অভৌতিক

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

জি সি ভট্টাচার্য
‘কাকু, আজ আমাকে তুমি পূজোর বিষয় নিয়ে একটা গল্প বলবে?’ আমি অনুরোধ করলুম।

শুনে কাকু হেসে ফেলল। আর গুন গুন করে নিজের মনেই বলল-‘এক শাহনশাহ নে বনবাকে হসীঁ তাজমহল, সারি দুনিয়াকো, মুহব্বত কী নিশানী দী হ্যায়…’

এটা একটা প্রসিদ্ধ হিন্দী ফিলমের সংগীত। কিন্তু আমার গল্পের আবদারের সাথে এটার সম্বন্ধ কি? আমার কাকু ও না বেশ মজার ছেলে একট।

আমাদের ডিনার তখন সারা হয়ে গিয়েছিল। কাকুকে চুপ দেখে বললুম-‘ও কাকু…?’

কাকু আমাকে কুর্ণিশ করে বলল-‘যো হুকুম, আলমপনাহ…’

আমি খিল খিল করে হেসে ফেললুম কাকুর কান্ড দেখে।

তবে একটা পুরনো ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল আমার হঠাৎ। তাই জিজ্ঞাসা করলুম-‘ও কাকু, তুমি ও কি আজ শেষে ইব্রাহীম গাইড হ’লে না কী?’

‘নাঃ….জাহিরুদ্দিন মোহম্মদ বাবর….’

ঠিক এই নামটাই যেন বলেছিল সেই গাইড ও।

ঘটনাটা বেশ কিছুদিন আগেকার। তখন যে ছিল ঘোর গরম কাল, তা আমার বেশ মনে আছে। আর আমার বয়স তখন ছিল মনে হয় নয় কি দশ বছর। আমি যে চঞ্চল তা হয়তো আর বলতে হবে না। বাদল আমার নাম দিয়েছে পরীর দেশের রাজকুমার, আমি নাকি একটা খুব খুব সুন্দর ছেলে বলে। আমি অবশ্য ওই সমস্ত বাজে কথায় কান দিই না আর এখন এই তেরো বছর বয়সে।

দিল্লী থেকে ফিরছিলুম আমরা।

বাপীর একটা জরুরী কি কাজে সাহায্যের জন্য সে’খানে আমাদের যেতে হয়েছিল। আমাদের মানে কাকুকে ডেকেছিলো বাপী। তা কাকু তো আমাকে ছেড়ে কোথা ও যাবার ছেলেই নয়। তাই আমি সঙ্গে ছিলাম ফাউ হিসেবে।

তা আমার কাকু তো একটু বেশ অদ্ভূত ধরণের ছেলে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে নেমে পড়ল আগরাতে পোঁছেই এ০সী০ টু টিয়ার কোচের অমন সুন্দর ঠান্ডার আরাম ছেড়ে আর সেইসাথে বেনারস অবধি কাটা টিকিটের ও দফা গয়া করে। কি? না তাজমহল দেখতে হবে।

আমি বলেছিলুম—‘ও কাকু, সে তো শুনেছি যে লোকে দেখে সকালে বা পূর্ণিমার রাতে। এই দারুণ গরম দিনের ভর দুপুর বেলায় খাঁ খাঁ রোদ্দূরে কেউ আবার যায় না কী?’

তা কাকু বলে- ‘আমি তো তাই যাই। আমার যে সবই উল্টো, তার কি হবে? ভীড় ভাড় থেকে বাঁচতে হ’লে…’

‘ক্লোক রুমে জিনিষপত্র রেখে একটা টাঙ্গায় উঠে তখুনি দিলো কাকু রওনা। সত্যিই ভীড় ছিল না তখন তাজে। দু’ চার জন বিদেশী টুরিষ্ট, গাইড আর ফটোগ্রাফারের দল ঘুরছিল। আর মাত্র কয়েকজন দেশী দর্শক ও ছিল।

আমরা টিকিট নিয়ে আরামে ঢুকে পড়লুম। তখন ও আজকাল যেমন কড়াকড়ি সব নিয়ম হয়েছে তাজে, তেমনটি ছিল না। পৃথিবীর এই আশ্চর্য্যের দ্বার ছিল অবারিত সকলের জন্যই। তবে একজন গাইড অবশ্য আমাদের বলেছিল উল্টোকথা। তাজ না কী সবার জন্য নয়। এ হ’লো মুহব্বতের অন্য নাম। বেগম মুমতাজ মহল আর বাদশাহ শাহনশাহ শাহজহানের প্রেমের সৌধ। এখানে মুহব্বত যার দিলে নেই, তার প্রবেশ নিষেধ। অনিষ্টের সমূহ সম্ভাবনা ও থাকে। তেমন অনেককেই নাকি তাজ দেখে ফেরবার পথে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে। তা দু্র্ঘটনা তো যে কোন সময়ে হ’তেই পারে। তাজ দেখার সাথে তার আবার সম্বন্ধটা কি? যতো সব বাজে কথা।

বিশাল লাল প্রাচীরের গায়ে সুবিশাল সিংহদ্বার পার হয়ে ঢুকেই আমি তো হতবাক। সামনেই অনেকটা দূরে সুবিশাল শ্বেত মর্মর সৌধ। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে যেন জ্বলছে শ্বেত অট্টালিকা। আমার চোখে দামী সান গ্লাস থাকা সত্বেও চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে গেল। সত্যিই সে এক জ্বলন্ত শ্বেত সৌন্দর্য্য। সামনে সারি সারি ঝাউ গাছের মতন গাছে ঘেরা ফোয়ারার জলের পাশ দিয়ে লম্বা শ্বেত মর্মর পথ চলে গিয়েছে।…..

