একটা কাঠঠোকরা পাখি সাত রঙ্গের ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল সায়ক গাছটার কাছে যেতেই ; তার ডানা থেকে একটা পালক খসে পড়ে তখনো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সায়কের মুখের সামনে থেকে পড়লো মাটিতে । সায়ক সেটা হাতে তুলে চোখ বন্ধকরে গালে বুলল । চোখ বন্ধ অবস্থায় সায়কের মনে হল আকাশে রামধনু আকাশ ছেড়ে তার পায়ের কাছে যেন এক মহাসমুদ্র নির্মাণ করেছে । তার পর সেই রং ধার করে বৃহৎ-সুন্দরী গাছটার আশেপাশের চাতাল জুড়ে অপরিচিত সব অপূর্ব ফুলের বাগিচায় ঢেকে গেল মুহূর্তে । হরেক রংয়ের প্রজাপতিদের ঢল নামলো নিমিষে । বৃষ্টির মতো তারা ফুলের ওপর ঝরে পড়লো । কয়েকটা সায়কের মাথায় বুকে উড়ে এসে বসতে ভুল করলো না । সায়কের একবার হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি বসা প্রজাপতিটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করার ইচ্ছে হল ; পরক্ষনেই মনে হল যে তার মনের এত কাছাকাছি এসে ধরা দিয়েছে হাত দিয়ে ধরতে গিয়ে যদি সে উড়ে যায় ।ওরা জানে মানুষ ফুল ছেরে গাছ কাটে , পশুদের কাছে এমন ভয় নেই । লোভ সংবরণ করে প্রাপ্তি টুকুতেই যখন আনন্দ পাচ্ছিল সায়ক ; হটাত একটা ঠাণ্ডা নরম স্পর্শ সে তার পায়ের ওপর অনুভব করে । সাপের গা ঠাণ্ডা হয় ; আর বাগানে সেটি থাকা কিছু অসম্ভব নয় । সাপ অনুমানেই সায়ক চোখ খুলে দেখল ওটা একটা গিরগিটি ।করাতের খাঁজ কাটা পিট , ডায়নোসার মতো দেখতে বড় গিরগিটিটা শুকনো পাতার ওপর থেকে করমর শব্দ তুলে ঘার ঘুরিয়ে সায়কের দিকে দেখতে দেখতে গাছটার আড়ালে পালায় । সায়ক চোখ খুলে কিছুটা হতাশ হয়ে ছিল ফুলের বাগিচার বদলে শুকনো পাতার আবর্জনায় প্রজাপতিদের সমারোহের বদলে এই গিরগিটিটাকে আবিষ্কার করে । তবে সে রুক্ষতা কাটিয়ে পরিবেশের সাথে রং মিলিয়ে মিলিয়ে সায়ক আর প্রকৃতির সাথে লুকোচুরি খেলা বহুরূপী গিরগিটি টাকে সায়কের এবার বেশ ভাল লাগে । গিরগিটি টাকে যখন আর গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ায় দেখা যাচ্ছিলো না তখন সায়ক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেগেলে একটা কাঠবেরালি তার সামনে দিয়ে ছুটে পালায় । সেযেন বলে ;
- বাঁচতে চাও তো পালাও এখান দিয়ে ।
সায়কের মনে হল এ তার শোনার ভুল । সে জানে ডারউইনের তথ্য ; বাঁচতে হলে এ পৃথিবীতে পালানো চলেনা লড়তে হয় ।যে লড়ে সেই বাঁচে । যে লড়তে জানে না সে বাঁচতেও জানেনা । মৃত্যু এখানে ছায়ার মতো মানুষের পিছু ধাওয়া করে আর মানুষ সম্মুখ সমরে তাকে বারবার পরাস্ত করে জীবনকে রাজ মুকুট পড়ায় । পিছু পালালেও যখন মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই নেই বুদ্ধিমানের কাজ মৃত্যুকে বরন করে তার মোকাবিলা করা । মাথায় চড়িয়ে তাকে শাসন করতে না দিয়ে পোষা কুকুরের মতো বস করা ।গাছের পেছনে গিয়ে সে দেখল গাছের গায়ে একটা বিশাল গর্ত আর সেই গর্তের গা বেয়ে সাড়ি সাড়ি লাল কাঠ পিঁপড়ে মুখে করে ডিম নিয়ে উদ্বাস্তুদের মতো দেশান্তরিত হচ্ছে । সায়ক মনে মনে যেন তাদের জিজ্ঞেস করলো ;
- কোথায় চললে তোমরা ?
