উৎসবের আগে

উৎসব (অক্টোবর ২০১৩)

জি সি ভট্টাচার্য
  • 0
  • 0
  • ১১২৬
সময়টা ছিলো বর্ষার শেষ। পূজো এসে গেছে বললেই হয়। পূজোর কেনা কাটা ও সব প্রায় হয়ে গিয়েছে। তবে বর্ষাটা যেন যাই যাই করে ও যেতে চাইছিলো না। মাঝে মাঝেই বেশ এক পশলা করে জল ঝরছিলো। চতুর্থির দিন বাদলের শরীরটা বিশেষ ভাল ছিল না।

তবে সে রোজকার মতন সেদিন ও ঠিক ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল বলে আমি বুঝতে ও পারিনি । চঞ্চল ওঠে বেশ দেরিতে। আমি ততক্ষণে বাদলকে ব্রাশ ট্রাশ করিয়ে ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করিয়ে দিই। তার পরে তেল টেল মাখিয়ে চান ও প্রসাধান করাবার পরে ঘরের পোশাক পরিয়ে জল খাবার খেতে বসিয়ে দিই ছেলেটাকে। তারপরে চঞ্চলের ঘুম ভাঙে।

সেদিন জলখাবার খেতে বসে বাদল বলল-‘কাকু, আজ আমার ঠান্ডা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না…’

‘তার মানে? শরীর খারাপ লাগছে তোমার, বাদল?’

কিছু না বলে বারো বছরের মিষ্টি ছেলেটা মুখ টিপে সুন্দর করে একটু হাসলো মাত্র।

আমি বললুম-‘কি কান্ড দেখো তো। আগে বলতে হয়। আজ আর তা হ’লে চান টান করাতুম না। ঠান্ডা ক্রীমগুলো ও না লাগালেই হতো। যত্ত সব ছেলেমানুষী কান্ড আর বলে কাকে। তোমার জন্য ঘন ঠান্ডা দুধের তৈরী স্পেশাল আইসক্রীম তবে আজ থাক। তুমি এখন গরম দুধ আর সুজির হালুয়াটুকুই খাও। অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে এই হয়। কাগজের নৌকো ডুবে যায় বলে, তুমি আরও যাও গিয়ে, নরম প্ল্যাস্টিকের শীট কেটে নৌকো বানিয়ে দিতে চঞ্চলকে আর ভেজো জলে। এখন ওষুধ খেয়ে গিয়ে শুয়ে থাক মোটা কাপড়ের ড্রেস পরে…’

‘ও কাকু, চঞ্চলের ঘুম ভেঙে যাবে কিন্তু…’

‘ভাঙুক গিয়ে….তোমার পরীর দেশের রাজকুমারের ঘুম….হ্যাঁ না তো…’

তখন বাধ্য ছেলের মতন বাদল গিয়ে শুয়ে পড়তে বুঝলুম যে ছেলেটার শরীর খারাপ বাড়ছে, তবে যা চাপা ছেলে না, একদম চুপ হয়ে থাকবে। চঞ্চল হ’লে চেঁচিয়ে মেচিয়ে জানান দিতো….মাথা ব্যথা করছে, জ্বর আসছে….বলে।

আমি চঞ্চলকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে চলে গেলুম। স্কুল আরো দু’দিন পরে বন্ধ হবে কিন্তু একলা চঞ্চলকে পাঠাবো না, তাই সে’দিন আর দু’জনের কেউই স্কুলে ও গেল না।

বিকেলে বাদল একটু কাশছে দেখে আমি ছেলেটাকে হোমিওপ্যাথির ওষুধ দিলুম খাইয়ে। তারপরে ভিক্স ভেপোরাব নিয়ে তার বুকে, পিঠে, গলায় মালিশ করতে বসলুম।

চঞ্চল বড় বড় চোখে চেয়ে শুকনো মুখে বলল-‘কাকু, বাদলের শরীর এখন কেমন আছে? ডাক্তার আংকলকে ফোন করবো, কাকু?’

‘নাঃ, আর একটু সময় দেখি। সন্ধ্যার পরে ও জ্বর না কমলে তখন না হয় ফোন করলেই হবে’।

তা সন্ধ্যার মুখে জ্বরভাব একটু কমলে ও বাদল কিচ্ছুটি খেতে চাইছে না দেখে মুস্কিলে পড়লুম। কি করি। শেষে ঘি দিয়ে গরম লুচি আর ঝাল ঝাল নরম আলুভাজা করে এনে দিতে ছেলের মুখে হাসি ফুটলো। অবশ্য চঞ্চল ও ভাগ পেলো।

বাদল খেতে খেতে হেসে বলল-‘তুমি আলুর ফুলুরি ভেজেছো মনে হয়, কাকু। বিট নুন, আদা, লংকা আর একটু গরম মশলা দিয়ে। আমাকে শিখিয়ে দিও তো, কাকু। কে বলে যে শুধু মেয়েরাই ভালো রান্না করতে জানে?’

চঞ্চল হেসে দিলো শুনেই তারপরে গিয়ে পড়তে বসলো আর আমি বাদলের বুকে, গলায়, পিঠে আর একবার ভিক্স লাগাতে বসলুম।

শেষে বাদলের গায়ে শাল চাপা দিয়ে ছেলের বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে ছিলাম আমি । খানিক পরে বাদল আস্তে করে ডাকল-‘ও কাকু….’

‘কি? কষ্ট হচ্ছে, বাদল? আমি এইভাবে বসে আছি বলে?’
‘তা না, কাকু…’

‘তবে?’

‘তোমার কেউ মিলিটারী মার্কা বন্ধু আছেন, কাকু?’

শুনে চমকে উঠে বললুম--‘কই ? না তো?’

