আমার ভাঙ্গা, ঘরে তুমি এলে ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে ঝরে
বর্ষাকালটা আমার পছন্দের ঋতু নয়, আমার কাছে এই সময়টা রীতিমতো বিরক্তিকর। প্যাচ-প্যাচে কাদা, ম্যানহোল কিংবা ড্রেন উপচে পড়া নোংরা পানি আর বিনা নোটিশে যখন তখন হতচ্ছাড়া বৃষ্টি! তবে নানা নাগরিক বিড়ম্বনা আর অসুবিধা সত্বেও অনেকে আবার বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হোন, নস্টালজিক হোন, কিংবা রোমান্টিক ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে দুএকটি কবিতাও লিখে ফেলেন। এই জন্যই হয়তো কবি বলেছেন, 'এমন দিনে তারে বলা যায়...'। অর্থাৎ কবিগুরুর মতে 'ভালোবাসি' বলার শ্রেষ্ঠ সময় হলো বৃষ্টি দিন।
শুধু কবি নয়, বৃষ্টি দিনে অনেক অ-কবির মনেও কাব্য ভাব জাগ্রত হয়। সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে এক গ্রামে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ীতে। দুপুর বেলা ঘরে বসে আছি। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে একটানা বৃষ্টির রোমান্টিক শব্দে ওর মনে সহসা কাব্য ভাব জাগ্রত হয়। রীতিমতো হাতে কাগজ-কলম আর ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ে সে। এমন সময় এক পল্লী-বালিকাকে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখার পর কিছুক্ষণ ভাবের জগতে অবাধ বিচরন শেষে বন্ধুটি কাগজে খস-খস করে লিখে ফেলেন কয়েকটি পংক্তি। অতপর কাগজটি আমার দিকে নীরবে এগিয়ে দেয়। শুভ্র কাগজের বুকে বল পয়েন্টের আঁচড়ে গোটা গোটা অক্ষরে বন্ধুটি লিখেছে...
'এমন ঘন বরষায়
বদনা হাতে কে যায়'!
নিয়মিত কাব্য চর্চা চালিয়ে গেলে আমার এই কবি বন্ধুটি যে ভবিষ্যতে অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির ভাত মারবে, এতে ঘোরতর কোন সন্দেহ নেই। আমার এই 'সুচিন্তিত' এবং অতি 'উৎসাহব্যঞ্জক' মন্তব্য শুনে উদীয়মান কবি বন্ধুটির চোখে রীতিমতো পানি চলে আসে। সে আমাকে 'একজন বিদগ্ধ কাব্য সমালোচক' বলে অভিহিত করে।
বর্ষা এবং বৃষ্টি প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, যা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এক বৃষ্টিদিনে মহিলা কলেজের সামনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় কবির নামের এক বন্ধু এসে আমার হাতের ছাতাটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলে, ‘দোস্ত, র-র-রত্নাকে একটু বা-বা-বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি...’। কবিরের তোতলানো কথা শুনে তাকিয়ে দেখি,ওর কথিত প্রেমিকা রত্না কলেজের সামনে বারান্দায় ব্যাগ হাতে একাকী দাঁড়িয়ে আছে।
অত:পর...আমরা এক প্রেমিক যুগলকে ক’মুহূর্তপর একই ছাতার নীচে অত্যন্ত রোমান্টিক পরিবেশে ঘনিষ্ট অবস্থায় দেখবো বলে নড়েচড়ে বসি...। কবির ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে রত্নার কাছাকাছি গিয়ে বলে, (পরে ওর মুখে শুনেছি) ‘একা একা এ-এ-এখানে দা-দা-দাঁড়িয়ে আছো কেন! ঠা-ঠা-ঠান্ডা লাগবে যে, চল ...তোমাকে বা-বা-বাসায় পৌঁছে....' ধপাস! অর্থাৎ কথা শেষ হওয়ার আগেই পা পিছলে প্রপাত ধরণীতল...। কাদা পানিতে বেকায়দা ভঙ্গীতে পড়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কবির।
ঘটনার আকস্মিকতায় রত্নাও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ক’মুহূর্ত। তারপর...আশ-পাশে কাউকে না পেয়ে নিজেই বৃষ্টির মধ্যে নেমে ওর হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলে, ‘বেকুবের মতো হাঁটেন কেন! দেখেশুনে চলতে পারেন না?’ অত:পর আছাড় জনিত ব্যথা আর রত্নার ধমকে বেদনাহত কবিরকে আমরা ধরাধরি করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি...। পরে অবশ্য কবির বলে,ও পড়ে গিয়ে যতোটা না আঘাত পেয়েছে, তার’চে বেশী কষ্ট পেয়েছে রত্না ওকে ‘বেকুব’ বলায়...। রত্না অবশ্য এখন ওই ‘বেকুব’র সঙ্গেই সংসার করছে...। আমার এখন প্রচন্ড জানতে ইচ্ছে করছে, এই বৃষ্টিদিনে ওদের সেই স্মৃতি মনে পড়ছে কিনা।