তারা যেন চি চি করে বলল ;
- এক স্বপ্ন-পুরিতে । ভারি সুন্দর স্বপ্নের মত সে জায়গা ।
সায়ক বলল ;
- সেখানে কী কী রং আছে ?
তারা বলল ;
- হরেক । শুধু দেখার মতো চোখ চাই ।
সায়কের মনে হল পিঁপড়ের সাথে কথোপকথন শোনার কান ও অনেকের থাকে না । তারা চেনা বন্ধুদের
অনেকের মুখ তার মনে পড়লো ; বধির আড়ষ্ট সেই পাথরের মতো মুখ গুলোর ওপর সায়ক দেখল
ঝলসে চলেছে নানা ভি ডি ও গেমের আলো আঁধারি । যখন মেশিন গানের আওয়াজ ; বাইকের রেস ;
থ্রিলার মিউজিকের ককটেল সায়কের শিরা উপশিরা বেয়ে চৈতন্যকে তার বন্ধুদের মতো বসকরে নিচ্ছিল ;
সায়ক কানে হাত চাপাদিয়ে চোখ বন্ধ করেনিল । সমস্ত আওয়াজ ঢাকা পড়ে গিয়ে একটা নিস্তব্ধতা
নেমে এলো সমস্ত চরাচরে । ধীর স্থির ধ্যান ভাঙ্গা ঋষির মতো সায়ক চোখ খুলে তাকাল বুড় গাছটার
প্রকাণ্ড কাণ্ডের গায়ে ক্ষোদিত বিশাল আকার গর্তটার দিকে । সে দেখল পিঁপড়েদের মিছিল শেষ হয়ে
গিয়েছে । হরেক রং - হরেক সাদ সায়কও পেতে চায় স্পর্শ ,গন্ধ , অনুভবে হৃদয়ের চোখ দিয়ে ; মস্তিষ্কের
বুদ্ধি-দিয়ে ; এই মহাবিশ্বের তিলবৎ সৌন্দর্য ও যেন তার দৃষ্টির অগোচরে গিয়ে চেতনাকে অভিষিক্ত করতে ভুলে
না যায় । তাই সায়ক স্বপ্ন-পুরি এক স্বপ্নের রাজত্বে যাবার উদ্দেশ্যে বড় গর্তটার কাছে এগিয়ে গেল । সায়ক দেখতে পেল বড় গর্তটার গা বেয়ে বৃহৎ গাছটার কাণ্ডের ভেতর একটা সিঁড়ি পথ অন্ধকার গুহার প্রবেশ দারের মতো এগিয়ে চলেছে ভূপৃষ্ঠের কেন্দ্রের দিকে । মশালের মতো জোনাকির আলো তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল । পথে সায়ক দেখতে পেল সিঁড়ির অনেকটা দূরে সেই গিরগিটি টাকে । তার কিছু পেছনে পিঁপড়ের মিছিল টা এগিয়ে চলেছে সায়ক বুঝল সকলেই চলেছে ওই স্বপ্নের রাজ্যের দিকে । হটাৎ অন্ধকারে ওৎপেতে বসে থাকা একটা পেঁচা উড়ে এসে গিরগিটি টায় ছোঁ মারে ; ধরে নিয়ে চলে যায় । কয়েক টা বাদুর ফরফর করে উড়ে চলে যায় সায়কের মাথার ওপর দিয়ে বিকট আওয়াজ করে । পিঁপড়ে গুলো মিছিল ভেঙ্গে ছোটা ছুটি করে । সায়ক প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও নিজেকে সংযত করে। সে জানে ভয়কে প্রশ্রয় না দিয়ে জয় করতে হয় । না হলে ভয়ের আসংখ্যায় জীবের অনেক মূল্যবান কার্য অধরা থেকে যায় ।দূরে সিঁড়ির শেষে সায়ক দেখতে পেল আলোক সাগরের ঢেউ । অসম্ভব রোমাঞ্চ নিয়ে যখন সায়ক সিঁড়ির কিনারায় গিয়ে পৌঁছল
সিঁড়ির ওপর বসে আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার মতো দেখল একটা নতুন দেশকে মাকড়সার জালে বেষ্টিত সিঁড়ির শেষ প্রান্তের গহ্বর মুখ থেকে।
