বুবলি ও একটি রাজঁহাস

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

অরণ্য হক কাব্য
  • ১৬
বুলি অবেক্ষণ আগে দু একবার ফ্যাস ফ্যাস করেছিল মাত্র। এখন একবারে নিশ্চুপ। বুঝার কোন উপায় নেই বেঁচে আছে না মরে গেছে। মাথা নিচে রেখে উপরে পা দুটি ধরে বুলির সাদা কালো নিথর দেহখানি ঝুলাতে ঝুলাতে বয়ে চলেছে বুবলি। বিরতিহীন ভাবে প্রায় ৬ ঘণ্টা যাবত এভাবেই বুবলি হেটে চলছে এবং বুলি ঝুলে চলছে। বুবলি এখনোও বুঝতে পারে নি তার অতি প্রিয় খেলার সাথি বুলি অনেকক্ষণ আগেই মরে গেছে। বুবলি না বুঝলেও রাবেয়া (বুবলির মা) বুঝতে পারছেন বুলি মরে গেছে। কিন্তু রাবেয়া এটা বুঝতে পারছে না এখন এটা বুলিকে বলা উচিত হবে কিনা । যেদিন রাতে হঠাৎ ওদের বাড়ি, ঘর, জমি-জমা সব রেখে বেরিয়ে পড়তে হল, তখন বুবলি বেকে বসল। তার কথা তাদের সাথে বুলিকেও নিতে হবে। বুলিকে ছাড়া সে কোথাও যাবে না। রাবেয়া বেগমের সাত রাজার ধন, আদরের মেয়ে বুবলিকে কোন ভাবেই বোঝান সম্ভব হল না যে, আজকের পর থেকে তারা কই থাকবে, কই যাবে, কী খাবে তা তাদের নিজেদেরই ঠিক নেই। তারা যাত্রা করবে অন্ধকার অজানার পথে। তারা যাত্রা করবে জীবন বাঁচাতে। এর মধ্যে বুলিকে কোনভাবেই বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে বুঝবেই বা কেন? তার এই আট বছরের ছোট্ট জীবনটিতে আবদার করার আগেই সে সব পেয়ে আসছে। তাই স্বাভাবিক ভবেই সে একটু জেদী। তাই তো সে তার জীবনের প্রথম প্রহর খাওয়া সত্ত্বেও তার হাতে লালিত পালিত তার খেলার সাথি বুলিকে ছাড়া যেতে রাজি হল না। তখন বাধ্য হয়েই বুলিকে সঙ্গে নিতে হয়েছিল। বুলির পা দুটো দড়ি দিয়ে বেধে বুবলির হাতে দেওয়া হয়েছিল। তার পর তো দু:স্বপ্নের মত কয়েকটিদনি পেরিয়ে গেল। আজকে সকালে বুলির পায়ের বাধন খুলে দেওয়া হয়েছে। বেচারা আর হাটতেই পারছে না। দড়ির শক্ত বাধনে তার পা কেটে রক্ত জমে আছে। বুলি যে এতদিন বেঁচে ছিল এটাই অবাক করার বিষয়। প্রথম দুই তিন দিন বুবলি তার খাবার থেকে বুলিকে খাইয়েছিল তারপর থেকে তো বুলি না খেয়েই আছে। বুবলি খেতে পেলে হয়ত বুলিও খেতে পেত। বুবলিও যে অনেকদিন ধরে প্রায় না খেয়েই আছে।