‘তবে অন্য কেউ হবেন হয়তো। এখন তোমার এই ছেলের ভাগ্য কিন্তু মন্দ। দু’বার প্যাঁ প্যাঁ করে হর্ণ বেজেছে বাইরে। অকারণেই। তারপরে দুম করে কোনো গাড়ির দরজা বন্ধ করা হয়েছে। কলিং বেল বাজলো বলে। তোমার পরম সুন্দর ভাইপোর খালি গরম লাগে বলে ওই দুধের বরণ ছেলেটা যে সুন্দর পাতলা ফ্যান্সী ড্রেসটা এখন পরে আছে না, তা কিন্তু বাইরের লোকের সামনে একদম অচল, কাকু। হিঃ হিঃ হিঃ….কি বুঝছো? পাশা উল্টে গেছে। সুতরাং তুমি ও আমাদের স্থানীয় মান বদল করে দরজা খুলতে যাও কাকু…’

ডিং ডং …..ডিং ডং ….করে বেল বাজল বাদল থামতেই।

বাধ্য হয়ে বাদল আর চঞ্চলের স্থান বদল করে গিয়ে দরজা খুলে আমি অবাক। সত্যিই একজন জবরদস্ত মিলিটারী মার্কা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।

‘আমি ডঃ রাজেশ সিংহ। পদার্থবিদ্যার প্রোফেসার। চিনতে পারছেন তো?’

‘তা…হ্যাঁ, আসুন’।

অনেকদিন পরে দেখা। চিনতে সময় লাগলো। শুনলুম তাঁর গাড়িটা না কী বিগড়েছিল মানে ট্রাবল দিচ্ছিল তাই গ্যারেজে দেন তিনি। তারা সারিয়ে দিলে ও কয়েক হাজারের বিল দিয়ে খুবই মুষড়ে পড়েন তিনি। এই ঘটনা দিন সাতেক আগের। আজ আবার বিপত্তি হয়েছিল বিকেলে, সাইলেন্সার জ্যাম হয়ে। তিন হাজার খসে যেতেই ছুটে এসেছেন আমার কাছে…

‘আসুন স্যার। বসুন। কি দিই বলুন? চা না কফি?’

‘কিছু না। আমার বেশ মন খারাপ। মেজাজ গরম’।
‘তবে কোল্ড ড্রিংক বা আইসক্রীম খেয়ে দেখুন না হয় একটা। মেজাজ ঠান্ডা হবে’।
‘আঁ…আইসক্রীম…তা তা…’

বাদল মুখ টিপে হেসে পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে বাসনের জালের ক্যাবিনেট খুলে একটা রূপোর চকচকে ট্রে নিয়ে তাইতে ফ্রিজ থেকে দু’টো আইসক্রিমের কাপ আর চামচ রেখে দু’হাতে ধরে নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো।

‘নিন, স্যার…’

‘এ এ কী? রূপোর ক্রকারী?’

‘হ্যাঁ, পোর্সিলেন বা স্মোকি কাচের হলে পাঁচ হাজারের কমেই পুরো মর্ডান ডিনার সেট হয়ে যেত। তা আমার ছেলের আধুনিক জিনিষ পছন্দ নয় বলে…’

‘আরে তোমার তো এই একটা ট্রেতেই তিনগুন টাকা নষ্ট হয়েছে মনে হয়’।

‘আজ্ঞে, তা হয়েছে। পুরো সেট কিনতে……….’

‘তুমি কি ছেলে পাগলা না কি হে? তবে তো সোনার চামচে ও কিনলেই পারতে রূপোর বদলে….’

‘তা ও কিনেছি। তবে সেই সেটটা তোলা আছে। রূপোরটাই ব্যবহার করি সব সময়। আসলে এইসব জিনিষের মূল্য বা ডিগনিটি তো আজকাল আর তেমন নেই। পালিশ করে নিয়মিত পরিষ্কার রাখাও এক মহা ঝামেলা। ব্রাসো বা ক্রকারী পালিশে তো হয় না কাজ। তাই পূজোর দিনেই শুধু ব্যবহার করি আমরা….’।

তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন-‘ও রে বাবা, করেছ কি? ডাকাত পড়বে যে তোমার বাড়িতে। তবে তুমি তো ডিটেক্টিভ। এই যা রক্ষা। তা তুমি একটু খুঁজে দেখ না যে আমারই ভাগ্যে কেন সবসময় গাড়ী খারাপ হয়। আমার গাড়িতে ডোর লক, বনেট লক, অয়েল লক সব লাগানো আছে। তবু ও দেখি যে….এই উপকার টুকু না হয় করলে তুমি আমার…’

‘আমি তো আর মোটর মেকানিক নই, স্যার। আপনি বরং জি০টি০ রোডে একটা ভালো গ্যারেজ আছে, সে’খানে চলে যান। আমি ফোনে প্রোপাইটার মুমতাজকে বলে দিচ্ছি। পুরো গাড়ী ওভারহলিং করে দেবে। চার্জ ও বেশী নয়। হাজার পাঁচেকেই হয়ে যাবে’।

‘কি সর্বনাশের কথা তোমার। ও রে বাবা। আবার পাঁচ হাজার। এ’দিকে তেলের দাম ও তো ষাট ছাড়িয়েছে। কি যে করি?’

কোনমতে তাঁকে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। বাদল তো তখনই খিল খিল করে হেসে দিল আর চঞ্চল ও উঠে এসে যোগ দিল তাইতে। সে হাসি আর থামেই না। চঞ্চলের পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র থেকে জল না বার হওয়া অবধি। হাসি বড় সংক্রামক জিনিষ। খুব খারাপ। আমি তাই মুখটি টিপে বসে রইলুম। আমি হাসলেই আরো ফ্যাচাং। ও’দের হাসি আর বন্ধই হ’তে চাইবে না…’

তা আমার কপাল তো। সহজে রেহাই হ’বার নয়। পরদিন সন্ধ্যায় আবার সেই বিপত্তি। সিংহমশাই এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লেন। কোথায় একটু মার্কেটে যাব ভাবছি, তা আর হ’লে তো। তখন বাদল ছিল ঘরে। চঞ্চল বারান্দায় ---

‘আসুন। তা কি ব্যাপার, স্যার?’

‘তোমার সেই মেকানিক তো দেখি আস্ত একটি অকর্মার ধাড়ী, ভাই। বলে কিনা গাড়ী ঠিক আছে আর ফেরবার পথেই কারবুরেটর না কি ছাই বলে একদম জ্যাম হয়ে….বড় মুস্কিল হে, আমার তো পাগল হ’বার অবস্থা হ’লো। তুমি কিছু করো, ভাই..’

