প্রাপ্তি

পূর্ণতা (আগষ্ট ২০১৩)

অদিতি ভট্টাচার্য্য
মোট ভোট ৫৬ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৯৫
  • ৪৫
‘ম্যাডাম জলদি আইয়ে, বারিশ আনেওয়ালি হ্যায়,’ ড্রাইভার শিবপ্রসাদের ডাকে সুনেত্রার নিবিষ্টতা ভঙ্গ হল।
কতক্ষণ যে এভাবে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমের দিলে তাকিয়ে ছিল তার ঠিক নেই। তাকিয়ে ছিল আর ভাবছিল দুটো আলাদা নদী, আলাদা তাদের গতিপথ প্রথম থেকে, স্পষ্ট তাদের স্রোতের পার্থক্য বোঝ যাচ্ছে এত ওপর থেকেও – অথচ তাও তারা মিশেছে একসঙ্গে, সম্ভব হয়েছে তাদের সঙ্গম, মিলেমিশে আবার এক হয়ে বয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে, যুগ যুগান্ত ধরে, সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে। অথচ দুটো মানুষের একসঙ্গে থাকাটাও একেক সময় কি রকম দুর্বিষহ হয়ে যায়, হলই বা তারা স্বামী স্ত্রী।
ড্রাইভারের কথায় ফিরতে হল। হ্যাঁ মেঘ করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল সুনেত্রা। যদি পারত এই ক্লান্তির বোঝা সঙ্গমে নামিয়ে আসতে, অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর উদ্দাম জলস্রোত তাকে মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু হায়, তা হয় না। কিছু কিছু বোঝা মানুষকে বয়েই নিয়ে চলতে হয়। নামিয়ে ভারমুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য বোধহয় সবার জন্যে নয়।
রূদ্রপ্রয়াগের সর্পিল পাহাড়ী পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল রিসর্টের দিকে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সুনেত্রা। দুপাশে সবুজ পাহাড়, গগনচুম্বী যাদের শিখর। এই সেই দেবভূমি হিমালয়, যুগে যুগে যার টানে মানুষ ছুটে এসেছে। কত দুর্গম ছিল আগে চার ধাম যাত্রা। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করে মানুষ ফিরলে তার আলাদা কদর হত, আদরযত্ন হত। বলা হত শুধু পুণ্য অর্জন নয়, সম্ভবত মৃত্যু জয় করেও ফিরেছে। পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে কেদারনাথের দর্শন পেতেই সে যুগে পুরো এক মাস সময় লাগত হৃষীকেশ থেকে। দীর্ঘ পথশ্রম, শারীরিক ক্লান্তি সব মুছে দিতে সক্ষম ছিল শুধু একবারের দর্শন। পূর্ণ হত ইচ্ছে, সম্পূর্ণ হত যাত্রা। পরিপূর্ণ মন নিয়ে মানুষ ফিরে আসত নিজের আলয়ে। আর আজ? সময় এগিয়েছে, তার থেকেও বোধহয় দ্রুতগতিতে এগিয়েছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। প্রকৃতিকে জয় করার নেশায় মানুষ বুঁদ, পেরেছে কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। তাৎক্ষণিক পরিপূর্ণতার আনন্দে মানুষ আজ বিভোর। তীর্থযাত্রার সঙ্গে ভ্রমণের ফারাক তাই আজ গেছে ঘুচে। গাড়োয়ালের পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ি চলে মসৃণ গতিতে। চতুর্দিকে হোটেল, রিসর্টের ছড়াছড়ি, সর্বত্রই পিকনিকের মেজাজ।
এই দেখতেই কি এসেছিল সুনেত্রা? মনের মধ্যে কি এই ছবিই ছিল? বোধহয় না। ছোটোবেলা থেকে ঠাকুমার কাছে কষ্টসাধ্য কেদারবদ্রী দর্শনের বর্ণনা শুনে শুনে দেবভূমির যে ছবি আঁকা হয়েছিল মানসপটে তা মিলছে না, মিলছে না একেবারেই। অবশ্য পারও হয়ে গেছে কত বছর। এখন সব কিছুই মেলে বিনা আয়াসে, সব কিছুই হাতের নাগালে, পরিবর্তনের চিহ্ন সর্বত্র। মিলবে কি করে?
