রেলসড়কের উপর দাঁড়িয়ে রেদোয়ান একবার বহুদূর বিস্তৃত রেললাইনের এক প্রান্তে তাকায়; কিছুক্ষণ পরে আবার অন্য প্রান্তে। যে দিক দিয়ে আসুক একটা রেলগাড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে সে। অথচ তার দৃষ্টিতে তাড়া বা ব্যস্ততার কোন ছাপ নেই কারণ তার গন্তব্য এ পর্যন্তই। বিদ্ধস্ত শহরের কোলাহল ছেড়ে কিছুটা নির্জনতা এখানে; এখানেই চলন্ত রেলগাড়ির নীচে ঝাপিয়ে পড়বে সে, পৃথিবীর কাছে নিজেকে আড়াল করার জন্য মহা মুক্তির নেশায় বিভোর রেদোয়ান। কিন্তু আজ বড্ড বেশীই দেরী করছে রেলগুলো। কী জানি, হয়ত বিশেষ কোন কারনে আজ রেল চলাচল বন্ধ আছে অথবা হয়ত আসবে, হয়ত আসবে না-এমন দোলাচলের মধ্যে রেদোয়ানের মনটা হঠাৎ ঘুরে যায়; আবার সে পা বাড়ায় ঘরে ফেরার পথে। সরকারী অফিসে ছোট খাটো চাকরী রেদোয়ানের; আজও প্রতিদিনের মতই সন্ধ্যের পরে বাসায় ঢোকে, হাতে ছোট কালো একটা খাবারের ব্যাগ। এ সময় স্ত্রী শ্রাবনী তাদের একমাত্র মেয়ে রাত্রীকে পড়াতে বসে। রাত্রীর বয়স ছয় বছর পেরিয়েছে। ঘরে ফিরে বাবাই রাত্রীকে নিয়ে বসে। কিন্তু আজ ব্যাগটি রেখে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ইদানীং রেদোয়ানের মন ভাল নেই শ্রাবনী জানে। শ্রাবনী নিঃশব্দে গিয়ে রেদোয়ানের শরীর ঘেঁষে বসে। "জামা কাপড় পাল্টিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।" রেদোয়ানের জামার বোতাম খুলতে খুলতে কথাগুলো বলল শ্রাবনী। আজ রাত্রীকে নিয়ে বসা হলনা রেদোয়ানের। রাতের গভীরতা বাড়ে আর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আর খাওয়া শেষে সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে রাত্রী। রেদোয়ান আর শ্রাবনী যেন ঘোমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাতের আঁধারে বিছানা ছেড়ে রেদোয়ান একাকী জানালার পাশে দাঁড়ায়। রেলসড়কের খুব বেশী দূরে নয় তাদের বাসা। একটা রেল চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে; আর সেই বিদায়ী শব্দ দিয়ে কষ্টের সাথে সমান্তরাল রেখা টেনে যায় জীবন খাতায়। জানালার পাশে অস্ফুট আলোয় শ্রাবনী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বিয়ের প্রথম দিকে শ্রাবনী খুব চঞ্চল ছিল। কিছু বুঝে না বুঝেই স্বামীর কাছে অনেক আব্দার তুলে ধরতো। ছোট ছোট সে আব্দার, বায়নাগুলো কখনো পুরন হয়েছে কিনা খেয়াল নেই। ধীরে ধীরে স্বামীর সাথে তার মনটাও একই বেদনার নীলে ছেয়ে গেছে। রেদোয়ানের বেতনের অর্ধেক বাসা ভাড়ায় চলে যায়। গ্রামে বাবা মা’র জন্য নির্দিষ্ট পরিমান টাকা পাঠাতে হয় প্রতি মাসে। তারপর নিজেদের সংসার চালিয়ে প্রায়ই লোন করতে হয় তাকে। প্রথমে অফিস থেকে শুরু তারপর সহকর্মী, বন্ধু, বান্ধব সবার কাছে পাহাড় সমান ঋণ। বাসার পাশের কয়েকটা দোকানে অনেক টাকা বাকি জমেছে। এভাবে ঋণের বোঝা বাড়াতে বাড়াতে এখন সবার চোখে সে একজন ধুরন্ধর ব্যক্তিতে পরিনত হয়েছে। অনেক পরে শ্রাবনী রেদোয়ানের এ অবস্থার কথা জানতে পারে। কিন্তু উত্তোরনের কোন পথ জানা নেই দু’জনার। রেদোয়ানের মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে আমতা আমতা করে শ্রাবনী বলে- "একটা কথা বলি!" "বল, শুনছি।" দূর কোন অজানায় নিথর দৃষ্টি রেদোয়ানের। শ্রাবনী বলে- "রাত্রীর স্কুলে কয়েক মাসের বেতন বাকি পড়েছে। শিক্ষকরা বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। বেতন ছাড়া মেয়েটা স্কুলে যেতে চায় না। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ওকে আর কতদিন স্কুলে পাঠাবো। বলছিলাম, আরো দু’টো বছর বাসায় বসে আমরা নিজেরাই ওকে পড়াতে পারি।" রেদোয়ান দূরে আলো আধাঁরের রাতের দিকে তাকায় আর বলে- "ঠিকই বলেছো। জানো শ্রাবনী, বাবা হয়ে এখন আমি স্বজ্ঞানে মেয়েটার সাথে প্রতারণা করার কথা ভাবছি। ভাবছি-কোন একদিন রাত্রীর মতো তোমার-আমার পথও ঢেকে যাবে আঁধারে।" এভাবেই সংসার চলছে তো চলছে না। পায়ে হেঁটে অফিসে যেতে যেতে রেদোয়ানের জুতোর বেহাল দশা। কোনো কালে শ্রাবনীকে ভাল একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল কিনা তা এখন স্মৃতিতে নেই। তবুও শ্রাবনী অহর্নিশ প্রতীক্ষায় থাকে কখন ফিরবে রেদোয়ান। যদি তাকে আজ হাসি মুখে দেখা যেতো-অযথাই এসব ভাবনা খেলা করে ভেতরে ভেতরে। রাত্রীকে অবিলাসী পথ দেখায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে। সব কিছুই হয়ত সুখের জন্য অথবা হয়ত বেঁচে থাকার জন্য। পৌষের কোন এক অফিস ছুটির দিনে গ্রাম থেকে রেদোয়ানের বাবা মা এসেছেন। দু’জনই বার্ধক্যের নানা রোগে আক্রান্ত। শীতে শরীরের রোগগুলো যেন একসাথে জাপটে ধরেছে। তাই শহরে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। তাদের আগমনে রাত্রীই শুধু খুশী হলো। কিন্তু রেদোয়ান আবার দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায়। হাতে টাকা পয়সা নেই-এই মুহূর্তে না জানিয়ে তাঁদের চলে আসা নিয়ে বাবা মা'র সাথে অনেকক্ষণ ঝগড়া হল রেদোয়ানের। প্রানের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে এভাবে দুর্ব্যবহার দেখে শ্রাবনীর মন খারাপ হয়ে যায়। সে রেদোয়ানকে বোঝাতে চেষ্টা করে। অতঃপর শ্রাবনী বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রেদোয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্রাবনী জানে রেদোয়ানের পকেটে কোন টাকা নেই। তবুও ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে নীচু কন্ঠে বলে- "এই নাও বাসায় চাল নেই। আরো অনেক কিছু নেই।" হতাশার চোখে শ্রাবনীর দিকে তাকায় রেদোয়ান। নিমিষেই সমস্ত শরীর যেন শীতল হয়ে যায়। তারপর বাজারের ব্যাগটা ভাজ করে হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে রেদোয়ান। রেদোয়ান যে দিকে তাকায় সেদিকেই শুধু শূন্যতা। মনের দৃষ্টিতে অতি আপন কোন মুখ খুঁজতে থাকে আবার ঋণ করার জন্য। প্রথমে পরিচিত দোকানগুলোতে বাকিতে চাল কেনার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারপর সমস্ত লজ্জা আর ভয় ভেঙে পায়ে হেঁটে অনেকের কাছে যায়। সবার কাছে শুধু পুরনো ঋণের তাগাদাই পায় রেদোয়ান। এভাবে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা নেমে আসে; বড্ড ক্লান্ত শরীর; চার দিকে তাকায়-তার চোখে পৃথিবীর রঙ আজ বড় ধূসর। সন্ধ্যার অস্ফুট আলোয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার রেদোয়ান সেই রেলসড়কের উপরে গিয়ে দাঁড়ায়; একটা রেলের অপেক্ষায় বসে থাকে। রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে আর থাকে ফেলে আসা জীবনের লেনদেন। দূরে একটা রেলগাড়ি আসতে দেখে রেদোয়ান ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুহূর্তেই পেছনের হাজার ভাবনা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। হঠাৎ যেন তার মেয়ে রাত্রী অতি উচ্চ কন্ঠে বলে ওঠে- "বাবা, তুমি এখনো আসো না কেন! মা, দাদা, দাদু আমরা সবাই না খেয়ে সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাদের সবার বড়ই কষ্ট ববা।" অতঃপর রেলগাড়ি চলে গেলো কোন এক গন্তব্যে আর শুধু হুইসিলের শব্দটা ভাসতে থাকলো এই ধূসর পৃথিবীর আকাশে বাতাসে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
বিষাদের এক ঝাক কথা আর বাস্তবতার কাহিনী খুব ধারুণ ভাবে চমকে দিলো। অনেক অনেক শুভকামনা, ভোট তো নিশ্চয়ই আর সেই সাথে আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।