"মনির রাজাকারের বাড়ি কোনটা" জিজ্ঞেস করলে যে কেউ এ বাড়িটা দেখিয়ে দেয়। লোক মুখে বহুল পরিচিত এ বাড়ি। হলুদ চুনকাম করা দেয়ালের নিচে কালো ডেডো। বাড়ির সামনে খানিকটা খোলা যায়গা। খোলা যায়গা আর রাসত্দার মাঝে চারটা ডাব গাছ। আমি সাধারনত বিকালের দিকে বাড়ির সামনে এই খোলা যায়গাটায় বসি। নানা ধরনের লোকজন আসে, কথা বলে। সবাই চাচা বলেই ডাকে অথবা মনির চাচা। সামনাসামনি কেউ রাজাকার বলার সাহস পায়না কিংবা দুঃখ পাবো এজন্যে বলে না। মাত্র নয় মাসের কোর্সে এই ডিগ্রি পেয়েছি। সেই দিনগুলোর কথা আজো মনে পড়ে। আমার বাবা ছিলেন ইংরেজ বিরোধী সাহসি সৈনিক। তার নেতৃত্বে একটা ক্লাবও গঠন হয়েছিল। ক্লাবের নাম ইংরেজ দমন সংঘ। ভাবতেই অবাক লাগে দুইশো বছরের শাসকদের সরানোর দুঃসাহস। বোকামিও বলা চলে। তবে উনার কারনেই কি-না জানিনা, খুন হবার বছরখানেক পরেই দুইশো বছরের শাসনের যবানিকা পাঠ হলো। ইংরেজরা ফিরে গেল। লোকে তো এটাই বলাবলি করতে লাগলো যে, এক সিরাজ দিয়ে শুরম্ন আরেক সিরাজে শেষ। সিরাজুলের প্রানেই হয়তো ইংরেজের প্রানপাখি লুকায়িত ছিল। বেচারারা কি জানতো এটা! জানলে কেন ঐ ঠুনকো বিরোধী ক্লাবের সভাপতির গায়ে হাত দিবে। বরং তাকে তো রাজমহলের পালঙ্ক ঘরে সযত্নে রাখতো। সে সময়ে আমার দাপট আকাশচুম্বি। "এটাই সিরাজের ছেলে।" রাসত্দা দিয়ে হাঁটলে এক লোক অন্যকে পরিচয় করিয়ে দেয়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে আড্ডায় আমার প্রভাব। কলেজে সব লাল ফিতায় বেনি করা মেয়েরা ডাক দিয়ে কথা বলে। "মনির আজকাল তো আমাদের চিনেই না।" ভদ্রতার খাতিরে বলতে হতো, কে বলল?, তুমি বুনিয়া, তুমি ফেনসি, তুমি রাহেলা, কি ঠিক আছে না?" সবাই খিলখিল করে হাসে। দৌড়ে চলে যায়। পরে আবার আসে আর কয়জন। সেইবার আই এ পরিৰায় ফেল করলাম। তখন শুধু বাবার কথা মনে পড়তো। বাবার ভালাবাসার অভাববোধ করতাম। তাঁর ভালোবাসা আমরা ভাইবোনরা পেয়েছিলাম একটু অন্যভাবে। তিনি আমাদের পছন্দকে সবচেয়ে গুরম্নত্ব দিতেন। পড়ালেখায় নিজের আগ্রহ জন্মানেরা পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল একমাত্র। তাঁর মৃতু্যর পর সব হারিয়ে গেল। পরেরবার আই এ পাশ করে ঢাকায় ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলাম। ঢাকায় থাকা শুরম্ন করলাম। বাড়িতে তো মা আমার জন্য সারাদিন কাঁদতো। সপ্তায় সপ্তায় চিঠি পাঠাতো। চলে আয়। চাকরি করা লাগবে না।" আমি তেমনভাবে কর্ণপাত করিনি চিঠির লেখায়। জানি আজ ফিরে গেলে সংসার টিকবে না। আমি বাড়ির বড় ছেলে। পরিবারের দেখভাল করার দ্বায়িত্ব আমারই। যে মা আমার জন্য আজ কষ্ট পাচ্ছে বাড়িতে ফিরে গেলে তাঁর জন্য আমাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে। এটা কি স্বার্থপরতা? নিজের কষ্টের কথা ভেবে মায়ের কষ্টকে মেনে নিলাম। ধীরে ধীরে পদন্নতিও হলো আমার। বেতন বাড়লো। সেবার বায়ান্নই অফিস থেকে সব স্টাফরা গেল মিছিলে। আমি যাইনি। এসব আমার ভালো লাগতো না। বলা যায় ভয়ও পেতাম। দেশের মাঝে ঝুট ঝামেলা মনটাকে বিষিয়ে তুললো। এভাবে চলতে পারেনা। মাঝে মাঝে মনে হতো ফিরে