জয়েন কচছেন ম্যাডাম, এটি আচচেন খুশি হইচি। কী দেখমেন? গরীপ এনজিও।
এনজিও-র নামটা সুন্দর। কী কী কাজ করেন? এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে প্রশ্ন করি। এরই মাঝে বাচ্চা আর বয়স্করা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। সবাই এনজিও প্রধানকে মা বলে সম্বোধন করছে। ব্যাপারটা খুব ভাল লাগল।
মায়ের মুখে হাসি ফুরায় না। কাম তিনট্যা। অসহায় মেয়েগুল্যান বিনি পয়সায় কাজ শেখে। কাজ শিখা শ্যাষ করি এটিও কাজ করবার পারে আবার নিজ স্বাধীন মত ব্যাপসা করি খাবার পারে। যারা এটি কাজ করে তারা পণ্য বেচা-বিক্রির লাভের ষাট ভাগ পায় আর চল্লিশ ভাগ পুরতিষ্টান পায়। বয়স্কো মেয়েগুল্যান বিনাপয়সায় লেখাপড়া শেখে। আর বার বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা যারা লেখা-পড়ায় আগ্রহী নয় তাদের চালাকি করি এটি আনি আগ্রহ সৃষ্টি করি দেওয়া হয় যাতে করি ইমরা ফির স্কুলে যাবার পারে।
বাচ্চাদের কিভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করেন? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।
এই কলা বিস্কুট চকলেট দেই, ফির নাস্তা নয়তো ভাতও দেই। খেলার জিনিসপত্র বল দাবা লুডু কেরাম পুতুল দেই। খাওয়ার লোভে, খেলার লোভে এটি আসি পড়ে। ভাল লেখা-পড়া করলে জামা-কাপড় কাপ-পিরিচ গেলাস বই পুরস্কার দেই।
অভিভুত হয়ে গেলাম। আমার নিজের কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না তবুও সরকারের গোলাম হয়ে তোতা পাখির মত বলে গেলাম, বড়ি কনডম ইনজেকশনের কথা...। লাইগেশন এন এস ভি-র কথা।
বিদায় বেলা মুখ ফসকে বলে ফেললাম, মা আসি। ফজর আলিকে বললাম, জাগ্রত মায়ের মা-কে সামনে ছুটির দিন বাসায় আসতে বলবা। আলাপ আছে।
ফজর আলি মাটির দিক তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে হাসে আর বলে, ঐ মহিলা একত্তরে যুদ্ধের সময় কী কী সব করছে। ম্যালা দুর্ণাম। সগে কয় এগুল্যা ঢাকি রাখার জন্যে নাকি এনজিও করে।
পরের শুক্রবার ছুটির দিন নাস্তা-পানি আর নিজ হাতে অনেক খাবার রেডি করে বসে আছি। এনজিও-র মা আসবে। অপেক্ষায় আছি। ঠিক নামাজের আগে ফজর আলি জানায়, আফা তার সাথে যোগাযোগ করবার পারি নাই। সে দিন দুই হয় ঢাকা গেইছে। ফির আজই আসপে। আফা তাঁই ফির মাঝে মাঝে ঢাকা যায়। এগল্যা নিয়েও ম্যালা দুর্ণাম।
পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল, ধমক দিলাম, চুপ কর। কাল রাতে আসতে বলবে।
আবারও সেই অপেক্ষার পালা একসময় অবসান হয়। রাতে ঠিক সময়েই মা এলো। নাস্তা দিয়ে ভাবছি কিভাবে শুরু করা যায়। আচমকা প্রশ্ন করি, আপনাকে কেন ডেকেছি জানেন?
সে চমকে আমার দিকে তাকায়।
আপনি আমার মায়ের মত। সবাই আপনাকে মা বলে। আমিও মা বলবো।
মা চুপ করে থাকে। অথচ তার অভিব্যক্তি বর্ণনাতীত। হয় তো তার ভেতরের মায়ের সত্বা টগবগ করছে অথবা কোন যন্ত্রনাদায়ক সুখ ক্ষত বিক্ষত করছে। একসময় সহজ হয়ে বলে, অন্যের মা হওয়া আর আপনার মা হওয়া এক?
বোধ হয় আমি কোন জ্বালায় জ্বলছিলাম তাই সুন্দর মুহূর্তটাকে তছনছ করে তাকে আঘাত করলাম, শুনলাম ঢাকা গিয়েছেন, তা কী কাজে জানতে পারি কী?
