“ ওরা রাজাকার । ছয়জনের একটি দল। এলাকার মানুষ ওদেরকে এড়িয়ে চলে। ভয়ে এবং ঘৃণায় । পাক হানাদার বাহিনী এলাকাতে এসেছিল ৮-৯ মাস আগে। এলোপাথারী ধ্বংস যজ্ঞ  চালিয়ে থানা সদরে চলে যায়। মাঝে মধ্যে আসে, দু’একটা চক্কর মেরে যায়।  সর্বসাধারণ সতর্ক হওয়ার একটা সুযোগ তবু পায়। কিন্তু এই রাজাকারের দল! ওদের কথা না বলাই ভাল। হেন কোন অপকর্ম নেই, যা গত কয়েকমাসে ওরা করে নাই। আমি অবশ্য স্বচক্ষে কিছু দেখি নাই। বেশীরভাগ শুনেছি দোকানদার দুলু চাচার কাছ থেকে। আরো দু’চার জনেও আমাকে কিছু কিছু জানিয়েছে। বয়সে ছোট। নচেৎ হয়তো আর অনেক কিছু জানা যেত।” কথাগুলো খালেদের ডায়েরীতে লাল কালিতে লেখা। 				     রাজাকারদের  প্রতি খালেদের প্রচন্ড ঘৃণা। বাবা বলেছিল, ”বাহার ভাই-কে স্থানীয় রাজাকাররা পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পরে পাক-বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে বাহার ভাই শহীদ হয় । ” নভেম্বরের শেষ দিকে খবর আসে যে, বাহার জেঠার একমাত্র ছেলে তারেক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়ে গেছে। চারটে মেয়ে নিয়ে জেঠি যে এখন কী করবে। ঐ বয়সে ছোট্ট খালেদের ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যেত।                    কিন্তু মানুষ যা চায় সর্বদা যদি তাই ঘটত, তবেতো বিধি বলে কিছু থাকত না!  
***			***				***				***
১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল। বিজয় দিবস ।  
গাজীপুর জেলায় গজারী বনের ধারে এক নিভৃত গ্রাম। উঠোনে  চাঁদর গায়ে আরাম কেদারায়  বসে খালেদ পৌষের মিষ্টি রোদ উপভোগ করছে। হাতে তার সেই সবুজ মলাটের ডায়েরীটি যাকে বিগত বিয়াল্লিসটি বৎসর যাবৎ যক্ষোর ধনের মত সে যত্ন করে আলগে রেখেছে। প্রতিটি বিজয় দিবসেই খালেদ একই কাজ  করে। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। তারপরও নজর বুলাতে থাকে। 
অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ধারে কাছে হৈ-হুল্লোড় করছে। হঠাৎ সবগুলো দৌড়ে এসে তার কাছে  জমায়েত হল। বাবা-মামা-চাচা-ফুফা-খালু ইত্যাদি ডাকাডাকিতে খালেদের ধ্যান কেটে গেল। সবাইর একই আব্দার, “ বিজয় দিবসের কাহিনী শুনতে চাই। ”
খালেদ আবার ডায়েরীটা ওল্টায়। একটু দেখে, একটু বলে। কারণ  ডায়েরীতে ঘটনা লেখা আছে সংক্ষেপে ।  সবাইকে বোধগম্য করার তাগিদে তাকে গল্প বলার ঢংএ বলতে হচ্ছে। ************************************************************
ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জ। এলাকাটা স্থানীয়ভাবে ‘গোডাউন’ নামে পরিচিত। মাত্র কিছুদিন আগে খালেদরা এই এলাকাতে এসেছে। সব কিছু এখনো ঠিকমত চিনে সারে নি, খুব বেশী জনের সাথে চিন-পরিচয়ও ঘটে নি।    											            ১৯৭১ সাল। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ। বেলা  আনুমানিক সকাল ১০টা। 				       দুলু চাচার দোকানের সামনের  বাঁশের বেঞ্চিতে বসে ঐ ছয়জন রাজাকার হাসাহাসি আর খোপ-গল্পে মত্ত। প্রত্যেকের হাতে ধৃমায়িত চায়ের কাপ। তবে ওদের চকিত চাহনি আর চেহারা দেখে বুঝা যায় যে কোন এক অজানা আশস্কায় তারা ভীত।  হয়তো ভয় তাড়ানোর জন্যই জোর করে হাসাহাসি করছে। 