এই কী তার সেই ছোট্ট মেয়ে বুবলি। রোগা উষ্ক ঘুষ্ক চুল, জীর্ণ কাপড় পড়া এ মেয়েটিই যে চুলে বণেী করা পরিপাটি, দুরন্ত হাসি খুশি সেই মেয়ে তা আকল্পনীয়। তার কোমল লাবন্য মাখা মুখটি কেমন কঠোর হয়ে উঠেছে। এবং এই অল্প কদিনেই যেন তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। বুবলি তার একহাতে একটি ব্যাগ আর অন্যহাতে বুলিকে ধরে রেখেছে। এভাবেই সে ঘন্টার পর ঘন্টা হেটে চলছে। রাবেয়ার অনেক ইচ্ছা করছে তার ছোট্ট মেয়েটির কাছ থেকে ব্যাগটি নিতে। কিন্তু তার উপায় নেই। তার নিজের হাতেও একটা মাঝারি আকাররে বস্তা আর কোলে তার আট মাসরে সন্তান “বাবু”। বাবুর মুখের দিকে তাকালেই রাবেয়ার বুকটা মুচড়ে ওঠে। অন্যদের মত বাবুও প্রায় না খেয়েই আছে। প্রথম কয়েকদিন সে খাবারের জন্য কাঁদত। এখন আর কাদে না। হয়ত কাদার শক্তি নেই কিংবা এই ছোট্ট শিশুটিও বুঝে গেছে কেদে কেদে শক্তি নষ্ট করে লাভ নেই। সেই শক্তিটুকু জমিয়ে রাখলে হয়ত আরও কিছু সময় কী বেঁেচ থাকা যাবে। এখন শুধু তার দেহখানা নিথর হয়ে মায়ের কোলে পড়ে থাকে।

কী দিন ছিল, এই তো সেদিনের কথা কিসের অভাব তার, স্বামী সন্তান ঘর, বাড়ী, জমি-জমা, কী নেই তার। শুধু সেই বা কেন গ্রামের আট দশটা পরিবারওতো তাদের মতোই সুখে ছিল। তাদের পুরো গ্রামটাইতো একটি পরিবার ছিল। সুখে দুঃখে সবাই কত আপন । তাহলে হঠাৎ করে এমন কী হল? পাকসেনারা নির্বিচারে মানুষ মারতে লাগল, ঘর বাড়ি লুটপাট আর যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়াও সমান তালে চলতে লাগল। প্রথম প্রথম সে মনে করত তারা হিন্দু বলে পাক সেনারা তাদের মেরে ফেলছে। শুধু হিন্দু বলেই কী মানুস মানুষকে এভাবে মারতে পারে? হিন্দু মুসলমানের কিসের বিবাদ? বছরের পর বছর মুসলমানরাে তাদের পূজায় আনন্দ উৎসব করে আসছে আবার ঈদে তাদেরই দাওয়াত দিতে সেমাই খাইয়েছে। তারা যুগ যুগ ধরে একটি পরিবারে মত বাস করেছে। তাহলে কী এমন হল? যে দিন গ্রামের ইমাম সাহেব কে মসজিদ থেকে বেড় করে পাক সেনারা বেযেনেটের খোচায় খোচায় নির্মম ভাবে হত্যা করল সেদিন সবাই বুঝল এইটা হিন্দু মুসলমানের সমস্যা নয়। কয়েকজন বলতে লাগল দেশে যুদ্ধ লাগছে। মুক্তি যুদ্ধ এই পাক সেনাগো কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে না পারলে তারা সবাইকে মেরে ফেলবে। তারা পশু তারা পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।

রাবেযা সেদিন ঘর থেকে বেড়িয়ে দিশেহারার মত দিক বেদিক ছুটছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল পাক সেনারা ধরে নিয়ে যাওয়া তার স্বামীর কথা। তারপর কিভাবে যেন সে একটা দলের সাথে মিসে গিয়েছিল। যারা সবাই তার মত ঘর ছাড়া। দুধের শিশুকে আছড়ে মেরে মেরে ফেলা। বাবার সামনে মেয়েকে বল্যৎকার করা, গর্ভবতী মাকে বল্যৎকার আর নির্বিচারে মানুষ খুন হওয়া। এসকল দেখার অভিজ্ঞতা দলের মানুষদের কম বেশী সবাই ছিল। একেক জনের অভিজ্ঞতা যেন এককজনের চেয়ে ভয়ানক। সারা দেশেই পাক সেনারা এমন ধ্বংশ চালাচ্ছে। বাচার একটি মাত্র পথ রয়েছে বর্ডার ক্রস করে ভারতে যাওয়া। এর পর থেকে তাদের গন্তব্য ভারত। তারা মাইলের পর মাইল হেটে যাচ্ছে বর্ডারের উদ্দেশ্যে। তাদের দলটি দশজনের। এর মধ্যে একজন বৃদ্ধ পথইে মরে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও তিনজন পাক সেনাদের হাতে ধরা পরে। তারা? তাদের কী হবে? বুবলি, বাবু সবাই কি তারা যেতে পারবে। তারা কি আবার ফিরে পারে তাদের সুখের সংসার।

