চৈত্রের পিয়াইন প্রায় পানিশূন্য । জীর্ণ- দরিদ্র হাওরের অসংখ্য মানুষের মতো । নদীর ঢালে গজিয়ে উঠা সবুজ ঘাস আর একেবারে তলায় জমে থাকা হাঁটুর চেয়েও কম পরিমাণ পানি দেখে কে বলবে এই নদীই দুই কুল ছাপিয়ে সর্বগ্রাসী দানবী'র রূপ ধারণ করে অবিরল বর্ষায় ? কিংবা কে বলবে , এই নদীই এক সময়ের প্রমত্তা নির্ঝরিণী ? অজানা কারোর পক্ষে বলা কঠিন । চৈত্রের দিনে হাওরবাসী মানুষদের জীর্ণতা দেখে বাইরের কোন লোক যেমন আন্দাজও করতে পারবে না বৈশাখ শেষে ফসল তোলার পরে কী নিঃসীম আনন্দে ভাসতে পারে হাওরের এই মানুষগুলোই , তেমনি বাইরের মানুষের পক্ষে পিয়াইনের সত্যিকার উর্বশী রূপও অকল্পনীয় ব্যাপারই হয়তো । নদীর তলা থেকে পাড় পর্যন্ত মাপ-জোঁক করতে থাকা ইন্ঞ্জিনিয়ারের সঙ্গী দুইজন আর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ইন্ঞ্জিনিয়ারেরও হয়তো এই নদী আর নদী তীরবর্তী গ্রামের মানুষগুলো সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই । আর থাকলেই বা কী , নদীর বুকের উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প ইন্ঞ্জিনিয়ার বা তার এই দুই সঙ্গীর ইচ্ছায় যে হচ্ছে না , এটুকু অন্তত বোঝে মারু ।
চৈত্রের দিনে গ্রামের সব বাড়িরই উঠান- বারান্দা শুকিয়ে যাওয়া নদীর ঢাল থেকে মাটি তোলে নিয়ে কম-বেশি ঠিকঠাক করে রাখা হয় । একবছর উঠান-বারান্দায় মাটি না দিলেই বর্ষার টানা ধারায় উঠান-বারান্দা পিয়াইনের মত না হোক , পিয়াইনের সাথে মন কষাকষি করে পিয়াইনের আঁচলের খুঁট ছেড়ে পশ্চিমের হাওরে গিয়ে পড়া নালার খাল হওয়ার উপক্রম হয়ে যায় ।
সকাল থেকে বাড়ির উঠানের জন্য নদীর ঢাল থেকে মাটি উঠাতে লেগেছিল মারু । কোদাল দিয়ে মাটি কেটে টুকরিতে ভরে সে তার মায়ের মাথায় ভরা টুকরি তোলে দিচ্ছিল । আর তার মা হাতের খালি টুকরিটা আবার মাটি ভরে রাখার জন্য মারুর কাছে রেখে ভরা টুকরিটা নিয়ে উঠানের শেষ দিকের পেয়ারা গাছটার নিচ পর্যন্ত গিয়ে মেয়ের মাথায় দিয়ে আসছিল এভাবে দুই মাথা বদল হয়ে উঠান পর্যন্ত মাটি যাচ্ছিল । মাথার উপর চৈত্রের সূর্য নিজের সার্বভৌমত্ব ভোগ করছিল যথেচ্ছভাবে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো । শ্বাস কষ্টে হাঁপিয়ে উঠা আধবয়সী মারুর মা মাটি তোলার গর্তের পাশে পাতলা ঘাসের উপর ধপ করে বসে পড়ে বলল , আজকে রাখ রে বাবা , রাখ । আমার দম বন্ধ অইয়া আইতাছে ।
কোমর সমান গর্তের ভেতর থেকে মাথা বাড়িয়ে ধমকে উঠে মারু বলল , আমি আগেই খইছি না , তুমি আইয়ো না । মরবার লাইগ্যা বাড়ছো , না ?
মারুর মা বলে , এখলা এখলা দাইরটা ঠিক খরলো তাই । অত বড় উডানডাতও অর্ধেক মাডিই তাই এখলা দিলো । জানতো সখলেরেই আছে । তুমি আর খতো সময় থাখো আমার জানা আছে না ?
শেষ বাক্যটা না বললে মায়ের কথাগুলো মোটামুটি ঠিকই ছিল । এই উপলব্ধি থেকেই আজ সকাল থেকে মারু মাটি কাটায় পড়ে ছিল । কিন্তু শেষ বাক্যটা দিয়েই তার উপলব্ধি আর অনুভূতিটুকুকে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে । কম-বেশি আত্মসম্মানবোধ সমাজের সব শ্রেণির মানুষেরই আছে । হঠাত্ করে আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় রাগে ফোঁসলাতে ফোঁসলাতে বোনের প্রসঙ্গে মারু বলল , খাওয়ার সময় তো ঠিকেই খাইতো ফারে । এখলা খাম খরলে আত ফইরা যায় , না ? হাঁপাতে থেকেই ঝাঁঝালো গলায় মারুর মা বলে , তর ঘরের খায় না কিতা রে , গোলামের ঘরের গোলাম ? খাওয়া লইয়া খতা খওয়ার তুই খ্যালা ? এই যে আজকে চৈত মাসটা ধৈরা এখটা ছাউল নাই , এখটা খড়ি-খাডি নাই । তুই এখদিন এখটা কুনতা আইন্যা দিছছ , না খ্যামনে কিতা ছলে জিগাইয়া দেখছছ ?
চৈত্র মাসে এলাকায় এমনিতেই তেমন কাজ থাকে না । তার উপর মারুর বাপ মরার আগে বাড়ির ভিটাটুকু ছাড়া এক তিল পরিমাণ জমিও স্ত্রী-সন্তানের জন্য রেখে যায় নি । যারা বাপ-দাদার আমল পার করে তিনপুরুষ ধরে যতেষ্ট পরিমাণ জমি ভোগ করে আসছে , চৈত্র মাসে তাদের পর্যন্ত ভাড়ালে টান পড়ে যায় । তাই চৈত্র মাস আসার পর থেকে শুধুমাত্র এই কয়দিন ধরে মারুর হাতে কোন কাজ নেই । সারা বছর তো একটা না একটা কাজে সে লেগেই থাকে । মাথার উপর রোদের ফুলকি ঝরছে । মায়ের মুখে নিজের সম্পর্কে অযৌক্তিক অভিযোগ শুনে মাথাটা আরো কয়েকগুণ বেশি গরম হয়ে যায় মারুর । চোখ দুইটা জ্বলে উঠে ।
মায়ের দিকে জ্বলন্ত চোখ দুইটা তাক করে বলে , ছালাও নানে দুইদিন , দেখি কিলাখান লাগে । হারা বছর তো গরুর লাখান খাইট্যা মরি । দুই দিন না খরতেই এমন দশা !
মা বলে , এরে , ছউকটি এখবারে গালাইলিমু ! কিতা এখবারে উলডাইয়া দিছো তুমি , আমার জানা আছে না । বাফটায়ই হারা জীবন জ্বালাইয়া গেল আমারে । আমি খতোবার খইলাম , খালের ফাড়ের জমিনডা তুমি বেইচ্য না , বেইচ্য না । ফানির দরে দিল বেইচ্যা ।
এই কাঠফাটা রোদের মাঝে বসে থেকে একটানা এটা-ওটা বলতেই থাকে মারুর মা । গ্রামে কিছু মাঝবয়সী মহিলা থাকে যারা মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও বকবক করার সুযোগ খুঁজে বেড়ায় । নিজের মায়ের ভাব-সাবও ইদানীং এরকমই লাগে মারুর কাছে । তিনমাসের মাথায়ই স্ত্রী ফজিলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পেছনে মায়ের যে যতেষ্ট ভূমিকাই ছিল, আজকাল ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে তা ভালমতই বুঝতে পারে মারু । খুবই আশ্চর্য হয়ে সে খেয়াল করে , রোদের তেজের কারণে বেশ ঘামতে থাকলেও হাঁপিয়ে উঠার পরের ক্লান্তিটা মায়ের কথা- বার্তায় এখন আর একদমই নেই । তার মানে এই বকবকানি আজকে সারাদিন ধরেই বিরামহীনভাবে চলবে । আর কোন কথা না বাড়িয়ে গর্তের ভেতর থেকে উঠে আসে মারু । যাওয়ার আগে কোদালটাকে গর্তের কিনারের ঘাস- মাটিতে সজোরে গেঁথে রেখে যায় । অবদমিত রাগের এই বহিঃপ্রকাশ নদীর ঢালের নিষ্কলুস পলিমাটি বুক পেতে সহ্য করে ।
ইন্ঞ্জিনিয়ারের সঙ্গী দুইজন এখন আজমলের বাড়ির সোজাসুজি নদীর ওই পাড়ের ঢালে মাপ- জোঁক করছে । আর ইন্ঞ্জিনিয়ার নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একবার স্ট্যান্ডওয়ালা দূরবীনের মতো দেখতে একটা জিনিসের দৃশ্য দেখার মতো জায়গায় চোখ রাখছে , আরেকবার হাতে ধরা ছোট একটা কাগজে কি কি যেন লিখে রাখছে । স্ট্যান্ডওয়ালা জিনিসটার নাম থিয়োডোলাইট । বই খাতা সঙ্গে নিয়ে এসে দাঁড়ানো এক স্কুলছাত্রের প্রশ্নের উত্তরে ইন্ঞ্জিনিয়ার নামটা বলেছে । এতক্ষণে এই তিনজন মানুষকে ঘিরে চল্লিশ-পন্ঞ্চাশজনের একটা জটলা তৈরি হয়ে গেছে । যদিও এদের মধ্যে বেশিরভাগই পিচ্চি-বাচ্চা , তবুও এসব নতুন নতুন বিষয় নিয়ে গ্রামের মানুষের কৌতূহলের কোন সীমা থাকে না । বিকালের মধ্যেই হয়ত এই জটলাটা দুই-তিনগুণ বড় হয়ে যাবে । এখানের মাঝবয়সী অনেকেই নিজেদের শৈশবকাল থেকে শুনে এসেছে , পিয়াইন নদীর উপর দিয়ে ভীমখালী থেকে নোয়াখালী বাজার পর্যন্ত বিশ্বরোড হবে । সেই রোড গিয়ে সুনামগন্ঞ্জ-সিলেট রাস্তার সঙ্গে মিলবে । আধা ঘন্টায় সুনামগন্ঞ্জ , দেড় ঘন্টায় সিলেট যাওয়া যাবে । দীর্ঘ নদীপথে শহরের হাসপাতালে নিতে গিয়ে ডালিমের বউ বা আলেয়ার মার মতো আর কোন প্রসূতি মাকে ইন্ঞ্জিন চালিত ট্রলারের একঘেয়ে কর্কশ শব্দ শুনতে শুনতে মাঝপথেই মরে যেতে হবে না । শেষ পর্যন্ত রোডটা হবে ! হবে তো ? মুহূর্তেই আশার নৌকাটা অনিশ্চয়তার ঢেউয়ে দুলে উঠে একটা বাঁক খায় । আরো কয়েকবারও তো মাপ-জোঁক করে নিয়েছে । কোথায় , কাজের তো কোন খবরই ছিল না । বিদ্যুতের মতোই আসবে আসবে করে এই রোডটাও এখন পর্যন্ত কল্পিত বাস্তবতা । চোখের সামনে মাপ-জোঁক করতে দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না জটলা করা লোকদের । একই মুদ্রার 'হেড' আর 'টেল' দুই পিঠের মতো প্রত্যেক বিশ্বাসের খুব কাছের পিঠেই যে অবিশ্বাস ঘোরাঘুরি করতে থাকে , এই মানুষগুলো এই সত্যটা সচেতনভাবে না জেনেও মাঝেমাঝে যতাযত জায়গায়ই অবিশ্বাস করে দুই একটা বড় ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলতে পারে । বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের খেলার মাঝেই যে এদের জীবন কাটাতে হয় ! হয়ত সব মানুষেরই কাটাতে হয় , তবু এদের ক্ষেত্রে কথাটা খুব বেশি মাত্রায় বাস্তব ।
মাটি কাটা ফেলে রেখে হাঁটুর চেয়ে কম পরিমাণ পানিটুকু পেরিয়ে এপাড়ে এসে ন্যাংটিটা খুলল মারু । কোমরের সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধা গেন্ঞ্জিটাকে কোমড় থেকে খুলে এনে পরে ফেলল তাড়াতাড়ি । এরপর মাপ-জোঁক করা লোকদের আশেপাশে ভিড় জমানো জটলাটার সাথে মিশে গেল । যতক্ষণ পর্যন্ত এদের সঙ্গে থাকা যায় , ততোই ভালো । গভীর রাতের আগে বাড়িতে যাওয়া মানে , অযৌক্তিক বকবকানি শোনা । তাই , এদের সঙ্গেই কিছু সময় কাটাবে মারু ।
সিদ্দিকের বয়স পয়ত্রিশের বেশি হওয়ার কথা না । অল্পবয়সে বিয়ে করে ফেলেছিল বলে এখনই সে চার বাচ্চার বাপ । বাচ্চা-কাচ্চার মাঝ থেকে অন্তত একজনকে মাদ্রাসায় পড়াতে হয় বলে দ্বিতীয় ছেলেটাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছে গতবছর । চালচলনে মুরুব্বীয়ানা ভাব আনার জন্য গতবছর থেকে দাড়িও রাখা শুরু করেছে সে । জটলা বাঁধা লোকজনের মাঝখান থেকে অতি কৌতূহলী হয়ে ইন্ঞ্জিনিয়ারকে প্রশ্নটা করায় যেন তাকে ঠিকঠাকই মানিয়ে গেল ।
স্ট্যান্ডওয়ালা থিয়োডোলাইটটার পাশে হাত দুইটা পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল , রউডটা কিতা হাছাই অইবো নি স্যার ?
কাজে নিবিষ্ট থেকেই ইন্ঞ্জিনিয়ার জবাব দিলেন , না হওয়ার কী আছে ?
সিদ্দিক আবার একটু হাসিমুখে বিদ্রুপ করার ভঙ্গিতে বলল , না , অইবো অইবো খইরা তো আমরার জীবন গেল গিয়া । আমরার ফুতের ঘরের নাতিনশায়ও ফাইবো কিনা এখটু বুইজ্যা যাইতাম আরকি ।
এই বিদ্রুপটাতে ইন্ঞ্জিনিয়ারের একটুও লেগেছে বলে মনে হল না । আগের মতই কাজ করতে করতে তিনি বললেন , আচ্ছা বোঝেন ভালো কথা । একটু ওইদিকে সরে দাঁড়ালে ভালো হয় । এটুকু বলে থিয়োডোলাইটের দৃশ্য দেখার জায়গায় চোখ রেখেই স্ট্যান্ডের সাথে প্রায় ঘেঁষে দাঁড়ানো সিদ্দিককে বাম দিকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত করলেন এক হাত নেড়ে । স্ট্যান্ডের পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল সিদ্দিক ।
এরপর আবার জিজ্ঞেস করল , আসল খাম শুরু অইতে আর খতো দিন লাগবো , কনটেকদার সাব ?
'কনটেকদার' শব্দটা খট করে কানে লাগল ইন্ঞ্জিনিয়ারের । এতক্ষণে কাজের মনোযোগ হারিয়ে তীব্র বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি সিদ্দিকের দিকে । ইন্ঞ্জিনিয়ারের সঙ্গী দুইজন ইন্ঞ্জিনিয়ারের বিরক্তির আসল কারণ মনে হয় বুঝতে পারল ।
চোখ-মুখ লাল করে সিদ্দিকের উদ্দেশ্যে একজন বলে উঠল , উনি কন্ট্রাক্টর না ভাই , উনি ইন্ঞ্জিনিয়ার
। এই কথাটা বলে সে যে নিজের অজান্তেই ইন্ঞ্জিনিয়ারের চাপা রাগের সলতাটা খানিকটা উস্কে দিল , তা সে বুঝতে পারল তার কথাটার রেশ শেষ হতে না হতেই ইন্ঞ্জিনিয়ারের জ্বলে উঠা দেখে ।
ইন্ঞ্জিনিয়ার বললেন , আমি আমার কাজ করবো , নাকি আপনার সাথে সওয়াল-জওয়াব খেলা খেলবো ? এই যে আপনি একটানা একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন , করেই যাচ্ছেন । আমিতো আপনার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলাম , এখন আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন ?
সিদ্দিক দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করল , জি , খইন ।
চোখমুখ লাল করে ইন্ঞ্জিনিয়ার বললেন , আর কয়টা প্রশ্ন করার পর আপনি আমাকে মাফ করবেন ? হঠাত্ করে ইন্ঞ্জিনিয়ারের অপ্রস্তুত জ্বলে উঠা দেখে আশেপাশে জটলা করে দাঁড়ানো পিচ্চি- বাচ্চাগুলো ফিকফিক করে হাসি শুরু করে দিল । হাসির চোটে একজনের নাকের শ্লেষা পিচ করে বেরিয়ে উপরের ঠোঁটের আগা পর্যন্ত নেমে আসল । এতে পিচ্চি-বাচ্চাদের দলজুড়ে চলতে থাকা হাসাহাসিটা অট্টহাসিতে পরিণত হয়ে গেল । গড়াগড়ি খেতে শুরু করল একজন আরেকজনের উপর । ঠেলাঠেলির চোটে নদীর খাড়া ঢালের মাটিতে পিছলে পড়ে একজনের কনুইয়ের চামড়া ছিঁড়ে গেল খানিকটা । উঠে এসে সে তার উপর গড়াগড়ি খেয়ে পড়া ছেলেটার কলার চেপে ধরল । " তর বাফের জাগা ইডা ?" "তর বাফের জাগা ?" চেঁচিয়ে দুইজনেই দুইজনের বুকে- পিঠে মুহূর্তেই আট-দশেক কিল-ঘুষি বসিয়ে দিল । এদের ঝগড়া ছাড়িয়ে দিয়ে ধমকে উঠে সবগুলো পিচ্চি- বাচ্চাকে পেছন থেকে তাড়া করে জটলা ভেঙ্গে যার যার বাড়িতে ফিরে যেতে বলল সিদ্দিক । ডানার সঙ্গে ডানার প্যাঁচ লাগিয়ে বেঁধে আনা দুইটা হাঁস ছিল কুতুবের ছেলের হাতে । পূবের হাওরের বোরো ক্ষেতে হামলে পড়া হাঁসের পালের পেছনে পেছনে দৌড়-ঝাঁপ করে এই হাঁস দুইটা ধরে এনেছিল সে । সিদ্দিকের ধাওয়া খেয়ে হাঁস দুইটা ফেলে রেখেই চলে গেল ছেলেটা । একে-ওকে জিজ্ঞেস করার পর কেউ একজনের কাছ থেকে জানা গেল , এই হাঁস দুইটার মালিক তবীর আলী ।
লতিফ হাঁস দুইটার ডানা উল্টিয়ে ডানার নিচে নীল রঙের চিহ্ন দেখিয়ে জোর দিয়ে বলল , অই দ্যাখো , ডানার তলে লিউল্ল্যা রঙ । তবীর বাই ছাড়া আর খেউর আঁসের শইল্য লিউল্ল্যা রঙ দেয় নাকিতা ?
জটলা বাঁধা লোকদের মধ্যে মারুই এখন বয়সে সবার ছোট । সিদ্দিক মারুর হাতে হাঁস দুইটা ধরিয়ে দিয়ে বলল , ইডি তবীর বাইর বাড়িত দিয়া আয় গিয়া । আর তবীর বাইরে খইছ , আঁসটি এখটু সাবধানে রাখতো । অখন মাইনষের খেতো তুর আইতাছে মাত্র । আঁসের ফাল ফইরা যদি ধানের তুর সবতা নষ্ট খইরা ফালায় , মানুষ ইতা সহ্য খরতো কিলাখান ?
হাঁস দুইটা হাতে ধরে তবীর আলীর বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মারু । এতক্ষণ জটলাটার সঙ্গে থাকার কারণে চৈত্রের রোদের তেজটা আর সবার সঙ্গে মিলে সহ্য করাটা তেমন কঠিন ব্যাপার ছিল না । কিন্তু অনেকটা জায়গা একা হেঁটে আসায় চৈত্রের আসল গরমটা এখন টের পাচ্ছে মারু । গরমে পুরো শরীরটা ঘেমে উঠে কাপড়ের সঙ্গে লেপ্টে যেতে চাইছে যেন । বেশ তেষ্টাও পেয়ে গেল তার । তবীর আলীর বাড়িতে কোন মানুষের সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না । পুরো বাড়িটা জুড়ে একটা খাঁ-খাঁ শূন্যতা । উঠানের দক্ষিন দিকের মুর্তার ঝোঁপের পাশে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর চোঙগুলো জীর্ণ শরীর নিয়ে অসহায়ভাবে পড়ে আছে । বেচারা তবীর আলী ! বউ মারা যাওয়ার তিন-চার বছর পার হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত সংসারটাকে গুছিয়ে আনতে পারল না । টেনেটুনে একটা সংসার দাঁড় করানো কত কঠিন , আর কোন একজনের অনুপস্থিতিতেই সবকিছু গাছের শুকনা ডালের মত মচমচ করে ভেঙ্গে পড়াটা কত সহজ ! উঠানের পশ্চিম কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সুপারি আর নারিকেল গাছের দীর্ঘ ছায়া উঠান পেরিয়ে পোড়া ঘাসের মাঠ পর্যন্ত নেমে গেছে । বিকাল হয়ে এল বুঝি ! হাঁস দুইটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বলে তবীর আলীর প্রতি খুব রাগ হল মারুর । কত কষ্ট করে মানুষ ফসল ফলায় । আর তবীর আলী হাঁসের পাল ছেড়ে দিয়ে খেতের পর খেত ধান নষ্ট করাবে , এটা মানুষজন মানবে কেন ? উঠানে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত সে হাঁকিয়ে বলল , তবীর বাই , তবীর বাই , তোমার আঁস ।
এতক্ষণে তড়িঘড়ি করে একজন অল্প বয়সী মহিলা একটা ডালের ঘুটনি হাতে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে । এসেই উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা মারুকে দেখে পুরোপুরিই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে । রান্না করতে করতে খানিকটা বিস্ত্রস্ত হয়ে পড়া গায়ের শাড়িটা ঠিক করে ঘোমটা টানে মাথায় । মারুও বছরখানেক আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া তার সাবেক স্ত্রী ফজিলার সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরিই ভ্যাঁবাছ্যাকা খেয়ে যায় । ফজিলার দিকে হাঁস দুইটা এগিয়ে দিয়ে হতভম্বভাবে সে বলে , আঁশ দুইডা ।
স্রেফ এটুকুই বলে মারু । ফজিলা প্রথম দৃষ্টিটার পর আর একবারও মারুর চোখে চোখ রাখার লজ্জাটুকু সরাতে পারে না । লজ্জাবনত চোখে হাঁস দুইটা হাতে নিয়ে আর একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে দ্রুত সে বাড়ির ভেতরে চলে যায় । ফেরার পথে মারু তবীর আলীর বাড়ির সামনের মাঠটার ভেতর দিয়ে ছুটে চলা চকের পথটা ধরে কয়েক পা এগোনোর পরই ঝিরঝিরে বাতাস বইতে শুরু করে । ডানদিকের বিস্তৃত ধানখেত চৈত্রের এই কয়দিনের ভেতরেই গাঢ় সবুজ রঙ ধারণ করে ফেলেছে । কয়েক জায়গায় ধানের শিষও পাতলাভাবে বেরিয়ে গেছে । ঝিরঝিরে বাতাসে মাথা দুলিয়ে ধানখেতের পুরো সবুজ রঙটাই যেন বৃষ্টির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে এখন । এই বৃষ্টিটা আসলেই খুব দরকার । হঠাত্ করে বাতাসের একটা জোর ঝাপটা এসে সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে পড়ে থাকা কয়েকটা শুকনা পাতা আর একটা আধছেঁড়া চানাচুরের প্যাকেট খানিকটা দূরে ঊড়িয়ে নিয়ে সবগুলোকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘোরাতে লাগল । চৈত্রের ঘাস-পোড়া গরমটা নিমেষেই এই বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল । মারুর শরীরটা স্থির প্রশান্তিতে শীতল হয়ে এল । কিন্তু কিলবিলিয়ে উঠা মনটাকে কিছুতেই স্থির করতে পারল না সে । বিলের পানিতে আজকের মত নিজের নিয়মে ডুব দেওয়ার আগেই একদল পাতলা মেঘ এসে সূর্যটাকে আবছা করে দিল । আজ রাতে কি বৃষ্টি হতে পারে ? হোক বৃষ্টি । চৈত্রের এই সময়টাতে বৃষ্টিটা খুব দরকার ফসলের জন্য । সময়ের আগেই পাতলা মেঘের আড়াল পেয়ে লুকিয়ে যাওয়া সূর্যটা যেন মারুকে দেখে লজ্জা পেয়েই তড়িঘড়ি করে গা ঢাকা দিতে চাইল নিজে থেকে । তবীর আলীর বাড়ির উঠানে ডালের ঘুটনি হাতে এসে দাঁড়ানো ফজিলার লজ্জাবনত চোখ দুইটা কিছুতেই এই মুহূর্তে ভুলতে পারে না মারু ।