আর মেলেও কি সব কিছু জীবনে? বছর বারো আগে আশা, আকাঙ্ক্ষা আর অনুরাগ দিয়ে যে কল্পনার ছবি মনের মধ্যে তৈরী করে তপোব্রতর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল সে ছবিও কি মিলেছে? না তাও মেলেনি। বরং কিছু দিনের মধ্যেই সে ছবি ভেঙে গেছে শত টুকরো হয়ে। সে টুকরো না আঁচলে বেঁধে রাখতে পেরেছে সুনেত্রা, না পেরেছে জোড়া লাগাতে। দেখেছে চোখের সামনে পদদলিত হতে, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।
কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল সুনেত্রা কত পার্থক্য তার আর তপোব্রতর মধ্যে। আসমান জমিন। কিন্তু তাও মানুষ একসঙ্গে থাকে, দুজনের পছন্দকে গুরুত্ব দেয়, গড়ে পরিবার। কিন্তু তপোব্রত অন্য কারুর পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার লোকই নয়, সে যেই হোক, সবাইকে ওরই পছন্দমতো হতে হবে। ওর পছন্দকেই পছন্দ করতে হবে, ওর অপছন্দকে অপছন্দ। যখন যেটা ভালো লাগবে, তখন, তখনই সেটা চাই! তাতেই ওর আনন্দ, তাতেই গর্ব। ছেলেও মনে হয় একই পথে যাবে, অন্তত সুনেত্রার আশঙ্কা তেমনই। ছোটো থেকেই ওও তাই দেখেই অভ্যস্ত, মুখের কথা খসতে না খসতেই সে জিনিস সামনে এসে গেছে।
মনে আছে সুনেত্রার বছরখানেক আগেকার কথা। ছুটির দিনে তপোব্রত কি একটা সিনেমা দেখছিল, ছেলে পাশে বসে খেলছিল। হঠাৎ সে সিনেমার নায়কের পরিহিত একটা শার্ট সম্পর্কে নিজের পছন্দ প্রকাশ করল। সিনেমা শেষ হল কি না হল তপোব্রত বেরিয়ে গেল। ফিরল একগাদা শার্ট নিয়ে।
দুঃখিতভাবে ছেলেকে বলল, ‘ঠিক সেম জিনিস পেলাম না। তবে অনেকটা একরকম। দেখ তোর কোনটা ভালো লাগে। নেক্সট উইকে তো আমি দুবাই যাচ্ছি ট্যুরে, তখন এনে দেব।’
ভালো কথায় বুঝিয়ে বা রাগারাগি করে যে কোনো লাভ হবে না ততোদিনে ভালোই বুঝে গেছে সুনেত্রা।
তবু সেদিন হুল ফোটাতে ছাড়েনি, বোধহয় ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।
‘আজ শার্ট পছন্দ করল, এনে দিলে নাহয়। কাল যদি হিরোইনকেই পছন্দ করে বসে কি করবে?’
ল্যাপটপে কাজ করতে করতেই জবাব দিয়েছিল তপোব্রত, ‘যখন তার সময় আসবে, তখন চাইলে পাবে,’ তারপর সুনেত্রার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘যা চাই তাই পাওয়াকেই যে লাইফের ফুলফিলমেন্ট বলে সেটা তোমার মগজে আগেও ঢোকেনি, এখনও ঢুকবে না। কাজেই এসব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।’
চমকে ছিল সুনেত্রা লাইফের ফুলফিলমেন্টের সংজ্ঞা শুনে। ভয় পেয়েছিল ছেলের কথা ভেবে। যেমন এখন ভয় পান ওর শাশুড়ি, কণিকা।
‘কিরকম হয়ে যাচ্ছে ও। ওপরে উঠতে উঠতে কত কিছু যে নষ্ট করছে সেটা বুঝছে না। আরও, আরও, আরও চাই, কি সর্বনেশে নেশা এ। এরকম তো ছিল না আগে,’ বলেছিলেন তিনি সুনেত্রাকে, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘আমাদেরই দোষ, পারিনি মানুষ করতে।’
তবুও টেনে চলেছে সুনেত্রা এই সম্পর্ককে। সম্পর্ক বলতে শুধু এক বাড়িতে থাকা আর সামাজিকতা রক্ষায় সুখী দাম্পত্যের মুখোশ পরে তপোব্রতর সঙ্গে হাজির হওয়ায়। নাহলে রোজ কথাও হয় না। ছেলেও দূরে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তারও আলাদা জগৎ এখন থেকেই। বন্ধুদের সঙ্গে সামার ক্যাম্পে গেছে, তার যে খুব ইচ্ছে ছিল। সুনেত্রার কি ইচ্ছে ছিল সেটা অবান্তর। বাড়িতে কথা বলার সঙ্গী বলতে একা কণিকা। তাও কিছুদিন হল তিনি নানা ব্যধিতে জর্জরিত। একেক সময় দুঃসহ লাগে সুনেত্রার। ইচ্ছে করে এই সম্পর্কে ইতি টানতে। কিসের জন্যে যে এতদিন টানে নি তাও জানে না। বুঝতে পারে না কি করবে।
