যেখানে কাশবন ছিলো

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

জুয়েল বড়ুয়া বাপ্পু
  • 0
  • 0
  • ৩৪
পর্ব এক

:কই যাও লালন মাঝি ?
:গাঙের ওপারে ঘাটে যাই।
:আসমানের মেঘগুলান দেখছো মাঝি। অহন তো মনে হয় বৃষ্টি ঝাপাইয়া নামবো !
:হ তা নামবো। তবু যাওন লাইগবো।
:ডিঙিখান ভিড়াও মাঝি। আমারে ও লইয়া যাও।
:তুই কই যাবি নিয়তি !
:ওপারের ডাকঘরে যামু।একখান চিঠি ছাইরা আসন লাগবো।
:আমারে দিয়া দে আমি ছাইড়া আসুম নে। অহন বৃষ্টি নামবো ভিইজ্যা যাবি।
:না ! তোমারে দেওন যাইবো না মাঝি। তুমি ডিঙিখান ভিড়াও। বৃষ্টিতে ভিজলে ভিজুম নে। বৃষ্টিতে ভিজনের আলাদা একখান সুখ আছে ।
:ঠিক আছে নাইমা আয়।
:কারে আনিবার যাও মাঝি?
:শহর থেইক্যা মাষ্টার দাদাবাবুর একজন বন্ধু আসতাছে। তারে আনিবার যায়। নতুন মানুষ কিছুই নাকি চেনে না।
:আচ্ছা একখান কথা কই মাঝি মাষ্টার দাদাবাবু আপনজন ছাইড়া এতদূরের একটা গাও গ্রামে কি লাইগ্যা একলা একলা আছে?
:তা কইবার পারুম না। আমি ও একবার জিজ্ঞায়ছিলাম। আমারে কইলো জীবন খুঁজতে খুঁজতে নাকি চইল্যা আইছে। কথাটার অর্থ কিছুই বুঝবার পারি নাই।
তুই অহন ডাকঘর খোলা পাবি নিয়তি ? বিকেল বেলা তো পার হয় মনে হয়।
:হ পামু নে।শেষ বিকেল পর্যন্ত খোলা থাকবো।
:কারে চিঠি পাটাস নিয়তি ?
:তোমারে কমু কেন মাঝি !
:মন না চাইলে কইস না। এমনে জিজ্ঞাবার মন চাইলো তাই কইলাম। কারো লগে বুঝি ভাব ভালোবাসা হয়ছে? (নিয়তি মাথার উপরের শূন্যতার আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো )
:আচ্ছা মাঝি কইবার পারো কোন একখান মাইনষের লাইগা বুকের ভেতরখান খালি খালি লাগনটারে বুঝি ভালোবাসা কয়?
:কইবার পারুম না। তয় ভালোবাসার মানুষটানরে আগলায় রাখন লাগে। থুইয়া গেলে আর ফিইর‌্যা আহে না...। ( লালন মাঝির বুকের খূব গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাম নেমে এলো )
:তাড়াতাড়ি চলো মাঝি বৃষ্টি তো নাইমা আইলো। লালন মাঝি বৈঠা দিয়া নাও বাইতে লাগল।



