যায়গাটা ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না।সময়টা ও কিছুটা অগোছালো।পশ্চিমের আকাশটা কিছুটা রক্তিম আভায় আলোকিতো হয়ে আছে।রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট গুলো এখনো সব জালানো হয় নি।অল্প আলো থাকায় রাস্তাটা কে ভূতুরে ভূতুরে লাগছে।কয়েকটি নেকড়ে কুকুর রাস্তার এগোলি থেকে ও গোলি ঘোরাঘোরি করছে।প্রায় জনশুন্য রাস্তাটাতে একজন লোক হাটাহাটি করছে।যেনো কিছু একটা হারিয়ে এখানে খুজতে এসেছে।কিছুটা বলশালী তার দেহ।পরনে মেরুন প্যান্ট আর সাদা হাফ হাতা শার্ট।ঠিক সাদা বললে ভুল হবে।শার্টের থোকায় থোকায় কিছুটা লাল দাগ লেগে ছিলো।অনেকটা পুরোনো সেই দাগ কালো দেখচ্ছিলো।লোকটির চোখে কেমন যেন উদাসী ভাব ছিলো।সাদা হাফ হাতা শার্ট পরায় তার ভেতর কিছুটা ছাত্র-ছাত্র ভাব ফুটেছিলো। রাস্তার লাইট গুলো সব জালিয়ে দেওয়া হয়েছে।ঢাকা মেডিকেলের রাস্তা ধরে লোকটি হাটছিলেন।কিছুটা গন্তব্যহীন ছিলো সেই হাটার ভঙ্গিমা।চারদিক লোকজনে টইটম্বুর।যে দিকে চোখ যায় শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং।দু’পাশে সারি সারি দোকান।রাস্তার লোকগুলো যেনো সবাই তার নিজ কাজে ব্যাস্ত।কারো যেনো কাউকে একটু সময় দেওয়ার সময়টুকু ও নেই।একেক জন যেনো একেক জনের থেকে অনেক দুরের।সবাই যেনো সবার অচেনা হয়ে গেছে। লোকটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছেন,সেদিন এমনটা ছিলো না।এই রাস্তা ছিলো জনশুন্য।রাস্তায় তেমন দোকানপাট ও ছিলো না।মামার দোকানের চা খেতে তাদের সেই ভার্সিটি থেকে পায়ে হেটে আসতে হতো।পিচ ঢালা পথ এতো শুকনো কেন।সেদিন এমনটা ছিলো না।সেদিন এই রাস্তা ভেজা ছিলো-রক্তে ভেজা।সেই রক্ত শুকিয়ে পুডিং এর মতো রাস্তায় লেগে ছিলো।তাতে লেগে ছিলো খালি পায়ে দৌড়ানোর দাগ।ছোটো বড় মানুষের পায়ের গোড়ালি।ছিটকে বের হয়ে যাওয়া মাথার মগজ।পায়ের আঙ্গুল হাতের আঙ্গুল।চাপ চাপ রক্তে ছিলো মানুষকে টেনে হিচরে নিয়ে যাওয়ার দাগ।এই দাগ তো উঠার ছিলো না।সেই রক্ত এতো দ্রুত কী করে শুকালো!!! রাস্তাটা কেমন যেনো অচেনা অচেনা লাগছে।লাগবেই না আর কেন।এতো অল্প সময়ে কতো কিছুর পরিবর্তন হয়েছে।শহীদ মিনারটা কোন দিকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।সামনে একটি চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে।লোকটি চায়ের দোকানে গেলেন।চা বিক্রেতার কাছে যেতেই লোকটি বললেন,ভাই শহীদ মিনারটা কোন দিকে বলতে পারেন? এইতো হাতের ডান দিকে গেলেই পাবেন।কেন স্যার লাগবো নাকী? বুঝলাম না ভাই,কী লাগবে? কী লাগবে তা তো আপনি ভালো জানেন।এতো দূর যাওয়ার দরকার নাই।লাগলে বলেন আমি জোগার করে দিতেছি। কী লাগবে?