নিজেদের গ্রাম থেকে ভাস্করকে বের করে দিয়েছে সব চামাররা মিলে। অবশ্য ওরা বের করে দিতে পারতো না যদি মদখোর কলিমের ইচ্ছা না থাকতো। ভাস্কর এর ঘরে সুন্দরী একটা কমবয়সী মেয়ে ছিল বলে মদের কাস্টমাররা সবাই মাছির মতো ভাস্করের ঘরে ছুটে আসতো। দুই একজন অনেক কষ্ট করে পুরাতন ছেঁড়া জুতাও খুঁজে বের করে নিয়ে আসতো সেলাই করানোর জন্য। বাজারে প্রতিদিনই জুতা সেলাইয়ের জন্য বসে ভাস্কর। তবু সেলাইয়ের জন্য জুতা নিয়ে বাড়িতে আসা এক ঢিলে কয়েক পাখি মারার মতো- মদ, জুতা সেলাই এবং যদি আরো কিছু পারা যায়। এদিকে কাস্টমার শূন্যতায় অন্যদের মদ বানানোর জন্য পঁচানো ভাতের বিশ্রী গন্ধে আকাশ ভারী হতে লাগলো। ভাস্করের সুখ অসহ্য হয়ে উঠলো অন্যদের কাছে। এক হাঁড়ি মদ খেয়ে এক রাতে ভাস্করের বউ-মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিল ভাস্করের এক ভাতিজা। চণ্ডি, ভূদেব আর রামও এসে যোগ দিল। বাইরে দড়িতে শুকাতে দেয়া ভাস্করের বউয়ের একটা আধময়লা শাড়িতে মাটি ভর্তি করে পেঁচিয়ে পাশের ডোবায় ফেলে দিল রাম। মন্টু একটা মাঝারি আকারের বাঁশ দিয়ে মাটির বেড়ায় দুইটা আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললো উত্তরের বেড়াটি। গণেশ কুকুরের মতো চিৎকার করে ভাস্করকে বেরিয়ে আসার জন্য ডাকতে লাগলো। ভাস্কর আর তার বউ দরজার সামনে এসে নিজেদের ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিল। চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে উঠে ভাস্করের আট-নয় বছরের ছেলে সুশীল মাছ-সবজি কাটার দা নিয়ে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলো। ভাস্করের বউ হাউমাউ করে কেঁদে বুঝিয়ে রাখলো ছেলেকে। গালাগালি, হাউমাউ, চেঁচামেচিতে নিজেদের কানই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো- কিন্তু মারামারি হলো না। একে একে সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসলো। শুধু ভাস্করের মেয়েটি বের হলো না। ভাঙ্গা মাটির বেড়াটি তার ক্রমবর্ধ্মান হৃদস্পন্দনগুলো অনুভব করলো গভীর মনযোগে- নীরবভাবে।
চণ্ডির বাপ মাটির কলসি ভর্তি করে মদ দিয়ে এসেছিলো কলিমের বাড়িতে। ভাস্কর দেখলো কলিমই শেষ রাতে এসে সবকিছু শান্ত করে দিল। কার্তিকের শেষ রাতের হালকা শিশির ভেজা বাতাসে নাক শিরশির করছে, তবু শরীরটা এখনো গরমই রয়ে গেছে ভাস্করের। একটা হিসাব সে মেলাতে পারছে না কোনভাবেই- এতকিছু ঘটলো কীভাবে? কয়দিন পরপরই তো ঝগড়াঝাঁটি হয় নিজেদের মধ্যে। কিন্তু সেটা কথ্য বা অকথ্য গালাগালি, বড় জোর চুলাচুলি পর্যন্ত। নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গচুর, ধবংস এর আগে কখনোই হয়নি। ভাঙ্গচুর করার মতো কী সম্পদই বা আছে তাদের? তাই মুখই তাদের প্রধান অস্ত্র। সৃষ্টিকর্তা এক আশ্চর্য মিল রেখে দিয়েছেন সমাজের শাসকশ্রেণি এবং একেবারে নিচু শ্রেনির মানুষের মধ্যে- মুখই তাঁদের প্রধান অস্ত্র! এরপর অন্য কিছু- কারো লাঠি, দা, ছুরি। কারো পিস্তল, বন্দুক, একে ফোর্টি সেভেন।