এখানে নাগরিক সভ্যতার ধূয়া -গ্যাস ,গাড়ি- ঘোড়া , বড় বড় বিল্ডিং , লাইট পোস্ট ,ফ্লাইওভার, কারখানার চিমনি কিংবা ওয়ারলেস-টি.ভি অথবা টেলিফোনের টাওয়ার নিদেন পক্ষে খাবার জলের উঁচু ট্যাঙ্ক কিছুই দেখা গেল না । দেখা গেল শুধু একটা সমুদ্র আর রাশি রাশি ফুল আর ফলের বাগান সমুদ্র তটে । সে সব বাগানে কাজকরা মানুষ গুলোকে ওপর থেকে পিঁপড়ের মতো দেখাল সায়কের চোখে । এদিকে
সেই মিছিলের লাল কাট পিঁপড়ে গুলো সিঁড়ির শেষের এই মাকড়সার জালে আটকে চটপট করছিল বেশির ভাগের মুখ থেকে ডিম গুলো খসে পড়েছিল সমুদ্রের জলে । এটুকু ভেবে পিঁপড়েরা আস্বস্হ ছিল তারা সে সুন্দর দেশে পৌঁছাতে না পাড়লেও তার ছানারা পাবে এক সুন্দর পৃথিবীর সাদ । সায়ক ভাবে যে জাল থেকে একটা পিঁপড়েও গলতে পারেনা সেই মিহি জাল টপকে সেও বা সে দেশে যাবে কিকরে । মাকড়সার
জালের ফাঁক থেকে সে আবার দেশটাকে দেখে ; সমুদ্রের বুকে বড় বড় জাহাজ ভাসছে না । ছোট একটা ডিঙ্গির ও দেখা মেলা ভার । শুধু রূপোর মতো চিকচিক করা কূল কিনারা হীন জলরাশি যেন জ্ঞান গর্ভ গভীরতা বুকে ধরে অপেক্ষা করছে কোন এক দেব দূতের যে এসে ডুব সাতরে তার গভীরতায় পৌঁছে সঞ্চয় করবে জ্ঞানের মণিমাণিক্য । কিন্তু সে দেবদূত কোথায় ? অনেক টা ঝুঁকে অনেক ওপর থেকে সায়ক সেই দেব দূতের সন্ধান করতে করতে হটাৎ হরকে পড়লো মাকড়সার জালে । বোধয় সায়ক কে দেখেই মাকড়সা টা কোথাও কাছাকাছি লুকিয়ে পরেছিল । সে জালে জড়িয়ে পড়তেই লোমশ বড় বড় ঠ্যাং গুলো নিয়ে সে জাল বেয়ে সায়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । মুখ দিয়ে জাল বুনে সায়কের হাত পা বেঁধে ফেলার চেষ্টা করলো সায়ক যখন হাতপা ছুড়ে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল সহায় হল সরবো হারা পিঁপড়ে গুলো । তারা মরণকামড় দিয়ে বসলো মাকড়সার সারা দেহে । সায়ক সুযোগ বুঝে হাতদিয়ে মাকড়সার জাল ছিঁড়তে লাগলো সে জাল এতো মজবুত আর মায়াবী কষ্ট করে ছিঁড়লেও সাথে সাথে জোড়া লেগে যায় । অনেক কষ্টে জালে একটা বড় ছিদ্র বানিয়ে সেখান থেকে সায়ক মহাকাশচারীর পৃথিবীতে ফিরে আসার মতো টুপ করে ঝরে পরে সমুদ্রের জলে । অনেক ওপর থেকে পড়ায় সমুদ্রের অনেকটা গভীরে চলে যায় সায়ক । সমুদ্রের তলায় কোরালের নগরের ওপরে মাছদের ঝাঁক যুদ্ধের এরোপ্লেনের মতো পাক খাচ্ছিল । সায়ককে দেখে একটা অক্টোপাস সড়ে গেলে কোরালের ওপর রাখা তার পেটের তলায় একটা নীল জ্ঞান নীলায় সূর্যের আলো পরে নীল শিখায় জলের ওপর প্রতিফলিত হয়ে পড়ে । ডুবুরির মতো ডুবসাঁতারে সেটার কাছে গিয়ে সায়ক সেটা সংগ্রহ করে । নীলা টা হাতে তুলে নেবার সময় জেলির মতো একটা চটচটে পদার্থ কোরালের গা থেকে তার হাতে সে অনুভব করে ।
তার তালু বদ্ধ নীলা টা সায়কের যেন মনে হল কথা বলছে ।
- আমায় সঞ্চয় করে তোমার কী লাভ ?
সায়ক বলে ;
