তখন আমার প্রেমে পড়ার বয়স। মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাই। যাকে দেখি তাকেই ভালো লাগে। পাশের ফ্লাটের ডলি ভাবির কিঙ্কিণি হাসি ভালো লাগে। কলেজের সহপাঠি শান্তার টোল পড়া গাল ভালো লাগে, কোচিং ক্লাসের সুরাইয়া ম্যাডামের ভরাট নিতম্বের হিল্লোল ভালো লাগে, নাটকের মেয়ে সোনালির আদুরে চিবুক ভালো লাগে। থার্ড ইয়ারের উর্বসী তনিমা’র পীনোন্নত বক্ষ ভালো লাগে, লাস্যময়ী অহনার কামুক চোখের বিলোল কটাক্ষ ভালো লাগে …। তন্বী তরুণী আইরিন খানের বব কাট চুল ভালো লাগে। আমার প্রেমিক চোখ তখন মেয়েদের দেহ সৌষ্ঠব জরিপ করে বেড়ায়, প্রেমিক মন তাদের নিয়ে কল্পনার আকাশে ভাসে আর স্বপ্নের ফানুষ ওড়ায়।
ঠিক এমন সময় লক্ষ্য করি আমি যেমন মেয়েদের জরিপ করি, আমাকেও একটি মেয়ে আড়ালে আবডালে জরিপ করছে। কলেজের এখানে সেখানে মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয়। চোখাচোখি হলেই চোখ সরিয়ে নেয়। আবিস্কার করি, আমি যেখানে যাই, কাকতালীয় ভাবে মেয়েটিও সেখানে উপস্থিত। ক্যাম্পাসের করিডোর, লাইব্রেরি, ক্যান্টিন সর্বত্রই তাকে দেখি, তবে কি মেয়েটি আমাকে অনুসরণ করে? করলে কারণ কি?
শ্যামাঙ্গিনী একটি মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এমন মেয়েকে নিয়েই লিখেছিলেন,
“...তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক...।”
কৃষ্ণকলির চক্ষু যুগল আসলেই সুন্দর। যেন মায়ার সমুদ্দুর। তার চোখে যখন চোখ পড়ে যায়, আমার যেন কি হয়ে যায়….। এক ঝিম মারা দুপুরে তাকে নিয়ে লিখে ফেললাম দু’টি ছত্র।
”তোমার চোখের সরোবরে মায়ার জলরাশি
আমি সেই জলের ওপর পাতা হয়ে ভাসি...।”
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা কাউকেই বলি না। নিজের ভিতর নিজে রোমাঞ্চিত হই, শিহরিত হই। কিন্তু আগুন আর ভালোবাসা নাকি লুকিয়ে রাখা যায় না, যেভাবেই হোক, প্রকাশ পেয়ে যায়।
আমার উথাল-পাতাল অবস্থা দেখে বন্ধুদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয়, একদিন ওরা দলবেঁধে আমাকে চেপে ধরে...
”কিরে তোরে এতো উদাস উদাস লগে কেন, প্রেমে ট্রেমে পড়ছোসনি?” জেরা করার ভঙ্গিতে বন্ধু স্বপন জিজ্ঞেস করে ।
আমি সলাজ ভঙ্গিতে বলি, ”আমি পড়ি নাই দোস্ত, তবে মনে হয় আমার ওপর পড়ছে।”
বলিস কিরে, ”কোন সে বেকুব, যে তোর উপ্রে ক্র্যাশ খাইছে?” ভীষণ অবাক হয় বন্ধু সোহাগ।
আমি আর বেশী কিছু না বলে ওদেরকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাই। এদিক-সেদিক একটু ঘোরাঘুরি করতে করতেই কৃষ্ণকলির দেখা পেয়ে যাই। একটি আমগাছের নীচে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে।
আমাকে দেখতে পেয়েই গল্প থেমে যায় ওর। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা আমার দিকে হেঁটে আসতে থাকে। এদিকে আমার তখন দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। পাঁজরে বন্ধু স্বপনের হালকা কনুইয়ের গুঁতা টের পাই। সোহাগ সজোরে খামছে ধরে আমার কাঁধ।
”কেমন আছেন?” আমার নিঃশ্বাসের ব্যবধানে এসে চোখে চোখ রেখে সরাসরি জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণকলি।
আমি তখন পৌষের শীতেও ঘেমে একাকার। বুকের ভিতরে ধড়াস ধড়াস হাতুড়ির শব্দ শুনি। অনেক কষ্টে ঢোক গিলে বলি, ”হুম ভালো, তুমি?” ”হা আমিও ভালো , আপনার সঙ্গে আমার একটি জরুরী কথা আছে। আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে...?’
হা, মানে আপাতত আমি ফ্রি….।
তাহলে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করুন প্লিজ, আমি একটি জরুরী ক্লাস সেরে আসছি।’
কথাটি বলে ঘুরে দ্রুত হাঁটা ধরে কৃষ্ণকলি। কয়েক পা এগিয়ে মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, ’চলে যাবেন না কিন্তু…।’
এতোক্ষণ আমার বন্ধু দ্বয় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কৃষ্ণকলি চলে যেতেই সজোরে চিৎকার করে বলে, দোস্ত তোর হয়ে গেছে রে…। এবার খাওয়া।
বন্ধুরা ধরে বেঁধে আমাকে কলেজের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে ঢুকায়। নান রুটি আর ’শিক কাবাব’ বাবদ পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বেরিয়ে গেলেও মনটা আমার আনন্দে ভরে যায়। প্রথম প্রেমে পড়ার অপার্থিব আনন্দ। তার কি তুলনা হয়?
ফুরফুরে মন নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর কৃষ্ণকলির ক্লাশ শেষ হয়। তাকে আসতে দেখে আমাকে আমগাছের নিচে একা রেখে বন্ধুরা সটকে পড়ে।
কৃষ্ণকলি সামনে এসে দাঁড়ায়। কোন ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করে…।
”আমি সেঁজুতি। এই কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম যে দিন ক্যাম্পাসে আসি,সে দিনই আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। মানুষে মানুষে এতো মিল ! হা, আপনি দেখতে ঠিক আমার চাচাতো ভাই রুদ্রের মতো। আমরা একই বাড়িতে একই সঙ্গে বড়ো হয়েছিলাম। আমার আপন কোন ভাই নেই। ও-ই ছিলো আমার ভাই। গত বছর লিভার সিরোসিসে হুট করে ও মরে যায়। সেই থেকে আমি প্রচণ্ড একা হয়ে যাই। আপন ভাইয়ের মতো ও আমাকে আগলে রাখতো, সুখে-দুঃখে আমার পাশে থাকতো। আচ্ছা আমি কি আপনাকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতে পারি? আপনি কি আমার ভাইয়া হবেন? এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো ডেলিভারি দিয়ে থামে কৃষ্ণকলি।
আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সেই কৃষ্ণকলি অর্থাৎ সেঁজুতি রহমান অনেকদিন পর আমাকে আবার খুঁজে বের করে। তার বড়ো মেয়ে আনমনার বিয়ে। অ্যাবাকাস কনভেনশন সেন্টারে। আমার হাতে বিয়ের কার্ডটি ধরিয়ে দিয়ে তার উপর্যুপরি অনুরোধ আমি যেন অবশ্যই যাই, আনমনার ‘মামা’ হিসেবে বিয়েতে উপস্থিত থাকি। হায়, স্মৃতি তুমি সত্যি বেদনার।
২৮ নভেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