নদীর পারে খাস জমিতে ভাস্করকে একটা ঘর তোলার সব ব্যবস্থা করে দিল কলিম। নিজের ঝাঁড় থেকে বাঁশও দিল কয়েকটা। ওরা যাতে ভাস্করের কোন জিনিসই ভোগ করতে না পারে সেটাও দেখলো সে। জুতা কালি করার বুরুশটিও পর্যন্ত কেউ রাখতে পারেনি। নদীর পশ্চিম পারের বাঙ্গালিদেরও সাহায্য পেল কান্নাকাটি করার পর। জুতা সেলাই, কালি করার যন্ত্রপাতি, তিনটা শূকর আর মদের হাঁড়ি-কলসি নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলো ভাস্কর । কাস্টমারের অভাব হলো না এখানেও। আগের মতোই জমজমাট হয়ে উঠলো ব্যবসা। তবু মাঝে মাঝেই হাওরের শেষ দিকের ছয় ঘরের ক্ষুদ্র গ্রামটির কথা মনে পড়ে ভাস্করের। বেশ কয় বছর আগে বাঙ্গালিরা তার দাদাকে এ জায়গাটুকু দিয়েছিলো নিজেদের কাজ করে দেওয়ার জন্য। সেখানেইতো তার জন্ম হয়েছে, কৌশর যৌবন কেটেছে। মানুষের জন্মের কথা শাসকেরা অস্বীকার করলেও জননী আর জন্মভূমি কখনোই অস্বীকার করেনা। হয়তো সেই গ্রামের মাটিও ভাস্করের হাঁটার শব্দ শুনতে চাইছে আকুল হয়ে। ভাস্করের সন্তানেরাও অনুভব করে সেই একই টান। বউ হয়তো কোন টানই অনুভব করে না। করলেও খুবই কম। তবে কেউ কাউকে এসব নিয়ে কিছু বলে না। একটা স্পষ্ট আকুলতা মাঝে মাঝে সবারই চোখে ফোটে উঠে।
নিজেদের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করিয়ে ভাস্করকে নতুন জায়গায় নিয়ে আসাতে কিছুটা লাভই হয়েছে কলিমের। ইচ্ছামতো যখন তখন ভাস্করের মেয়েকে দিয়ে চুলগুলো আচড়ে নিতে পারে, শরীরটা টিপিয়ে নিতে পারে। দুপুরবেলা কলিম আসলে মাঝে মাঝে ভাস্করের বউই মেয়েকে বলে, ‘তোর চাচার মাথাডা টিইপ্যা দে। মাথাত ধইরালিছে মন অয়।’ কলিম মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘লাগতো না। মেয়ে মাথার চুলে আলতোভাবে বিলি কাটতে থাকে। কলিম মনে মনে আনন্দ পায়। আবার কিছুক্ষন পরেই আনন্দ মাটি হয়ে যায়। একটা নীরব সময়ের জন্য অস্থিরতা বেড়েই চলে। ভাস্করের বউ সামনে বসে এটা ওটা আলাপ করতে থাকে। ক্রমেই ভাস্করের বউয়ের কথাগুলো নিজের চায়নিজ মোবাইলের কর্কশ রিংটোনের মতো কানে বাজে কলিমের।হঠাৎ করে সে চেঁচিয়ে উঠে, -‘ গোসল খরছ নি এইকহছামান্নি?’ -‘না আজকে করছি না।’ -‘কোনদিন করছ তোরা ছামারের জাত?’ বলেই উঠে দাঁড়ায় কলিম। - ‘দে এক ব্যাগ মদ দে।’ একটা পুরাতন প্লাস্টিকের জগে আধাজগ ভর্তি করে মদ নিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে ভাস্করের বউ। মেয়েটা ভাস্করের কয়েক মাসের ময়লা একটা ধুতি দিয়ে একমাত্র কাচের গ্লাসটাকে ঘষে দেয় তাড়াতাড়ি। গ্লাস ভর্তি মদ নিয়ে একবার দেখে নেয় কলিম। বাচ্চাদের পেশাবের মতো স্বচ্ছ দেখায় গ্লাসের ভেতরের বাংলা মদকে। এরপর গদ্গদ করে গিলে ফেলে দুই-তিন গ্লাস। যাবার আগে পেছন ফিরে ভাস্করের ধুতি নাড়তে থাকা মেয়েটাকে ঝাপসা চোখে একপলক আপাদমস্তক দেখে নেয় কলিম।মেয়েটা মনে হয় গোসল করে প্রতিদিন। হঠাত পিটের কাছে জামার ছেঁড়া অংশটুকুতে চোখ আটকে যায়। এরপর মাথাটা একটু ঘুরতে থাকে। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
মেয়ের জন্য জামাই ঠিক করে ফেলে ভাস্কর। হাটের দিনে তার পাশেই জুতা সেলাইয়ের বসে ছেলেটা। ভারি কর্মঠ। কাজ ছাড়া একদিনও বসে থাকেনা। দশ মাইল দুরের বাজারেও জুতা সেলাইয়ে চলে যায়। যৌবনে ভাস্কর এর চেয়ে বেশি কাজ করেছে সন্দেহ নেই। তবুও আজকালের দুনিয়ায় এটুকু কর্মঠ আবার জাতের ছেলে পাওয়া যাবে কোথায়? তাই নদী শুকিয়ে যাবার আগেই একদিন মেয়েকে বিয়ে দেয় ভাস্কর। আত্মীয় স্বজন কেউই আসেনি বিয়েতে। ভাস্করের অতিথি বলতে উপস্থিত থাকে আশেপাশের বাজারগুলোতে জুতা সেলাই করতে গিয়ে ভাব জমে উঠা চামাররাই। কলিমকেও নিমন্ত্রণ করেছিল ভাস্কর। কিন্তু কলিম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে জবাব দিয়েছিল- ‘ছামারের বিয়াত আমি যাইমু, না?’