তার মুখ শুকনো, কোন কথা নাই। অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থাকতে দেখে আমার সন্দেহ আকাশ-পাতাল করতে থাকে। আবারও আকষ্মিক প্রশ্ন করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনাকে নিয়ে অনেক রটনা আছে। অবশ্য সেসব কী তার কিছুই জানি না। ভয় নেই আমাকে খুলে বলতে পারেন।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মা মাথা উচু করে। তার জলে ভরা দু’চোখ টকটক করছে। মনে হয় জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠে, সত্যিই শুনমেন? এগুল্যা কথার কোন পুরতিকার আছে? যখন একলা থাকি ডুকরি ডুকরি কাঁদি। কাইয়ো মোক চিনলো না। কাইয়ো মোর কথা শুনলো না। সত্যিই যুদি মোক মা মনে করি থাকেন সবই খুলি কইম। লজ্জা কিসের। তয় আজ না। আরেক দিন কইম...।
আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম, ঠিক আছে আরেক দিন শুনবো। আজ খাওয়া দাওয়া করেন। সামনে শুক্রবার সকাল সকাল চলে আসবেন, মা-বেটি মিলে অনেক মজা করবো।
মায়ের মুখে হাসি ফোটে। আমি টেবিলে কদমফুল সজিয়ে রেখেছিলাম। মনে হলো সেগুলোও হাসছে...।
শুক্রবারের আগেই মা এক রাতে আচমকা আমার বাসায় আসে। ভরাট মুখ আর প্রস্ফুটিত চোখে প্রথম দিনের দেখা সেই চাঁদপনা হাসি। অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমিও কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারি না। তার কথায় হুশ হয়, এক কাজ শেষ করি এদিক দিয়া যাওছি মনে হইল মেয়াটাক ফির দেখি যাই। কেমন আছেন ম্যাডাম?
এটা কী মেয়েকে সম্বোধন হলো? মাধুরীভরা হাসি দিয়ে বললাম।
আপনি উপজেলা অফিসার আর আমি সামান্য অশিক্ষিত এনজিও কর্মী। ফির আবার অপয়া নারী। খুব আপত্তি করলে মা কবার পারি। তাও সবার সামনে না। আর অনুরোধ করমেন না বাহে।
আচ্ছা ঠিক আছে। আগামী শুক্রবারের কথা মনে আছে তো?
থাকপার নই? আসিম বাহে, আসিম।
রাতে শুয়ে মা-র কথা ভাবি। তার গলার স্বর নিটোল। আড়বাঁশির মত সুরাল। এই স্বর শুনলে বোঝা যায় সবটুকু অন্তর থেকে আসে। মুখে অল্প কথা বললেও ঘন কালো পুরু পাপড়িঅলা চোখ দিয়ে অনেক অনেক কথা বলে। আয়নায় নিজের চোখ কতবার দেখেছি, সেকি আর গুনে বলা যায়। এতো মায়াবী চোখ আমার, ভাবাও যায় না। তবুও যেন অই মা-র চোখই বেশি করে দেখতে ইচ্ছা করে আর ভাবি, তার চোখ জোড়াই যেন নিখুত নিরেট দেখার মত। আমারটা নিছক চলনসই। ঠোঁট জোড়াও যেন তাই। আমি জানালায় বসে বর্ষার ভেজা হাওয়ায় হারিয়ে যাই..., পূর্ণপঞ্চদশির শুক্লাকে দেখি..., ভাবি..., কে বেশি সুরম্য, ঐ চাঁদ না মা...?
শুক্রবার সকাল দশটার দিক মা বাসায় আসে। হাতে লাউ কুমড়া ডাঁটার শাক আর এক জোড়া কদমফুল। দরজায় দাঁড়িয়েই বলে, আগ করমেন না। একনাও ফির কেনা নয়। মা নিজেকে আত্মরক্ষার একটা উপায় খোঁজে।
আমার উপচে পড়া হাসি যেন থামে না। তাতে সে যেন সমুহ বিপদ থেকে রক্ষার একটা উপায় খুঁজে পায়। আমাকে জড়িয়ে ধরে।
দুই প্রজন্মের দুই নারী রান্নার কজে সামিল হলাম। আজ আর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজে থেকেই সব উজার করে দেয়। যেন সে কোন সমান্তরাল সমগতির ¯্রােতের সন্ধান পেয়েছে। সে আবেগপ্রবন হয়ে বলতে থাকে, সব নষ্টের গোড়া শয়তান বছের। আজাকার বছের। যুদ্ধের আগে ডাকাত বছের হামাক জোর করি তুলি নিয়্যা সির্যারজগঞ্জের খারাপ পাড়ায় মাসির কাছে বেচি দেয়। বলতে না বলতে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেলে।
আশ্চর্য, তারপর!
ওটি হারাজাদি মাসি মোক তিন মাস বাঁন্দি রাখে। খালি ডাঙ্গাইতো, চমড়া ছুলি নবন লাগে দিত। খানা দ্যায় কোটে, জোর করি মদ খিলায়া আইতোত পুরুষ মানুষ ঘরোত ঢুকি দিত। এ্যার ভিতর দ্যাশে যুদ্ধু নাগি গেল। পাকিস্তানের মেলেটারিরা বাছি বাছি বেটিছাওয়া এটি থাকি নিয়্যা গেল। মোকও নিয়্যা গেল, সোদপুর মেলেটারির ক্যাম্পোত। ঐ শয়তান বছের মেলেটারির সাথোত হাত মিলায়্যা আজাকার হয়্যা এগল্যান কচ্চে। জানোয়ারগুল্যা নয়ডা মাস কী অত্যাচার নিজ্জাতন যে কচ্চে।
এসব কথা শুনে কোন মানুষ সুস্থ্য থাকতে পারে? আমার দম বন্ধ হবার দশা হয়। আমারই যা অবস্থা সুতরাং মা-র পরিস্থিতি কী হতে পারে অনুমান করে বললাম, থাক মা থাক। অন্য দিন শুনবো।
আমার লেখালেখির অভ্যেস খুব পুরনো নয়। উইনিভার্সিটি থেকে। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি মুক্তিযুদ্ধের উপর কিছু লিখব। চোখ থেকে ঘুম যেন কোথায় পালিয়েছে। আজ যদি নিজের মা কাছে থাকতো তার কোলে মাথা রেখে বলতাম, মা ঘুম আসছে না, একটা গল্প বল...। মা নিশ্চয় গল্প বলতো, রূপকথার গল্প। আমি ছোট্ট এক শিশু হয়ে যেতাম। মা-র কোলে মাথা রেখে গল্প শোনার অনুভুতি আমার আছে কী? থাকবে কী করে, সে তো আছে তার সুখের পায়রার সাথে। আমার অনন্তকালের ক্ষোভ দুঃখ ভালবাসা অভিমান আমার চোখের পানির সাথে বালিশে লুটোপুটি খায়...।
একদিন ছুটির দুপুরে ভাত ঘুম শেষে সোফায় বসে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ মা এসে এক চিলতে হেসে বলে, চুল খসখসা ক্যান মা? মাথায় ত্যাল দিয়্যা দেই?
এমন প্রস্তাবে আবেশিত হয়ে যাই। পত্রিকার পাতা থেকে চোখ ফেরাই, পোড়ামাটির রঙ সোনা রঙ হয়েছে, কাঁচা-পাকা চুল বাতাসে উড়ছে, স্বাস্থ্যের হালে পানি পেয়েছে, মনের পালে বাতাস লেগেছে। যেন আমার দেশের পতাকা আমার সামনে উড়ছে। মা-র এতো পরিবর্তন? তবে সে কি তার কোন আপন জনকে পেয়েছে...?
মা সারা বিকাল ধরে মাথায় তেল ঘষে। যেন এর কোন শেষ নেই। আমি যে কোন সুখের সাগরে ভেসে গিয়েছিলাম জানিনি, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আসতে দুটো বেণি হয়ে গেল; অদক্ষ হাতে লাল হলুদ সবুজ ফিতে দিয়ে! অয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখি, ঠিক যেন সবুজ-সাথী পড়–য়া বালিকা!
মা মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ডান পায়ের বুড়াআঙ্গুল দিয়ে মাটি কচলায়। লজ্জায় যেন সে মরে যায়। নিজে থেকে বলে, ছোল-পোল নাই বাহে। খারাপ হয়ছোল? ফির খুলি দেই?