- বা জ্ঞান অর্জন করতে কে না চায় ।
নীলা বলে ;
- সে তুমি করেছো । অনুসন্ধান করতে করতে তুমি আমার এতো কাছে পৌঁছে আমার সম্পর্কে সমস্ত কিছু জেনে নিয়েছ । আমার বাহ্যিক নীল শরীর টা সঞ্চয় না করলেই নয় । জ্ঞান তো মগজে সঞ্চিত ;টেকে সম্পদ সঞ্চয় করে কী লাভ । আমার জন্য ; চোরে সিঁদ কাটবে , ডাকাতে তোমায় লুট করবে ,
লোভী প্রতিবেশী বা নিকট আত্মীয় তোমাকে ঠকাবে , প্রিয় বন্ধু বিশ্বাস ঘাতকতা করবে । এই সবকিছুই যখন একটা পাথরের টুকরোর জন্য তা হলে সেটা বর্জন করনা কেন বাপু । যে সম্পদ মানুষে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট করে জানি না তোমরা মানুষের সে সম্পদ অধিকারে কী লাভ পাও ।তোমার অন্তরে সিঁদকাটার
কিংবা মস্তিষ্কে ডাকাতি করার সাধ্যি কার নেই । চুরি ডাকাতি দুরের কথা তোমার মনের মনি মাণিক্য যদি বিশ্বাস ঘাতকতা করেও কেউ নিতে চায় ধরা পরে যাবে । সায়কের মনে হল সে নতুন কত কিছু শিখল । যা তার পড়ার বইয়ের কোথাও লেখানেই । নীলাকে ধন্যবাদ জানাবে বলে সে যেই না হাতের মুঠো খুলল
দেখল শুধু তার হাতের মধ্যে একরাশ বুজ-বুজ সমুদ্রের ফেনার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে । সায়ক হতাশ হল না বুঝল কোনকিছুর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির চেয়ে বড় ভেবে দেখা সেটা আদপে কতটা জীবনের প্রয়োজনীয় । সে ডুবুরির মতো যখন ওপরে ভেসে উটতে লাগলো দীর্ঘায়ু একটা কচ্ছপ তার পাশ থেকে ভেসে গেল । খরগোসের
সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় কচ্ছপের জেতার গল্প সকলে জানে ; কচ্ছপের মন্থরতা সম্পর্কে অভিযোগ সর্বজন অবিদিত । তবে এই উভয় চর টি এখন তার সম্পর্কিত সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে সাঁ সাঁ করে সায়কের সামনে থেকে ডাঙ্গার দিকে ভেসে চলল । যাবার সময় সে যেন সায়কের কানে কানে বলে গেল ;
-সময়ের সাথে তাল-মিলিয়ে গতিশীল হয়েছি আমরা । বলতে পারো এটা আমাদের অভিযোজন ।
সায়ক বলে ;ধীরে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে সে চলে । লম্বা দৌড় জিততে হলে দম সঞ্চয় করা খুব জরুরি ।
সায়ক যে অভ্রান্ত প্রমাণিত হল মাঝপথে কচ্ছপকে হাঁপিয়ে হাবুডুবু খেতে দেখে । লুকিয়ে পড়া লাল ক্যাঁকরা দের গর্তের পাশে সায়ক যখন পারে উঠে বালুকা তটে এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে বেশ কিছুটা সতেজ হয়ে উঠে সে দেশ দেখতে যাবার উপক্রম করছিল । কচ্ছপ টা পারে পৌঁছায় ।
সায়ক বলে ;
- জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কিন্তু জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার ; তোমার আয়ু তিনশো বছরের কতকিছু শিখবে বলো দেখি ।