‘তা আপনি মেকানিককে কি বলেছিলেন, স্যার?’

‘কি আবার বলবো? গিয়েই বললুম-‘এ্যাই মেকানিক, একটু চট করে এ’দিকে আয়। এসে দেখ তো যে আমার গাড়িটা ঠিক আছে কি না। খারাপ হয়ে থাকলে ঠিক করে দে দেখি এখুনি। আমি প্রোফেসার সিংহ… আমার সময় তুই বাজে নষ্ট করবি না। ’।

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনে বললুম- ‘ওরে খাইছে রে, মেকানিককে তো এই প্রোফেসার দেখি মানুষই ভাবে না। আর মোটর মিস্ত্রি হ’লে কি হয়. মুমতাজ যা মেজাজী মানুষ না, নির্ঘাৎ রেগে টং হয়ে গেছে এই কথা শুনে। ফল যা হ’বার তাই হয়েছে। এখন আমি কি করি?

বাদল ও তখন হঠাৎ করে উঠে –‘আমি এখনি আসছি, কাকু’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আমি আরো বিপাকে পড়লুম। একটা ঠান্ডা মিরিন্ডাএনে দিয়ে অতিথি সৎকার সারলুম। গরম চা দিয়ে মরি আর কি।

বললুম—‘তা দেখুন স্যার, আপনি হ’লেন একজন পন্ডিত মানুষ, সবদিক তো আর একা হাতে দেখতে পারেন না। সেটা সম্ভব ও নয়। তাই অসুবিধে হ’তেই পারে। আপনি গাড়িটা ওভারহলিং করিয়ে নিলেই মনে হয় আর ঝামেলা হবে না…’

তিনি রাগত মুখে বললেন—‘ভাবছি, গাড়িটাই বেচে দেব। এইবারের পূজোয় একটা নতুন গাড়ী হ’লে মন্দ হয় না। দামী গাড়ী। রি সেল ভ্যালু ও আছে। তুমি কি যে ছাই গোয়েন্দাগিরি করো, তাও তো বুঝি না। আমার কোন তো কাজেই তুমি লাগো না। আর কিছু না পারো তো একটা খদ্দেরই খুঁজে এনে দাও তো দেখি এই ভূতুড়ে গাড়ির জন্যে..’

এ্যাই মরেছে। বলে কি? ভূতুড়ে? সে তো শুনেছি যে হয় অনেক পুরণো গাড়ী। তার মানে নিজে ও সেকেন্ড হ্যান্ড বা থার্ড হ্যান্ড কিনে যতদিন পেরেছেন বেপরোয়াভাবে চালিয়েছেন। জন্মে ওভারহলিং করান নি মনে হয়, এখন ও রাজী ন’ন। কি গেরো রে বাবা…

বললুম—‘তা মুমতাজকে বললেই আপনি ভালো খদ্দের ও পেয়ে যাবেন। আজই চলে যান। ১৯৯০য়ের মডেলের গাড়ী হ’লে ও…’

‘আমার গাড়ী যা তা না। ৮০’র মডেল, তবে ওরিজিন্যাল ফিয়াট। নাম শুনেছো তুমি জীবনে? আমি ২০০০ সনে যখন কিনি তখন ও ঝকঝক করছে। খুব ভালো চলতো। আমার কপালগুণে ইদানীং দেখছি যে….’

ওরে বাপরে। এ’ তো মান্ধাতা আমলের গাড়ী মনে হয়। তেমনি তার মালিক। এখন আমায় কে রক্ষা করে?

তখনই বাদল এসে বসলো পড়ার টেবিলে।

বললো—‘আংকল, আপনার সমস্যার সমাধান হ’তে পারে যদি একজন ভালো ড্রাইভার রাখেন…’

‘ওরে বাবা। কি সর্বনাশ….ড্রাইভারের আবার ভালো। সোনার আবার পাথর বাটি। সে তো খুব কম করে ও পাঁচ হাজার মাইনে চাইবে আর তেল চুরি করে আর পার্টস বদল করে দু’দিনেই যে আমাকে ফতুর করে ছাড়বে। আমার যে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। ও ভাই ডিটেক্টিভ, তোমার এই সুন্দর মতন ছেলেটা বলে কি?’

শুনে তো আমার আবার মাথায় হাত। মনে পড়লো সেই শেঠের গল্পটা। এ ও সেই শেঠ না কী? তিনি টাকা রাখতে না পেরে মানে দু’নম্বরী টাকা লুকোতে না পেরে শেষে এক গাড়ী কিনে বসেন, একজন বন্ধুর কথায়। নিজে চালাতে ও জানেন না তাই বাধ্য হয়ে ভয়ে ভয়ে একজন ড্রাইভার রাখেন। একদিন তিনি গাড়ী নিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছেন। গাড়ী চলছে। আরামে শেঠের তন্দ্রামতন ও একটু এসে গিয়েছে। হঠাৎ খড়র খড়র করে কেমনধারা এক শব্দে চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন—ও হে ড্রাইভার, ও কিসের শব্দ হয়?’

অবজ্ঞাভরে সে বললো-‘ও কিছু না, শেঠ সাহেব। আপনার গাড়ী তো বহুৎ পুরণো আছে। একটু ওভারহলিং করিয়ে নেবেন। আর শব্দ হ’বে না…’

‘তা না হয় করিয়ে লিবে হামি তোবে ওহি শব্দটা হয় কেন হে?’