খালেদ দোকানে এসেছে টুক-টাক এটা-সেটা কেনার জন্য। সারি সারি বেশ কয়েকটা দোকান । বাসা থেকে ৫/৬ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। সবগুলো খোলা নয়। অনেক দোকানদারই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।  তবে দুলু চাচার দোকান যথারীতি খোলা। ওটাই সবচে বড় দোকান। প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। খারিদ্দারদের আকুষ্ট করার জন্য দোকানের সামনে বাঁশের তৈরী লম্বা লম্বা তিনটে বেঞ্চ আছে। তার একটিতেই রাজাকারগুলো বসা। কালো পোষাক’ ভেতরের মানুষগুলোর বর্ণ যেমনই হোক না কেন, মনটা নিশ্চয়ই ঘোর কালো। নচেৎ হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয় কেউ ? একটা বোমা কিংবা গ্রেনেড থাকলে সব কটাকে শেষ করে দেয়া যেত। কেন যে এত ছোট হল সে! যুদ্ধে যেতে পারল না। আফসোসের একটা  দীর্ঘশ্বাস খালেদের বুক চিড়ে বের হয়ে আসে। আপাতত: মনস্থির করল যে, ব্যাটারা কি বলে উহা মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। অতএব, কানটা আপনা-আপনি খাড়া হয়ে গেল। 				        : যুদ্ধের হালচাল ভাল ঠেকছে না। পাকিস্থান তো মনে হয় হেরে যাবে। তুই কি বলিস, সগীর ?              : হ্যা-রে আমজাদ, আমারও তাই মনে হয়।						                  : তখন আমাগো যে কী হবে! কোন বোকামিতে যে রাজাকার হতে গেছিলাম!                                 : কেন ? আমি তো কোন অন্যায় করিনি। কারো গায়ে একটা টোকাও দিই নি। জান বাঁচানোর তাগিদে রাজাকারে নাম লিখিয়েছি। বলল সগীর নামের রাজাকারটি। 					    নিজের অজান্তেই খালেদ একটা ভেংচি কাটল। মনে মনে বলল, ”হইছে রাজাকার ; আবার বলে কিছু করে নাই। ভূতের মুখে রামনাম একেই বলে।”  							        : শোন সগীর, ভুলের ওপর খাকিস না।  সত্যি সত্যি যদি মুক্তিরা জয়ী হয়, তখন তারা দেখবে না তুই কি করেছিস বা না করেছিস। তখন তোর একমাত্র পরিচয় হবে, ’তুই রাজাকার’। তোকে ঠিক ঠিক মেরে ফেলবে।
বেখেয়ালে খালেদ হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল। এবং সেটা ধরা পড়ে গেল একজন রাজাকারের দৃষ্টিতে।           : এ্যাই ছোকড়া, এদিকে আয়।									    খালেদ ভয়ে ভয়ে রাজাকারের দলটির কাছে গিয়ে দাড়াল। 					        : ছোড়াটা বোধ হয়, মুক্তিবাহিনীর চর । পেটে কি আছে বের করতে হলে কসে দুটো থাপ্পড় দে।            : তার চেয়ে ভাল হবে, বেঁধে ওস্তাদগো হাতে তুলে দেই। ভাল ইনাম জুটবে। 			  খালেদ ভয়ে কাঁপছে ; কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারছে না। অপেক্ষা করছে কোন এক মর্মান্তিক পরিণতির।  দোকানদার দুলু চাচা ও আর দু’চার জন পথিক ফ্যাল ফ্যাল করে ঘটনা দেখছে। কারো মুখে রা নেই।  										                  : এ্যাই আমজাদ, রফিক! থাম তোরা । একটা দশ বছরের বাচ্চার সাথে কি শুরু করেছিস।  হঠাৎ করে বলে ওঠল সগীর নামের রাজাকারটি। 								        : দ্যাখ, সগীর, ও-কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে ছাড়া ঠিক হবে না। 			                 : ঠিক আছে, আমিই করছি।  ভাইয়া, তোমার নাম কি ?				                  খালেদকে উদ্দেশ্য করে খুবই নরম সুরে সগীর প্রশ্ন করে। 				            খালেদ উত্তরে নাম বলে। সগীর আরো কয়েকটা প্রশ্ন করে।  					         : কেন এসেছো ?									                 : আম্মু দোকানে পাঠিয়েছে।								                 : বাসা কোথায় ?									                  : ঐ ওখানে, সরকারী কোয়ার্টারে।								        : তুমি কি মুক্তিবাহিনীর সদস্য।									         : জ্বী, না। 										                 : কেনা-কাটা শেষ ?										          : জ্বী, হাঁ।										                  : বেশ বাসায় চলে যাও। ঘর থেকে বেশী বের হবে না। ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে।			     খালেদ বাসার দিকে রওয়ানা হয়। বুঝতে পারে, সগীর স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়ে তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন ? খালেদ কোন উত্তর খুঁজে পায় না। 	                 ****************************** ****************************  খালেদ থামল। ডায়েরীটা বন্ধ করে দেখতে লাগল কার কী প্রতিক্রিয়া। 		                           : মা-গো, কি ভয়ংকার ঘটনা।									        : কপাল ভাল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।							                  : রফিক আর আমজাদ তো অনেক শয়তান। চাচ্চু ওরা কোথায় এখন। ওদেরকে পিট্টি দিতে হবে।          : তবে মামা, সগীরটা কিন্তু রাজাকার হলেও ভাল।					                 : হ্যা, খালু। আমিও এ কথা বলি। ও-র ঠিকানা কি ?					                  : ফুফাজী, চলেন সগীরকে দাওয়াত দেই। ও-র কাছ থেকেও শুনবো ঘটনাটি। অনেক মজা হবে।             : আব্বু, এটা-তো তের তারিখের ঘটনা বললে। বিজয়ের দিবসের একটা ঘটনা বল।                         : ঠিক কথা। ১৬ তারিখের ঘটনা শুনাতে হবে।						              সায় দেবার ভংগীতে মাথা নেড়ে খালেদ পুনরায় ডায়েরীটা খুলে। আগের মত করেই শুরু করে, একটু দেখে, একটু বলে। 
**********************************************************
১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। 								            জাতির জীবনে এক অবিস্মবরণীয় দিন। 							          আসরের নামাজ শেষ হয়েছে বেশ অনেক্ষন হল। পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে সকালে যে সূর্য উঠেছিল, সেই সূর্যটি আর আধঘন্টা বাদে অস্ত যাবে, তবে বিজয়ের বরমাল্য গলায় নিয়ে। 			  দুপুরের আগে-ই একথা ফলা-ও হয়ে গেছে যে, পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে নি:শর্ত আত্মসমর্পন করবে। 											            খবরটি শোনার পর থেকেই খালেদের মনে আনন্দের এমন এক প্রসবন বইতে লাগল যেমনটি ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। গত নয়টি মাস ধরে কী যে এক নরক যন্ত্রনা গেছে, সেটা ভূক্তভোগী ছাড়া কেউ কোনদিন   বুঝবে না। 											   খালেদ রেডিওর নব ঘুড়াচ্ছে। কোথায় কোন খবর পাওয়া যায় এই প্রত্যাশায়। আচমকা কানে এল প্রচন্ড এক চীৎকারের আওয়াজ। 									        : বাবা-গো, মেরে ফেলল-গো, ও মাগো মরে গেলাম গো! 				       গগনবিদারী আর্তনাদ শুনে খালেদ দৌড়ে বারান্দায় গেল। চারতলা সরকারী বাসার দোতলায় খালেদরা থাকে। বারান্দার রেলিংএ ভর দিয়ে সীমানা প্রাচীরের ওপারের ঘটনাটি দেখতে থাকল ।  	            একটি ছেলেকে ধরে ৬ জন লোক এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি-থাপ্পড়-লাথি মারছে। 		          