ছেলের যখন সামার ক্যাম্পে যাওয়া ঠিক হল তখন কণিকাই সুনেত্রাকে বলেছিলেন ক’দিন কোথাও ঘুরে আসতে। শুনে প্রথমেই সুনেত্রার মনে হয়েছিল কেদারবদ্রীর কথা। কতবার যেতে চেয়েছে কিন্তু তপোব্রত সব সময়েই নাক সিঁটকেছে। তাই আর যাওয়া হয় নি। এবার সুযোগ আসাতে কণিকার দেখাশোনার সব বন্দোবস্ত করে সেও একদিন রওনা দিল হরিদ্বারের পথে। ভেবেছিল হিমালয়ের কোলে ক’টা দিন শান্তিতে কাটাবে। সব ভুলে উপভোগ করবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে। কিন্তু তা হল না। হরিদ্বারে পৌঁছে ফোন পেল তপোব্রতর, সেও নাকি এসেছে, সেও যাবে কেদারবদ্রী। তবে সুনেত্রার সঙ্গে নয়, আবার একাও নয়। সঙ্গিনী আছে, মিস ভাটিয়া, অফিসের নতুন স্টাফ। সুনেত্রা কত রিক্ত, কত ব্যর্থ আর ও কত সফল, কত পরিপূর্ণ – পদে পদে সুনেত্রাকে তাই বোঝানোই যেন তপোব্রতর নতুন নেশা। তপোব্রত নামটা শুনলেও সুনেত্রার আজকাল হাসি পায়। তপস্যা নয়, যা চাই তাই তক্ষুণি যেনতেন উপায়ে পাওয়াই তপোব্রতর জীবনের ব্রত। সেখানে জড় বস্তু আর মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারপর থেকে চলেছে এই খেলা। যেখানে সুনেত্রা সেখানেই মিস ভাটিয়া সহ তপোব্রত। কেদারবদ্রী দর্শন না করে ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছে না, তাই বইতেই হচ্ছে মনের ওপর এই সাংঘাতিক অত্যাচারের বোঝা।
‘এত বিশাল হিমালয়, এত উদ্দাম অলকানন্দা, মন্দাকিনী, গঙ্গা – তোমাদের কারুর ক্ষমতা নেই এ বোঝা দূর করার? তোমাদের কাছে এসেও শান্তি অধরাই থেকে যাবে আমার? এতই অভাগিনি আমি?’ প্রাণের আকুতি অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে।
রিসর্ট এসে যাওয়ায় দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় সুনেত্রা। সামনেই বাগানে তপোব্রত তার সঙ্গিনীকে নিয়ে হাস্য পরিহাসে লিপ্ত, আড়চোখে দেখে সুনেত্রাকে। সুনেত্রা পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নামল বৃষ্টি মুষলধারে, যেন আকাশজোড়া মেঘের শেষ জলবিন্দুও নিঃশেষ করে। সারা রাত ধরে চলল সেই অবিশ্রান্ত বর্ষণ। কাল বেরোনো যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে এক সময় নিদ্রাদেবীর কোলে সুনেত্রা আশ্রয় নিল।
‘ম্যাডাম, ম্যাডাম উঠিয়ে, বাহার আইয়ে,’ প্রবল দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে আর চেঁচামেচিতে সুনেত্রার ঘুম ভেঙে গেল।
কি ব্যাপার? এখনো তো ভোর হয় নি। কিন্তু বাইরে যেন বড়ো বেশী কোলাহল আর ত্রস্ত পায়ের ছোটাছুটি। কোনো রকম বেশভূষা ঠিক করে দরজা খুলে বেরিয়ে যা শুনল তা গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর হড়পা বানে পুরো এলাকা বিপর্যস্ত। পাহাড় ধ্বসে পড়ছে, ফুঁসছে অলকানন্দা, মন্দাকিনী। যে কোনো মুহূর্তে রিসর্টও চলে যাবে নদীগর্ভে। তাই এক্ষুণি সবাইকে রিসর্ট ছেড়ে চলে যেতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, এক্ষুণি। পালাচ্ছে যে যেদিকে পারছে, সঙ্গে শুধু অত্যাবশকীয় জিনিস নিয়ে। সুনেত্রার মালপত্তর বেশী ছিল না, কোনো রকম নিজেই টানতে টানতে নিয়ে এল।