‘ওই গিয়ারটা বদলাচ্ছিলাম তো, তাই একটু শব্দ…’

শুনেই শেঠ অগ্নিশর্মা। ড্রাইভারকে এই মারে তো সেই মারে। বলে—‘কি? হামি নিজে গাড়িমে বৈঠে আছি, আর এত্তো হিম্মৎ তোমার, যে হামার সামনেই গাড়ির গিয়ারঠো তুমি বদলিয়ে দিচ্ছে। আবার বলছে যে পুরণো গাড়ী আছে তো, তাই একটু শব্দ হয়ে গেছে। হে রামজী, গাড়ী নতুন হ’লে তো শব্দ ভি হ’তো না আর হামি জানতে ভি পারতো না যে হামার গাড়ির গিয়ারঠো বদল হইয়ে গেলো। তুম আভি কোঠি ওয়াপস চলো। একদম গিয়ার টিয়ার বদলাইবার কোশিশ করবে না। তোমার নোকরী খতম করবে হামি। তুমি তো সাংঘাতিক ড্রাইভার আছে হে। একলা গাড়ী নিয়ে কভি পথে বের হ’লে তো তুমি হামার গাড়িঠো পুরোই বদলিয়ে দিবে। হামি পথ মে বসিয়ে যাবে। হামাকে ভিখ মেংঙ্গে খেতে হোবে, হামিতে পটোল তুলিয়ে ফেলবে….’

বাদল হেসে বললো-‘আংকল, তা হ’লে কাকুর আর কিচ্ছু করবার নেই’।
‘কেন হে? কি কারণ?’

‘অকারণ। মানে শূণ্য কারণ…’

শুনে তিনি আরো রেগে গেলেন।

বললেন—‘ডেঁপো ছোকরা, কোন সাহসে তুমি আমাকে শূণ্য দেখাও? অ্যাঁ। তুমি শূণ্যের মানেই তো জানো না হে। শূণ্য মানে অসীম, শূণ্য মানে মহাকাশ। অনন্ত। শূণ্য মানে দশগুন। কোন সংখ্যার পরে একটা শূণ্য বসালেই দশগুন হয়, দু’টোয় এক’শোগুন, শূণ্য কখনো অকারণ হয়? শূণ্য একটা পদার্থ। কসমিক বা মহাজাগতিক পদার্থ। আমি ইউনিভার্সিটিতে পদার্থ বিজ্ঞান পড়াই। আমি সব পদার্থের গুণ, অ্যাটমিক স্ট্রাকচার, বৈশিষ্ট্য সব জানি। তা তুমি জানো কিছু? যত্ত সব মূর্খের দল, ম্যাটারলেস…’

বাদল বললো-‘সরি, স্যার। আমি তো অপদার্থ…তাই শূণ্য যে একটা পদার্থ তাই জানতাম না। তবে আমি পদার্থের গুণ না জানলেও নেচার একটু একটু জানি বৈকি’।

‘তার মানে?’

‘শূণ্যে অনেক জ্ঞান, শূণ্যেই পূর্ণতা । শূণ্য থেকে যে পূর্ণে যেতে পারে সে মহা শক্তির অধকারী হ’তে পারে। এই হ’লো শূণ্য দর্শণ। শ্লোকে বলা হয় তা জানেন তো-‘
অখন্ড মন্ডলাকারং, ব্যাপ্তং যেন চরাচরে, তৎ পদং দর্শিতং যেন, তৎস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ…’

শুনেই তিনি দারুণ রেগে টেবিল থেকে নিজের নীল রঙের অফিস ফাইলটা খপ করে একটানে তুলে নিয়েই ঠিক উড়ন তুবড়ির মতন লাফিয়ে উঠলেন আর ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলেন।

বাদল হাসতে হাসতে বললো-ওং নমঃ স্বাহা…হিঃ হিঃ হিঃ…পূজোর মধ্যে আর দর্শণ না দিলেই এখন বাঁচি যে।

প্রোফেসার সাহেব বিদায় হ’তেই রূপকমার চঞ্চল এসে ঘরে ঢুকে বলে উঠলো-‘কাকু, বাদল ভারী দুষ্টু হয়েছে । কাল সবে জ্বর থেকে উঠেছে আর আজই মনের সুখে জল ঘেঁটে বেড়াচ্ছে। তুমি তো জানতে ও পারো নি, কাকু। খুব করে বকে দাও তো তুমি এখন ছেলেটাকে ’।
‘সে কী? কখন?’

‘এই তো একটু আগে…’

‘বাদল, সত্যি?’

‘হ্যাঁ, কাকু। তবে চঞ্চলের মতন একটা পরী ছেলে যার পাহারায় থাকে সবসময়, সেই ছেলের ভাগ্যে কি আর মনের সুখে জল ঘাঁটতে পারা সম্ভব, কাকু? তুমিই বলো’।

‘তার মানে?’

‘মানে আমি শুরু করলে কি হবে, শেষ করলো চঞ্চল। হিঃ হিঃ হিঃ…’

এ আবার কি হেঁয়ালী রে বাবা? অতি কুশাগ্রবুদ্ধি ছেলে বাদলের ভাষা বলে কথা । স্কুলের দিদিমণিরা ও বাদলের সেই ছোট্টবেলায় অনেকেই বুঝতে পারতেন না, শুনেছি। এখন দু’জনের কে খায় বকুনি? নাঃ, বাদলকে নিয়ে আর তো দেখি পারা যায় না। রাগ করে স্রেফ চুপ করে বসে রইলুম আমি।

হাসি থামতে বাদল বললো-‘ও কাকু, তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে?’

‘মোটেই না। করেছি ঢেঁকির ওপরে….’

আর বলতে হ’লো না। শুনেই দুষ্টু ছেলেদু’টো হেসে আবার কুটিপাটি হয়ে গেলো। কি মুশ্কিল যে আমার, সে আর কি বলি? কথা বলাই এক দায় হয়েছে ওদের সাথে।

হাসি থামতে বাদল বললো—‘তুমি ঠিক বলেছ, কাকু। তোমার ওই বন্ধু বা পরিচিত স্যার হ’লেন একটি অবতার। অকর্মার ঢেঁকি, কুড়ের বাদশা আর কঞ্জুষের তিমিমাছ…’
‘সে আবার কি রে বাবা?’