এমুহূর্তে সেই কচ্ছপ যে কি শিক্ষা পেল হাঁপিয়ে উঠে সে কিছুই বলতে পারলো না ; হা করে শুধু সমুদ্র পারের বাতাস নিতে থাকলো । তখনি একটা অতভূত বাঁশির সুর দূরে কোথায় বেজে উঠলো । সেই বাঁশির সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সায়ক এগিয়ে চলল নতুন দেশের সুর সাগরের দিকে । সাগর য়ই বটে ; সমুদ্রের চড়ার বড় বাঁকটা পেরতেই বাঁশির সুরটা অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের কনসাটে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল । যা সে আগে কোন দিন শোনেনি । সায়ক যখন বিচিত্র সুরের বাদ্য যন্ত্রের উৎস স্থলে গিয়ে পৌঁছল দেখল সে এক মহা মিলন সমারোহ । আমাদের দোতারা , বীণা , সন্তুর তো আছেই; সাথে আছে প্যরাগুয়ান বীণা , জাপানি কোটো ,ত্রিনিদাদের ইস্পাত চাটু ,চীনা ইয়ানজিকিন , অস্ট্রেলিয়ান ডিডজেরিডোও আর কতকি ।বিভিন্ন বর্ণের ; বিভিন্ন পোশাকের ; নানা রকম বাদ্যযন্ত্র ধারী একদল লোক ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে এই মিলন মেলায় তাদের ভাবের আদান প্রদান করছে সুরের মাধ্যমে । আনন্দের সুরে প্রত্যেকে নাচছে ; আবার করুন সুরে সকলে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠছে । বিষণ্ণতা হতাশার সুর কার কাছে আশার হতে পারে না । সায়ক এই প্রথম বুঝল একমাত্র সুরের একটা সার্বজনীন ভাষা আছে । যেমন চিত্র
দেখে আমার চিত্রকারের মনের ভাব বুঝি আমাদের সাথে চিত্রকারের মনের সংযোগ ও জারণে সংমিশ্রণ হয় । সঙ্গীতেও এ শক্তি বিদ্যমান । সঙ্গীতে যদি বিদেশী ভাষার ব্যাবহার থাকে আর আমরা যদি সে ভাষা নাও জানি এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না সেটা আমার কোন ভাবকে জাগিয়ে তুলছে ভালবাসার না ঘৃণার । আসলে মানুষের কয়েক টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য জাতি -ধর্ম-বর্ণ ; দেশ -কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক । যেমন জাতীয়তা বোধ বা দেশপ্রেম । আর সেই বৈশিষ্ট্য গুলোই মনে অধিক আলোড়ন ঘটালে সুরের মূর্ছনায় তার বহি প্রকাশ ঘটে । সঙ্গীত হয়ে ওঠে সকলের । অতি বড় নিষ্ঠুর ব্যক্তিও গান শুনে কানে হাত চাপা দেয়না । সায়ক যখন সুরের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়ে উঠেছিল সুযোগ পেয়ে বাঁশিওলা আবার বাজাতে শুরু করলে সমারোহের মাঝখানে সায়ক তাকে আবিষ্কার করে । কাঁধে তার ঝোলা ব্যাগ আর ব্যাগ ভর্তি বাঁশি । সায়কের মনে হল অমন বাঁশি তার যদি থাকতো হৃদয় মিলিয়ে পৃথিবীর সবার সাথে ইংরাজি , ফার্সি, আরবি না শিখেও ভাবের আদান প্রদান করতে পারতো অনায়াসে । নানা বর্ণের মানুষের ভিড় ঠেলে সায়ক যখন বাঁশি আলার দিকে এগিয়ে চলল সে তখন অন্য কোন সমারোহে প্রদীপ প্রজ্বলনের উদ্দেশ্যে চলল ।