বাইরে এসে প্রকৃতির যা রূপ দেখল ইহজীবনে কোনোদিন ভুলবে না। মানুষের সব অনাচার, যথেচ্ছাচারের বদলা নিতে আজ প্রকৃতি যেন বদ্ধপরিকর। সর্বংসহার সহ্যশক্তির বাঁধও ভেঙেছে আজ। ধ্যানমগ্ন মহাদেবের ধ্যান বুঝি হঠাৎ বিঘ্নিত হয়েছে, রূদ্ররোষে চলছে তাণ্ডব। আজ বোধহয় আর কারুর নিস্তার নেই। অলকানন্দার উত্তাল জলরাশি ক্রুদ্ধা সর্পিনীর মতো সগর্জনে এগিয়ে আসছে। অবলীলায় ওপর থেকে নামিয়ে আনছে বিশালাকায় পাথর, তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলছে দোতলা তিনতলা বাড়িগুলোকে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিনা আয়াসে, মানুষ তো সেখানে খড়কুটোরও অধম। আজ যেন হিমালয়ের বুক থেকে সব কিছু অবাঞ্ছিত ধ্বংস করার ব্রত নিয়েছে, সব গ্লানি সব কলুষতা মুছে হিমালয়কে ফিরিয়ে দেবে সেই আদিকালে। চতুর্দিকে শুধু আতর্নাদ আর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ।
কি করে ওই উন্মত্ত জলস্রোতে সব খুইয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু বাঁচিয়ে একটা পাথরের খাঁজে বসে পড়ল তা আর মনে করতে পারে না সুনেত্রা। মনে করার চেষ্টাও করে না। বেঁচে আছে, এই যথেষ্ট। পাথরে ঠেসান দিয়ে খোলা আকাশের নীচে কতক্ষণ বসে ছিল তাও জানে না, এতই ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর, মন। হঠাৎ বাচ্ছার কান্নার আওয়াজে সম্বিত ফিরল। তাকিয়ে দেখল কিছু দূরে একটা ছোট্ট বাচ্ছা কাঁদছে। বড়ো বড়ো মানুষ যেখানে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল সেখানে এই একরত্তি বাচ্ছাটা বেঁচে গেছে! আশ্চর্য! কিন্তু বাচ্ছাটার কাছে যাবে কি করে, দুপায়ে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও আর নেই। কোনো রকম হামাগুড়ি দিয়ে বাচ্ছাটার কাছে পৌঁছল সুনেত্রা। আরে, এতো সেই ছোট্ট মেয়েটা! বড়ো জোর বছর দু আড়াই বয়স হবে। ওদের রসর্টেই উঠেছিল। একসঙ্গে অনেকে ছিল, গেল কোথায় সব? নিশ্চয়ই নেই, অন্তত এখানে নেই, থাকলে কি আর এভাবে বসে বসে কাঁদত? কোনোরকম বাচ্ছাটাকে কোলে তুলে অতি কষ্টে পাহাড়ের দেওয়াল ধরে ধরে আবার আগের জায়গায় এসে বসল। এবার খেয়াল করল কাছে দূরে অনেকে আছে। কেউ আছে, কেউ নেই। যারা আছে তাদের কেউ কেউ কাতরোক্তি করে বেঁচে থাকার প্রমাণ দিচ্ছে, কেউ উঠে বসার চেষ্টা করছে। বাকীদের কে অজ্ঞান আর কে পৃথিবী ছেড়ে পরপারের বাসিন্দা হয়েছে বলা মুশকিল।
বাচ্ছাটা কেঁদেই চলেছে। এক ফোঁটা জলও নেই সঙ্গে যে দেবে। সুনেত্রা এদিক ওদিক তাকাল। চতুর্দিকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার স্বাক্ষর আর হাহাকার। স্বজন হারানোর হাহাকার, সর্বস্ব খুইয়ে পথের ভিখারি হওয়ায় হাহাকার। ওখানে কে ওটা? মাথাটা ঝুঁকিয়ে বিধ্বস্ত, পরাজিত এক মানুষের মতো বসে রয়েছে? তপোব্রত না? হ্যাঁ ওই তো তপোব্রত। তপোব্রতকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আর যার নাম মনে এল তাকে দেখার জন্যেও সুনেত্রার চোখ সন্ধানী হল। কিন্তু না, সে নেই, অন্তত সুনেত্রা দেখতে পেল না। আশ্চর্য হল সুনেত্রা। এতক্ষণ ওর তপোব্রতর কথা মনে পড়ে নি তো! এতটাই দূরত্ব হয়ে গেছে ওদের!