‘তাই কাকু, কি করে যে প্রোফেসার হয়েছেন আর ইয়ু. পি. কলেজে ছাত্র পড়াচ্ছেন, তা ভগবানই জানেন’।

আমি বললুম-‘কেন? পয়সার জোরে। কিন্তু আমাকে যে বললেন যে ইয়ুনিভার্সিটিতে পড়ান’।
‘অনেকেই তাই বলে, কাকু। ও’তে না কী সম্মান বাড়ে কাকু। তাই। তবে ওনার ফাইলটা তুমি তো দেখলেই না। বেচারা নেহাৎ বস্তু মানে পদার্থ তো তাই মিথ্যা বলতেই শেখে নি। কোন জীবই শেখে নি। মিখ্যা কথা মানুষের এক মহৎ আবিষ্কার, কাকু’।

এই রে, বাদলের দৃষ্টিকে দেখছি প্রোফেসার সাহেব জানেন না। বাদলকে জানা তো দূর অস্ত। বললুম—‘ তা তুমি জল ঘাঁটতে গেলে কেন,বাদল?’

‘আমি তো আংকলের গাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম, কাকু। জল ঘাঁটতে যাবো কেন?’

‘তবে? গাড়ী কি জলে ভেসে বেড়াচ্ছিল?’

হিঃ হিঃ হিঃ….

‘কাকু, গাড়িটা পুরণো তবে জাতে খাঁটি সাহেব’।

‘গাড়ির আবা র জাত হয় না কী? কি জ্বালা…’

‘খুব হয়, কাকু। সব পদার্থেরই জাত হয়। সব বড় বড় কোম্পানির তৈরী সব জিনিষের আবার বড় বড় জাত হয়, বেশ মেজাজ ও হয়। ওনার গাড়িটা বেশ দেমাকী আর বেশ নিয়ম মেনে চলতে ভালবাসে। আর সবসময় খুব পরিষ্কার পরিছ্ছন্ন থাকতে ও পছন্দ করে, অনেকটা ঠিক চঞ্চলের মতন। হিঃ হিঃ হিঃ…’

‘তা উনি তেমনি কুড়ে। গাড়িটা জীবনেও ধোওয়া মোছা, তোয়ালে,সীট কভার বদলানো কিচ্ছুটি তো করেনই না উল্টে মদ খেয়ে যা তা ভাবে গাড়ী চালান। ক্লাচ ঠিকমতন না চেপেই গিয়ার দেন। আচমকা দুম করে ব্রেক কষেন স্লো না করে। গিয়ার দেন বেপরোয়া ভাবে। দুমদাম দরজা বন্ধ করেন। তাই বেজায় রেগে আছে ওনার গাড়ী। একদম অগ্নিশর্মা’।

‘আরে ভাই, জাতে সিংহ যখন, মদ তো একটু আধটু…তা তুমি জানলে কি করে, সে সব কথা, বাদল?’

কেন, কাকু? গাড়িটাকে গিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলুম যে, কাকু’।

‘যাঃ, গাড়ী কি কথা বলতে পারে না কী আবার? লোকে শুনলে তোমাকেই পাগল বলবে, তা ঠিক কথা বাদল’।

‘ইঃ, লোকে শুনবে কেন, কাকু? আমি তো শুধু তোমাকে বলেছি। আর জানো কাকু, সব্বাই কথা বলতে পারে। গাছ, পাখী, জিনিষপত্র, বই খাতা। সব্বাই। তবে ভাষাটা অবশ্য আলাদা আমি অবশ্য বাংলাতেই বলি। কি করবো? তা গাড়িটা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না দেখে আমার ও গেল বেশ রাগ হয়ে। দিলুম বাগানের পাইপ দিয়ে আচ্ছা করে ধূলো কাদা সব ধুয়ে সাফ করে একটা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে। পাঁচ মিনিটের তো কাজ। তখন মেজাজ ঠান্ডা হ’তে গড়গড় করে সব বলে ফেললো আমাকে’।

‘সে কী?’

‘হ্যাঁ, কাকু। সে তুমি জানোই না। দুঃখী মানুষদের থুড়ি জিনিষদের একটু আদর করে সহানুভূতি দেখিয়ে কথা বললেই তারা সবকিছু গড়গড় করে বলে দেয়। কিন্তু আমি কি করবো? আমার তো আর গাড়ী নয়,কাকু যে যত্ন করবো রোজ। তাই আংকলকে ভালো ড্রাইভার রাখতে বলছিলাম। তা তিনি পয়সা খরচের ভয়ে তা ও করতে নারাজ যখন, তখন আর কি হবে তুমিই বলো না, কাকু’।

আমি আর কি বলি।

কিন্তু আমার ভাগ্যটাই যাচ্ছেতাই। তারপরের দিনই আবার বিপদে পড়লুম আমি।

হঠাৎ করে সেদিন আবার হালুম। সিংহ মশাই এক্কেবারে যাকে বলে সেই হন্ত দন্ত হয়ে এসে হাজির।

‘কি হয়েছে প্রোফেসার সাহেব। আপনাকে বড় চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে। আবার গাড়ী বিগড়েছে না কী আপনার আজ?’

‘সে তো বিগড়েই আছে। নতুন আর কি হবে? তবে আজ আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে,সিদ্ধার্থ’।

‘তাই না কী? সেটি ও তো উত্তম কথা। সেরকম শুনেছি অনেকেরই মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। তা এখন আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন। একটা কোল্ড ড্রিংক খেয়ে নিয়ে তারপরে বলুন এটি আবার কি ধরনের জিনিষ’।
তিনি খাপ্পা হয়ে বললেন-‘কি? কি বললে? উত্তম ? মানে ভালো হয়েছে। আমার সর্বনাশকে তুমি ভালো বলছো একজন মানুষ হয়ে?’

‘আজ্ঞে না। তবে আপনি সাড়ে সর্বনাশ তো আর হয়েছে, তা বলেননি। তাই তুলনা করে এটিকে উত্তম বলেছি, স্যার। কেননা শুনেছি সেটি না কী আরো ও বিচ্ছিরি জিনিষ। সে আর কহতব্য নয়। তা এ’টি কি ধরনের?’

‘কি ধরনের আবার? তালাচাবির’----

‘চাবী হারিয়েছেন?’

‘নাঃ, এই যে হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি…’

‘সে আবার কী?’

‘তাই। এই চাবিতে আর আমার তালা খুলছে না…;

‘বিলক্ষণ। তা চাবিটি কি সেই তালারই বটে?’