পর্ব দুই

বাস থেকে নেমেই আকাশের দিকে থাকালো নীল। আকাশের প্রায় সবটায় জুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কালো মেঘের ভেলা। চারিদিকে কিছুটা আঁধার হয়ে গেছে। কিছুটা ভারী ভেজা হাওয়া ভেসে আসছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। নীল চারিদিকে একটু দেখলো। জায়গাটা কেমন যেন একটু নির্জন। আশে পাশে কোন জনমানবের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। দূরে একটা গ্রামের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। চারপাশে কেবল সবুজ ধানক্ষেত । রাস্তার ডান পাশে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একটা মেঠো পথ ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে। নীল সে পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। এরমধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নীল এগিয়ে যেতে লাগলো।ধানক্ষেত পার হতেই গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ডুকতেই একটা ছোট চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে নীল সেখানে ডুকল। দোকানটাতে আর কোন মানুষজন নেই। একজন বৃদ্বলোক সেখানে বসে আছে। শীর্নকার দেহ,উদোম শরীর। নীলকে দেখেই লোকটি বলে উঠল :এক্কেবারে তো ভিইজ্যা গেছেন। শহর থেইক্যা আসতাছেন বুঝি ?। নীল লোকটার মুখের দিকে থাকালো। লোকটার অবয়বে একধরনের সারল্যতা আছে।
:হ্যাঁ শহর থেকে আসছি।
:চা খাইবেন ?
:এক কাপ আগুন গরম চা দিতে পারবেন।
:কোনখানে যাইবেন বাবু ?
:মধুমতি নদীর পাড়ে দীঘির পাড় গ্রামে যাব। কিন্তু নদীটা এখান থেকে আর কতদূর?
:ধরেন বাবু চা লন আপনের আগুন গরম চা। আমাগো এই গাঁ পাড় হইয়া সামনে আধক্রোশ হাঁটলেই মধুমতি নদীর ঘাটে গিয়া পৌঁছাইবেন। নদীখান পাড় হইলেই দীঘির পাড় গ্রাম।
চা শেষ করে নীল দোকান থেকে উঠে আবারো হাঁটতে শুরু করলো বৃষ্টির মধ্যে। বৃষ্টির মাঝে একা একা হাঁটতে নীলের দারুন লাগে। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর ঝাপটা যখন মুখে এসে পড়ে তখন এক ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হয়। অনুভূতিগুলো বুকের ভিতরে এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে দিয়ে যায়। সে সময় ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে তাদেরকে। যে প্রিয় মুখগুলো কষ্ট দিয়ে দূরে সরে গেছে...।
হালকা বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে নীল নদীর কাছাকাছি এসে পৌঁছলো।চোখের সামনে এখন মধুমতি নদী। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নদীর জলে মিশছে। নদী যেন অভিমানী জলগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে দুরে-বহুদূরে আর কখনো ফিরবে না বলে। নীল নদীর তীরে এসে দাড়ালো। ঘাটে কয়েকটা নৌকা বাঁধা। চরের উপর কুড়েঘরের মতো একটা চাউনিতে কয়েকজন মাঝি বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বসে আছে। সবার হাতে বিড়ি। মনে হয় শরীরের উত্তাপের জন্য এই মুহুত্বে বিড়িটা ওদের জন্য অপরিহার্য। পারাপারের জন্য মানুষজন নেই বললেই চলে। বৃষ্টিটা আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। নীল দেখলো চাউনি থেকে একটা দাড়িভর্তি মুখওয়ালা লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে বলল-
:আপনে কি নীল দাদাবাবু ? দীঘির পাড় গ্রামে যাইবেন?
:হ্যাঁ আমি দীঘির পাড় যাবো।
:আমি লালন মাঝি। অনিক মাষ্টারদাদাবাবু পাঠায়ছে আপনারে নেওয়নের লাইগা। আপনে তো ভিইজ্যা গেছেন গা। আপনের সাথে ছাতা ছিলো না বুঝি ?
নীলের সোল্ডার ব্যাগের ভিতর একটা ছাতা আছে। কিন্তু নীল ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজবে বলে সেটা বের করে নি। লালন মাঝিকে তা বলাটা অপার্থিব মনে হলো নীলের কাছে।
:দাদাবাবু কি চাউনিতে একটু বইবেন নাকি ডিঙিতে উঠবেন?
:না মাঝি চলেন নৌকায় বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অনেকদিন নদী পার হই না।
নীল নৌকায় ওঠে বসল। লালন মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।