বাচ্ছাটা কি বলে উঠতেই সুনেত্রা আবার ওর দিকে তাকাল। সমস্যা হচ্ছে বাচ্ছাটার ভাষা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও এটা ভালোই বুঝছে যে বাচ্ছাটা মাকে খুঁজছে। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু খাবার তো দূরের কথা এক ফোঁটা জলও নেই।
কাদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না? ওই তো কারা আসছে। কিছু স্থানীয় লোক এল। তারা খুইয়েছে অনেক কিছু তবুও ঘুরে বেড়াচ্ছে যদি কাউকে বাঁচাতে পারে, কোনো সাহায্য করতে পারে – এই আশায়। তাদের কাছেই জানা গেল রূদ্রপ্রয়াগ নামটা হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে, কিন্তু অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম ঘিরে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল তার প্রায় বেশীটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। অল্প কিছু বাড়িঘর, দোকানপাট এখনো আছে, যদিও তারাও কতক্ষণ টিঁকবে তা কেউ জানে না। শুধু রূদ্রপ্রয়াগ নয়, দেবপ্রয়াগ থেকে কেদার পর্যন্ত সর্বত্র একই অবস্থা। শয়ে শয়ে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে, মানুষ যে কত মারা গেছে তার কোনো হিসেবই নেই। সবাই অপেক্ষা করছে কখন উদ্ধারকারী দল আসবে, সেনা নামবে, বায়ুসেনার হেলিকপ্টারের দেখা পাওয়া যাবে। সব শুনে শরীরে মনে যেটুকু শক্তি ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গেল সুনেত্রার। কতদিন যুঝতে পারবে এভাবে, বিনা আশ্রয়ে, বিনা খাদ্যে? ছেলের মুখটা মনে পড়ল। হবে কি আর দেখা কোনোদিন?
ওদেরই একজন বলল কিছুদূরে একটা দোকানে রুটি আর জল পাওয়া যাচ্ছে, যদিও অগ্নিমূল্যে, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। যাদের ক্ষমতা ছিল তারা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ঘষটাতে ঘষটাতে গেল। গেল তপোব্রতও। সুনেত্রার সে ক্ষমতাও আর নেই। শুধু একজনকে বলল ওদিকে গিয়ে সম্ভব হলে বাচ্ছাটার মা বাবার খোঁজ করতে। বাচ্ছাটাকে ওর মা বাবার হাতে তুলে দিতে পারলেই ও নিশ্চিন্ত। অবাক হল ও, জীবন সম্পর্কে এত নিস্পৃহ কবে হল ও? মনে হচ্ছে এই রিক্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটলেই বা পৃথিবীর কি এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? তপোব্রত অক্ষত আছে, ও ঠিক ফিরে যেতে পারবে বাড়িতে, ছেলের কাছে। পরিপূর্ণ জীবনের স্বাদ যারা পেয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদও তাদের বেশী। ও ঠিক পারবে, সুনেত্রা জানে।
বাচ্ছাটা কাঁদতে কাঁদতে ঝিমিয়ে পড়েছে, হয়তো ঘুমও পেয়েছে। সুনেত্রা ওকে কোলে শুইয়ে চাপড়াতে লাগল।
মনে পড়ল একদিন আগে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে তপোব্রতর কথাগুলো, ‘মানুষ চাইলে সব করতে পারে। আগে কিরকম ছিল এ অঞ্চল? আর এখন দেখো আরাম ফূর্তির সব কিছু পাবে এখানে। যা চাও তাই।’
মাত্র চব্বিশ ঘন্টার তফাতে অবস্থার কি আমূল পরিবর্তন! মানুষের ঔদ্ধত্য, দম্ভ আজ চূর্ণবিচূর্ণ। বিলাসিতা তো দূরে থাক, প্রাণ বাঁচানোই দুরূহ। এই অবস্থাতেও হাসি পেল সুনেত্রার। মাত্র ক’ঘন্টার দুর্যোগ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মানুষ কত অসহায়। তবুও মানুষের অহমিকার শেষ নেই তার ক্ষমতা নিয়ে, সাফল্য নিয়ে, বিত্ত নিয়ে, যখন তখন যেন তেন প্রকারেণ ভোগের উপকরণ জোটানোকে জীবনের পরিপূর্ণতার নাম দিয়ে!
