প্রতিদিনের মত আজকেও শেষ বিকেলের রোঁদ এসে বাড়ির আঙিনায় ডোবার পানিতে চিকমিক করছে। সজল রোজই এই ডোবায় ছোট্ট ছোট্ট মাটির ঢিল ছুড়ে, তাতে রোদ্দুর আর ডোবার পানির
ঢেউ -এর নৃত্য খেলে যায়, এসব দেখে কি যেন একটা সুখ পায় । বেকারত্ব যেন সজলকে আস্তে আস্তে শিশু বানিয়ে দিচ্ছে। আছরের ওয়াক্তের পর যাবে মহল্লার ছোট বাচ্চাদের সাথে মার্বেল খেলতে। রোজই এই বিচ্ছু পোলাপানদের সাথে গো হারা দিয়ে বাড়ি ফেরে।
চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে দিতে এখন আর চেষ্টাই করেনা। চাকরি নাকি কপালে না থাকলে হয়না।চাকরির বাজারের নিয়ন্ত্রক নাকি মামা চাচারা। কিন্তু সজলের দুই কুলেই কেউ নেই। যুদ্ধের সময় সবই হারিয়েছে। সজলের বৃদ্ধা মা এর সেলাই মেশিনই একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম।
সজলের বৃদ্ধা মা আজ সজলকে বলে বাবা আমাকে একদিন শহীদ মিনার দেখাতে নিয়ে যাস ।মরার আগে অন্তত একবার শহীদ মিনার দেখে যেতে চাই। আজ বাংলায় কথা বলছি যাঁদের জন্য, তাদের একবার সালাম জানাতে চাই। সজল অবাক হয়! তার মায়ের ভাষাপ্রেম দেখে ! ভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের যুগে জন্মেও ভাষাকে হৃদয় থেকে গ্রহণ করতে পারিনি। সুযোগ পেলেই ভাষাকে বিকৃত করতে দ্বিধা করিনা।হয়ে যাই রেডিও জকির মত বাংলিশ ভাষার ধারক বাহক। মনে মনে সজল একটু লজ্জাই পেলো।
সজল- কেন মা তুমি শহীদ মিনার দেখোনি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, না... দেখবো কেমন করে, তোর বাবা বলেছিলো দেখাতে নিয়ে যাবে এর মধ্যেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো মানুষটা সেই যে গেলো আর ফিরলোনা, দু চোখ ছলছল করে ঊঠলো, মা চোখ মুছলো। স্মৃতির পাতা উল্টালো কিছুক্ষণ।
সজল ভাবে হাতে টাকা নেই। শহরে যেতে অনেক টাকার দরকার । আগে একটা রোজগারের ব্যবস্থা হোক তারপর না হয় মাকে শহীদ মিনার দেখাতে নেয়া যাবে।
এর মধ্যেই ঢাকা থেকে সজল বন্ধুর চিঠি পায় দ্রুত যেতে বলেছে, বায়িং হাউজে চাকরি হবে। সজলের চোখে মুখে সামান্য হলেও খুশীর ঝিলিক খেলে গেলোও, আবার বিমর্ষ হয় এই ভেবে মাকে কার কাছে রেখে যাবে। মা সজলকে সব সময় আগলে রেখেছে , একটি দিনের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেয়নি। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে মা নাকি অন্য রকম হয়ে গেছে। কোন এক অজানা কষ্ট যেনো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় । কোনদিন কাউকে বলেনি সে অব্যক্ত বেদনার কথা।
উত্তর পাড়ার গফর মাতব্বর তিনিই আছেন মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী , তিনিও এসব ব্যাপারেও মুখ খুলে কিছু বলেনি কোনদিন। শোনা যায় সজলের মাকে রাজাকার সহায়তায় পাক সেনারা ধরে নিয়ে যায় , কিভাবে পালিয়ে এসেছেন কেউ জানেনা। তারপর থেকে এই ভিটা ছেড়ে কোনদিন কারো আঙিনা মাড়ায়নি। এক রকম বন্দী জীবনযাপন করেন বলা যায়।
মা কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সজল ঢাকায় যায়, কিন্তু বিধিবাম... কাঙ্ক্ষিত চাকরি পায়না পায় নিম্নশ্রেণী চাকরি। এখানেও হতাশার জালে আবদ্ধ হয় মানুষের মিথ্যাচার দেখে। এক চাকরির কথা বলে অন্য চাকরি দেয়ায় কোন প্রতিবাদ করেনি, কারণ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো এই ভেবে চুপ থাকে। সজল রোজ ভাবে একটা প্রমোশন হলে হাতে টাকা জমলেই মাকে শহরে নিয়ে আসবে। কিন্তু স্বপ্ন তো সব সময়ই সুদূরপরাহত ।জন্মই যেন আজন্ম পাপ।