সায়ক কে সে লক্ষও করল না ; ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল । ভিড় পেছনে ফেলে ছুটে সমুদ্র তটের আর কিছুটা এগিয়ে গেলে সায়ক আবার শুনতে পায় সেই বাঁশিওলার সুর । সায়ক ছুটে চলল দুই একবার সমুদ্র পাড়ের বালির ওপর পড়ে গেলেও সে থামল না । সমুদ্রের পাড়ের নতুন বাঁকটায় এসে দিগন্ত
বিস্তৃত পটে আর কাউকে দেখতে পেল না সে । সা সা করে বয়ে আসা দমকা হাওয়ায় সমুদ্রের গর্জনের সাথে একখণ্ড বাঁশির সুর তখনো লেগে । সুরটা যেন সায়ক কে কানে কানে অনন্তের পথের মোরে বাঁশিওলার ঠিকানা দেয় । সায়ক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে । আর একটা বাঁকের পর সে দূরে বাঁশিওলা কে দেখতে পায় ।
অনন্তের পথে আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে সে ; কোন অচেনা রঙ্গের সন্ধানে অপর কোন অচেনা স্বপ্নরাজ্যে । সায়ক ছুটেগিয়ে যখন তার ঝোলা টেনে ধরল ;একটা বিভেদ , বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা হীন ব্যাপ্ত সুরের বাঁশির জন্য । সায়কের কক্ষচ্যুতি ঘটলো । মা রান্না ঘর থেকে এসে পটাস করে আটা মাখা হাতেই
স্কেলের বাড়ি বসাল সায়কের পিঠে । ডেক্সের ওপর থেকে চোখ মুছতে মুছতে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল চক্ষু তার রক্ত বর্ণ ।
- হোম-ওয়ার্ক করতে বসলেই ঘুমপায় না । তারা তারি কমপ্লিট কর আমি রান্না সেড়ে এসে দেখবো । আবার আঁকা স্কুলে যেতে হবে । কাল পাড়ায় আঁকা প্রতিযোগিতা
আছে । গত বার যা এঁকেছিলি আমি কার কাছে মুখ দেখাতে পারি না ।
পরের দিন যেমন খুশি আঁক প্রতিযোগিতায় সায়ক মনে করেকরে তার স্বপ্নের ফেরি-ওলার ছবি আঁকতে আঁকতে সময় পেরিয়ে গেল । ছবি টি আর সম্পূর্ণ হল না ।
গত বছরের মতো এবার টুবলু প্রথম হওয়ায় তার মা বেস ভিজিয়ে ভিজিয়ে ছেলের গুণকীর্তন করলো । সায়কের মা মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে সায়ক কে আবার ঠেঙ্গাল ।
- গাধা টা তোর দারা কিছুই হবে না ।
সায়ক কাঁদতে কাঁদতে বললো ;
- হবে কী করে স্বপ্ন টা পুরপুরি দেখতে দিলে ।
আবার স্বপ্নের কথা শুনে সায়কের মা আর চোটে গেল । কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল বেডরুমে ;
- রাত দিন সুযোগ পেলেই শুধু ঘুম আর হাবি যাবি স্বপ্ন ।
সায়ক যন্ত্রনায় কাতরে উঠে বললো
- কান ছার লাগছে ; আজ পর্যন্ত আমার কোন স্বপ্নই তুমি পুর পুরি দেখতে দাওনি ।
সায়কের মা আর চেঁচিয়ে ওঠে ;
- তুই ক্লাসে ফাস্ট হবি ; আঁকায় distinction পাবি ; কম্পিউটারে তোর দখল থাকবে সকলের থেকে ভাল ; তোর সাথে জেনারেল নলেজে কেউ পরবে না । এ গুলো আমার
স্বপ্ন । আমার কোন স্বপ্ন টা তুই পুড়ন করছিস বল দেখি ?