তাজমহল।

বিশ্বের সেরা অতুলনীয় সৌধ দেধে কাকু ও চুপ।

গোটাকয়েক সিঁড়ি নেমে মূল চত্বরে ঢুকতে হয়। আমরা গেট সংলগ্ন শ্বেত আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিলুম আর একজন বৃদ্ধ গাইড ও আপনিই জুটে গিয়েছিল সঙ্গে, কাকু মানা করা সত্ত্বে ও। মাত্র দু’শো টাকা তার দাবী। সব ঘুরিয়ে দেখাবে আর পুরো ইতিহাস ও শোনাবে সে। তা কাকু ও কিছুতে ইতিহাস শুনবেই না। বলে আমি ভূগোলের ছাত্র। ইতিহাস পছন্দ করি না। তা সে গাইড ও শুনবে না। মহা মুশ্কিল ব্যাপার।

এক দর্শক দম্পতী এসে দাঁড়ালো তখন আমাদের বাঁ পাশে। সঙ্গে একটি বছর দুই কি তিনেকের ছোট্ট ছেলে। ছেলের কথা ভূলে তারা ও অবাক হয়ে তখন সেই বিস্ময়কর সৌধের দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটা টলোমলো পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে খেয়াল খুশী মতন।

কাকু বলল-‘বাপু ইব্রাহীম, তুমি না হয় ওই ওদের কাছে যাও। গাইড করে অনেক বেশী দক্ষিণে পাবে। আমি হলুম গিয়ে এক কাঠ খোট্টা মানুষ। ও’সব ঐতিহাসিক মুহব্বতের আমি কি বুঝি? তুমি সরে পড়’।

তা সে কিছু বলবার আগেই ঘটলো এক অঘটন।

সেই বাচ্চাটা, সে হঠাৎ আমাদের কাছেই ডানদিকের সিঁড়ির কাছে গিয়ে হাজির হয়ে দিব্যি নীচে নামতে ও শুরু করলো আর তখনি কি ভাবে তার পা স্লিপ করতেই সে আছাড় খেয়ে পড়ে গড়গড়িয়ে গড়িয়ে গেল নীচের দিকে। সিঁড়ি অবশ্য সংখ্যায় খুব বেশী নয়। সাত আটটা হবে কিন্তু নীচের কঠিন মার্বেল চত্বরে গিয়ে সজোরে আছড়ে পড়লে ওইটুকুন বাচ্চার মাথা ফেটে যাওয়া খুব একটা অসম্ভব নয় মনে হ’লো। তবে বাহাদূর ছেলে বটে সে। একটু ও চীৎকার করলো না পড়ে গিয়ে। ফলে তার মা বাবা কেউ জানতে ও পারলো না ঘটনাটা। তাদের চোখ তাজের বিশাল আকার ও সৌন্দর্য্য দেখে স্থির তখন।

তা কাকু তো বলেই যে আমি না কী বাদলের সঙ্গে থেকে বেশ কিছু গুণ ও পেয়ে বসে আছি ছেলেটার। অনেক সময়েই কেউ যা দেখে না বা খেয়াল ও করে না আমি তাই দেখে ফেলি। আর দেখে চুপ করে থাকতেও পারি না তেমন কিছু ব্যাপার হ’লে। কি আর করি?

আমি ও তৎক্ষণাৎ দিলুম এক লাফ ডান দিকে। নির্ভূল লক্ষ্যে। সোজা একেবারে ঠিক সিঁড়ির নীচে গিয়ে পড়েই বসে পড়লুম লাফ মারবার ধাক্কাটা সামলাতে আর আমার দুধ সাদা হাতদু’টো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলুম। বাচ্চাটা তখনি এসে ছিটকে পড়লো আমার হাতের ওপরে আর আমি তাকে বুকে টেনে নিতে গিয়ে নিজে ও পেছন দিকে উল্টে পড়ে গেলুম, ছিটকে এসে পড়বার সময় তার পায়ের ধাক্কা লেগে। আমার সান গ্লাশটাও ছিটকে গেল একদিকে। বেশ একটু চোট ও লাগলো আমার পিঠে ও মাথায়। আমার হাত দু’টো ও দেখতে দেখতে একদম লাল হয়ে উঠলো। তবে তা গ্রাহ্য করলুম না আমি।।

তবে আমি বেশ বুঝতে পারলুম যে বাচ্চাটা খুব জোরে এসে পড়েছিল নীচে । মার্বেল চত্বরের ওপরে ওই বেগে গিয়ে আছড়ে পড়লে তার কচি মাথাটা যে আস্তো থাকতো না আর তা নির্ঘাৎ কথা। তা পরক্ষণেই আমি সান গ্লাসটা তুলে পরে তাকে নিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লুম আর তিন লাফে ওপরে উঠে এলুম। বাচ্ছাটা তখন ভয়ে ক্ষীণস্বরে কাঁদছিলো। তাই দেখে আমি তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাতে নিজের ক্যাডবেরিজটা গুঁজে দিলুম পকেট থেকে বার করে।

চকোলেট পেয়ে দেখি যে ছেলেটা দিব্যি করে সব কান্না ভূলে গেলো। বেশ মজা তো।

তবে পুরো ঘটনাটা ঘটলো প্রায় তিন চার সেকেন্ডের মধ্যে।
কাকু ছাড়া অন্য কেউ তেমন খেয়াল ও করলো না। বাচ্ছাটার মা বাবা তো নয়ই। তবে তাদের একটু পরেই খেয়াল হতেই ছেলে কোথায় গেছে তাই দেখতে নীচে নেমে ছুটলো আর তখনি হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সেই ইব্রাহীম মিঁয়া আমাকে বার বার কুর্ণিশ করতে করতে বিড় বিড় করে ওই নামটাই যে বলেছিলো তাও মনে পড়লো আমার।

বাচ্চাটার মা আর বাবা নীচেয় নেমে গিয়ে তখন ওপরে আমার কোলে ছেলেকে দেখতে পেলো আর তড়বড়িয়ে উঠে এলো আবার হাসিমুখে। আমি ছেলেটাকে দিয়ে দিলুম তার মায়ের কাছে তখনই; তবে ঘটনাটা আর কিছু বললুম না। কি দরকার? তারা তাজ চত্বরে নেমে গেল ছেলে নিয়ে।

সেই ইব্রাহীম আমাদের ও নিয়ে চললো।

সে পুরো তাজ আমাদের ঘুরিয়ে দেখালো। পেছনে যমুনা নদী ও দেখালো। আগে তাজমহল ছিল যমুনার মধ্যেই। শ্বেতপদ্মের মতন। এখন জল সরে গেছে। তাজের ইতিহাস ও সে শোনালো।