যে চামারের জন্য কলিম এত কিছু করলো, এই চামারের মেয়ের বিয়েতে যেতে তার এতো জোর আপত্তি কেন তা বুঝে উঠতে পারেনি ভাস্কর। যাহোক, মদ বিক্রি আর জুতাসেলাই করে জমানো টাকা দিয়ে জাঁকজমকেই মেয়ের বিয়ে দিলো ভাস্কর। বিয়েতে আসা বরযাত্রী বা অন্য চামাররা কেউই বিয়ের আয়োজন নিয়ে কোন কথা বলতে পারে নি। জামাইকে ধুতি গেঞ্জি শার্ট সবই দেয়া হলো।
মদ খাওয়ার জন্য কলিমের কোন সময়ের বাছ-বিচার নেই। ভর দুপুর বা মাঝরাতে যে কোন সময় এসে ধপ করে বসে পড়ে ভাস্করের ঘরের একমাত্র খাটটাতে। তারপর গম্ভীর হওয়ার ভাব নিয়ে ভাস্করের বউকে বলে, ‘মদ আন।’ ভাস্করের বউ যত যত্নের সাথেই মদ পরিবেশন করুক না কেন তাতে মন ভরে না তার। হঠাৎ গম্ভীর ভাব ছেড়ে রেগে উঠে চেঁচাতে থাকে, ‘যে খাম পারছনা, এই খাম করতে যাছ ক্যানে, এই মাগী?’ কোন কাজে ত্রুটি হয়েছে তা বুঝতে না পেরে ভয়ে ভয়ে ভাস্করের বউ জিজ্ঞেস করে, ‘কিতা অইছে?’ পালটা প্রশ্ন শুনে মাথা আরো বিগড়ে যায় কলিমের। খাট থেকে উঠে এসে ভাস্করের বউয়ের চুলের গোছায় টেনে ধরে বেঁহুশের মতো সজোরে লাথি মারতে থাকে তলপেটে। প্রচণ্ড ব্যথায় , মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ভাস্করের বউ। আর চিৎকার করতে থাকে তারস্বরে। চিৎকারের শব্দ আর্তনাদ হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে নদীর পার জুড়ে।
রাতে হাট থেকে ফিরে ভাস্কর আর তার ছেলে সুশীল দুজনই ঘটনা শোনে। রাগে সুশীলের পুরো শরীরটা ঘেমে যায়। ঘরের বেড়ায় গেঁথে রাখা পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত তিনটা চাকু থেকে একটা চাকু নিয়ে কলিমকে মেরে ফেলার জন্য বেরিয়ে যেতে প্রস্তুত হয় সুশীল। ভাস্করের বউ কান্নাকাটি করে ছেলেকে বোঝাতে থাকে। ভাস্কর নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে আসে। শূন্য দৃষ্টিতে কলিমের ব্যবস্থা করে দেয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটাকে নরকের পার্থিব রূপ বলে মনে হয় । আগামী ভোরের আলো ফুটলেই কি ধূসর হয়ে মিলিয়ে যাবে এর ভৌতিক হাতছানি ? ভাস্কর তা জানে না । তবু সে অধীর হয়ে বসে আছে সে আলোর অপেক্ষায় ।
০৬ এপ্রিল - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৮ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৪৩
বিচারক স্কোরঃ ২.৫৬ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৮৭ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