কী বলছেন? এ্যাঁ, আমি কী আপনার খুকি নই...? মা-র চোখ ছেপে পানি আসে...। আমিও লুকিয়ে চোখের পাতা মুছি...।
তখন বর্ষাকাল শেষ হয়ে গেছে, অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছি; পথে ডাকপিয়ন একটা চিঠি দিয়ে গেল। বাবার চিঠি। মনে একটা কেমন দোলা দিতে থাকে Ñ
বীণা মা,
এই বুড়োটাকে এতো করিয়া কী সব আিভমান ঝারিয়াছিস।
একজন অকৃতজ্ঞের কথা নতুন করিয়া তুলিয়া পুরাতন ক্ষতে খোঁচা দিয়া অসহ্য করিয়া তুলিয়াছিস।
বিশটি বছর ধরিয়া চোখের পানি ফেলিয়া ঘা করিয়া ফেলিয়াছি। তুই কখনও আর এমন করিয়া লিখিবি না। বলিবি না। কাঁদিবি না।
ইতি,
তোর বাবা।
চিঠিতে যেমনটি উপদেশ ছিল না কাঁদার, ঠিক তার চেয়ে বেশি কেঁদেই আমার রাত কেটে গেল। পরদিন সকাল থেকেই আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শীত করে জ্বর এলো। মুখে রুচি নেই। ফজর আলিকে দিয়ে মা-কে আসার জন্যে খবর পাঠালাম। আমার অবস্থা দেখে মা সারাক্ষণ মুখ ভার করে থাকে, সারাদিন কিছু খায় না। কাছে আসে, গা’য়ে ¯েœহের হাত বুলায়, বাহে জ্বরত গাডা পুরি যাওছে!
নাওয়া খাওয়া ফেলে টানা সাত-আট রাত জেগে তার চোখে কালি পড়ে গেছে। মাথায় পানি ঢালা, কপালে পানি পট্টি দেওয়া, ঔষধ, পথ্যি, কোনটাতে একবিন্দু ত্রæটি নেই। কত করে বলি, থাক লাগবে না। কে কার কথা শোনে। মাঝে মাঝে জ্বরের ঘোরে অবচেতন হয়ে কী কী সব বলেছি জানি না। সেরে উঠার পর মা-র মুখে হাসি ফোটে। হাসতে হাসতে বলে, জ্বরত বেহুস হয়া কোলোত মুখ রাখি কত যে মোক কইনেন, মা, মাগো, আমার কদমগাছটা কই, মা... মা গো।
দূর্বল শরীর, আমার মাথাটা টলকাচ্ছিল। আস্তে করে এসে বারান্দায় বসি। বিকেলের কাঁচা হলুদ রোদ বারান্দায় এসে পড়েছে। সবুজমাঠে সোনারঙ আলো মেখে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। ভাবতে অবাক লাগে, ক্রিকেট আজ গ্রামও মাতিয়েছে। কোন যুগে যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরা বিশ্বকাপ নিয়ে আসবে? এখানেও অনেক পলিট্রিকস। মাঠের পাশে এক মহিলা গোবরের ঘুটে ভাঙছে। তার দু বছরের বাচ্চাটা পিঠে চড়ে দুলছে। তার হাতে কদমফুল। আরে! এ সময় কদমফুল? ভুল দেখছি না তো? ঠকাস! শব্দে হুস হয়। মা এসে কমলা আপেলের ট্রে সামনে রেখে বলে, মা কী দেখবার নাগছেন?
তাকে বলি, আচ্ছা শরতে কী কদমফুল ফোটে?
কী যে কন বাহে? মা মিটমিট করে হাসে...।
বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। আমি পরিবেশ আঁচ করার চেষ্টা করি। বুঝলাম সেটা অনুকুলে। তখন কথাটা এভাবে উপস্থাপন করি, মা মুক্তিযুদ্ধের উপর আমি বই লিখছি। তাই জনতে চাই যুদ্ধের কাহিনী। আমি শুনবো বলে অপেক্ষায় আছি। বলবেন না?
