এখানে প্রাচুর্যের সুখ নেই, কিন্তু স্বস্তি আছে। আমরা থাকি কলোনির দু’রুমের এক বাসায়। বাবা সরকারী চাকুরী করে আর মা গৃহিণী। অনেক বছর আমি একাই ছিলাম; এখন দু’বছরের এক বোন আছে আমার। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, বাসার কাছেই স্কুল, এক দৌড়ে চলে যাওয়া যায়। কলোনির বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই এই স্কুলে পড়ে। সকাল সাতটা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত মেয়েদের ক্লাস হয়। মেয়েদের ছুটি হলে আমাদের শুরু, চলে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। স্কুলে বেশ কড়াকড়ি। স্কুল কামাই দিলেই বেতের বাড়ি। প্রতিদিন স্কুলে যেতে কার ভালো লাগে, কিন্তু উপায় নেই। বৃহস্পতিবার হাঁফ বেলা স্কুল হয়। এখানে অধিকাংশ বাসাতেই বছর দুয়েক আগেও টিভি ছিলো না। কলোনির যে বাসায় টিভি আছে, আমরা দলবেঁধে চার পাঁচটা পরিবার একসাথে নাটক, আলিফ লায়লা, শুক্রবারের বাংলা সিনেমা দেখি। এক সময় আমাদের সামনের বিল্ডিঙয়ের রিপন ভাইদের বাসায় শুধু টিভি ছিল, ম্যাকগাইভার শুরু হলেই দৌড় লাগাতাম। এখন অনেক বাসাতে টিভি এসেছে। আমাদের পাশের বাসাতেও টিভি আছে, সাদাকালো টিভি। আমাদের বাসায় এখনও টিভি ঢুকেনি। বাবা বলে টিভি কিনলে নাকি আমার পড়ালেখা হবে না। আসলে কথা সত্য না। বাবার কাছে এখন টিভি কেনার টাকা নেই। বাবার কাছে টিভি কেনার টাকা আসলেই সে ধুম করে কিনে ফেলবে কারণ বাবারও টিভি দেখার খুব নেশা।
আমি খেলাধুলায় খুব বেশি ভালো না। আমাদের বাসার কাছেই কলোনির মাঠ। ছেলেপেলে তিনটে থেকেই খেলা শুরু করে দেয়। আমি পাঁচটার আগে খেলার জন্যে বাসার বাইরে বেরুতে পারি না। বাবা জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কতদিন মন খারাপ করে দুপুরে শুয়ে থাকি, একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মধ্যে ঘুম ভেঙে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কী যে মন খারাপ লাগে! বাসায় এখন অবশ্য মন খারাপ করে থাকার উপায় নেই, ছোট বোনটা সারাক্ষণ পটপট করে, এটা কি, ওটা কেন; নানান প্রশ্ন। আমার ছোট বোনের নাম ঐশী। আমার নাম অনি।
আমাদের দোতালায় এক বিহারী থাকে। এলাকায় বেশ ক’জন বিহারী আছে। এরা একত্রিত হলে উর্দুতে কি যেন বলে, আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। ওরা গরু পালে। বলতে ভুলে গেছি এখানে অনেকেই গরু পালে; গরু পালার জন্যে কলোনির মধ্যে একটা জায়গায় গোয়াল ঘর আছে। বিহারীর বউটা বাঙালি, ভুলভাল বাংলা উচ্চারণ করে, জানালাকে বলে জিনালা। ওদের তিন ছেলেমেয়ে। বিহারী পরিবারটা বেশ ভালো, মাঝে মধ্যে বিহারীটা গাঁজা টেনে বুঁদ হয়ে থাকে আর মাঝে মধ্যেই মারপিটের শব্দ পাওয়া যায়। সন্ধ্যে হলে এমনিতেই প্রায়দিনই বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শুনা যায়। এতে অবশ্য কেউই আতঙ্কিত হয় না, কারণ কান্নার ঘটনা সবাই জানে। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তের সামান্য উপরে আমাদের অবস্থান; আমি সঠিক করে বলতে পারবো না; স্কুলের সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে স্যার যেভাবে বলেছে তাতে করে আমি আমাদের পরিবারের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করতে পারি নি। বাবাকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিলো কিন্তু সাহস ছিলো না। এখানে যারা বসবাস করে আমাদের বাসার আশে পাশে অধিকাংশ ফ্যামিলিই অতোটা উচ্চশিক্ষিত না। কিন্তু এরা স্বপ্ন দেখে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায়, বাবারা তাদের ব্যর্থতা সন্তানের মধ্যে দেখতে চায় না। সেকারণেই আমার মতো কলোনির বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদেরই রাত ঘনিয়ে এলেই পড়ার টেবিলে মার খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। বাবাও আমাকে মারে। মাঝে মধ্যেই বেতিয়ে হাত পা ফুলিয়ে দেন।
বাবা সকালে অফিস চলে যায় সাড়ে ছ’টার মধ্যে। মা ভোরে উঠে নাস্তা বানায়, রুটি আর ভাঁজি। ঐশী তখন ঘুমিয়ে থাকে। আমি স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঐশীকে নিয়ে খেলা করি, নাহলে পড়ার টেবিলে বসে থাকি। সকালে আমার নিচে নামা নিষেধ। তারপরেও কখনো কখনো বাগানে গিয়ে পেয়ারা গাছে উঠে বসে থাকি। আমাদের দু’টো পেয়ারা গাছ। আমি এই দুই পেয়ারা গাছ ছাড়া আর কোন গাছে চড়তে জানি না। বাবা বিকেলে বাগানে পানি দেয়, পুঁইশাকের মাচা তৈরি করে, লাল শাকের গুড়া থেকে আগাছা বেছে দেয়। কলোনির সব ফ্যামিলির জন্যেই বিল্ডিঙয়ের সামনে সামান্য বাগানের জায়গা বরাদ্ধ আছে। সেখানে সবাই সবজি চাষ করে, ফলের গাছ লাগায়।
বাবার অফিস ছুটি হয় দুইটা দশে। সাইরেন বাজে, আমরা বাসা থেকেই শুনতে পাই। বাবা ফেরার আগেই গোসল সেরে নিতে হয় স্কুল না থাকলে। এখানে বেশির ভাগ লোকেই পায়ে হেঁটে অফিসে যায়, কারো অবশ্য সাইকেল আছে। আমাদের পাশের বাসায় তিন বছরের এক পিচ্চি আছে, নাম কাজল। কাজলের একটা খেলনা সাইকেল আছে। ঐশীর অবশ্য খেলার সেরকম কিছু নাই। প্লাস্টিকের বাঁশিওয়ালা পুতুল কিনে দেয়া হয়েছিল সেটা ও ক’দিনের মধ্যেই কামড়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে কাজলের সাইকেল ধরে দাড়িয়ে থাকে। আমি বেশ বুঝতে পারি একটা খেলনা গাড়ির জন্যে ওর খুব লোভ। মা বাবা দু’জনেই বুঝতে পারে কিন্তু লাভ নাই। ঐশী কথা বলে বালিশের সাথে, টেবিলের সাথে, এমনকি ওর গাঁয়ের জামার সাথেও।
এরই মধ্যে বাবা একদিন অফিস ফেরার পথে নিয়ে এলো এক টিয়া পাখির বাচ্চা। সবে মাত্র এক দু’দিন বয়স হবে। গাঁয়ে লোম গজায়নি ভালো করে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বই খাতা ছুড়ে দিয়ে বসে গেলাম পাখির বাচ্চা নিয়ে। ঐশী দূরে থেকে দেখছিলো, আমি ধরতেই একটু সাহস পেল। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে এসে কোলে বসলো, ধীরে ধীরে বাচ্চাটার গাঁয়ে হাত বুলালো।
বাবা কখনোই এত করিৎকর্মা ছিলো না। কিন্তু সেদিন বিকেলের মধ্য একটা খাঁচা জোগাড় করে ফেললো। আমরা তিনজনই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঐশী হুটহাট করে বাসার বাইরে চলে যেত। তাই মেইন দরজার সামনে কাঠের তক্তা দিয়ে বেরিকেট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেদিন থেকে ওর বাইরে যাওয়ার ঝোঁক কমতে থাকল। ধীরে ধীরে বাচ্চাটার গাঁয়ে লোম গজাতে লাগলো। বাবা অফিস থেকে ফিরেই নিজে খাওয়ার আগে পাখিটাকে খাওয়াতে ব্যস্ত হতে লাগলো। আমি দিনের বেলায় পাখিকে খাওয়ানোর উছিলায় স্কুলের টাইম পেরিয়ে গেছে বলে মাঝে মধ্যে স্কুল কামাই দিতে পারলাম। বাবা অফিস থেকে ফিরে আমাকে বাসায় দেখে তেমন কিছু বলতো না। কারণ সে নিজেও পাখিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরতো। মা মাঝে মধ্য বিরক্ত হতো আমাদের কাজ কাম দেখে। বাচ্চাটা বাড়তে লাগলো, বাবা বাসায় না থাকলে দরজা জানালা বন্ধ করে পাখিটাকে খাঁচার বাইরে বের করে আনতাম, ও উড়তে শিখেছে কিনা দেখার জন্যে।