যায় মায়ের কোলে। ঢাকার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে। গোলাগোলি আর মিছিল মিটিং। মিছিলে বোমা। সেবারের পর সিদ্ধানত্দ চেঞ্জ করলাম। দিনকাল ভালোই চলতে লাগলো। একবার পাকিসত্দান থেকে ভুট্টো সাহেব এসে আমার সাথে দেখা করে গেলেন। তিনি জানতে পেরেছেন আমার বাবা ছিলেন ইংরেজ বিরোধী লোক। সে সূত্রে আমার রক্তেও বইছে ইংরেজীবিমূখ ধ্যানধারনা। তার চেয়ে বড় কথা সেদিন আমি একমাত্র মিছিলে যাইনি। সেই থেকেই শুরম্ন। ভুট্টো সাহেবের সাথে আমার খাতির বাড়তে থাকে। ফোনে কথা হতো প্রায়ই। তিনি আমাকে পাকিসত্দানে ডাকলেন। আমি যাইনি। এমনিভাবেই চলছিল দিন। যুদ্ধ শুরম্ন হলো। ভুট্টো সাহেব আমােেক ঐ চাকরী ছাড়িয়ে দিয়ে নতুন চাকরীতে লাগিয়ে দিলেন। যুদ্ধের সময় আমি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন ক্যাম্পে যাতায়াত করতে লাগলাম। তখন উনার সাথে কথাবার্তা কমই হতো। বাড়ির সাথেও যোগাযোগ বন্ধ। মা চিঠি পাঠায়, পড়া হয় না। মনের মধ্যে বাসা বাঁধলো ধ্বংসাত্বক প্রবৃতি্ব। বন্দুক চালানো শিখলাম। কয়েকটার বুক ঝাঁঝরাও করতো হলো। প্রথম দিকে ভীষন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। কিছু খেতে পারিনি। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। অবস্থা এমন যে, মানুষের বুকে গুলি না করলে দিনটা কেমন পানসে মনে হয়। আমাকে পাঠানো হলো আমার গ্রামে। অনেক দিন পর গ্রামে ফিরলাম। লোকজন আমার খবর জানতে চায়। কেমন আছি? সে সময় মন মেজাজ ভীষণ রম্নক্ষ্ম। কয়েকটাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় ছিল আমাদের অভিযান। পারলে দু একটা চিড়িয়া। রাহেলা আর ফ্যানসিকে নিয়ে গেলাম। মিলিটারি প্রধান দারম্নন খুশি আমার উপর। উৎসাহ দিতে থাকেন। যুদ্ধের সময় অফিস স্কুল কলেজ সব বন্ধ। তবু আমাকে ঢাকায় থাকতে হলো। প্রধানের আদেশ। কি করবো, থেকে গেলাম। যুদ্ধের বাঁকি কদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মায়ের সাথেও যোগাযোগ নাই। মায়ের চিঠিও আর আসতো না। সেবার গ্রামে ফিরেও দেখা করা হয়নি। দুদিন থেকেছি মাঠের মধ্যে তাঁবু করে। যুদ্ধের বাঁকি সময় আরো নানা জাতের অস্ত্র চালনা শিখলাম। মুক্তি বাহিনি ধরে এনে গুলি করি। আঙ্গুল কাটি। চোখ উপড়ায়। রক্ত দেখে তৃপ্তি হতো। যুদ্ধের শেষ দিকে আমার মাঝে আবার ভয় চেপে বসে। তখন একক দিন একেক যায়গা থেকে খবর আসে যে ওমুক যায়গায় মিলিটারি কোনঠাসা। তমুক যায়গায় আত্মসমর্পন। স্বাধীনতার পর আমি লুকিয়ে পালি এলাম গ্রামে। গ্রামে ফিরে আমি সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেলাম। জানতে পারলাম মা মারা গেছে। মিলিটারিরা গুলি করেছে। মাথায় আর বুকে। আমি থমকে যাই। মুক্তিবাহিনি আর পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াই। লজ্জা ভয় আর অনুশোচনা গ্রাস করে খায় আমাকে। কুরে কুরে খায় আমার অসত্দিত্ব। আমি জ্বলে পুড়ে মরি। আমার মায়ের খুনির শত্রম্নরা খোঁজে আমাকে মারার জন্য। মায়ের খুনির দলে আমি। এই লজ্জা কোথায় রাখি। বিবেকের শাসন রম্নপ নেয় নির্যাতনে। সিদ্ধানত্দ নেই প্রায়শ্চিত্ব করার। ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ধরা পড়ি। বেঁচে বেরিয়েও আসি। সেটাও বাবার পরিচয়ের গুনেই। আমি আজো মুছে ফেলতে পারিনি সেই স্মৃতি। সেই লজ্জা। সেই উপাধী। রাজাকার। শেষ বিকেলে এসে বসি এই খোলা যায়গায়। আমার চোখের সামনে চারটি ডাবগাছ। এরপর ধুলিপথ। পথ পেরিয়ে সবুজ মাঠ। নদীর রূপালী জল। ডুবনত্দ সূর্যের লালিমা চিক চিক করে সেই জলে। আমার হঠাৎ চোখ যায় ডাবগাছের গোড়ায়। গুচ্ছ কতগুলো সবুজ ঘাস। আজ হঠাৎ দেখছি। প্রতিদিন বসি এখানে। আজই দেখছি এখানে কচি ঘাসেরা গজিয়েছে। আমার দৃষ্টি আটকে যায়। এ ধুলিময় শুস্ক মাটিও ফলায় সবুজের বীজ। অতীত আমার বারবার ডেকে যায়। না কোন ধ্বংসাত্বক দিনে নয়। আরও পেছনে। সেই ছোটবেলায় যখন বাবার হাত ধরে এইখানে বসে থাকতাম, খেলা করতাম, তখন। এ যায়গা পূরোটা ছিল সবুজের চাদর পাতা। ছোট ছোট ঘাসের মেলা। সেই আমি আজ। এইখানে। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। সবুজ ঘাসগুলোর মতই কত আগে হারিয়ে গেছে মায়ের স্নেহ, মমতা আর ছেলের মুখ দেখার অতৃপ্ত দৃষ্টিদুটো। মনে হয় যেন এ মাটিরও আছে আমাকে শাসত্দি দেয়ার বাসনা। এ মাটিরও অতৃপ্ত দৃষ্টি খোঁজে সেই মনির কে। আজ এই মাটিকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে "আমায় মুছিয়ে দাও মা, মুছিয়ে দাও। আমায় শোষন করে ফেলো।" আমি ক্লানত্দ দেহ নিয়ে পড়ে যায় চেয়ার থেকে। কিছু প্রায়শ্চিত্বের নোনা জল গড়িয়ে পড়ে শুস্ক মাটিতে। বুকের বাঁ পাশটা ব্যথায় চিন চিন করে ওঠে। জানিনা এ মৃতু্য আমার না-কি রাজাকারের। "হে প্রভু, দোহায় তোমার আমায় আরেকটু বাঁচিয়ে রাখো। আমি বাঙ্গালি হয়ে আরো একবার দেখতে চাই সেই একগুচ্ছ সবুজ ঘাস।"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
বাস্তবেই যদি এমন হতো, রাজাকারগুলো হাত জোড় করে ক্ষমা চাইত তাদের কাছে যাদের সব কিছু নিংড়ে নিয়েছিল ওরা হিংস্রতায়, মিশে যেত দেশ গড়ার কাজে.... এগুলো ভাবতেই ভাল লাগে। বাস্তবে ওরা এখনো তেমনই দাম্ভিক আর হিংস্রই রয়ে গেছে। পাপবোধ ওদের দংশন করে না কখনোই। আজো আছে ঠিক ৭১এর দিনগুলোর মতোই। তাই এখনো তাদের প্রতি ঘৃণার পরিমান কমতে পারে না। গল্প ভাল লাগলো তবে বিষয়টা ছিল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লেখার.....
তাপসকিরণ রায়
হ্যা,রাজাকারের জীবনী ভালো ভাবে ফুটিয়ে উঠিয়েছেন.আপনাকে না,আপনার রচিত নায়কের প্রায়েশ্চিত্ত হলো কোথায়! সবকিছু পাষন্ডের মত করে সবুজ ঘাসের স্বপ্ন দেখলে কি পাপের খন্ডন হয়?আপনার নায়কের ওপর আমার ভীষন ভীষন রাগ হচ্ছে-- আর এই রাগই আপনার গল্পের স্বার্থকতার কথা জানিয়ে দিচ্ছে! হ্যা,একটা কথা না জানিয়ে পারছি না--জানে আনজানে অনেক শাব্দিক ভুল রয়ে গেছে কিন্তু আপনার গল্পে--সংশোধন করিয়ে নিতে অনুরোধ করছি.
আহমেদ সাবের
সব রাজাকাররা যদি মনির রাজাকারের মত প্রায়শ্চিত্ত করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত হতো, তবে হয়তো দেশের এ হাল হতো না। সুন্দর থিম। ভালো লাগলো গল্প।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।