মায়ের ফর্সা মুখ লাল হয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করে। আঁচলে কপাল মুছে দীর্ঘশ্বাস নেয়, হ কইম। জানবার চাইছিল্যান না ঢাকা ক্যান যাই? হারামী বছেরক খুঁজি পাউছি। তাই ফির বনানীত থাকে। বড়লোক হইছে, শিল্পপতি হইছে। ওয়াদা কচছি ওক আমি শেষ দেখা দেখি ছারিম। ইমার জন্যে মুই সব হারাছি। সোদপুর ক্যাম্পোত মেলেটারিক সেবা কচছি, ইমার জন্যে।
বুঝলাম না। খুলে বলেন না।
সোদপুর মেলেটারি ক্যাম্পোত থাকাকালে ওটি এক বুইড়াব্যাটা বাজার করি রান্না-বান্না করি দিত। তাই একদিন মোক কইল, বেটি সগে মোক বিহারী মনে করে। মুই আসলে বাঙ্গালী। মিথ্যা ছাড়া বাঁচি থাকার কায়দা নাই। সগই যখন গেইছে তখন দেশের জন্যি জানটাও দেব। শোধ নিয়ে ছাড়িম। কায়দা করি চল।
মুই বুঝি নিছ। তারপর থাকি খুব সাজগোজ করি থাকি আর বিহারীর সাথে ভাব করি চলি। মাসখানেকের ভিতর আমার অবস্থান উপরে উঠি গেল। তখন ক্যাপ্টিন, লেপ্টিন্যান্ট, মেজররা পর্যন্ত মোর পিছনত ঘুরঘুর করতো। ইমার কাছ থাকি গোপন কথা মুই শুনি আসি আলাউদ্দিন চাচাক বলি দিত্যাম, চাচা গোপনে চিঠি লেখি মুক্তিবাহিনীর কাছোত পাচার করি দিত। মুক্তিরা গেরিলা ফাইট করি মেলেটারিক মারি ফালাইতো। যুদ্ধের প্রায় শেষের একদিনকার ঘটনা জীবনেও ভুলিবার নয়। মেলেটারির বড় বড় অফিসাররা আইতে এক আজাকারের বাগান বাড়িত দাওয়াত খাবার যাবে। ইমরা মোক আর আলাউদ্দিন চাচাক সঙ্গে নিয়ে গেল। চাচা পাক-শাক করবে, ইমরা মদ খাইবে আর মোক নিয়া ফুর্তি করবে। কর শয়তানের বাচ্চারা কর, জম্মের মত কর। ইমরা আইতে মদ খায়া ফুর্তি করি নিন পারবার ধচছে। গভীর আত। ওটি কারেন্ট আছলো না। হারিকেন জ্বালানোর ঢোপ ভরা কিরাসিন, সেটা নিয়া আমি আর চাচা ঘরের চারদিক ঢালি দিয়া অনেকখানি পথ কিরাসিন ঢালি ভিজি নিয়া গেল্যাম। তারপর ওটি ম্যাচ জ্বালে দিয়া পিট্টি দোড়। চোক-কান বন্দ করি কতক্ষণ দৌড়ি গেইছি ঠিক নাই। অনেক্ষণ শয়তানগুল্যার চিকরাচিকরি কানোত গেল, বন্দুকের গুলির আওয়াজ কানোত গেল। তারপর সব ঠাণ্ডা। সেদিন কম করি পাঁচ ছয়ডা খান মাচচি। ভোর হয়া গেল। গোপনে পালে নিলফামারির কিশোরগঞ্জ আসনু। ‘জাগ্রত মা’ এনজিও যেটি সেইট্যা চাচার ভিট্যা বাড়ি। বেশ কিছুদিন নুকি থাকনু। একদিন যুদ্ধ থামি গেল। চাচা মরি যাবার আগে বাড়ির দেড় বিঘ্যার বেশি জাগাসহ সব মাঠাম জমি মোক লেখি দিয়া যায়। যুদ্ধের পর আর এক যুদ্ধ। সে যুদ্ধ এলাইও থামে নাই। মানসের বাড়ি বাড়ি কাম করি পেট চালাই। কত মানুষ ষরযন্ত করি মোক বাড়ি ছাড়া করবার চাওছে। কত কষ্ট কচচি, মরি যাবার দশা হইচে, বাপের ভিট্যা ছারি নাই। এক মানুষ আর কতবার মরিবার পারে...?
থাক থাক, আর না। মা-র চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। চোখ লাল টকটক করছে, হঠাৎ হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
এসব শুনে শিউরে উঠছিলাম। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একটা চাপা ব্যাথায় বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। হায়রে বাংলাদেশ! মায়ের প্রসব বেদনায় সৃষ্ট সোনার বাংলাদেশ..।
এরপর থেকে অনেক দিন মা-র দেখা নাই। অফিসের ফাঁকে রাত-দিন খেটে যাচ্ছি সামনে বই মেলায় বইটা প্রকাশ করব। লিখতে যেয়ে কিডন্যাপের আগে মা-র স্বামী-সংসারের বিষয়টা নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম, একদিন মা-কে ডেকে বললাম, বসুন। আপনাার স্বামীর কথাটা জানা দরকার, বলুন তো।
ইমার কথা কী শুনমেন বাহে, তাইয়ো এক জালেম। বলেই মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্য ঘরে চলে গেল।
সেদিন আর লেখা হল না। নানা ভাবনা এসে মাথায় ভীড় করছিল। বাবাকে এক চিঠি লিখলাম Ñ
প্রিয় বাবা,
তুমি আজ পর্যন্ত এলে না। তবুও তোমার আশির্বাদ আমার পথকে প্রসস্থ করে দিয়েছে। আমি এক মা-র সন্ধান পেয়েছি। সবাই বলে, সে দেখতে নাকি অনেকটাই আমার মত। বিশ্বাস কর বাবা, তার জীবনটা এতো দুঃখের ভাষায় বর্ণনাতীত। স্বামীর ঘরেও সে নির্জাতিতা। সে বিরাঙ্গনা অথচ সহসী। না জেনে, না বুঝে, তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ভাবছি এক সময় ক্ষমা চেয়ে নেব।
পুণশ্চঃ তার জন্যে একখানা পাবনার তাঁতের শাড়ী নিয়ে আসবে।
ইতি,
বীণা।
তার কদিন পরই বাবার ফিরতি চিঠি পেলম।
মা বীণা,
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নতুন ভর্তি সম্পন্ন করিয়াছি। তোর মুখখানা দেখিবার জন্যে মনটা ছটফট করিতেছে। শিঘ্রয় আসিব। একটা কথা বলি বলি করিয়াও বলা হয় নাই। একটা ভাল পাত্রের সন্ধান পাইয়াছি; ছেলেটি ঈশ্বর্দী হাসপাতালের ডাক্তার। শুনিয়াছি এফসিপিএস করিতেছে। তোর ছবি দেখিয়া যাহার পর নাই পছন্দ করিয়াছে। তুই সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া মতামত দিলেই বিষয়টি চূড়ান্ত করিব। অবশ্য তোর নিজস্ব কোন পছন্দ থাকিলে, আমার বিশ্বাস কোন অবস্থাতে অমঙ্গলজনক হইবে না।
ভাল থাকিস।
ইতি বাবা।
কয়েকদিন পরের কথা। ছুটির দিনটা যেন অসহনীয় হয়ে উঠছিল। বই লেখার কাজ শেষ। সেটাতেই চোখ বুলাচ্ছিলাম। এক জায়গায় একটা খটাকা লাগে, মা-কে বছের রাজাকার কখন কোথা থেকে কিভাবে অপহরণ করেছিল, সেটা স্পষ্ট হলো না। তাকে ডেকে এনে বসালাম। এখন মা আর আগের মত ইতস্তত করে না, যা বলি মাথা নিচু করে ঝটপট উত্তর দেয়। বোঝা যায় সে এইসব অপশাক্তির বিরুদ্ধে আবারও যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত।
প্রশ্ন করতেই বলতে থাকে, এলাও কী শুনমেন বাহে। সেদিন আছলো ঝড়-বৃষ্টির আত। স্বামী ঘরোত আছলো না। ইমরা কী ঠিক মত ঘরোত থাকে? আইত বেশি নুয়োয়। পানি হওছে তো হওছেই। হঠাৎ করি গাবীন গাইখান দড়ি ছিঁড়ি ছুটি গেল নদীর দিক। ম্ইুয়ো দড়ি হাতে যাওছি ইমার পিছোন পিছোনত। হাঁকাও কোটে থাকি ডাকাইতের দল আসি মোর মুখখান বান্দি নাওয়োত তোলে। কয়দিন নাওয়োত রাখি শ্যাষে সিরাজগঞ্জ নিয়্যা য্যায়া বেচি দেয় মাসির কাছোত। ফির তোরা সগই জানেন।
মনের ভিতর এক চেনা সন্দেহ চাঁই করে উঠে, মা-র মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলি, দাঁড়ান দাঁড়ান, ওটা ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিল, মানে কদমফুল ফোটার সময়? আপনার স্পষ্ট মনে আছে?
কী কন বাহে মনোত থাকপার নাই?
তার চেহাড়ায় কোনই সংসয় খুঁজে পেলাম না আমি। আপনার স্বামীর দেশ কোথায়?