ছেলেটির  পরণে লুংগি, গায়ে কালো রঙের শার্ট। ঠোটের কোণ বেয়ে রক্তের ধারা বইছে। ছেলেটির বয়স আনুমানিক ২০-২৫  হবে। একবার এর পা ধরছে, অন্যবার আরেকজনের পা ধরছে। কিন্তু কারো কাছেই কোন করুনা মিলছে না। ও-কে যারা মারছে, তারা প্রত্যেকে অস্ত্রধারী। কারো হাতে রাইফেল, কারো হাতে ষ্টেনগান বা এ জাতিয় কিছূ। আসলে খালেদ তো আর অস্ত্রবিসারদ নয়। যুদ্ধ শুরুর আগে বন্দুক ছাড়া বোধহয় কিছুই চিনত না, কোন কিছুর নামও জানত না। তার ছোটখালুর একটি বন্দুক ছিল, খালু ওটা  দিয়ে পাখী শিকার করত। তবে গত ৯ মাসে অনেক অস্ত্রের নাম শুনেছে। নাম না জানা অনেক অস্ত্র দেখেছে পাক-বাহিনীর হাতে। 								                 : শালা রাজাকার। বল,কত জনকে মেরেছিস ? সজোরে থাপ্পড় কষে একজন জিজ্ঞাসা করে।	         : বিশ্বাস করুন, একজনকেও মারিনি। কারো গায়ে হাত পর্যন্ত তুলিনি।			                 : আবার মিছা কথা। সজোরে আরেকজনের সবুট লাথি। 						        : ও বাবা-গো, মরে গেলাম গো। মেরে ফেললরে। 						    খালেদ খুব ভাল করে রাজাকারটির দিকে তাকাল। চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আরে ও-তো সগীর !  রীতিমত চমকে উঠল খালেদ। পরিধানে চেক লুংগী আর কালো শার্ট। মারের চোটে শার্টের দুটো বোতাম ছিড়ে গেছে। চেহারায় ভয়াবহ আতংকের ছাপ। একেই কী মৃত্যুভীতি বলে ? ভীতি জিনিসটা  প্রচণ্ড সংক্রামক।  খালেদের মধ্যেও সেটা চলে এল। বুঝতে পারল সগীরকে আজ ওরা মেরে ফেলবে। কিন্তু কোন বিচার-আচার ছাড়া ? মনকে সে প্রবোধ দিতে পারছে না। 					            দু’জনে মিলে সগীরকে টেনে দাঁড় করালো। সগীর হাপাচ্ছে। চোখ দু'টো প্রায় বোজা। ছেড়ে দিলে নির্ঘাৎ পড়ে যাবে। চেতনা আছে কি নেই, বুঝা যাচ্ছে না। একজন কাঁধ থেকে অস্ত্র নামিয়ে সগীরের বুকের বাম পার্শ্ব বরাবর তাক করল। দাঁড়ি গোঁফে মুখ ঢাকা একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ ওস্তাদ ! দেই শেষ করে” ? 										            ওস্তাদ বলে সম্বোধিত লোকটি ’হ্যা’ সূচক মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।			          খালেদের ইচ্ছা হল চীৎকার দিয়ে না বলতে । কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না । বরং ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ল।								          অতঃপর  ? 											    গুলির বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। একটা অস্ফুট আওয়াজও কালে এল। 		    খালেদ আতংকে থড় থড় করে কাঁপছে । সুস্থির হওয়ার জন্য মেঝেতে শুয়ে পড়ল। কানে এল কোন একজনের কণ্ঠস্বর, ”শালা শেষ! চল, অন্য কোথাও যাই। পাকিদের-কে তো আর গেলাম না। অতএব, যতগুলি পারি রাজাকার ধরে ধরে শেষ করি ”।  						              প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে খালেদ নিশ্চিত হল যে, আর কেউ নেই। সে হিম্মৎ করে উঠে দাড়াল।  দেখল যে, সত্যি সত্যি সকলে চলে গেছে। কি মনে করে সিদ্ধান্ত নিল যে,  খুব কাছে গিয়ে সগীরের মৃতদেহটা দেখে আসবে। 											    খালেদ চুপি চুপি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।  