ফিরে এসেছে কয়েকজন, পানীয় জল আর খাবারের দাম নিয়ে আলোচনা করতে করতে। কেউ পেরেছে কিনতে, কেউ পারেনি। ওই যে তপোব্রত ফিরছে। ও পেরেছে কিনতে। দু বোতল জল আর কিছু খাবার নিয়ে ও ফিরেছে। সুনেত্রা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাচ্ছাটাকে দেখল। ঘুমোচ্ছে।
‘ঘুমোও সোনা ঘুমোও। তোমাকে কিছু খেতে দিতে পারার ক্ষমতা আমার নেই। জানি না তোমাকে তোমার মার কোলে তুলে দিতে পারব কিনা,’ মনে মনে বলল ও।
একভাবে পাথরে ঠেসান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে পিঠ, কোমর ধরে গেছে। কিন্তু নড়তেও পারছে না, সারা শরীরে এত ব্যথা। এখনও বেলা আছে, রাত হলে কি হবে কে জানে। বসে থাকতে থাকতে ক্লান্তিতে কখন যেন সুনেত্রারও চোখ লেগে এসেছিল। ঘুমের ঘোরে যেন চোখের সামনে ভাসছিল ওদের বাড়ি, ছেলে ঘরময় ছুটোছুটি করছে।
‘উঠিয়ে মাঈজি, আরামসে, আইয়ে,’ সুনেত্রার তন্দ্রা ভেঙে গেল।
না ওকে বলা হয় নি। কাছেই এক বৃদ্ধার জ্ঞান ফিরেছে, তাঁকেই উঠিয়ে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে। গলাটা কার? তপোব্রতর না? না না তপোব্রতর হতে পারে না। সে এতক্ষণে খাবারদাবার খেয়ে ঘুমোচ্ছে হয়তো। সুনেত্রা মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখল। তপোব্রতই। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে হাত লাগিয়ে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করছে। আলো পড়ে আসছে দ্রুত। রাতে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিরাপদ নয়। যারা আহত, চলতে পারছে না তাদের বহন করে নিয়ে আসছে, নিজের বোতল থেকে জলও খাওয়াচ্ছে। অবাক হল সুনেত্রা, খুবই অবাক। এ তপোব্রত তার অচেনা। ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কিন্তু হঠাৎ বাচ্ছাটা কেঁদে উঠে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। জাপটে ধরল সুনেত্রাকে। সুনেত্রাও ওকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, জড়িয়ে ধরে আদর করে ভোলাতে লাগল।
পাশে এসে কে দাঁড়াল। মুখ তুলল সুনেত্রা। তপোব্রত। হাতে রুটি আর জলের বোতল। মুখে কিছু না বলে সুনেত্রার সামনে নামিয়ে রাখল সেগুলো। বাচ্ছাটাকে সুস্থ রাখতে হলে কিছু খেতে দিতেই হবে। সুনেত্রাও তাই আর দেরী না করে শুকনো রুটি জলে ভিজিয়ে দিল। ক্ষুধার্ত শিশু তাই খেতে লাগল পরম তৃপ্তি ভরে। কান্না থেমে গেল। খাওয়া শেষে পরম মমতায় মুখ মুছিয়ে সুনেত্রা আরো একবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ও! চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সরল শিশু খেলতে লাগল সুনেত্রার ওড়নাটা নিয়ে।
তপোব্রত চলে যায় নি, দাঁড়িয়ে ছিল। আস্তে করে বলল, ‘আরেকটা রুটি আছে, খেয়ে নাও তুমি।’
সুনেত্রা মুখ তুলে দেখল ওকে, বলল, ‘আমার দরকার নেই, নিয়ে যাও।’
হড়বড়িয়ে বলে উঠল তপোব্রত, ‘আমি খেয়েছি। যখন খাবার কিনতে গেছিলাম তখনই ওখানে খেয়ে নিয়েছি।’
আশেপাশে বেশ কিছু বাঙালিও ছিল, তাদের মধ্যে একটি ছেলে এসে তপোব্রতকে একটা ছোটো প্যাকেট ভর্তি মুড়ি দিয়ে বলল, ‘এটা খেয়ে নিন। যা খাবার কিনেছিলেন সবই তো দিয়ে দিলেন। এটা অন্তত খেয়ে নিন। এখান থেকে কবে বেরোতে পারব তার তো ঠিক নেই।’
মিথ্যে ধরা পড়ায় তপোব্রত অপ্রস্তুত। সুনেত্রা স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বোধহয় আগের তপোব্রতর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছে।
‘বাচ্ছাটার মা, বাবা বোধহয় আর নেই। পুরো ফ্যামেলিটারই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব। যদি ওর মা, বাবাকে না পাওয়া যায় বা ওর আত্মীয়স্বজন না নিতে চায় তাহলে আমরা ওকে অ্যাডপ্ট করব। সুইট বেবি।’
‘আর মিস ভাটিয়া? তার কি হল?’
তপোব্রত থমকাল, মনে হল এ প্রশ্নটা আশা করে নি।
‘জানি না। ভোররাতে যখন রিসর্ট ছেড়ে বেরোতে হল, ভয়ের চোটে হুড়মুড়িয়ে রিসর্টেরই কিছু লোকজনের সঙ্গে ওও বেরিয়ে গেছিল। আমাদের সঙ্গে ছিল না। তারপরের খবর আর কিছু জানি না। যোগাযোগেরও কোনো রাস্তা নেই। তুমি রুটিটা খেয়ে নাও,’ তপোব্রত চলে গেল।
সুনেত্রা তেমনই বসে রইল আর তপোব্রতকে দেখতে লাগল। কতকাল বাদে এক’টা কথা বলল ওরা? ইদানীং তো কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। যাও বা হত সে তো কথা নয়, শাণিত বাক্যবাণ। সুনেত্রা তাকিয়েই আছে, তপোব্রত একটু দূরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
খোলা আকাশের নীচে প্রস্তর শয্যায় শুয়ে তপোব্রতর মনে হল কত কিছু আজ ও খুইয়েছে। ওর বিদেশী ল্যাপটপ, বিদেশী ক্যামেরা, আরো অনেক মহার্ঘ জিনিসপত্র যা ওর অত্যন্ত প্রিয় – সবই গ্রাস করেছে উন্মত্ত জলরাশি। কিন্তু তাও যেন মনে হচ্ছে আরও দামী কিছু পেয়েছে। সব কিছু নিজের জন্যে, নিজের ইচ্ছে মতো পেতে অভ্যস্ত ও আজ প্রথম অন্যর জন্যে কিছু করল, তাও একেবারেই অপরিচিত মানুষজনের জন্যে। চতুর্দিকের রিক্ততা আর ধ্বংসলীলার মধ্যে জীবনের পরিপূর্ণতার প্রকৃত অর্থ বুঝল তপোব্রত।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Russell Hossain দারুন, সত্যি অনেক ভাল লেগেছে
কবি এবং হিমু অভিনন্দন।
ভালো লাগেনি ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
অদিতি ভট্টাচার্য্য অনেক ধন্যবাদ জায়েদ ভাই এবং নাজিয়া।
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
জায়েদ রশীদ প্রাপ্তির ঝুলিটা পূর্ণতা পেল... অনেক অনেক শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
নাজিয়া জাহান অনেক অভিনন্দন অদিতিদি................
ভালো লাগেনি ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
অদিতি ভট্টাচার্য্য অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
ভালো লাগেনি ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
অদিতি ভট্টাচার্য্য অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মোঃ আরিফুর রহমান প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা .......................
ভালো লাগেনি ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
অদিতি ভট্টাচার্য্য সনাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। হ্যাঁ মৌসুমী, তুমি বলেছিলে। তোমাকে অভিনন্দন জানাতে পারলে আমার আরনন্দ পূর্ণ হত।
ভালো লাগেনি ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৬ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৯৫

বিচারক স্কোরঃ ৩.৮৫ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.১ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