আর কী জোগার করবেন আপনি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এহ ন্যাকা।রাত্তির বেলা মানুষ ওখানে কেন যায় তা জানিনা মনে করেছেন।বেসি দিতে অইব না।অল্পেই অইব।লাগলে কন জোগার কইরা দেই।নাইলে ফুটেন। তিনি কিছু বুঝতে না পেরে ওখান থেকে চলে এলেন।তিনি রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাটছেন।অনেক খোজাখুজির পর ও তিনি শহীদ মিনার খুজে পেলেন না।তাকে কিছুটা বিব্রত দেখাচ্ছিল।কিছুদুর হাটার পর তিনি একটা গোলিতে কয়েকটি ছেলেকে দেখতে পেলেন।ছেলেগুলো একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলো।ছেলেগুলোকে দেখে তার সেই ভার্সিটির ক্যাম্পাসের কথা মনে পরে গেলো।ভার্সিটির বন্ধুরা মিলে যখনি সময় পেতেন আড্ডা দিতে বসতেন। কখন যে বেলা ফুরিয়ে যেতো তা তারা টের ও পেতেন না। গোলির মোড়ে যেতেই ছেলেগুলো উঠে দারালো।কিছুটা কাছে যেতেই লোকটি বললেন,বাবারা শহীদ মিনার কোন দিকে বলতে পার? ছেলেগুলো একসাথে হেসে উঠল।তাদের ভিতর একজন এগিয়ে এসে বলল,বয়স তো কম অয় নাই।রাত্তির বেলা বউ পুলাপান থুইয়া অই হানে কী কাম? তোমরা এভাবে কথা বলছ কেন বাবারা।তোমরা আমাকে চেন নাই?আমি ভাষা সৈ্নিক শফিকুর রহমান।সর্গ থেকে একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি এদেশ দেখব বলে।তোমরা আমাকে ভুলে গেছ? ছেলেগুলো আবার হেসে উঠল আর বলল,বলে কী ব্যাটা!ভাষা সৈ্নিক?এরা আবার কে রে!!বলেই আবার হাসতে লাগল। তোমরা আমাদের ভূলে গেছ!! ধুর……এতো কথার কাম নাই।যা আছে বাইর করেন। আমার কাছে কিছুই নাই।দেখছ না আমার পকেট ছেরা।সেদিন যখন মিছিলে গুলি খেলাম তখন সব হারিয়ে ফেলেছি।চোখের চশমা হারিয়ে ফেলেছি।নতুন কেনা ঘরিটা ও হারিয়ে ফেলেছি।আমার মায়ের চিঠিটা পকেটে ছিলো তাও হারিয়েছি।অনেক খুজেছি কিন্তু পাই নাই তাই…… আরে হালায় কয় কী?হালায় বলে গুলি খাইছে!হালায় তো পুরাই পাগল।চল কাইটা পরি।নাইলে পাগলের হাতে উলটা মাইর খাইতে হইব।ছেলেগুলো লোকটিকে পাগল ভেবে ইট মারতে মারতে পালিয়ে গেলো।তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না।শুধু ভাবলেন,একি দেশের অবস্থা!এদের জন্যেই কী তারা তাদের প্রান দিয়েছিলেন।এই সন্মান টুকুই কী তাদের প্রাপ্য ছিলো।এতো তারাতারি মানুষ তাদের ভুলে গেলো?সেদিনের সেই রক্তের দাগ এখনো তো তার শার্টে লেগে আছে।তাহলে মানুষ কেন তাদের ভুলে যাবে… তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে হাটতে লাগলেন।অনেকক্ষন হাটার পর তিনি শহীদ মিনারে আসলেন।বড় বড় গাছে ছেয়ে আছে মাঠটি।রত্রের বেলাতেও এখানে অনেক লোকের সমাগম।কিন্তু তারা কেউ এখানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেনি।সবাই জুতা পরেই মিনারে উঠছে।গাছের নিচে ছেলে আর মেয়ের আড্ডাখানা।কয়েক জন কে দেখা গেল একসাথে বসে সিগারেট ফুকছে।কে জানে হয়তো গাজাও ফুকছে।ছেলে আর মেয়ের অশ্লিল আচরন তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না।তিনি এখন বুঝতে পারছেন চা বিক্রেতা কেন তাকে ঐ সব কথা বলে ছিলো। মিনারে উঠার জন্যে যখন তিনি জুতা খুলছিলেন ঠিক তখন পিছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল,কী?একা নাকি? মানে? মানে একা নাকী?আইজ কোনো কাষ্টমার পাই নাই।কম দিলেও চলব।নিবেন আমারে? তুমি কে মা তোমার নাম কী? আমার একেক দিন একেক নাম।আইজ আমার নাম কুসুম। তুমি হিন্দিতে কথা বলছ কেন? মডার!মডার্ন!এহন যে যতো হিন্দিতে কথা কয় সে তত মডার্ন।মাঝে মাঝে বাংলাই ভুলে যাই হা হা হা…… হিন্দি ফিলিম দেখাইয়া কাষ্টমার আকৃষ্ট করি।তাই শিখা ফালাইছি হা হা হা…… মেয়েটি খিল খিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল।শফুকুর রহমান কিছুক্ষন দারিয়ে থেকে হাটতে লাগলেন আর ভাবতে থাকলেন-এর জন্যে কী আমরা সেদিন মিছিলে গিয়েছিলাম।যারা আমাদের সন্মান দিতে জানেনা যারা আমাদের মায়ের ভাষার সন্মান দিতে জানেনা তাদের জন্যেই কী আমরা আমাদের প্রান দিয়েছিলাম?এদেসের মানুষ এতো তারাতারি সব ভুলে গেল?আমরা তো কিছু ভুলিনি।আমার ছেরা শার্টের সেই রক্তের লাল দাগ তো এখনো মুছে যায়নি।তবে কেন… এখনো ভোর হয়নি।ল্যাম্প পোস্ট গুলো সব নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।ভোরের কয়েকটি কাক ঝুলন্ত তারে বসে আছে।এখনো তারা ডাকাডাকি শুরু করেনি।হয়তো তারাও ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছে।ভোর হতে শফিকুর রহমান কে আর দেখা জায়নি।কিন্তু শহীদ মিনারের উপর একটি চিরকুট পাওয়া গেছে যাতে লিখা ছিলো, যার তরে,রাজ পথে নিজেরে করেছি বিসর্জন, ক্ষমা কর মা,রাখতে পারিনি তা করতে পারিনি তা অর্জন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন
ভাই একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প পড়লাম, খুব ভাল লাগলো. ধন্যবাদ.
সূর্য
মুফতে পাওয়া ভাষা আর স্বাধীনতা আমাদের ততটা ভাবায় না যতটা আত্মত্যাগে উৎসাহিত হয়েছিলেন ভাষা সৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা ভাবি ওগুলো আমাদের ওয়ারিশে পাওয়া। যদি নিজের রক্তে কিনতে হতো তাহলে সত্যি সত্যি খুব করেই বুঝতাম এগুলোর কদর। ভিন্ন একটা থিমে বেশ চমৎকার করেই লিখেছ। খুবই ভাল লিখেছ।
তাপসকিরণ রায়
গল্পটি নতুন চিন্তনে লেখা,খুব ভালো লেগেছে। হ্যাঁ,তবে এ ধরনের একটি গল্প গত সংখ্যাতে পড়েছি।তবু বলবো এ গল্পটিও বেশ ভালো।লেখককে আনুরোধ করবো,বেশ কিছু আশুদ্ধ বানান এতে রয়েছে সেগুলিকে শুদ্ধ করিয়ে নিতে।ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।