আমি আর ঐশী খেলনা পেলাম। বাসার আরো একজন অনেকদিন পর, হয়তো শৈশব কৌশরের পর হাতের কাছে একটা খেলনা পেল। তিনি হলেন বাবা। বাবা বরাবর অফিস থেকে এসে খেয়ে রেডিওটা মাথার কাছে চালিয়ে ঐশীকে নিয়ে ঘুম লাগাতেন। ঘুম থেকে উঠে বাজার। এরপর বাসা, কোন কোন দিন আমাকে উত্তম মাধ্যম, ঐশীকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো, রাতে খেয়ে ঘুম, পরদিন অফিস। অনেকটা ঘড়ির মতো টিকটিক করে একই পথে সারাক্ষণ।
খাঁচাটা নাকি পাখির সাথে মানাচ্ছে না। বাবা পেইন্ট কিনে এনে নিজেই খাঁচা রাঙানোর কাজে লেগে গেল। বাবা আর ঐশীর এমনিতেই খুব ভাব। এবার তারা দু’জন খেলার সাথীর মতো টিয়ার পেছনে লেগে গেল। আমারও সুবিধা হলো, বাবা যখন দুপুরে টিয়া নিয়ে ব্যস্ত, আমি চুপিচুপি মাঠে দৌড়।
বাবা একদিন আবিষ্কার করলো টিয়াটা ঠিক মতো খাচ্ছে না। সিরিঞ্জে করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হলো। মা ততদিনে যথেষ্ট পরিমাণে বিরক্ত। তিনি ঘোষণা করে দিলেন, পাখিকে তার নিজে মতো থাকতে দিতে হবে। খাঁচার মধ্যে খাওয়া দেয়া হবে; সারাক্ষণ নাড়াচাড়া করা যাবে না। আমার কর্মকাণ্ড কিছুটা কমে এলো। কিন্তু বাবা থোড়াই কেয়ার করে এই নির্দেশের। আগের মতোই অফিস থেকে ফিরে সিরিঞ্জে করে খাবার খাওয়ানো চলতে থাকলো। সুন্দর পালকে আর লাল ঠোঁটে টিয়া ততদিনে তার নিজ রূপ প্রকাশ করেছে।
প্রতিদিনের মতো বাবা অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সিরিঞ্জে টিয়ার খাবার ভরেছে। বৃহস্পতিবার, আমার স্কুল হাঁফ বেলায় ছুটি হয়ে গেছে। টিয়ার খাঁচা সিঁড়িতে আনা হয়েছে। ঐশী গিয়ে খাঁচার পাশে বসেছে। টিয়াকে খাঁচা থেকে বের করে আনতে যাবে এমন সময় বাবার মনে হলো পানি তো আনা হয় নি। বাবা পানি আনতে বাসায় ঢুকলেন। মিনিট দু’একের মধ্যে ঐশী ডাকতে লাগলো, "“বাবা, তিতি"।”
বাবাসহ আমরা সিঁড়িতে এলাম। খাঁচা পাখি শূন্য। বাবা ভুলে খাঁচার দরজা খুলে গিয়েছিলো, আর ততদিনে টিয়া উড়তে শিখে গেছে। পাখি কোন দিকে গেছে জিজ্ঞেস করতে ঐশী দু’ হাত দু’দিকে এমনভাবে দেখালো যে কিছুই বুঝা গেল না। বাবা আর আমি বিল্ডিঙয়ের চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজে খালি হাতে ফিরে এলাম। সেদিন দুপুরে আমরা কেউ ঘুমালাম না।
টিয়ার কোন নাম দেয়া হয়নি। ঐশী টিয়া ডাকতে পারতো না, ডাকতো তিতি। বাবা সন্ধ্যায় বাহির থেকে ফিরে এসে বলল, পাওয়া গেছে, চল। আমি খুশিতে চললাম তার সাথে। কলোনির এক নিচতলা বাসায় গিয়ে বাবা দরজা নক করলো। ভিতরে গিয়ে দেখলাম, দশ বারো বছরের একটা ছেলে খাঁচায় তিতিকে নিয়ে বসে আছে। এর মধ্যেই পাখা, লেজ কেটে দেয়া হয়েছে। বাবা টিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে, সে জানালো, পাখিটা দু’দিন আগে জয়দেবপুর বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে। বাবা আমাকে বলল, চলো। আমরা ফেরার পথে কেউ কোন কথা বললাম না।
পরেরদিন, অফিস থেক ফিরে বাবা প্রথমেই শূন্য খাঁচা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। ঐশী বলল, “"বাবা তিতি"।”
বাবা বলল নিজমনে," “ধুর, পাখি রেখে শুধু শুধু বাসা নোংরা”"।
খেয়ে ঘুমাতে গেলেন। এরপর চক্রাকারে চলতে লাগলো আগেরই মতো।