মুখ খুবড়ে পড়ে আছে সগীরের লাশ। দু’হাত দূরে নিথর দাঁড়িয়ে খালেদ। খালেদের খারাপ লাগছে। অথচ সগীর তার কেউ নয়। একজন রাজাকার। কিন্তু ৪/৫ দিন আগে তার সাথে খুব সুন্দর করে  দুটো কথা বলেছিল। কেবল ঐ টুকুই। আসলে মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যের আশেক। আর সুন্দর ব্যবহারও তো এক ধরনের সৌন্দর্য। খালেদ সেখানেই দুর্বল। 
একজন মানুষ আসছে। অচেনা, স্থানীয় কেউ হবে হয়তো! সগীরের লাশের পাশে একটু দাড়ালো।          : ওটা কে? রাজাকার !  মরেছে ? খুব ভাল হয়েছে। থুঃ ।					           লোকটা একদলা থু-থু ফেলল সগীরের মৃতদেহের ওপরে। কাছে গিয়ে একটা লাথি-ও মারল। অত:পর একটু অবাক হয়ে খালেদের দিকে তাকাল।							        : এই বাচ্চা, তুমি এখানে কি করছ। বাসা কোথায় ? বেশ কড়া সুরের প্রশ্ন।			         : ঐ যে আমার বাসা। খালেদ আঙুল দিয়ে বাসা দেখালো। 					         : যাও !  তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। একথা বলে লোকটি তার পথে হাটা দিল। 				   খালেদ বাসায় গেল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল ।  				      সূর্য ডুবো ডুবো। আরো দু’জন লোক আসছে । ওরা-কি করবে ? খালেদ ভাবছে। 			        : আহ-হা! এযে দেখছি সগীর, রইসদ্দির পোলা। ছোড়াডা কিন্তু খারাপ ছিল না। যদিও রাজাকারে নাম লেখায়, কিন্তু কোনদিন কারো কোন ক্ষতি করে নাই। 						        : পোলাডারে কইছিলাম, কয়দিন লুকিয়ে থাকতে। শুনে নাই। বলত, আমি কারো কোন ক্ষতি করি নাই। আমাকে কেউ কিছু বলবে না।								                 : খোকা, তুমি এখানে কি করছ ? 								         : কিছু না । আমার বাসা ঐ টা । 								        : ও, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাও । ঝামেলায় পড়ে যাবে।  					         : আচ্ছা, চাচা ওকে কেউ কবর দেবে না। খালেদের বিনীত জিজ্ঞাসা।				         : না বাবা, শিয়াল শকুনে খাবে। ২৫শে মার্চের পরও এভাবে রাস্তা ঘাটে লাশ পড়ে থাকত, কবর দেবার কেউ ছিল না। যা-ও, দেরী কর না। 							            ওদের তাগিদে খালেদ বাসার দিকে হাটা শুরু করল। লোকগুলোও এক সময়ে চলে গেল। খালেদ বাসায় ঢুকল। আম্মু হারিকেন জালাচ্ছে । এলাকায় তখনো কারেন্টের লাইন আসেনি। 
বাসায় ফেরার পরে খালেদের কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। সারাক্ষণ আব্বু-আম্মুর কাছে ঘুর ঘুর করতে থাকে। কোন রকমে চাট্টি খেয়ে খুব দ্রুত লেপমোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ে। রাতে নানা দু:স্বপ্ন দেখে। কখনো দেখল সগীরকে হত্যা করা হচ্ছে ; কখনো দেখল সগীর জিন্দা হয়ে তার কাছে অনুযোগ করছে, ”অনেক রাজাকার অন্যায় করলেও আমি তো কোন অন্যায় করিনি। অথচ দেখলে তো কি নিষ্ঠুরভাবে আমাকে হত্যা করে পথের ধারে ফেলে রাখল। যে আমাকে কোনদিন দেখেনি, সে-ও থু-থু দিল।”  একপর্যায়ে দেখল, সগীরের মৃতদেহ দিয়ে হায়নারা আর শিয়ালরা টানাটানি করছে। ভয় পেয়ে ঘুমের ঘোরে চিৎকার দিয়ে ওঠল। এক সময়ে শরীরে জ্বর এসে গেল। দু’দিন বিছানায় পড়ে রইল। যথন সুস্থ হল, তখন সগীরের মৃতগেহকে আর দেখল না। কে জানে কি হয়েছে! কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাউকে জিজ্ঞাসাও করে নি। হয়তো শিয়াল – শকুনে খেয়ে ফেলেছে, নয়তো বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে। খালেদ জানতে পারেনি আসলে কি হয়েছিল ?  