পর্ব তিন

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। দিনের আলোটুকু মুছে গিয়ে একটু তাড়াতাড়ি যেন আঁধার নেমে এসেছে। একটানা বৃষ্টির শব্দ ভেঙে পড়ছে টিনের চালে। রুমের মধ্যে একটা হারিকেন মিঠ মিঠ করে জ্বলছে। সেই হারিকেনের আলোতে অনিক একটা উপন্যাস পড়ছে। জানালা দিয়ে অল্প দূরের নদীটা দেখা যাচ্ছে।জানালার বাম পাশে লালন মাঝির বাড়ি। জানালার পাশে দাড়িয়ে নীল হাতে এক কাপ চা নিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে নদীর জলে ক্লান্তিহীনভাবে বৃষ্টি নেমে আসার দৃশ্যটা অবলোকন করতে লাগল। বৃষ্টির শব্দের পৌনঃপুনিক নিরবতা ভেঙে চায়ে চুমুক দিয়ে নীল বলল-
:এভাবে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন অনিক ?
উপন্যাসের পাতা থেকে চোখ তুলে অনিক নীলের দিকে থাকালো।নীল তখনো জানালার বাহিরে বৃষ্টির পানে তাকিয়ে আছে।
:যদি বলি জীবনের প্রয়োজনে !
:জীবনের প্রয়োজনে!!! জীবনের প্রয়োজনে তুই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস অনিক? নিজের ইচ্ছায় সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাকে তুই জীবনের প্রয়োজন বলছিস ?।
:নীল একজন মানুষ কখন তার প্রিয়মুখগুলো থেকে দূরে সরে আসে ।কখন নিজেকে একা করে গোপন দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে নিজ অস্তিত্বটাকে মুছে ফেলতে চায় । বলতে পারবি ?।
:মানুষ নিজ অস্তিত্ব কি মুছে ফেলতে পারে অনিক?
:জানি পারে না।কিন্তু অনাহুত হয়ে বেঁচে থাকাটা তো মৃত্যুর আয়োজন !
:তবে তুই কি বলতে চাস অনিক প্রেম, ভালোবাসা,মায়া ,অভিযোগ ,অভিমান,অধিকার ,অনুযোগ এই সবকিছুই মিথ্যে?।
:আমি টিক জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজনের ভিন্নতা রয়েছে। আর হয়তো প্রয়োজন শব্দটা বোঝার যোগ্যতাই আমার ছিলো না। আর যখন থেকে প্রিয় মুখগুলোর অবহেলা পেতে শুরু করলাম সেদিন থেকে সব যোগ্যতা হারিয়ে ফেললাম।
:তাই যদি তুই ভেবে থাকিস এভাবে পালিয়ে না থেকে অধিকার নিয়েই তো প্রিয় মুখগুলোর সামনে দাড়াতে পারতি?
:যোগ্যতা হারালে অধিকার শব্দটা গৌন হয়ে যায় নীল!!!।
:অনিক তবে কাপুরুষের মতো জীবন থেকে পালিয়ে থাকাটায় এখন তোর কাছে জীবন ?
:আমাকে কেউ বুঝে নারে!কেউ বুঝে না।
:তুই নিজেকে নিজে বুঝিস তো?
:হয়তো।হয়তো না।
বাহিরে এখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টির জল বাতাসের ঝাপটায় জানালা দিয়ে নীলের মুখে এসে পড়ছে।নদীটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে সামান্য কতদূর।এখন পুরোপুরি আঁধার নেমে এসেছ্।েনীল বৃষ্টি থেকে মুখ ঘুরিয়ে অনিকের দিকে দাড়ালো।
:তুই হেরে গেছিস অনিক! তুই হেরে গেছিস!
:কিছু কিছু জীবনকে হেরে যেতে হয় নীল।
নীল অনিকের চোখের দিকে চোখ রেখে তাকালো।অনিকের চোখে এক ধরনের গভীরতা মিশে আছে যেখানে কষ্টগুলো খুব সহজেই লুকিয়ে ফেলতে পারে।
:অহনা কেমন আছে জানিস অনিক ?
:কেন একটা প্রাচীন অতীত সামনে এনে দাড় করাচ্ছিস!।
: নিজের জীবনের স্বপ্ন ভুলে থাকার চেয়ে বড় ব্যার্থতা তো আর কিছুই নেই।কেন মিথ্যা বলছিস অনিক?।
অহনা তোর ভালোবাসা !!! প্রকৃতির নিয়মে হয়তো কখনো কখনো আজকের সত্য আগামীকাল মিথ্যার মুখোশে ঢাকা পড়ে। তবু সত্যটা তো অবিনশ্বর।তুই কি চাইলেই মিথ্যে করে দিতে পারবি তোর হৃদয়ের গোপন যন্ত্রনা।
:ভালোবাসা শব্দটা যখন একবার মিথ্যে হয়েই যায় কিছূ জীবনে সেটা আমৃত্যু মিথ্যা হয়েই রয়ে যায়।একটা অতীত টেনে এনে কেন ভালোবাসা শব্দটা কে অপমান করছিস নীল ?।
:তুই ভুল অনিক !এই নে তোর প্রশ্নের উত্তর।
নীল অনিকের দিকে একটা কাগজ সামনে বাড়িয়ে দিয়েই রুম থেকে রের হয়ে সামনের বারান্দায় এসে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো...।
অনিক কাগজটা খুলতেই দেখলো অহনার হাতের লেখা।হঠাৎ মস্তিস্কের মাঝে ম্মৃতির টুকরোগুলো আঘাত করা শুরু করলো-
অনিক.
”আমি বুঝতে পারি নি কাজলকালো স্বপ্ন ছিলো তোমার ঐ সীমান্তে ভাসানো বৃষ্টির আকাশ নিলীমায়।কি আভা ছিলো তোমার ঐ কপোল জুড়ে অবিরাম রক্তিম আভা।আমি বুঝতেই পারি নি এক একটি শরত বিকেল তোমার কাছে সন্ধ্যার আকুতির মতো ছিলো।তুমি তো সব লুটিয়েই আমার পদতলে নিঃস্ব হতে চেয়েছিলে ভালবাসবে বলে...।কিন্তু আমি !!!
সত্যিই আমি বুঝতে পারি নি তোমার অবারিত ভালোবাসা।তাই মুক্তো ডানা জোনাক ঘিরে আমি আকাশের তারা হয়ে গেলাম। বিবেকে আমাকে ক্ষমা করে নি তাই চলে গেলাম মৃত্যুর ওপারে...। জানি তুমি ও ক্ষমা করবে না। তবু ক্ষমাপ্রার্থী...।
তোমার কাশবন ।
অনিক রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো। এখনো একটানা বৃষ্টির শব্দ মাটির বুকে আঁচড়ে পড়ছে। বৃষ্টি অবিরাম জল যেন পৃথিবীর সব স্বপ্নগুলো আজ ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে।নীল তাকিয়ে দেখলো অনিকের চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্র“জল। অশ্র“সিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

২৬ মার্চ - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