সজল কদিন ধরে মায়ের খোঁজ পায়না । এর মধ্যে বাড়ি থেকে চিঠি আসে, “মা অসুস্থ”। সজল রওয়ানা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। মা’কে গঞ্জের হাসপাতালে ভর্তি করায় সজল। সারা রাত মা এর মাথার কাছে বসে থাকে। মায়ের মুখে কোন কথা নেই । শুধু একবার চোখ খুলে বলেছিলো বাবা তুই এসেছিস? যেন কত তৃপ্তির ছাপ। অস্ফুট স্বরে আরো বলে, বাবা আমার মনে হয় শহীদ মিনার আর দেখা হলোনা।মা আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলো।
শেষ রাতে সজল একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলো। ফজরের আযানের সময় হঠাৎ মা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে সজলকে আঁকড়ে ধরলো। সজল মাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। মায়ের হাত সজল ছেড়ে দিয়ে হেলে পড়লো। ইহজাগতিক যাত্রা শেষ হয়েছে সজল বুঝতে পারে। সজল মাকে জড়িয়ে ধরে নির্বাক বসে রইলো অনেকক্ষণ। মাকে কোনদিন এভাবে বুকে নেয়নি সজল। সারাজীবন যে মা এত কষ্ট করে লালন পালন করেছে সেই মাকে নিয়ে চিন্তা করার তেমন সুযোগই হয়নি, শুধু নিজের বেকারত্ব নিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে দিন অতিবাহিত করেছে। সজল নিজেকে ধিক্কার দেয় নিজের স্বার্থপরতার জন্য। এখন ভেবে আর কি হবে, বেলা যে সাঙ্গ হয়েছে । সজল আক্ষেপ করে ভাবে হয়তো কোনো অসময়ে জন্ম নিয়েছে সে,না হলে এমন হবে কেন? কাঁদতেও পারছে না চারপাশের নির্মমতায় মনটাও পাঁথর হয়ে গেছে।কিছুটা কাঁদলেও চোখে অশ্রু মিলছে না। কিন্তু বুকটা যেনো ভেঙ্গে চুরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
২১ বছর পর ...
সময়ের আবর্তনে ভাগ্যের চাকা এখন সজলের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপের কোন এক প্রান্তে আবাস গড়েছে সজল। স্ত্রী ও দু সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ।সুইসদের সভ্যতার ভিড়ে সজল উপলব্ধি করতে পারে মাতৃভাষায় কথা বলার তৃপ্তি। অনেক কিছুর পরেও কি যেন নেই, কোনো এক শূন্যতা সজলকে প্রতিনিয়ত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। ‘রাইন’ নদীর তীরে সবুজ ঘাসের বিছানায় হেলান দিয়ে পাঁথর টুকরো ছুঁড়ে যাচ্ছে রোজ বিকেল বেলায়, ঠিক সেই আঙিনার ডোবায় যেভাবে ঢিল ছুড়তো। আজ কত সাফল্য বিত্ত বৈভব অথচ মায়ের জন্য কিছুই করার নেই।সময় যে তার সময়মতই পাট তুলে ফেলে। সজল প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরে শহীদ মিনারে বসে মায়ের কথা স্মরণ করে অঝোরে কাঁদে আর ভাবে... স্বামী, সন্তান, দেশ মাকে সীমাহীন অপেক্ষার গ্লানি ,অবহেলা,লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এরা দিয়েছিলো নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু। হয়তো এ কারণেই মা শহীদ মিনারে যেতে চাইতো। এখন সজলের চোখে অনেক অশ্রু ,খুব সহজে কাঁদতে পারে।কিন্তু পেরেছে কি সজল সুখী হতে ?
১১ জানুয়ারী - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