***			***			***				***
কাহিনীটা শেষ করে খালেদ ডায়েরীটা বন্ধ করল । চোখ তুলে মাথাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে সমবেত সকলকে এক নজরে দেখে। কেউ কথা বলছে না। সগীরের মৃত্যুর নির্মমতা সকলকে স্পর্শ করেছে। তাই সবাই একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে গেছে। 								         : খালু, সগীর কি সত্যিই নিরপরাধী ছিল ? দীর্ঘক্ষণ পর একজন জিজ্ঞাসা করে। 			        : কিভাবে বলি! ওতো অসম্ভব কিছু নয়। গোবরে পদ্মফুলের ন্যায় রাজাকার-আলবদর-আশশামছ এমন কী পাক-হানাদার বাহিনীর মধ্যেও দু’ চারজন ভাল লোক থাকা আশ্চর্য কিছু নয়। প্রবাদ আছে না, ” মক্কাতেও  পাপী থাকে, লঙ্কাতেও সাধু থাকে।” 								         : চাচ্চু, আর কাউকে এ রকম করে মরতে দেখেছো ?						         : না-হ বাবা আর দেখিনি।  জীবনে অনেক মৃত দেখেছি, অনেককে মরতে দেখেছি। কিন্তু সগীর ছাড়া আর কাউকে মেরে ফেলতে দেখিনি, এর আগে-ও না, পরে-ও না। 					        : আমাদের সবার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজ আর কোন ফুর্তিতে মন বসবে না। 		     তাই-তো! খালেদ ভীষণভাবে চমকে ওঠে। বিজয় দিবসের এই আনন্দঘন আর উৎসবমুখর দিনের শুরুতে কেন সে সবাইকে একজন রাজাকারের করুণ কাহিনী বলতে গেল ? 				      তবে কি সে স্বাধীনতাবিরোধী ? গুপ্ত রাজাকার-প্রেমিক ? দেশদ্রোহী ?				  অসম্ভব! নিজের দেশপ্রেম নিয়ে খালেদের মনে একবিন্দু সন্দেহ নেই। রাজাকারদের প্রতি তার ঘৃণা বিগত বিয়াল্লিশটি বছরে এক বিন্দুও কমে নি। এই বাংলার মাটিতে রাজাকারদের বিচার হবে, এই স্বপ্ন সে কতবার দেখেছে! আর খালেদ তো  নিজকে সর্বদা ঐ সমস্ত সৌভাগ্যবানদের একজন মনে করে যারা বুক ফুলিয়ে বলে, ”আমি বিজয় দেখেছি।”								     কিন্তু তারপরও প্রতিটি বিজয় দিবসে কেন সে বিমর্ষ হয়ে থাকে ? কেহ যদি বিজয় দিবসের স্মৃতিচারণা করতে বলে, সগীরের ঘটনাটি-ই শুনায়। 							             কেন ? কেন ?? কেন ???