একটা শব্দ সুনে রাবেয়া সচকিত হল। তার চিন্তায় ছেদ পড়ল। শব্দটা ক্রমশ তাদের দিকে আসছে। তাদের দলে একটা হইচই পড়ে গেল। জীর্ণ মুখ গুলো ভয়ে আরও জীর্ণ হয়ে উঠল। সবাই বুঝতে পারল এটা পাক সেনাদের গাড়ীর শব্দ। সময় খুবই অল্প দ্রুত কোথাও সরে যেতে হবে। শব্দটি ক্রমষ ষ্পস্ট হয়ে উঠছে। তাদের দলটি রাস্তা থেকে নেমে পাট খেতের আড়ালে লুকালো। গাড়িটি এখন দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি মানুষের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেছে। এ যেন সাক্ষৎ যমদুত সামনে দিয়ে যাচ্ছে। একটু শব্দ হলেই সবার মৃত্যু। হঠাৎ কান্নার শব্দ। বাবু কাদছে। পাট ক্ষেতের কোন পোকা হয়তো তাকে কামড়েছে। রায়ো দ্রুত তার হাত দিয়ে বাবুর মুখ চেপে ধরল। গাড়িটি একটু দীরগতি হল। দুটি পাকসেনা এদিকে ওদিকে ভাল করে দেখে নিয়ে আবার বসে পড়ল। তাদের কান পর্যন্ত হয়ত কান্নার শব্দ পুরোপুরি পৌছায় নি। তবে গাড়িটি আস্তে আস্তে চলতে লাগল । বাবু প্রাণ পন চিৎকার করতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে এত শক্তি সে পেল কোথায় । রাবেয়ার হাত আরও শক্ত হল। একটু শব্দই সবার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ সুনলেও ভয় হয়। মনে হয় ওরা বুঝি শুনে ফেলল। আস্তে আস্তে গাড়িটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