সায়ক বিরক্ত হয়ে বলে ;
- তোমার স্বপ্ন তুমি দেখ ; আমার স্বপ্ন আমাকে দেখতে দাও ।
এবার সায়কের মা আরো রেগে গিয়ে তার পিটে কিল মারতে মারতে তাকে বেডরুমে আটকে দরজা বন্ধ করে দেয় ।
- আজ থেকে তোর খাওয়া দাওয়া সবকিছু বন্ধ ।
রাতে কাজ থেকে ফিরে বাবা সে ঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকে দেখল সায়ক অঘোরে ঘুমিয়ে কি যেন বির বির করে । সায়কের আর কাছে গেলে সে পরিষ্কার শুনতে পেল
সায়ক বলছে ;
- ফেরি-ওলা তুমি তোমার বাঁশি বন্ধকরো এখান থেকে যাও । আমার মা তোমার সাথে আমায় দেখলে কষ্ট-পাবে । আমি মা কে কষ্ট দিতে চাইনা ।
সায়কের মা রাতের রান্না সেড়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে;
- ওকে ডেকে দাও । না খেয়ে শুলে আবার শরীর খারাপ করবে ।
সায়কের বাবা বলেন :
- আস্তে কথাবলো ; এক দিন না খেয়ে শুলে কিছুই হবে না l
সায়কের বাবার কাছে সায়কের ঘুমন্ত প্রলাপ শুনে সায়কের মার চক্ষু ভিজে যায় ।
রাতে বিছানায় শুয়ে সায়কের বাব যখন তার মায়ের কাছ থেকে সংসারের খুঁটি নাটি খবর নিচ্ছিল সে শোনে সায়কের আঁকা সেই ফেরি ওলার কথা গ্রামের বাড়ির রথের মেলায় এমনি একটা ফেরি-ওলার কাছথেকে সায়কের বাবা একটা আড় বাঁশি কিনেছিল শখকরে । বাঁশি বাজানোর তার ছিল খুব ইচ্ছে ; কিন্তু তার বাবা সায়কের ঠাকুর দা রাগ করতেন ; বলতেন '' শেষ মেষ যাত্রা দলে গিয়ে ভিড়বে । " তার আর বাঁশি বাজানো হয়নি । সে এখন সরকারি দপ্তরের ক্লার্ক । অথচ তার বাড়িতে এক সময় রবীন্দ্র নজরুলের ছড়াছড়ি ছিল । বাবা মহা মনবের উদাহরণ দিলে এদের কেই সামনে দাঁড় করাতেন । অথচ কোন দিনও বলেননি ; দুক্ষু-মিয়া যদি যাত্রাদলে বাঁশি বাজিয়ে কাজি নজরুল হতে পারে '' আমাগো পোলা বাজাইলে জাত জাইবো কেন ? '' অনেক রাত অব্ধি সায়কের বাবার আর ঘুম এলো না । বাল্য স্মৃতি সংরক্ষিত একটা টিনের বাক্সর মধ্যের
লাট্টু , লেত্তি , লাটাই , গুলি কতকিছু সে উলটে পালটে দেখে শেষমেশ তার সেই মেলায় কেনা আড় বাঁশিটা হাতে তুলে নিল ।
পরের দিন সকালে সায়কের বালিশের তলায় সায়ক আবিষ্কার করলো তার স্বপ্নের ফেরি-ওলার সেই বাঁশি । সেটা স্বপ্ন না সত্যি; বোঝার জন্য সায়ক নিজেকে চিমটি-কাটে ।
১০ মার্চ - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