ক্যানে বাহে ঈশ্বর্দীর রূপপুর।
কীহ! রূপপুর? আমার চারদিক সহস্র গ্রেনেডের শেল ভাঙতে থাকে, চিৎকার করে বলি, আপনার স্বামীর নাম?
এগল্যান মানুষ নয়, নেমক হারাম, ফির নাম শুনি কী করমেন?
বলুন বলুন, দেরি করবেন না, বলুন...। মাথায় চক্কর দেয়, দ্রুত সোফার হাতল শক্ত করে ধরি।
হঠাৎ সেই সময় বাসার প্রধান ফটকের কড়া নাড়ার শব্দ হয়।
মা উঠে দাঁড়ায়, কাঁই আসিল? দেখি আসি।
পরে যান, আগে বলেন তার নাম কী, বলেন? আমার দম কষে আসতে থাকে। বুক চেপে ধরি।
কই এ্যালা, কাঁই আসিল দেখি আসি। বুক ভরা জিঘাংসায় মা যেতে যেতে বলে, আশরাফ হোসেন।
আশরাফ হোসেন! মুহূর্তে বুকের ভিতর বিশ হাজার টন টিএনটি-র একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়। আমি ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ি। গা কাঁপছে, মাথা শূন্য, দঁড়ানোর শক্তি নেই। তবুও শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে উঠে দেয়াল হাতরে মা-র পিছনে ছুটে যাই। মুখে কোন শব্দই বের হচ্ছে না, শুধু ঠোঁট নড়ে, মা..., মা..., মা...। মা-র পিছন ছুটে যেতে আমার কতক্ষণ লেগেছিল মনে নেই দেখি, ঘরের দরজা হাট করে খোলা। মা নেই। বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠে। সেখানে বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার চোখ টকটক করছে, যেন ঠিকরে বের হবে। মুখের আকৃতিতে ঘৃণাভাব স্পষ্ট। দাঁড়িয়ে কাঁপছে। অনেক কষ্টে বাবাকে শুধু বললাম, মা কোথায়? মা? তিনি দেখলেন আমার দু’চোখে পানির স্রোতে বয়ে যাচ্ছে। তবুও তার মুখে কথা নেই।
বাবাকে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, মা কোথায়? আমি আহত পাখির মত ছটফট করছিলাম, আরও আগে কেন মা-কে চিনতে পারলাম না?
বাবা একবার আমার দিকে এক কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর তার দৃষ্টি অন্য রকম হয়ে গেল। যেন তিনি আমাদের পুরনো কদম গাছটা খুঁজছেন।
এক ধককায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে বাবা রাস্তার দিকে ছুটে যায়।
বাবা যেও না, ও আমার মা...। আমার মা...। মা...।
কাণ্ড-জ্ঞানহীন কতক্ষণ তাদের পিছনে ছুটেছি, জানিনা। আশ-পাশে গ্রামের মেঠোপথে কোথাও কেউ নেই। হৃদপিণ্ডের প্রতিটি কাঁপুনিতে ধ্বনিত হতে থাকে মা..., তুমি আমার মা, তুমি বাংলার মা, তুমি এ জাতির মা...।
বাবাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। মাকেও না। অবশেষে ‘জাগ্রত মা’-র কার্যালয়ে এলাম। সেখানেও মা নেই। কেউ একজনকে বলতে শুনলাম, মা এইমাত্র ঢাকাগামী নাইট কোচে উঠেছে...।
হৃদয়ের শুন্যতা নিয়ে অন্ধকারে আবারও পথে নেমে এলাম। মধ্য ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতের আকাশে চকচকে চাঁদ ধূসর মেঘে ঢেকে যেতে যেতে পাণ্ডুর হয়ে গেল। সেই ঝাপসা আলোয় দেখা গেল, মেঠোপথের ধারে গোয়ালে একটি বাছুর বাঁটে মুখ লাগিয়ে নিবিষ্টচিত্তে দুধ পান করছে আর গাভীটি জিব দিয়ে বাছুরকে চেটে চেটে দিচ্ছে। হঠাৎ বাড়িঅলা এসে বাছুরটাকে শপাং-শপাং করে মারতে মারতে অন্য দিক নিয়ে গেল। বাচছুরটা হাম্বা হাম্বা করে গগনবিদারী চিৎকার দিতে থাকে...। গাভীটি সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়ি ছিঁড়ে ফেলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে...।