‘অবশ্য’

‘তবে তালা না খোলবার কারণ?’

‘স্বয়ং ভগবান জানেন। এ হচ্ছে সব ওই শয়তান তালার বদমায়েসী…’

‘চাবিটি একবার দেখতে পারি আমি?’

‘স্বচ্ছন্দে, এই নিন…;

‘হুঁ, এ দেখছি পেতলের চাবী। গোদরেজ নবতালের। তালাটি বেশ পুরণো…’

‘হ্যাঁ…’

সেদিন ও বাদল আমার কাছেই বসে ছিল। চঞ্চল জলখাবার খেয়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বাথরুমে গিয়েছিল। হঠাৎ বাদল বলল-‘কাকু, আমি কি এখন চাবিটা একটু দেখতে পারি?’

‘এই নাও…’

‘আংকল, চাবির গায়ে এতো তেল লেগে রয়েছে কেন?’

‘সবাই মিলে তালাতে তেল ঢেলেছে, তাই…’

‘তার মানে এটা আপনার অফিসের তালার চাবী নয়। বাড়ির। অফিসে এত সর্ষের তেল
দুর্লভ। মবিল হ’লে ও বা একটা কথা ছিল’।

‘হ্যাঁ, আমার ফ্লাটের তালা’

অর্থাৎ বাড়িতে আপনি একা থাকেন, আংকল?’

‘হ্যাঁ, একটা কাজের লোক আছে। রান্না ও সেই করে’।

‘আপনি …মানে …ব্যাচেলর?’

‘হ্যাঁ’

‘কলেজ থুড়ি থুড়ি…মানে ইয়ুনিভার্সিটি থেকে আজ আপনি বিকেলে বাড়ী গিয়েছিলেন সোজা,আংকল?’

‘হ্যাঁ’

‘ফ্ল্যাট বাড়ির মেন গেট খোলাই থাকে। হয়তো সিকিউরিটি আছে তাই। তালা আপনার ফ্ল্যাটের দরজায় লাগানো আছে’।

‘হ্যাঁ’

‘আপনি গিয়েই তালায় চাবী লাগিয়ে ঘুরিয়েছেন। কিন্তু তালা খোলেনি। তখন আপনার হাঁক ডাকে আশে পাশের ফ্ল্যাট থেকে কয়েকজন লোক ছুটে এসেছেন। এজজন অন্তত মহিলা ও ছিলেন। তাঁরা প্রাণপনে যুদ্ধ করেছেন তালার সাথে একঘন্টা ধরে। একজন শেষে প্লাশ বা সাঁড়াশী কিছু একটা নিয়ে এসে তাই দিয়ে ধরে চাবী ঘুরিয়ে দিতে অনেক চেষ্টা করেছেন সর্বশক্তি দিয়ে। ফল কিছুই হয় নি। তখন সেই মহিলা ছুটে গিয়ে তেল নিয়ে এসে তালার ফুটোয় ঢেলে চাবী ঘোরাবার চেষ্টা করে হেরে গিয়ে আপনাকে চাবী তৈরী করাবার লোক ডাকতে হবে এই বলে সবাই হাল ছেড়েদিয়েছেন তাঁরা…’

‘একদম ঠিক কথা। কিন্তু তুমি ভাই জানলে কি করে এই সব কথা? হাত গুনে?’

‘চাবিটা যে একটু বেঁকে গিয়েছে, তাই দেখে। আপনি তালা চাবিওয়ালা ডাকেননি, আংকল?’

‘তা …তা তাদের আমি পাচ্ছিটা কোথায় এই সময়? সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কাল দশটার আগে খুলবে না। কাল আবার সপ্তমী। দোকান খুললে হয়। আয়রণ বা গ্যাস কাটার ও তখন পেতে পারি হয়তো। এখন আমি পূজোর সময় এই বচ্ছর গন্ডার দিনটায় মানে রাত ভোর পথে পথে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই চুয়িংগাম চিবিয়ে আর কি। কাল পূজোর দিনে ও আমার ঘরে প্রবেশ নাস্ত হবে হয়তো। কি সর্বনেশে বদমায়েস বিচ্ছু সাংঘাতিক তালারে বাবা। সিদ্ধার্থ, ভাই আমাকে বাঁচাও তুমি’।

‘আরে আপনি এতো ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আর পথে পথেই বা ঘুরবেন কেন? আপনি আমাদের বাড়িতে থেকে যান। আমাদের যদি খুঁদকুড়ো জোটে তা আপনার ও জুটে যাবে। হাত মুখ ধুয়ে ঠান্ডা হয়ে খেয়ে দেয়ে বসে শুয়ে বিশ্রাম করুন। কাল ও যদি চাবিওয়ালা বা গ্যাস কাটার কিছুই না পান তখন না হয় ফায়ার ব্রিগেডে খবর দিলেই হবে …’

‘সে কি সর্বনাশ। শেষে তালার দায়ে আমাকে ফায়ার ব্রিগেড ডাকতে হবে? আমার ছাত্ররা শুনলে….’

‘আরে সে তো অন্তিম বিকল্প, স্যার…’

‘আর কালকে আমার ক্লাশ আছে না? পূজোর ছুটি আমাদের হয় অষ্টমীর দিন থেকে। একটি সি০এল০ ও পাওনা নেই আমার এদিকে। সেটি জানো? আর আমি পড়াব কি, ছাই? আমার সব ক্লাশ নোট তো পড়ে আছে আমার ঘরের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে….’

বাদল চাবিটা ফিরিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো-‘তবে আর কি করা, আংকল? চলুন, একবার তবে এখনই যাই, আপনার তালাটিকে দর্শন করে আসি। যদি মানভঞ্জন হয়।…কাকু,.আমি চঞ্চলকে বলে ড্রেসটা চেঞ্জ করে পাঁচ মিনিটে চলে আসছি। তুমি তৈরী হয়ে নাও। তিনজনের যাবার প্রয়োজন নেই এই সামান্য কাজে…’

‘সামান্য কাজ মানে? আমার শিরে সংক্রান্তি আর তুমি বলছো কি না…?’