আমার বৃষ্টি না পছন্দের একটি বিশেষ কারন রয়েছে। আমার এক সুন্দরী কাজিন, একসময় যাকে দেখলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো, বাকরুদ্ধ হয়ে যেতো (এখন অবশ্য কুমড়ো পটাশ)। স্বপ্না নামের সেই মেয়েটি একদিন স্বত:প্রণোদিত হয়ে আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলে, 'ঈশান ভাই, বিকেলের দিকে একটু বাসায় আসুনতো, আমার সঙ্গে একটি জরুরী কথা আছে।' ওর কথা শুনে আমার বুকের ভেতর যেন একসঙ্গে ফুটে ওঠে হাজার গোলাপ কলি। 'জরুরী' কথা শুনবার বাসনায় দুপুরের পর যথেষ্ট মাঞ্জা মেরে ফুরফুরে মেজাজে ওদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
কিন্তু কিছুদূর যেতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। এদিকে রিক্সাওয়ালার আবার পর্দা নেই। সারা রাস্তা কাকভেজা হয়ে স্বপ্নাদের বাসার সামনে গিয়ে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটাতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। বৃষ্টিভেজা রাস্তা দিয়ে সশব্দে চলে যায় একটি প্রাইভেট কার। সে সঙ্গে এক আঁজলা কর্দমাক্ত পানি ছিটিয়ে দিয়ে যায় আমার গায়ে। রাগে-দু:খে-ক্ষোভে প্রায় কান্না চলে আসে আমার। উদাস ভঙ্গীতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় চলে আসি। তারপর টানা তিন-চার দিন সর্দিজ্বরে বিছানায় পড়ে থাকি। সেই থেকে বৃষ্টি আমার দু'চোখের বিষ। হতচ্ছাড়া বৃষ্টি আমার উঠতি যৌবনের একটি রোমান্টিক সম্ভাবনাকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করে।
আমি বৃষ্টি পছন্দ করি আর না করি, বৃষ্টির তাতে কিছু যায় আসে না। বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টি ঝরবে প্রাকৃতিক নিয়মে। কে তাকে দেখে মুগ্ধ হলো, কে বিরক্ত হলো, বৃষ্টি তার খবর রাখেনা। বৃষ্টি পছন্দ না করলেও বৃষ্টিদিনে আমার কিঞ্চিত রসনা বিলাসের শখ জাগ্রত হয়। ভুনা খিঁচুড়ি, সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা। আহা ভাবলেই জিভে জল এসে যায়। কিন্তু শখটা সঙ্গে সঙ্গে মিটেও যায়, যদি এসবের ইন্তজাম করতে স্বয়ং আমাকেই বাজারে যেতে হয়। ভুনা খিচুড়ির খোয়াব ত্যাগ করে আলুর ভর্তা আর ডাল খেতে রাজী আছি, তবু বৃষ্টিদিনে বাজারে যেতে রাজী নই। বৃষ্টিদিনে বাজারে যাওয়ার চেয়ে না খেয়ে থাকাই বরং উত্তম।
এ প্রসঙ্গে একটি বিড়ম্বনার কথা না বললেই নয়। মনে পড়ে একবার এক বৃষ্টিমুখর দিনে বাজার থেকে এক কুড়ি কৈ মাছ কিনে পলিব্যাগে করে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার কাছে এক বিরাট মাঠ ছিল। সেখানে জমেছিল প্রায় একহাটু জল। মাঠের কাছে এসেই আমি পা পিছলে প্রপাত ধরনীতল। বাসায় এসে ছেঁড়া মশারীর টুকরো আর ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম কৈ মাছ উদ্ধারে। দু'ভাই মিলে ঘন্টা খানেক চেষ্টা করে চার-পাঁচটি মাছ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ফেরার পথে পাড়ার এক সুন্দরী টিপ্পনী কেটে বলে, 'কি জাইল্যা মিয়া, মাছ কেমন পাইলেন ?' এই জাইল্যা শব্দটি শেষ পর্যন্ত আমার নামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অনেকদিন যাবত আমাকে বিব্রত করেছিল। এত কিছুর পরও কি আমার বৃষ্টি পছন্দ করার কোন কারন আছে ! আসলে ঝিরঝিরে বৃষ্টির একটানা ছন্দময় পতন কিংবা বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য চাই শিল্পিত মন, সেটা হয়তো আমার নেই।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
আমার ভাঙ্গা, ঘরে তুমি এলে ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে ঝরে
২৮ নভেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
সমন্বিত স্কোর
৩.৯৮
বিচারক স্কোরঃ ১.৭৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.২৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