আমাদের বাসাটায় ছিল অনেক গাছপালা - দুটো রেইন ট্রি, তিনটে নারিকেল গাছ, দুটো জাম গাছ, একটা আম গাছ, একটা কুল গাছ, একটা দেশি মেহগনি আর একটা কাঁঠাল গাছ। ছোট বেলার একটা বড় সময় পাড়ার বন্ধুদের সাথে এইসব গাছে গাছে চড়ে, বাদর কিংবা টারজানের মত ঝুলে ঝুলেই কেটেছে। পরিবারের সদস্য বলতে ছিলাম আমি, আমার আব্বা, আম্মা, নানু আর দুই খালা। তো এই গাছগুলোকেও আমি আমার পরিবারের অংশই মনে করতাম। আম্মা যখন ঘরের কাজ সেরে দুপুরে একটু তন্দ্রা যেত সেই সময়টা ছিল আমার ঐ আম না হয় কাঁঠাল গাছের ডালে বসে রূপকথার রাজ্যে আনমনে হারিয়ে যাওয়ার সময়। সে যাই হোক। এখন মূল ঘটনায় আসি। আজ থেকে ২৪ বা ২৫ বছর আগের কথা। ১৯৮৮ কি ৮৯ সাল হবে। এখনো আবছা আবছা মনে পড়ে।আমাদের ছিল ১৮ ইঞ্চি প্যানাসনিক রঙিন টিভি। আম্মা বিদেশ থেকে এনেছিল। তখনো ময়মনসিংহে রঙিন টিভি এত সুলভ নয় । স্বভাবতই অনেক কদর তার। টিভি রাখার জন্য বাক্স বানাতে হবে। আব্বার ইচ্ছে নিজেদের কাঁঠাল গাছ কেটে কাঠ বানিয়ে রীতিমত বাসায় কাঠমিস্ত্রী রেখে বাক্সটা বানানো। শুনে আমার যে কি মন খারাপ হলো তা আর বলার নয়। ছোট খালাকে আর বড় খালাকে অনেক করে বললাম আব্বাকে গাছটা কাটতে মানা করতে, কিন্তু দুলাভাইকে তাদের যমের মত ভয়। আম্মাকে বলতেই খেলাম এক ঝাড়ি। যেদিন কাঠগোলার লোকগুলো এসে গাছটা কাটছিল সেদিন মনে হচ্ছিল কাঁঠাল গাছটা আমার দিকে তাঁকিয়ে কাঁদছে। মনে হচ্ছিলো আমাদের পরিবারের, আমার খুব কাছের কেউ মারা যাচ্ছে। চোখের পানি আড়াল করে গাছ কাটা দেখলাম। বেশ কিছুদিন পর কাজ শুরু করা হল। বাসায় কাঠ মিস্ত্রী এলো। মিস্ত্রীর নাম নান্নু মিয়া, আমি ডাকতাম নান্নু কাকা। চুল তেলে চিকচিক করত, প্রচুর বিড়ি খেত আর খুব ধীরে কাজ করত। কাজ করার সময় তাকে মনে হত তপস্যী। আমি সামনে বসে বসে তার ধীর কিন্তু নিখুঁত কাজ দেখতাম। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্পও করতাম, কি গল্প তা আজ আর মনে নেই। আমার সাথে তার কিছুটা ভাবও হয়ে গিয়েছিল, তাই সে বেঁচে যাওয়া কাঠ দিয়ে আমার জন্য একজোড়া খড়ম বানিয়ে দিয়েছিল। তা সেই নান্নু কাকার হাতে ধীরে ধীরে তৈরী হয়ে গেল একটি সুন্দর কাঁঠাল কাঠের টিভি বাক্স উইথ রেক এণ্ড চারটি সুদৃশ্য পায়া। আমার কাছে মনে হলো আমার প্রিয় সেই কাঁঠাল গাছটাই আবার আমাদের পরিবারে এসেছে নতুন রূপ নিয়ে। তার সুন্দর দুইটা ডালার মধ্যে টিভিটাকে যেন আরো সুন্দর লাগতো।
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। নানু গত হয়েছেন, খালাদেরও বিয়ে হয়ে আলাদা সংসার হয়েছে। আমাদের পরিবারেও নতুন সদস্য এসেছে অর্থাৎ আমার বউ এসেছে। সেই সাথে এসেছে নতুন ২১ ইঞ্চি এলজি টিভি। ১৮ ইঞ্চি টিভি নষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। টিভি বাক্সটা ব্যবহার হচ্ছিলো আম্মার টুকিটাকি দরকারি অদরকারি জিনিষ রাখার আসবাব হিসেবে। নতুন টিভি টা মহা আনন্দে টিভি বাক্সে ঢুকাতে গিয়ে দেখি, উহু, বাক্সের ভিতরে নতুন টিভি ঢুকছে না কোন মতেই।
এদিকে বাক্সটা পুরনো হলেও জৌলুস কমেনি একতিলও। কোথাও একটু ঘুণেও ধরে নি। নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দিতে কষ্ট হত না। কিন্তু এমন কাঁঠাল কাঠের মজবুত জিনিস ফেলে দিতেও মন চায় না। আবার এদিকে ঘরের এতখানি জায়গা দখল করে রেখেছে কোন কাজে না লেগে। অতএব কি আর করা। সব মায়া ঝেড়ে ফেলে আজকে কাঠ মিস্ত্রী ডেকে ওটা কেটে দুটা ছোট টি টেবিল আর তিনটা চেয়ার বানালাম। মিস্ত্রী যখন করাত চালাচ্ছিল তখন একটু খারাপ লাগলেও বানানোর পর দেখলাম বেশ হয়েছে। অন্তত কাঁঠাল কাঠগুলো তো ঘরেই রইল, আব্বা আম্মার হাতে গড়া জিনিস! থাক না আরো কিছুদিন আমার পরিবারের অংশ হয়েই। থাক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
সেই সময়টায় টিভির কদরই ছিল অন্য রকম। আর টিভি থাকলে একটা বাক্সও জরুরী হয়ে পড়তো। একটা ব্যাপার গল্পে নতুন পেলাম বাক্স বানানোর জন্য কাঠাল গাছ কেটে ফেলা। সাধারণত ঘর তোলার প্রয়োজনে গাও গেরামে গাছ কাটা হয়। তার পর সেটার ব্যাবহার নিয়ে ভাবা হয়। "বাবা-মায়ের হাতে গড়া" এই ম্যানিয়াটায় কম বেশি আমরা সবাই জর্জড়িত। মনে হয় যেন তাদের ছোয়া লেগে আছে। গল্প ভালো লাগলো।
আপনার চুলচেরা বিশ্লেষনে আমি মুগ্ধ। গল্পটির বুলস আইয়ে আপনি স্পর্শ করতে পেরেছেন, "বাবা-মায়ের হাতে গড়া" এই ম্যানিয়াটাই পরিবারের থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।