‘ওটা কিছু নয়, আংকল। কথার কথা। সংক্রান্তি মানে শূণ্যকাল। জিরো আওয়ার। সেটা কোন একজনের মাথায় পড়ার ব্যাপার না’।

ছেলে ঠিক পাঁচ মিনিটে তৈরী হয়ে এসে বললো—‘চলুন আংকল। আপনার পূজোর দিনগুলো যাতে ভালোভাবে কাটে, সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য।’।

‘তুমি কি খালি হাতেই যাবে, ভাই? একটা প্লাস বা রেঞ্চ বা স্ক্রু ড্রাইভার অন্তত নিয়ে নাও…’

‘ওই সব দিয়ে কি হবে, আংকল? আপনিই তো বলেছিলেন শূণ্য মানে দশ গুন, তাই শূণ্য মানে স্রেফ খালি হাতেই তো যাওয়া ভালো। ও’সব কিছুর দরকার নেই’।

শুনে রেগে মেগে তুম্বোমুখে তিনি নেমে এসে গাড়িতে বসলেন। আমরা উঠতেই দমাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইগ্নিশন লকের চাবী ঘোরালেন বোঁ করে। ইঞ্জিন গর্জন করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু উঠেই চুপ করে গেল। আবার…. আবার…. চেষ্টা করলেন তিনি। একই ফল লাভ হ’লো। গাড়ী অচল। তিনি নীচে নেমে পড়ে পাগলের মতন চেঁচাতে লাগলেন তখন হাত পা ছুঁড়ে।

‘দেখ সিদ্ধার্থ, আমার কপালে আজ শান্ট লেগেছে। আমার ভাগ্যে যে শয়তানে কতো অ্যাম্পিয়ারের কারেন্ট চালিয়েছে তা খোদাই জানেন। কোন ভোল্টমিটারেও সে আর এখন মাপা যাবে না। আমাকে যেতে হবে সেই শিবপুর আর ছাতার মাথা একটাও অটোর টিকি দেখা যায় না কোথাও। রিক্সাওলার যেতে তো বড় বয়েইঽ গিয়েছে অতো দূরে। আমার মতন তাদের তো আর টিউনিং ফর্কের ফ্রিকোয়েন্সী বদলে যায় নি। শয়তান গাড়ীটা সময় বুঝে আবার…’
‘কাকু, বোঝা যাচ্ছে এখন যে উনি সত্যিই পদার্থ বিজ্ঞানের প্রোফেসার। হিঃ হিঃ হিঃ তোমার রুমালটাই দাও কাকু, আমি নেমে গিয়ে দেখি। উনি রাস্তায় সব লোক জড়ো না করে আর থামবেন না দেখছি…..’

বাদল নেমে পড়ে বললো--‘আংকল, আপনি চুপ করে এসে বসুন দেখি কাকুর পাশে। আমি দেখছি…’

‘তু… তুমি কি দেখবে? একটা দশ বছরের পুঁচকে ছোঁড়া। গাড়ী চালানোর তুমি কি জানো হে?’

‘আমি ড্রাইভিং জানি, আংকল। তবে লাইসেন্স নেই, তাই চালাবো না। শুধু একটু দেখব। আপনার গাড়ী আপনিই চালাবেন, আংকল। তবে আপনি আর না চেঁচালেই হবে।‘

তিনি মুখ হাঁ করে জগদম্বার মতন দাঁড়িয়ে রইলেন বাদলের কথা শুনে।

বাদল গিয়ে তাঁর সীটে ধীরে করে বসে কি সব খুটখাট করল। বিড়বিড় করে কিছু বললো। রুমাল দিয়ে ড্যাশবোর্ড পরিষ্কার করলো। নেমে গিয়ে বনেট তুলে কি সব মুছলো ও কয়েকটা তার খুলে মুছে আবার লাগালো। মনে হ’লো ব্যাটারির তার। বনেট বন্ধ করে এসে বসে আস্তে করে চাবিটা ঘুরিয়ে দিলো শেষে। স্টার্ট নিয়ে ইঞ্জিন বিকট গর্জন করে উঠলো আর একরাশ কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এসে জায়গাটা অন্ধকার করে দিলো।

বাদল নেমে এসে ধীরে কিন্তু কঠোর স্বরে বললো-‘আংকল, আপনার গাড়ী চলতে রাজী হয়েছে । আমি এখন গাড়িটা চালাতেও পারি। পুলিশ আমাকে আটকাবে না। তারা চেনে কাকুকে আর আমাকে ও কিন্তু অকারণে আমি আইন ভাঙতে চাই না। এখন আপনিই চালান । তবে নো রাফ ড্রাইভিং, প্লীজ। সামান্য কারণে আচমকা ব্রেক নেবেন না জোরে। ক্লাচ পুরো চাপবেন। আর আপনার অয়েল ফিল্টার কতদিন বদলানো হয় নি, তা একবার শুনি। কেন বদলান নি সেটা? এমন কিছু মহার্ঘ্য বস্তু নয়। আর আপনি স্পার্কিং প্লাগ ও পরিষ্কার করেন না কেন? মেকানিক লাগে না কি এইসব কাজে? প্লাগ খোলবার স্প্যানার, আলো আর সময় থাকলে আমিই করে দিতাম এখনি। আপনি কথা দিন যে আজ পৌঁছেই এই কাজটি নিজে প্রথমে করবেন…’

‘আ আচ্ছা। তাই ক করবো’।আর কিছু তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল না বাদলের কথা শুনে।

তিনি উঠলেন। বাদল ও উঠে বসলো আমার পাশে। গাড়ী সচল হ’লো।

তবে পথে বেশ ভীড় বলে পৌঁছতে দেড় ঘন্টা সময় লেগে গেল। গাড়ী থামতে আমরা নেমে মেন গেট দিয়ে ঢুকলুম। গেটের গার্ড সেলাম ঠুকলো। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ৩ বি-এইচ- কে বেশ বড় ও দামী ফ্ল্যাটের গেটে হাজির হয়ে নবতাল তালাটা দেখে বাদল হাত বাড়াতে তিনি চাবী বার করে ছেলেটার হাতে দিলেন। বাদল এগিয়ে গেল।