সিঁড়ি দিয়ে তাজের উঁচু চাতালে উঠে প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে প্রায় অন্ধকার করিডোরে নিয়ে গিয়ে প্রতিটি মার্বেল দেওয়ালের গায়ে সাদা প্ল্যাষ্টারের গোল গোল অনেক দাগ দেখালো যেখানে ঝকঝকে হাজার হাজার মণিমুক্তো ছিলো থালার মতো আকারে লাগানো, আলোর জন্য।

ইংরেজ লুঠেরারা তখনকার দিনের হিসেবে সেই কোটি কোটি টাকা দামের সব দুর্লভ হীরে, মণি, মুক্তো, পান্না, নীলা, পোখরাজ, মরকত এমন কি সোনা ও রুপোর পাতগুলো পর্যন্ত সব খুলে নিয়ে গেছে দেওয়াল ভেঙ্গে। শুধু তার নীচের পাথরে তৈরী করা নকশা, লেখা আর ডিজাইনগুলোই এখন পড়ে আছে। ফলে তাজের অতুলনীয় সেই ঝকঝকে চমক আর জ্যোতি হয়েছে লুপ্ত। সেই সব রত্নরাজি পড়ে আছে ইংরেজ রাজা -রাণী, লর্ড আর ভাইসরয়েদের কোষাগারে। আর সেই মুঘল চাঘতাই বংশের বাবরের বংশধরেরা নিরুপায়, নির্বাক হয়ে সেই লুন্ঠন দেখেছে। তাও সে অতি দুঃখের সঙ্গে বললো।

‘তাজ তো তখন যা তৈরী হয়েছিল, এখন তার কংকাল মাত্র অবশিষ্ট আছে। নেহাৎ অনেক চেষ্টা করে ও অতি কুশলী ইংরেজ ইঞ্জিনীয়ারেরা শ্বেত পাথরগুলো ও সব খুলে নিয়ে যেতে আর পারে নি তাই এই অবশেষটুকু মাত্র পড়ে আছে আজও। কি আর করবে বেচারারা? সিমেন্টে বা কংক্রীট ছাড়াই কি দিয়ে বা কি করে যে পাথরগুলো এমনভাবে অতি সূক্ষ্ম নকশা, লেখা ও ডিজাইন সমেত সেইযুগে জোড়া হয়েছিল যে একটি জোড়ের দাগ পর্যন্ত কোথাও নেই আর সেই জোড় আজ ও খোলা কঠিন, তা তারা না কী টানা দশ বছর ধরে নানা মেশিন দিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা ও রিসার্চ করে বা অন্য পাথর এনে সেইভাবে জোড়বার চেষ্টা করে ও কিছু বুঝে উঠতেই পারেনি। তাই শেষে হাল ছেড়ে দিতে হয়েছিল ব্রিটিশ সিংহকে যাদের রাজ্যে কখন ও সূর্য অস্ত যেতো না। এমনই তাদের পোড়া কপালের দুর্ভাগ্য’।

সেই গাইডই বলেছিলো যে শাহজহান ছিলেন সৌন্দর্যের উপাসক। খুব সংবেদনশীল বাদশাহ। তিনি আজ ও আছেন। মিথ্যা গুজব মনে করবেন না। তিনি পছন্দ করেন মিষ্টি ব্যবহার। নরম মনের দিলী মুহব্বত।
‘চলুন বাবু আপনাকে আসল কব্রগাহ দেখাই’।

‘সে দেখেছি তো’…

‘ও তো ওপরের নকল কবর দেখেছেন বাবুজী। সবাই এসে ওই দেখেই ফিরে যায় । কিন্তু ভেতরে নীচে আছে আসল কবর। তাজের মূল চত্বরে উঠে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হয় মূল কবর দেখতে হ’লে। সংকীর্ণ পথ। সাবধানে আসুন। একদম ওপরের মতনই নীচে ও আছে জোড়া কবর। সে’খানে সবার যেতে মানা হয়ে গেছে আজকাল’।

‘তবে ওই আসল কবর দু’টো যে কারুকার্য ও রঙিন মীনে করা আর হীরে মাণিক ও পান্না আর নীলা বসানো কয়েক মন ওজনের বিশাল সোনার পাত দু’টো দিয়ে মোড়া ছিলো, তা আজ আর নেই। তখন তো বিজলীবাতি ও হয়নি বাবুজী। তাই রত্নের আলোতেই দেখা যেতো তাজের এই কবর’।

‘আমি মুঘল বংশধর। আপনারা হিন্দু কিন্তু আপনার এই ছেলেটির মধ্যে বেগম মুমতাজ মহলের অপরূপ সৌন্দর্য আর আমাদের পূর্বপুরুষের ক্ষিপ্রতা আর নির্লোভ উদারতা আমি দেখতে পেয়েছি। যিনি বাদশাহ হয়ে ও এমনি ভাবে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না একটা সাধারণ বাচ্ছার জান বাঁচাতে। কথাটা আজ তক আমার ও ঠিক বিশ্বাস হ’তো না বাবুজী। মনে হ’তো সব বাজে ঝুঠি প্রসংশা। আজ আমার সেই ভূল ভেঙ্গে গেছে, বাবুজী। আপনারা আসুন। এইখানে দাঁড়িয়ে আপনি সাচ্চাভাবে যা দোয়া করবেন তাই পুরো হবে’।

‘তারপরে ওপরে উঠে এসে তাজের অলিন্দে একটু বসে দেখবেন কেমন সঙ্গমরমরের জাফরির মধ্যে দিয়ে বাইরের আগুন গরম হাওয়া এখন ও সুশীতল হয়ে বইছে। এই প্রাকৃতিক শীততাপনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থায় তাজের ভেতরে কোন গরম নেই। পাখা বা এ সী ছাড়াই তাজ এই গরমে আজ ও সুশীতল। এই হ’লো পরম আশ্চর্য বাবুজী..’।

তা আমরা সব দেখে মূল চত্বরের বাইরে সেই আঙিনায় উঠে এসে চানাচুর আর পেঠা কিনে খেয়ে কুলারের ঠান্ডা জল পান করে গাইডকে তিনশো টাকা জোর করে গছিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসি। সে আর তখন কিছুতেই নিতে চায় না টাকা।

সেই বলেছিল-‘আসলি মুহব্বত হুকুম করে না বাবুজী, করে অনুরোধ, ইম্তিহান নেয় না বাবুজী, দেয়, সব কুছ বিলিয়ে দেয়। মুহব্বত নেয় না দিয়ে দেয়। এ শুধু দু’জনের মধ্যেকার মুহব্বত নয় বাবুজী, সমস্ত দুনিয়ার, সমস্ত ইন্সানের প্রতি ইন্সানের মুহব্বত। শুধু বাইরের সৌন্দর্যের মোহে পড়ে কখন ও তাজমহল গড়া যায় না বাবুজী। দিলি সৌন্দর্য থাকা চাই। সে না থাকলে তাজে না আসাই ভালো। সহ্য হয় না। দুর্ঘটনা ঘটে যায়….. এ বড় কঠিন ঠাঁই। ….’।

সে কথা যাক। এখন আমি আবার বললুম-‘তা কাকু, তাজমহল থাক। এখন আমার গল্প কই’?

‘আমি তো কাকুর খুব আদরের ছেলে। আবদার করতে ছাড়বো কেন?’

কাকু আমার কথা শুনে হেসে ফেললো।

তারপরে বললো-‘আজ তো মহাসপ্তমী পূজো। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে দুর্গা ঠাকুর দেখতে গিয়ে তো আজ তুমি অনেক হেঁটে এসেছ, চঞ্চল। তোমার বেশ ঘুম পাচ্ছে এখন তো খেয়ে উঠে?’

আমি হাত নেড়ে বললুম--‘মোটেই না। …তুমি বলো, কাকু’।

‘বেশ। তা হ’লে জামা কাপড় ছেড়ে চলো বিছানার আশ্রয় নিয়ে নিই আমরা। তার পরে যদি ঘুম না আসে তখন গল্পই শুনো’।

তা কাকু যা বললো আমি ও তাই করলুম।

কাকু বিছানায় উঠে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ে আমার দুধের বরণ শরীরটা নিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ আদর করে নিয়ে তারপরে আমার আকর্ণ বিস্তৃত বড় বড় টানা টানা চোখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলতে শুরু করলো—‘চঞ্চল শোন………এই ঘটনার স্থান ---বিহারের এক গুরুর আশ্রম। কাল ---আজ থেকে অনেকদিন আগের। তখন ও কাতরাসগড় শহর হয়ে ওঠে নি। সে’বার ঠিক হ’লো যে আশ্রমে দূ্র্গাপূজো করা হবে প্রতিমা এনে। তা যেমন চাঁদা উঠলো সেই মতন একটি ছোট প্রতিমার অর্ডার ও দেওয়া হয়ে গেলো কাছের ছোট শহরের এক কারিগরকে’।

‘কিন্তু মুশ্কিল হ’লো পঞ্চমীর দিনে। প্রতিমার শিল্পী খবর পাঠিয়ে দিলো যে সে এক শেঠের জন্য বড় এক প্রতিমার অর্ডার নিয়ে ফেলে আর আশ্রমের জন্য ঠাকুর গড়তেই পারে নি। তাই অন্যত্র চেষ্টা করতে. হবে’।
‘শুনে আশ্রমের সকলের তো মাথায় হাত। শিষ্যেরা গিয়ে ধরে পড়লো-‘গুরুদেব, আপনি এর একটা বিহিত করুন…’

‘আমি বুড়ো হয়েছি, কি করতে পারি? তোমরা সবাই যা ভালো বোঝ, তাই কর’।

‘আপনি একবার চলুন, গুরুদেব। আপনি গিয়ে বললে সে না করতে পারবেই না’।

‘এই রোদ্দূরে, আমি?.তা যথা আজ্ঞা তোমাদের। আনো তোমার বাহন। দেখি, চলো যাই…’

প্রধান শিষ্য রবি বললো--‘গুরুদেব, ভ্যান রিক্সায় যেতে তো আপনার বড়ই কষ্ট হবে। সময় ও অনেকটাই লাগবে। আর আজ রবিবার বলে তাও মেলা কঠিন। আমি নিতীশের স্কুটারটা না হয় নিয়ে আসি…’।

কিন্তু প্রতিমা পাওয়া গেলো না অতো কষ্ট করে গিয়ে ও। কারিগরের সেই এক কথা।

অগত্যা দু’জনেই বেরিয়ে এলেন কর্মশালা থেকে হতাশ হয়ে।

গুরুদেব বললেন-‘কি আর করা? ঘটে পটেই সেরে ফেলো তোমরা এই বারের পূজোটাও…’

বিমর্শ হয়ে রইলো রবি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল কর্মশালার। নিজেই গিয়ে ধরলো ফোনটা প্রধান শিল্পী। অন্য সাহায্যকারী সবাই যে যার কাজ করতে লাগলো একমনে। দশজন কাজের লোক ও যোগানদার রেখে ও হিমশিম খাবার অবস্থা তখন।

কিন্তু দু’মিনিট কথা বলেই ফিরে এসে নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো সে।

ক্ষীণকন্ঠে ডাকলো--‘নিতাই…’

‘বলুন আজ্ঞা..’

‘তুমি গিয়ে ওই স্বামীজিকে একবার ডেকে আনো। হয়তো এখন ও চলে যান নি।‘
‘আনছি…’

‘এই যে ভাই, বলুন…’

‘আপনি প্রতিমা পাবেন গুরুজী। শেঠ সাহেবের হঠাৎ একটা কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। পূজোই হবে না হয়তো আর তাই অর্ডার ক্যানসেল। আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে গুরুজী………’

‘না ভাই। তোমার কিছুই ক্ষতি হবে না। চিন্তা নেই তোমার। ওই প্রতিমাখানাই তুমি না হয় আশ্রমে পাঠিয়ে দিও, তৈরী করে। বুঝলে। তুমি দাম পেয়ে যাবে। আর এখন অন্য নতুন করে প্রতিমা গড়বার মতন সময় ই বা কই? চলো হে রবি…আমরা এখন যাই…’

মহানন্দে রবি নামের শিষ্যটি স্কুটার স্টার্ট করে গুরুদেব উঠে বসতেই ক্লাচ ছেড়ে গিয়ার চালু করলো। কিন্তু বিধি বাম। অর্ধেক পথ পার হ’তে না হতেই ক্লাচ ওয়্যার ছিঁড়ে গাড়ী অচল হ’য়ে পড়লো। নামতে হ’লো দু’জনকেই এবং প্রখর রোদে রবিকে স্কুটার ঠেলে নিয়ে এগিয়ে যেতে হ’লো। সামনে তখন ও চার মাইল রাস্তা খাঁ খাঁ করছে পড়ে। আধ মাইল যেতেই রবির অস্তাচলে যাবার মতন অবস্থা হ’ল। গুরুজীর ও গলা বুক শুকিয়ে কাঠ। ঘামে নেয়ে গেলেন দু’জনেই।

হঠাৎ একজন লোক ছুটতে ছুটতে আসছে দেখা গেল সেই ভরা দুপুর বেলার নির্জন পথ দিয়ে। দেখতে লোকটা বেশ একটু অদ্ভূত। ধড়ের চেয়ে নিম্নাঙ্গ মানে কোমরের নীচের অংশ বেশ খাটো। গোল মুখ। কুতকুতে লাল লাল চোখ। হাত দু’টো রোমশ আর বেশ লম্বা। গায়ের রঙ ঘোর কালো। পরণে একটা ময়লা মতন নীল ট্রাউজার ও হলদেমতন হাওয়াই শার্ট। কিন্তু তার চেহারা বা বেশবাশের দিকে কারো নজর দেবার মতন অবস্থা নয় কারোই।

‘কি হয়েছে? কি হয়েছে, ও গুরুজী?’

‘তুমি কি মেকানিক, বাবা?’

‘না….কিন্তু আপনাদের কি গাড়ী বিগড়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ…। তা কাছে পিঠে কোন মেরামতির জন্য গ্যারাজ আছে কি না বলতে পারো, বাবা?’
‘না নেই। আর থাকলে ও লাভ ছিলো না কিছু’।

‘কেন বাবা?’

‘কেননা আজ রবিবার। সব মার্কেট বন্ধ.’

রবি বলে উঠলো-- ‘সর্বনাশ। আমার তো মনেই ছিলো না। কি হবে এখন তবে গুরুদেব?’

‘হবেটা আবার কি? অতো ভাবনা কিসের? আপনারা আমার সঙ্গে চলে আসুন সামনের ওই গলিতে…’ এই বলেই সে খাটো পায়ে খর খর করে খরগোশের মতন দৌড় দিলো। পেছন স্কুটার ঠেলে রবি আর নির্বাক গুরুদেব চললেন।

‘বসুন…..একটু এই গাছতলার বেদিতে আপনারা….’

তখন আবার কোথা থেকে উদয় হয়ে সেই লোকটা বললো।

‘আর এই নিন হাতপাখা আর এক লোটা জল। খানকতক বাতাসা ও আছে পাতার ঠোঙায়। জল খেয়ে একটু ঠান্ডা হয়ে বসুন। আমি মেকানিক ডেকে আনছি.’ বলেই সে আবার উধাও হয়ে গেল একদিকে দৌড়ে।

দশ মিনিটের মধ্যে সে একজন ঠিক ভিখিরির মতন দেখতে ছেঁড়াখোঁড়া পোষাক পরা লোককে সঙ্গে করে এনে হাজির হ’লো। সে নাকী মেকানিক। লোকটা শুধু চেয়ে দেখলো একবার গাড়িটাকে। ছুঁয়ে ও দেখলো না কিছু। তারপরে কেমন খোনাসুরে বললো-‘তিঁনটে পাঁর্টস লাগবে। একশোটা টাঁকা দিন দেখি.’

আবার নিজের মনেই সে বললো-‘না থাঁকলে বলবেঁন। আমিই কিঁনে আনবো পঁয়সা দিয়ে…’

রবি বললো--‘না না …আছে…এই যে নিন…’

‘বঁসুন, আমি আসছিঁ.’ বলেই মেকানিক হাওয়া।

ফিরলো বিশ মিনিট পরে ক’টা পার্টস আর যন্ত্রপাতি নিয়ে আর দক্ষ মেকানিকের মতন লেগে গেল নিজের কাজে। রবিবারে যে সে পার্টস পেলো কোথায় সে আর কে বলে।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই গাড়ী একদম তৈরী। মেকানিক এক রাউন্ড চক্কর ও দিয়ে এলো গাড়ী নিয়ে। টেস্ট রাইড সেরে।

‘নিন প্রভুঁ। গাড়ী তৈরী.’

‘কিন্তু.’

‘কোন কিন্তু নেই। ওর পয়সা মানে চার্জ ও পেয়ে যাবে। যান…প্রণাম গুরুজী.’

গুরুজী বললেন-‘ধন্যবাদ ভাই। চলো হে রবি। আর যেন আমাকে ত্যক্ত কোরো না। আর হ্যাঁ, আশ্রমের সামনের গেটটা তো পুরো তৈরী হয়নি এখন ও। রঙ ও হয় নি। দেওয়াল ও হবে পরে। বুদ্ধি করে যেন আবার প্রতিমা নিয়ে কাল আবার তুমি ওই গেট দিয়ে ঢুকতে যেও না। তোমরা করবে সব অকাজ আর তার ঠ্যালা সামলাবো আমি? এই বুড়ো বয়সে …হুম্….’

পরদিন ষষ্ঠী।

সন্ধ্যায় হবে দেবীরঅধিবাস ও বোধন।

দলে দলে আশ্রমের শিষ্যেরা সকাল থেকেই সপরিবারে আসতে শুরু করে দিয়েছে। অনেকেই নানান জিনিষপত্র সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। চাল ডাল আটা ময়দা ঘি তেল এমন কি কাঁচা আনাজপাতি পর্য্যন্ত।

গুরুদেব তখন নিজের একান্ত সাধন কুটিরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। রবি ও অন্য প্রধান শিষ্যের দল চারদিক সামলাচ্ছে উঠে পড়ে। যেন কোন ভূল ত্রুটি না হয়।

বিকেলেই গোটা পাঁচেক ভ্যান রিক্সা নিয়ে এসে সবাই ঢাক ঢোল বাজিয়ে প্রতিমা আনতে চললো। বিরাট বড় প্রতিমা হয়েছে তৈরী। এক ব্যারিষ্টার শিষ্য এসে ছিলেন। মিঃ দাশ। তিনি নিজেই পুরো পেমেন্ট করে নিয়ে চললেন ঠাকুর প্রসেশান করে। ঢাক ঢোল শাঁখ কাঁসি বাজিয়ে।
গেটের সামনে এসে তিনিই বললেন-‘বাঃ, এই নতুন গেটটার উদ্বোধন মা দুর্গাই করবেন আজ। ওই গেট দিয়ে নিয়ে চলো ঠাকুর’।

রবি আপত্তি করলো---‘না …না…গুরুজী বারণ….’

‘আরে রাখো তোমার না…..চলো সবাই…’

তখনি একটা কালো রোগা ছেলে একটা লম্বামতন বাঁশ হাতে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে হাজির হ’লো কোথা থেকে তা কে জানে। এবং সে এসেই সবাইকে বললো—‘একটুকুন দাঁড়ান, আগে এইটারে লাগায়ে দিই…’

‘অ্যাই, তুই আবার কে রে? আর কোথ্থেকে জোটালি এই বাঁশটা?’

‘আমি বিরু মুন্ডার ছেলে বটি হে। আমার বাপটো বললেক—‘ঠাকুরঠো পার কইরে দে গা। তাই এলোম…তবে তাড়াতাড়িতে বাঁশঠো ঠিক আনি লাই রে…ইটো থমকাবেক লাই….’

বলেই সে গেটের গায়ে বাঁশের মাথাটা ঠেকিয়ে দিয়ে দু’হাতে একলাই উঁচু করে তুলতে লাগলো ঠেলে। আশ্চর্য্য কান্ড….আর বাঁশটা ও দেখা গেলো যে লম্বায় একদম গেটের মাপেই ছিলো। ছেলেটা গেটের বাঁ পাশের দেওয়াল ঘেঁষে দ্রুত হাতে সেটা লাগিয়ে দিয়ে বললো –‘জল্দী….জল্দী কর রে তুরা.’….

তা তাড়াতাড়ি করে ঠাকুর নিয়ে আসা হ’লো ভেতরে আর ছেলেটা ও বাঁশটা ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরকে দালানে এনে তোলা আর বেদীতে বসানো দেখতে এলো এগিয়ে। সবে তখন প্রতিমা বসানো হয়েছে….ধড়াম…ধাঁই….দমাস করে বিকট এক শব্দে ভেঙে পড়লো সেই নতুন তৈরী উঁচু মজবুত গেটখানা আর সঙ্গে সঙ্গে ….চারদিকে ধূলো আর ধূলোয় ভরে গেল। তাড়াতাড়ি একটা কাপড় দিয়ে ঠাকুরকে ঢেকে দেওয়া হ’লো তবে সেই ছেলেটাকে আর কোথা ও দেখা গেলো না।

হৈ হৈ করে তিন দিন ধরে চললো পূজো। নবপত্রিকা তৈরী মানে প্রবেশ, স্নান, পূজো ভোগ আরতি সন্ধিপূজো সবই হ’লো। গুরুদেব হৈ চৈ থেকে দূরে নিজের সাধন কুটিরে থাকেন দিন ভোর আর সন্ধ্যার পরে বেরিয়ে এসে তখন মায়ের ভোগ আরতিটুকু শুধু দেখেন।

এলো দশমী। সকালে পূজো শুরু হয়েছে আর গুরুদেব ও নিজের কুটিরে ঢুকতে যাচ্ছেন হঠাৎ রবি দৌড়ে এসে তাঁর পা জড়িয়ে ধরলো।

‘গুরুদেব….বাঁচান.’

‘আঃ …পা ছাড়ো…ওঠো…আগে কি হয়েছে তাই বলো…’

‘সর্বনাশ হয়েছে গুরুদেব। মা রুষ্ট হয়েছেন মনে হয় পূজোয় তুষ্ট না হয়ে’।

‘সেটি খুবই সম্ভব। তোমরা যা কান্ড শুরু করেছো। যেটি আমি করতে বারণ করবো, সেইটি দেখি যে আগে করো তোমরা। তা তোমার ওই পূজুরী বামুনটিকে জোটালে কোথ্থেকে, শুনি?’

‘গুরুদেব…উনি তো অতি কুলীণ ব্রাহ্মণ। নাম প্রশান্ত মুখার্জী। পাশের গাঁয়ে…’

‘আঃ….ওটা তো ছিল ফিরিওয়ালা….দোকানে দোকানে বিস্কুট পাঁউরুটি ফিরি করে বেড়াতো…ওকে ফিরি পন্ডিত ও বলা চলে….ওটা চন্ডীপাঠ বা পূজোর কি জানে? দুর্গাপূজো হ’লো কলির রাজসূয় যজ্ঞ…এ কী সকলের জন্য…রে বাপু? তা হয়েছেটা কি তাই বলো এখন…’

‘মিঃ দাশ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন….মনে হয় স্ট্রোক…’

‘তা অবনী তো এসেছে। ও তো ডাক্তার। ওকে দেখতে বলো …একটু ঠিক মতন দেখে….ইঞ্জেকশানফান দিক যা দেবার…’

‘সবই দেওয়া হয়ে গেছে গুরুদেব……জ্ঞান ফেরেনি’

‘তবে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি কি করবো?’

‘গুরুদেব….ডাক্তার সময় দিয়েছেন আর মাত্র আধঘন্টা…….বড়জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট উনি বেঁচে আছেন……….মৃত্যু সুনিশ্চিত….আর আমাদের এখন ও পূজো ভোগ আরতী… পরের বছরের জন্য আমন্ত্রণ… বিসর্জন…শান্তির জল সব…সব বাকী যে।…সবই বন্ধ হয়ে যাবে গুরুদেব। বিকেলেই বা আমরা কি করবো বলুন? ঠাকুর নিয়ে বিসর্জন দিতে যাবো পুকুর ঘাটে না মড়া নিয়ে যাবো পোড়াতে। আশ্রমে এমনিতে ও বাসি মড়া রাখবার তো নিয়মই নেই। পূজো তো অসম্ভব। কেউ জল ও খেতে পারবে না। আর এতো এতো প্রসাদ ভোগ সব সব ফেলা যাবে। কাঙালী ভোজনের জন্য রান্না ও তো চড়ানো হয়ে গেছে। সেই সব আয়োজন ও পন্ড হবে। আমি যে কি করবো, তাই কিছু ঠিক করতে পারছি না এখন আর। আপনি এখন বাঁচান যে করে হোক, গুরুদেব.?’

‘আমি? আমি কি করবো? মৃত্যু কি আমার হাতে ধরা যে….যত্ত সব মহা আপদ আমার বরাতেই এসে জোটে দেখছি…………..’

‘দাশকে দূরে নিয়ে যাও পূজো মন্ডপ থেকে। আউটহাউসে… নিয়ে গিয়ে রাখো। পূজো যেমন চলছে চলুক…কিছু বলবার দরকার নেই বামুনকে ও…. আর আমাকে ডি ডি টি, গঙ্গাজল আর কীটনাশক লোশনের শিশিটা এনে দাও। আমি সাধন কুটিরে চললুম। আমি আজ আর বেরোবোই না। কেউ আমাকে যেন ভূলে ও এসে ডাকবে না। বিসর্জনটন যা পারো করো সব তোমরাই। আর হ্যাঁ…কাল ভোরের আগেই সব শিষ্যরা যেন আশ্রম ত্যাগ করে চলে যায়, যারা যারা সব এসেছে। বিজয়ার প্রণামের ও দরকার নেই। যাও….. .’

রবি জিনিষগুলো এনে দিয়ে ম্লানমুখে চলে গেল। গুরুদেব সাধন কুটিরের দরজা বন্ধ করলেন।

পূজো চলছে তখন ও তবে আর দশ বারো মিনিট পরেই সব বন্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক। মিঃ দাশকে আউটহাউসে মানে আশ্রমের পাঁচিলের পাশের গেটের রক্ষকের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন তাঁর শেষ অবস্থা। আর কোন ওষুধই কাজ করছে না। কোমাতে চলে গেছেন । কয়েক মিনিট পরেই সব ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি চলে গেলেন।

ডাক্তার বললো—‘সব শেষ। উনি মারা গেছেন। আর কিছুই করবার নেই আমার।
যাও …এইবার পূজো বন্ধ করিয়ে দাও, রবি’।

‘দশ মিনিট দেখুন আরও। হয়তো……….’

‘হয়তো আবার কি? আমি একজন ডাক্তার মানে রেজিষ্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার হয়ে সার্টিফাই করছি যে উনি মারা গেছেন আর….তারপর আবার কী? …’

‘ওই দেখুন উনি একটু যেন….মানে ওনার চোখের পাতা…..’
‘আরে বাবা….পাল্স..নেই…এই দেখো হার্ট বিট বন্ধ…গা ও ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে, আর তুমি মশ্করা করে সময় কাটাতে চাইছো…আশ্রমে মড়া রয়েছে আর পূজো ও হচ্ছে…ছিঃ…’

‘আপনি ভূল করছেন হয়তো। ভূল তো মানুষ মাত্রেরই হয় আর ডাক্তার ও যখন মানুষ তখন………..’।

‘কে বলেছে যে মানুষ?’ বলেই তিনি অ্যাত্তো বড় এক জিভ কেটে চুপ করলেন। আর তাঁর যেন মনে হ’লো তখনি যে সত্যি সত্যিই মড়ার একটা চোখের পাতা তির তির করে একবার কেঁপে উঠলো এক সেকেন্ডের জন্য.।

তিনি ঝুঁকে পড়লেন মৃতদেহের ওপরে। কই পাল্স কই? নেই তো। সব মনের ভূল। যাঃ…

আবার প্রতীক্ষা….

কয়েক মিনিট পরেই আবার সেই কম্পন………

এই চললো আধঘন্টা প্রায়। তারপরে সত্যিই খুঁজে পাওয়া গেলো ক্ষীণ নাড়ি। হ্যাঁ পাল্স ফিরে এসেছে। বাড়ছে হার্টবিট। তবে তো তিনি ডাক্তার হয়ে এক অসাধ্য সাধন করলেন আজ। ওষুধের জোরে মরা মানুষটাকে বাঁচিয়ে তুললেন। ভাগ্যিস সময় মতন ঠিক করে ওষুধগুলো দিয়েছিলেন ফল হবার কোনই আশা নেই তা বুঝতে পেরেও।

আত্মীয় পরিজনেরা কান্না থামালেন সবাই।

আরো একঘন্টা পরে উঠে বসলেন মিঃ দাশ। আর কি? আনন্দের ঢেউ উঠলো চারদিকে। ও’দিকে তখন ঠাকুরের বিসর্জনের মন্ত্র পড়া শুরু হয়েছে।

হৈ হৈ করে বিকেলে সবাই ভোগ প্রসাদ খেয়ে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য বাজনা বাদ্যি আর বাজি পটকা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফিরতে রাত দশটা।

তখন বিজয়ার প্রণাম আলিঙ্গন মিষ্টিমুখ চললো রাত বারোটা অবধি। সেই উৎসবেতে সবাই ছিলেন এক গুরুদেব ছাড়া। তিনি তখন ও তাঁর সাধন কুটিরে।

গুরুদেবের আদেশ শোনালো তখন রবি।

সে কী? এখনি যেতে হবে? গুরুপ্রণামের কি হবে?’

‘দরকার নেই তার আর। গুরুর আদেশ।.’

সবাই বিমর্শমুখে উদ্দ্যেশে প্রণাম করে প্রণামী রেখে যে যার জিনিষপত্র গুছিয়ে নিতে বসলেন। অনেকগুলো ভ্যান রিক্সা ঠিক করাই ছিলো। সবাই উঠে পড়লেন। মিঃ দাশ ও সপরিবারে চলে গেলেন। আশ্রম ফাঁকা হয়ে গেল।

রবি ছুটলো তখন গুরুদেবের সাধন কুটিরের দরজায়। পড়ে রইলো সেইখানেই সে চুপচাপ বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে।

গুরুদেব বাইরে এলেন অনেকখানি বেলা করে। দেখা গেল যে তখন সামান্য কাঁপছেন তিনি।

রবি তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একগ্লাশ শরবৎ নিয়ে এলো।

শরবৎ পান করে গুরুদেব ধীরে ধীরে বললেন-‘রবি, আমার শরীর খুব অসুস্থ। আমি এখন অনেকদিন ভুগবো তা বুঝতেই পারছি। কি করবো? উপায় নেই। প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করেছি পূজো বাঁচাতে গিয়ে কয়েকবার’।

‘তাও তো শেষ রক্ষা হ’লো না। যেমন এক পন্ডিত এনেছিলে তেমনি আমার ওই শিষ্য। হেন অন্যায় কাজ নেই যা ও করেনি বা করতে পারে না। ব্যারিষ্টার? হুঁ……দু’টোই যাবে। পূজো করতে এসেছে? বিশ্বমাতার পূজো করলেই হ’লো? জ্ঞানগম্যি তো নেইই, মনে একটু ভয় নেই, ভক্তি নেই, ভালোবাসা…………কিছুই তো নেই’।

‘ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মালেই বুঝি সে পন্ডিত হয়? পুরোহিত হয়? ছ্যাঃ……….আমন্ত্রনের মন্ত্রটুকু তো ও বলতে বা লিখতে জানে না। দেখ গিয়ে কি লিখেছে ভূর্জপত্রে? আর হবে না পূজো এই আশ্রমে। বলে দিলুম আমি আজ তোমাকে। দুর্গা পূজো সবার জন্য নয় হে। এ’হচ্ছে শক্তির উপাসনা। শক্তিহীনের জন্য নয়। হৃদয়হীনের জন্যে তো মোটেই নয়। মনে ভক্তি আর জীবে প্রেমই হচ্ছে পূজোর মন্ত্র। এইজন্য মায়ের প্রসাদ নিতে যে আসবে তাকেই দিতে হয়। সবাইকার যে মা, সে কি একলা খায় কখনো?
হুঁ, দুর্গাপূজো করলেই হ’লো? যত্ত সব………… ’

‘তারপর, কাকু?’ আমি জানতে চাইলুম সাগ্রহে।

কাকু বললো---‘তারপরে আর কিছু নেই রে, ভাই। আমি তো দেখি যে ওই তাজমহলের যা মন্ত্র, হিন্দুর ঘরের এই মহাপূজোর বেলায় ও তো দেখি তাই। দিলি মুহব্বত…সবখানেই। কসমিক লভ বলা যায় হয়তো। এতে ফাঁকিবাজির স্থান নেই……..বারোয়ারী পেটপূজোগুলোর কথা অবশ্যই বাদ….’।

তা তখনি রবি ছুটে গিয়ে দেখলো যে বিসর্জনের ঘটের নীচে রাখা ভূর্জপত্রে লাল চন্দনে লিখে রেখে গেছে পূজারী ঠাকুর-‘সংবৎসরো ব্যতীতে তু পুনরানগমনায় চ………………’

কি সর্বনাশ???????????????????

‘হা ভগবান……. এই অতিরিক্ত ‘ন’ টা এলো কোথ্থেকে? এই কারণে মানেই তো বদলে গেল সম্পূর্ণ কথাটার। এ আমন্ত্রণ না বিদায়? কিসের মন্ত্র? নাঃ…গুরুজী সর্বজ্ঞ….সবই জানতে পারেন। সত্যিই হয়তো আর পূজো হবে না এই আশ্রমে …..’

আমি তাড়াতাড়ি আবার সাগ্রহে জানতে চাইলুম তখনি—‘কাকু, সত্যি কি তাই হয়েছিলো?’

কাকু বললো—‘হ্যাঁ, এটা কিন্তু সত্যি ঘটনা, চঞ্চল। নিছক গল্প নয়। হয়তো তাজমহল সম্বন্ধে সেই গাইড ও যা বলেছিলো তাও মিথ্যা নয়। এই পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা এখন ও জানি? কোনটা ভৌতিক কান্ড আর কোনটা যে অভৌতিক, তাই বা কে বলবে, চঞ্চল?’

‘তবে। সেই রাতেই খবর এসেছিলো যে পথে ট্রেনে যেতে যেতেই আবার এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে তৎক্ষনাৎ মিঃ দাশ মারা গিয়েছেন। তাঁর ডাক্তার বন্ধু ও গুরুভাই সঙ্গে থেকে আর যথাশক্তি ওষুধপত্র ইঞ্জেকশান সব দিয়ে ও তাঁকে আর বাঁচাতে পারেন নি। মৃতকে বাঁচিয়ে তোলবার তাঁর ক্ষমতার অসীম অহংকার ধূলোসই হয়েছে। আর তার পরদিন সকালে জানা গিয়েছিলো যে হঠাৎ কলেরা হয়ে সেই পন্ডিত মানে পূজারী ঠাকুর ও স্বর্গলাভ করেছেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
গোবিন্দ বীন বেশ ভাল চমৎকার।। "আমার চলতি সংখ্যায় কবিতা গুলো পড়ার আমন্ত্রণ করে গেলাম। আশা করি আমার পাতায় আসবেন "
মাহমুদ হাসান পারভেজ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি এই জন্য যে আপনার গল্পটি নিয়ে এই সংখ্যার ৫১ তম গল্পটি পড়া এইমাত্র শেষ হলো।এবং এখানে এসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মন্ত্র শিখে ফেললাম। মন্ত্রটি সবার জন্য উন্মুক্ত না করলে কৃপণতা হয়ে যায়- ভালবাসা, ভালবাসা এবং ভালবাসা- দিলকি মহব্বত!
thank you,sir. really it is the only mantra in this world for our survival.
সাদিয়া সুলতানা ৪২১৪ শব্দের দীর্ঘ গল্প। মাঝখানে এসে খেই হারিয়ে ফেললাম। আরেক সময় পুরোটা পড়বো আশা করি।
মুহাম্মাদ লুকমান রাকীব ভাল লাগল প্রিয়।"ভৌতিক সংখ্যায় আমার লেখা গল্প কবিতা পড়ার আহ্বান জানিয়ে গেলাম। আমার পাতায় আসলে চির ধন্য হব হে প্রিয় কবিবন্ধু।"
শামীম খান বেশ গুছিয়ে লিখেছেন । ভাল লাগলো । শুভ কামনা রইল ।

২৩ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