সবাই একটা বড় নি:শ্বাস নিল। বুবলি মাটিতে পরে থাকা বুলির দিকে তাকিয়ে আছে। রাবেয়া বাবুর মুখ থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাড়াল। কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। বাবুর কান্না চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। বাবুর মুখ হা করা দুটি চোখ মায়ের দিকে স্থির। চোখ দুটিতে ভয়, কষ্ট, কিংবা ঘৃণার কোন চিহ্নই নেই। আছে অবাক বিস্ময়। রাবেয়া এক দৃষ্টিতে বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। দলের সবাই বলল বাবুকে ফেলে রেখে আসতে। বুবলি ততৎক্ষনে বুলিকে শুইয়ে রেখে দলের সাথে হাটতে শুরু করেছে। রাবেয়া বুলির পাশে বাবুকে শুইয়ে দিয়ে দলের দিকে পা বাড়ালো। সে বুঝতে পারছে না সে কী হত্যাকারীনী না এতগুলো মানুষের জীবনদাত্রী। সে কী একটি প্রজন্মকে হত্যা করল, না মুক্ত করল প্রজন্মকে। নাকি পরাধীনতাকে স্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে আনল স্বাধীনতা। কিছু দূরে গিয়ে রাবেয়া পিছনে ফিরে ডুকেের কেদে উঠল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দলটি আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেছে। আকাশে হলুদ এবং নীল রং মিলে অদ্ভুদ নকশা একেছে। ঘাসের বিছানায় শুয়ে একটি শিশু ও একটি রাজহাস যেন অবাক বিস্ময়ে তা দেখছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন আপনার গল্পটি হৃদয় ছুয়ে গেল এবং মনটা বেদনায় ছেয়ে গেল. অনেক সুন্দর একটি গল্প পড়লাম
সূর্য গল্পটা পড়েছি প্রায় ৯/১০দিন আগে। বিদ্যুত চলে যাওয়ায় মন্তব্য করতে পারিনি। গল্পে উপমায় বাবু আর রাঁজহাঁস যেন ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানীর প্রতীক হিসেবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গল্পের বুনন খুবই ভাল হয়েছে, ভবিষ্যতেও এমন গল্প পড়ার ইচ্ছে রইল।
মামুন ম. আজিজ গল্প বোনার মেধা আছে....নিয়মিত চাই এখানে দেখতে তোমায়।
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব সুন্দর লিখেছেন| অব্যাহত চর্চায় একদিন আপনি আমাদেরকে অনেক অনেক ভালো লেখা উপহার দিতে পারবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই| ধন্যবাদ|
রোদের ছায়া সুন্দর গল্প , এবং সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বাস্তব ও কিন্তু এরকম কাহিনী আমাদের সাহিত্যে আরও অনেক বার এসেছে । আর হা গল্পটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে কিন্তু স্বাধীনতার কথাটিও গল্পে আনা যেত ।
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইফতেখার তৌকির আহমেদের 'জয়যাত্রা' ছবিতে এমন একটি দৃশ্য ছিল। তবে আপনার উপস্থাপনা ও বর্ণনাশৈলী ভালো লেগেছে। "আকাশে হলুদ এবং নীল রং মিলে অদ্ভুদ নকশা এঁকেছে। ঘাসের বিছানায় শুয়ে একটি শিশু ও একটি রাজহাস যেন অবাক বিস্ময়ে তা দেখছে।" -লাইনটি অসাধারণ হয়েছে।
এশরার লতিফ সুন্দর গল্প. তবে মূল থিমটি (সৈন্য আসা, বাচ্চার কান্না থামাতে মুখ চেপে ধরা এবং মৃত্যু) অন্যত্র অন্য কারো লেখায় আগে পড়েছি. অনেক শুভেচ্ছা.
jahutu nejar souvaggo hoi ne mohan a juddho dekhar....sahutu r sobtai janache pore o sune....r besoy bostu jode hoy 71 r juddho tahole sob golpai kesu komon jinish chole asa tai shavabek....tai noi ke...janena sofol hoyeche kena tobe chasta korache notun kechu sristi korte...DONNOBAD SOMALOCHONAR JONNO....
তানি হক স্বাধীনতা সংখ্যাতে পরা সেরা গল্প ..অসাধারণ লাগলো ..পুরো কাহিনীটা সামনা সামনি দেখা বাস্তব মনে হয়েছে ..গল্পের শেষের দুই অংশ বুকের ভেতরে ঝর উঠিয়েছে ..এবং বেদনাতুর মায়ের আত্ম উপলব্ধিটা অনেক দিন মনে থাকবে ..আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা এই গল্পটির জন্য
রনীল আরে বাপরে বাপ... কি গল্প পড়লাম! বিস্ময়য়ের মাত্রাটা একটু বেশি কারন গল্পটি একজন ২১ বছরের নবীন এমনভাবে লিখেছে যে সে নিজ চোখে ৭১ দেখেছে... যারা ব্যস্ততা, অভিমান কিংবা অন্যান্য কারনে গল্প কবিতা থেকে দূরে সরে আছেন- সবাইকে অনুরোধ করবো নবীন এই লেখকের অসামান্য গল্পটি পড়ে এর সঠিক মূল্যায়ন করুন ...

১৭ জানুয়ারী - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