তালাটা বাঁ হাতে ধরেই ছেড়ে দিয়ে সে বললো-‘আংকল, একটু কাপড় চাই। অনেক তেল…’

তাড়াতাড়ি করে প্রোফেসার সাহেব গ্রে কালার সাফারী সুটের পকেট থেকে নিজের দামী সেন্টেড রুমালখানাই বার করেই এগিয়ে দিলেন। বাদল খুব যত্ন করে তালাটাকে মুছলো। তারপর চাবী না লাগিয়ে তালাটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ আর কি সব বিড় বিড় করে বলতে লাগলো।

প্রোফেসার সাহেব ভয়ে তিন হাত পিছিয়ে এসে আমাকে বললেন—‘সিদ্ধার্থ। তোমার এই ছেলেটি নির্ঘাৎ মন্ত্র জানে। ওই দেখো বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। মন্ত্র পড়েই তখন আমার গাড়িটাও ঠিক করে দিলো আর আমি যা যা করি সব জেনে নিয়ে আমাকে বকে দিলো। তালা খোলবার ও কোন মন্ত্র আছে না কী ভাই? পদার্থ বিজ্ঞানে তো লেখা নেই…’

আমি কটমট করে তাকাতেই তিনি চুপ।

বাদল তখন চাবিটা লাগিয়েছে তালাতে।

কট করে একটা শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই কটাৎ করে তালাটা খুলে যাবার শব্দে ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে ছুটে গেলেন দরজার দিকে।

‘এ এ কী কান্ড? খালি মানে শূণ্য হাতে এ’টা কি তোমার ম্যাজিক না কী, ভাই? তুমি কি গতজন্মে ম্যাজিশিয়ান ছিলে না কী, বাবুয়া? খোলা তালার দিকে অবাক হয়ে হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রোফেসার সাহেব জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ আংকল। তাই ছিলাম। জাদুকর পি০সি০সরকার- সিনিয়র। নাম হয়তো শুনে থাকতে পারেন। এ’বার চলো কাকু…’

‘সে কী? এসো, বসবে এসো ঘরে দু’মিনিট। জলটল খাও। তারপর আমি নিজে গিয়ে তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবো। এ’টা হচ্ছে আমার …কি বলে সেই…কর্তব্য। তবে আমার তালাটা নষ্ট হয়ে যায়নি তো ভাই, খোলবার সময়ে? মানে ব্যবহার করা যাবে তো?

বাদল হেসে ফেলে বললো—‘আংকল, আপনার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর তো।। তাই একে একে দিচ্ছি। এক নম্বর -আমরা খেয়ে এসেছি। এখন অসময়ে কিছুই খাবো না। দু’নম্বর-আপনি আমাদের পৌঁছে দিতে ও পারবেন না। তাই আমাদের নিজেদেরই যেতে হবে। আর তিন নম্বর-আপনার তালা একদম ঠিক আছে। আমি দারা সিংয়ের ছোট ভাই হচ্ছি তা ঠিক কিন্তু খালি হাতে আপনার তালাটা ইচ্ছে থাকলেও মড়াৎ করে ভেঙে ফেলিনি। আপনি না হয় একজন তালাচাবির মিস্ত্রিকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে তবে ব্যবহার করবেন। আমার কথায় নয়। চলো কাকু, আমরা এই কলোনির বাইরে গেলেই স্ট্যান্ডে অটো পেয়ে যাবো। আসবার সময় দেখে এসেছি আমি…’

তিনি লাফিয়ে গিয়ে আবার তালাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার খুলে দেখে নিয়ে বললেন-‘নাঃ মনে তো হয় ঠিকই আছে তালাটা। দিব্যি খোলা বন্ধ করা তো যাচ্ছে।। চলো, গাড়িটা ও তো গ্যারেজে ঢোকাতে হবে । তোমাদের পৌঁছে দিয়ে এসেই না হয়…’

তিনি আমাদের সাথে মেন গেটের বাইরে এসে গাড়িতে চাবী লাগিয়েই বোঁ করে ঘুরিয়ে দিলেন। কিন্তু ইঞ্জিন আর সাড়া ও দিলো না দেখে বাদল খিল খিল করে হেসে ফেললো।

অটোতে উঠে আমি বাদলকে জিজ্ঞাসা করলুম—‘তালার রহস্যটা কি, বাদল?’

বিরক্তমুখে বাদল বললো—‘অতি সামান্য ব্যাপার, কাকু। তবে ওনার হাত থেকে পূজোর দিনকটায় অন্তত রেহাই পেতে আসতেই হ’লো, কাকু। ওনার তালাটাও দামী। তবে খুব মেজাজ আছে। তা যেমন মালিক তেমনি তো হবে জিনিষ ও তার। তবে তালাটা অযত্নে রেগে থাকলে ও ভদ্রতা জানে। গাড়িটার মতন একবগ্গা নয়। বেশ মাখনের মতন চাবী ও ঘোরে। তবে অনেক পুরণো তো। লিভারগুলো সামান্য ঢিলে তো হয়ে যেতেই পারে। তাই বলে চাবী ঘুরিয়ে বন্ধ করে আবার গায়ের জোরে চাবী টিপে বন্ধ হয়েছে কি না তা দেখবার দরকারটা কি? সব আংকলের স্বভাব দোষ,কাকু। উল্টো চাপ পড়ে একটা লিভার একটু সরে গিয়ে সিস্টেম জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে মিষ্টি কথায় তালাটাকে ভূলিয়ে ভালিয়ে আগে সেটা জেনে নিয়ে তারপরে উল্টো দিকে চাবী ঘোরাতেই কট করে লিভারটা সেট হয়ে গেল। তখন আবার সোজা দিকে চাবী ঘুরিয়ে দিতেই কটাৎ । নইলে কিন্তু একটা হাতির জোর দিয়ে ও ওই ইতালার চাবী সোজা দিকে ঘোরানো আর যেতো না কখনো বা টেনে ও ওই তালা খোলা যেতো না, তা কিন্তু এক্কেবারে ঠিক কাকু….হিঃ হিঃ হিঃ ‘
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

২৩ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী