আসাদ ঘুমাচ্ছে।
গভীর ঘুম।
পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমাতে গেছে নিজেও জানে না। বাতি নিভিয়েছিল কী না, দরজা-জানালা ঠিকমত বন্ধ করেছিল কী না ইত্যাদি কিছুই বলতে পারবে না। আসাদ ক্লাস এইটে পড়ে। বয়স তেরো। কিন্তু রুমে সে একাই থাকে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দুঃসাহসী। ভয়-ডর ছাড়াই যেন তাকে তৈরি করা হয়েছে। দাদা বলেন, আসাদ আসলে আসাদ-ই (সিংহ)। সেই গভীর ঘুমটা আচানক ভেঙ্গে গেল। মনে হচ্ছে গায়ের ওপর ভারী কিছু বসে আছে। বড় বড় মোলায়েম পশমের পরশ অনুভূত হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিল যে, চোখ কচলে ভাল করে দেখতে হবে। কিন্তু, একি! চোখ যে খোলা যাচ্ছেনা, হাত-ও নাড়তে পারছেনা। চোখ, হাত-পা সব কিছু যেন চেপে ধরে রাখা হয়েছে। নাকের ওপর ভারী শ্বাস পড়ছে। ভাল্লুক জাতীয় কোন জন্তু বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভাল্লুকের তো এতক্ষনে তাকে মেরে কেটে খেয়ে-দেয়ে সাবাড় করে ফেলার কথা। তা-ও করছে না। তবে কি ? জীন-ভুত ? এবারে সত্যি সত্যি ভয় পেল দুঃসাহসী আসাদ। জীন-ভুত যা-ই হোক না কেন, তার কাছে এই মুহূর্তে আসাদ ষোলআনাই অসহায়। তবে ভাগ্যিস, প্রাণীটা কোন ক্ষতি করছে না। এই কারণে আসাদ একটু স্বস্তিতে আছে, এই যা! ঠাণ্ডা মাথায় দোয়া-দরুদ পড়তে হবে। জীন-ভুত তাড়ানোর একমাত্র পদ্ধতি। কিন্তু ঠোঁটও নাড়তে পারছেনা। অতএব, আসাদ মনে মনে পড়তে থাকল দোয়া-দরুদ যা সে জানত। কাজ হল। সারা শরীরের ওপর থেকে চাপটা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। এক পর্যায় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু চোখ খুলতে পারছে না। কানে এল শিঞ্জন, ধীরে ধীরে তা-ও মিলিয়ে গেল। আসাদ! ওঠ্, আজান হয়েছে অনেকক্ষণ। তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ে নে। আসাদের আম্মা ডাকছে। ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে আসাদ ওঠে পড়ে। নামাজ-কালাম শেষে আবার বিছানায় শোয়; আর একটু যদি গড়ানো যায়! এই সময় তার নজর পড়ে টেবিলের ওপরে। নাহ্, সে তো এমনভাবে সাজায় নি। সব কিছু কে যেন ওলট্-পালট্ করে রেখেছে। বিস্মিত আসাদ উঠে বসে। আরে! ডায়েরীর পাতা খোলা! অথচ কাল রাতে সে ডায়েরী ধরেই নি। এই ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত। শুধু কি খোলা ? কে যেন কিছু লিখে গেছে। অনেক বড় অনুচিত কাজ। একজনের ডায়েরীতে অন্যজন লিখবে কেন ? রেগে উঠতে গিয়েও কিন্তু আসাদ রাগ করতে পারল না। কারণ ? হাতের লেখা। অপূর্ব! সে তো দেখেনি, অন্য কেহ কোনদিন দেখেছে কী না তাতেও সন্দেহ। ইশ্! পরীক্ষার খাতায় সে যদি এমন করে লিখতে পারত!! আসাদ আবার তাকাল। মুক্তার মত হস্তাক্ষরে কে যেন একটি চিঠি লিখে গেছে।
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় আসাদ, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই এবং তোমাকেও আমার বন্ধু রূপে পেতে চাই। আশা করি প্রত্যাখ্যান করবে না। তাই আজ তোমার সাথে মোলাকাত করতে এলাম। ইতি, দোস্ত।
চিঠিখানা পড়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকের মত গতরাতের সব ঘটনা আসাদের মনে পড়ে গেল। আর কোন সন্দেহ নেই, যে কাল রাতে তাকে জীনে ধরেছিল। যেহেতু বন্ধুত্ব পাততে এসেছিল, এ জন্য কোন ক্ষতি করে নি। কিন্তু সে এখন কী করবে! প্রায় পনের মিনিট যাবৎ আসাদ কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে বসে রইল। অতঃপর ধীর পায়ে সে ঘর থেকে বের হল। দেখা করল মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে। বুজুর্গ মানুষ, আসাদকে আপন সন্তানের মত স্নেহ করেন। সব শুনে তিনি বললেন, “বাবা, তাবিজ নেয়ার কোন দরকার নেই। সাহস হারাবে না। আর জীন তো তোমার কোন ক্ষতি করছে না। না,হয়— দোস্তি পাতিয়েই নাও। ” বলতে বলতে হুজুর হেসেই দিলেন। এমনিতেই দুঃসাহসী, তার ওপরে হুজুরের অভয়বাণী। আসাদের সাহস পুরোমাত্রায় ফিরে এল। সিদ্ধান্ত নিল, সে জীনের সাথে বন্ধুত্ব পাতবে। কিন্তু কেমন করে ? সারাদিন সকল কাজের ফাঁকে নানা ধরণের বুদ্ধি আঁটতে থাকল সে। অবশেষে শোয়ার সময় সঠিক বুদ্ধিটা মাথায় এল। যেখানে জীন চিঠি লিখেছিল, তার নিচে সেও দু’লাইন লিখল। ওয়ালাইকুম সালাম, প্রিয় দোস্ত, এ কেমন আমন্ত্রণ! আর একটু হলেই তো দম বন্ধ হয়ে অক্কা পেতাম। যদি দেখা দাও, তবে বন্ধুত্বে আমার আপত্তি নেই। ইতি, আসাদ। নিয়মের ব্যতিক্রমে বাতিটা না নিভিয়ে আসাদ শুয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। :দোস্ত আর কত ঘুমাবে ? ওঠ! :কেন ? কি হয়েছে ? :আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছ দেখে খুশি হয়েছি। দেখ, আজ তোমার চোখ-মুখ চেপে ধরি নি। :তা বটে, কিন্তু আমি তোমায় দেখছি না যে। তুমি আসলে কে ? :আমি আসলে জীন। আমাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তা এমনভাবে তৈরী করেছেন যে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করা ব্যতীত আমাদেরকে প্রকৃত সুরতে কেহ দেখবে না। তবে আমরা নানান সুরত গ্রহণ করতে পারি। তুমি চাইলে তেমন কোন সুরতে তোমার সাথে দেখা এখুনি দিতে পারি। তবে কথা বলতে পারি কেবল মাত্র দু’সুরতে-নিজস্ব সুরত আর মানুষের সুরতে। এখন বল, অন্য কোন সুরত গ্রহণ করব কি না ? আসাদ দ্বিধায় পড়ে গেল। কি বলবে ? শেষমেশ চিন্তা করে বলল, পারলে বারাক ওবামার সুরত নাও। :বেশ, চোখ বন্ধ কর। ধীরে ধীরে এক হতে দশ পর্যন্ত গুনে চোখ খুলবে। আসাদ তাই করল। আ-রে! এ কী!! বারাক ওবামা বসে আছে তার পড়ার চেয়ারে। ভাগ্যিস প্রকৃত ব্যাপারটা জানা ছিল। তাই চমকে ওঠলেও আসাদ হুলস্থূল বাধাল না। মিটি মিটি হেসে বলল, মি. প্রেসিডেন্ট! বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির জন্য তোমার পরবর্তী পরিকল্পনা কি ? জীনটিও মিটিমিটি হাসল। বলল, শুনো দোস্ত! আমরা মানুষের সুরত ধরতে পারলেও মনের খবর জানতে পারি না। :বেশ! কিন্তু তোমরা কি এই সুরত নিয়ে ওদের কিছু প্লান-প্রোগ্রাম ভণ্ডুল করতে পার না ? :তাও পারিনা। কারণ প্লান-প্রোগ্রাম পাশ হয় মিটিং-কনফারেন্স ইত্যাদিতে। সেখানে অনেক মানুষ থাকে। কেহ যদি একা থাকে, তাহলেই কেবল আমরা দেখা দিতে পারি। :বুঝতে পারলাম। তবে আর এই সুরত রেখে লাভ কী! আসল সুরতেই ফিরে যাও। :তাহলে আবার চোখ বন্ধ কর। আসাদ তাই করল। দশ পর্যন্ত গুনে খুলল। নাহ্, নেই। ওবামা নেই। কিন্তু জীনটি কি আছে! :কী দোস্ত! কেমন অভিজ্ঞতা ?
আসাদ প্রশ্ন শুনল। কিন্তু কাউকে দেখলনা। বুঝল, তার দোস্ত আছে। :দোস্ত, এক গ্লাস পানি খাওয়াবে ? :কেন নয় ? পানি খেলে তোমার পক্ষে ধাক্কাটা কাটানো সহজ হবে। আসাদ দেখল আরেকটি বিস্ময়কর দৃশ্য। কোন অদৃশ্য হাত জগটি তুলে ধরল। গ্লাসের ওপরে কাত করল। পানি পড়ছে। গ্লাস ভর্তি হওয়া মাত্রই জগটি রেখে দেয়া হল। তারপর! গ্লাসটি শূণ্যে ভাসতে ভাসতে তার ঠোঁটের নিকটে এল। সে ঢক্ ঢক্ করে পানি পান করল। গ্লাসটি আবার তেমনি করে পূর্বের জায়গাতে চলে গেল। আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসাদের মনে হল, গ্লাসটি হাতে নিলে সে জীনের ছোঁয়া পেত। ইশ্! একটি সুযোগ চলে গেল। :দোস্ত! এমন চুপ মেরে গেলে কেন ? কিছু ভাবছ বুঝি। :ভাবছি তোমাদের দেশে আমাকে নেবে ? :অবশ্যই। চাইলে এক্ষুনি। :আবার ফিরিয়ে আনবে তো ? :নিশ্চয়ই। তোমাকে আমি বন্ধু বলে গ্রহণ করেছি না ? তবে হটাৎ এই শখ! ওহ্, বুঝতে পেরেছি। আমাদেরকে স্বরূপে দেখার জন্য। তাই না ? আসাদ সম্মতিসূচক হাসি হাসে। :দোস্ত! উঠে দাঁড়াও এবং দরজা খোল। এক বিন্দু আওয়াজও যেন না হয়। আওয়াজ শুনে কেহ হাজির হলেই আমাকে চলে যেতে হবে। ছাদে চল। :কেন ? এখান থেকে সরাসরি যাওয়া যায় না ? এই যেমন তুমি আসা-যাওয়া করছ। :উঁহু, ওটা তোমাদের দ্বারা হবে না। কারণ তোমাদের অর্থাৎ মানুষের দেহ স্বেচ্ছায় সংকুচিত বা সম্প্রসারিত হয় না। খোলা প্রান্তরে তোমাকে আমি বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব, কিন্তু দরজার নিচে যে ফাঁকটুকু আছে সেখান দিয়ে না তুমি নিজে বের হতে পারবে, না আমি তোমাকে বের করতে পারব। বুঝতে পেরেছ ? আসাদ হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ে। অতঃপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। নিশুতি রাত। ছাদে আসাদ একা দাঁড়িয়ে। পাশে অদৃশ্য অশরীরী জীন। :দোস্ত! ভয় পাচ্ছ না কি ? :মোটেও না। ভয় পেলেও আসাদ সেটা স্বীকার গেল না। কৈশোরের কৌতূহল তাকে অভিযানের নেশায় পাগল করে তুলেছে। :ঠিক হ্যায়। গোলাকার একটি পিলারকে যেভাবে আঁকড়ে ধর, ঠিক সেভাবে তোমার সামনে কিছু আছে মনে করে আঁকড়ে ধর। আসাদ তাই করল। স্পষ্ট বুঝতে পারল তার হাত দিয়ে লোমশ কিছুকে আঁকড়ে ধরেছে।
:চোখ বন্ধ কর। বলার আগে ভুলেও মেলবে না; কারণ তুমি নতুন। ভয় পেয়ে হাত ছেড়ে দিবে। রেডী ? :ইয়েস! চোখ বন্ধ করে আসাদ উত্তর দেয়। আসাদের মনে হল যে, হঠাৎ করে সে শূন্যে ওঠে গেছে। তারপর বাতাসে উড়ছে। প্রায় মিনিটখানেক পর কোথায় যেন নামল। :দোস্ত, এবার চোখ খোল। আসাদ ধীরে ধীরে চোখ মেলল। এ কোথায় এল সে! চারদিকে শুধু ফুলের আর ফলের গাছ। তবে সকল কিছুই প্রকাণ্ড আকৃতির। ফাঁকা ফাঁকা ঘর বাড়ী। জীবনে যা কল্পনাও করে নি, তাই দেখছে। বিশাল বিশাল তালগাছগুলো হাটছে। কিন্তু তালগাছের গায়ে এত পশম কেন! একটি তালগাছ তার দিকে এগিয়ে আসল। ন্যাকা সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে হে বাপু! এখানে কেমন করে এলে।’ তালগাছ হাটে এবং কথা বলে!!! আসাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাবার উপক্রম। :চাচা! ও আমার দোস্ত। আমি এনেছি আমাদের দেশ দেখাতে। আসাদ পাশে তাকিয়ে দেখে একটু ছোট আকারের একটি তালগাছ কথা বলছে। আসাদের অবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ভয় নেই! আমিই তোমার দোস্ত। অভয়ের হাসি হাসল জীনটি। আসাদ দেখল জীনকে তার আসল সুরতে। পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দর মানুষটিকে যদি তালগাছের মত আকার দেয়া হয়, তবে ঐটিই হবে জীনের আকৃতি। আসাদ তার বন্ধুর সাথে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, ওদের বাড়ীতে গেল। চা-নাস্তা খেল। সবই মানুষের তৈরী; কেবল চমচমটা কোল বালিশের সমান সাইজের। আসাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে দোস্ত বলল, ‘তুমি মানুষ তো। তাই তোমরা অভ্যস্ত এমন জিনিষ রেখেছি। কেবল নমুনা স্বরূপ আমাদের খাদ্যগুলোর সাইজ বুঝানোর জন্য চমচমটি দিয়েছি।’ আসাদ বিশাল চমচমের সামান্য অংশ চামচ দিয়ে কেটে খেল। মনে মনে স্থির করল, যাবার সময় সাথে করে ঘরে নিয়ে যাবে। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরল। নয়ন জুড়ানো অনেক কিছুই দেখল। অতপর দোস্তকে বলল ফিরে যাবার কথা। দোস্ত পূর্বের নিয়মে তাকে জড়িয়ে ধরতে বলল। আসাদ তাই করল। চোখ খোলার পর দেখল তাদের বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। চুপি চুপি দু’বন্ধু ঘরে ফিরল। আসাদ বিছানায় শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড ক্লান্তি ভর করেছে, শরীরে এবং মনে। দোস্ত কিন্তু এখন অদৃশ্য, তবে অনুভূত। আসাদ হঠাৎ দেখল যে একটা ট্যাবলেট আর এক গ্লাস পানি তার মুখের সামনে ভাসছে। :দোস্ত, এটা খেয়ে নাও; ভাল ঘুম হবে, ক্লান্তি কেটে যাবে। আসাদ তাই করল। :এবার ঘুমাও তুমি। আমি এখন যাই; সময়মত আসব। আবার শুনল শিঞ্জন। আসাদ গভীর ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেল। তবে ঠিক আগ মুহূর্তে মনে পড়ল চমচমের কথা। ইশ! জিনিষটা আনতে মনে ছিলনা। :আর কত ঘুমাবি, অলস কোথাকার! চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা আর আম্মার বকুনির চোটে আসাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আম্মুটা এমনই!! অনেক উৎপাত সহ্য করেন। কিন্তু আসাদ ও তার ভাইবোনদের যাদের বয়স চারের ওপরে সকালে তারা কেহ ঘুম থেকে দেরি করে ওঠলে আম্মু এক্কেবারে দারোগা বনে যান।
:জানো আম্মু! কাল রাতে কত পরিশ্রম করেছি। আজব এক দেশে গিয়েছি...। :হ, ব্যাটা! স্বপ্নে মানুষ কত দেশে যায়। তাই বলে সকালে নাক ডেকে ঘুমাতে হবে ? :স্বপ্ন নয় আম্মু! বাস্তব। :হইছে! এখন তুই আগে ওঠ, মুখ হাত ধো, নাস্তা খা, পড়ে শুনব কোন দেশে গিয়েছিলি। কী আর করা! অসহায় আসাদ উঠে বসে। হাত মুখ ধুতে ধুতে নিজেই দ্বিধায় পড়ে যায়, রাতে যা ঘটেছিল, সেটা স্বপ্ন না বাস্তব। রাতেরবেলা শোয়ার সময় যা যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে। খড়কুটো নড়ার একটু চিহ্নও কোথাও নেই। সারাটা দিন কেটে গেল, কিন্তু এই দ্বিধা দ্বন্দ্বের সমাধান করা আসাদের পক্ষে সম্ভব হল না। পরপর আরো তিন রাত পার হল। দোস্ত আসেনি এক রাতেও। আসাদ এখন রীতিমত হতবুদ্ধ। জীনের আগমনের একমাত্র প্রমাণ সেই চিঠিখানা, যেটা আসাদ দুনিয়ার কাউকে দেখায় নি। কিন্তু শুধুমাত্র এটা দিয়ে কাউকে কিছু বিশ্বাস করানো যাবে না। ইশ্! দোস্তটা যদি আরেকবার আসত!! ৬ষ্ঠ রাত। কে যেন পা টিপছে। আসাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয় পায় না; বুঝতে পারে বন্ধু জীন এসেছে। :কি মিয়াঁ ? এত দেরি করলে কেন ?? আসাদ হালকা রাগের সাথে জিজ্ঞাসা করে। :দোস্ত, আমার শরীর খারাপ ছিল। সামান্য ডায়রিয়া। এজন্য আসতে পারি নাই। :Sorry, really sorry. খবর পাঠাতেও তো পারতে। আওয়াজ শুনে বুঝা গেল যে, জীনটি হেসে দিয়েছে। :খবর কিভাবে পাঠাতাম ? যেহেতু আমরা অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারি, তাই আমরা তোমাদের মত মোবাইল-ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করি না। আর অন্য কারো মাধ্যমে খবর পাঠালে তুমি আরো ভেজালে পড়তে। যাক এখন আমি পরিপূর্ণ সুস্থ। আর তুমি যে আমার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলে, এতে বুঝা যায় যে তুমি আমার খাঁটি বন্ধু। :অনেক হইছে। আর ফুলাতে হবেনা। আজকে আবার বেড়াতে যেতে পারবে ? :পারব। কোথায় ? :সেই সন্দ্বীপের সন্তোষপুর গ্রামে। দুশো মাইলের ওপরে দূরে; আমার নানা বাড়ী। :এটা কোন ব্যাপারই না। কখন ? :এখুনি, বলেই আসাদ উঠে বসে। তারপরে সে দরজা খুলে বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে নিঃশব্দে বন্ধুর সাথে ছাদে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আগের পদ্ধতিতে আকাশে উড়াল দেয়। কয়েক মিনিট পর এক জায়গায় নেমে দাঁড়াল। :দেখোতো দোস্ত, চিনতে পার না কি ? বিস্ময়ে আসাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। নানাবাড়ীর উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঐ-তো নানার রুম। ডিমলাইট জ্বলছে। নানাকে দেখা যাচ্ছে, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছেন। নিয়মিত অভ্যাস। :যাও দোস্ত, কাছে গিয়ে দেখে এসো। আমি এখানে দাঁড়াই। আস্তে আস্তে পাশ থেকে বলল বন্ধু জীন। :না ভাই, তোমার দাঁড়ানোর দরকার নাই; আমি কয়েকদিন বেড়াবো। তুমি চলে যাও। :সর্বনাশ! বলো কি!! কিভাবে আসলে ব্যাখ্যা করতে পারবে ? রীতিমত হুলস্থূল পড়ে যাবে। আসাদ তো তাই চাচ্ছে। কিন্তু মনের কথা গোপন রেখে বলল, সে যাই হোক আমি সামাল দেব। প্লিজ, তুমি আমাকে ফিরে যেতে বাধ্য কর না। :ঠিক আছে দোস্ত, সে তোমার ব্যাপার। আমি গেলাম। মৃদু শিঞ্জন শুনে আসাদ বুঝল বন্ধু জীন চলে গেছে। এবারে কি হবে ? সকালে আম্মু দেখবে বিছানায় আসাদ নেই। অথচ রাত এগারোটায় আম্মুর সাথে কথা হয়েছে। নানাকে ফোন দেবে। নানা বলবে, আসাদ আমার সাথে বসে নাস্তা করছে। রাত এগারোটা পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে হেলিকপ্টার ছাড়া রাত দু’টায় সন্দ্বীপ পৌঁছা ঠিক ততটুকুই অসম্ভব, যতটুকু অসম্ভব দুই যোগ দুই সমান পাঁচ হওয়া। কিন্তু তারপরেও তাই ঘটে গেছে! আস্তে আস্তে এক কান দু’কান হয়ে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পত্রিকায় ওঠবে, Talk of the country হবে ভাবতে ভাবতে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠল আসাদ! দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে নানার রুমের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে।