১৫-ই ডিসেম্বর, ২০০৮। সূর্য অস্ত যায় প্রায়; ভেতর থেকে ছেলেমেয়েদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, 'পাকিস্তান...পাকিস্তান...এবার ছক্কা...ওহ্ মাই ডিয়ার আফ্রিদি...!' বারান্দার গ্রিলটা শক্ত করে ধরেন হামিদা বেগম, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম; বুকের ওপর খামচানো ক্ষতটা একবার দেখে নেন তিনি; পশ্চিমাকাশে রক্ত ঝরছে; রক্তে রক্তে লাল হয়ে গেছে শিলা দিঘির পানি, সামনের শাল বাগান। রক্ত ঝরছে হামিদা বেগমের অসুস্থ জরায়ু থেকেও।
সন্তানেরা বড় হয়েছে। আর কত বড় হবার স্বপ্ন দেখেছিল ওদের বাবা জানেন না হামিদা বেগম। বয়সের ভারে হয়ত অনেক কিছুই ভুলে গেছেন তিনি আবার অনেক কিছুই তীব্রভাবে গেঁথে আছে স্মৃতির ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়ালে। ছত্রিশ বছর অনেক সময়,অনেক কিছুই বদলানোর জন্য যথেষ্ট, কোন সন্দেহ নেই তাতে; কিন্তু হামিদা বেগমের ক্ষত বিগত হয়নি এখনো, তবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত শুকাতে ঠিক কতটা সময় প্রয়োজন জানেন না হামিদা বেগম। বিবেকের বিগলিত আত্ম জিজ্ঞাসা আর সময়ের সুস্থতার সন্ধিক্ষণে অনেক হিসাবই হামিদা বেগম মেলাতে পারেন না আদৌ। তবে পাকিস্তান যে শেষ পর্যন্ত জিতেই যাবে সন্তানদের বাড়াবাড়ি রকমের উল্লাসে এই হিসাবটা পাকাপক্ক করে ফেলেন তিনি।
রাত ১১:৩০ মি.। 'শোয়েব আক্তার, মাই সুপার হিরো, আর দুইটা উইকেট প্লিজ! ...ওহ্ পাকিস্তান মাই জান....তোমাকে জিততেই হবে !' 'হায়রে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, হায়রে রুহুল আমিন...! কোথায় গেলো তোমাদের শ্রেষ্ঠতা!' হামিদা বেগম ভাবতে থাকেন, "যেদিন ওদের বাবা যুদ্ধে গেলেন, আমি এবং তাঁর বার বছরের কলিজার টুকরা যমুনা ও সদ্য আগত মানিক জোড়া_সফিক আর রফিককে রেখে,আমার আতঙ্কিত চেহারা দেখে বলেছিলেন, 'ওদের জন্য মানচিত্র আনতে হবে না ?' আমি ঠেকাতে পারিনি তাঁকে। ঠেকাতে পারিনি ওদের কেউও; যে দিন ওরা আমাকে এবং আমার বার বছরের শিশুকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল ওদের ভোজালয়ে, কেটে ছিঁড়ে আমাদের রক্তে জন্মের পিপাসা মেটালো পালাক্রমে। আহা আমার ছোট সোনামণি কী কষ্টটাই না সইলো সেদিন ! মরণের তীব্র স্বাদে মিটে গেল জীবনের সমস্ত পিপাসা। ওদের বাবা যেদিন বুকের রক্তে মানচিত্র এঁকে দিয়ে বললেন, 'এই যে আমার সফিক-রফিকের বাংলাদেশ।' আমি ঠেকাতে পারিনি তাকেও। পিতার মৃত্যু দিয়ে রচিত হল সফিক-রফিকের এই স্বাধীনতা ? 'সফিক আর রফিক' আহা কত সাধ করে সে রেখেছিল নাম দুটি !" হামিদা বেগম অন্ধকারে মুখোমুখি অন্ধকারের। 'আজ ওরা বড় হয়েছে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত,' ভাবেন হামিদা বেগম, 'আমার মত করে ওরা ভাববে কেনো! আর ওদের বাবা ?' টানা নিঃশ্বাস ছাড়েন হামিদা বেগম, 'কী বিস্তর ব্যবধান! যে কি-না পাকিস্তানকে কোনদিনও মেনে নিতে পারে নি। আজ তাঁর সন্তানেরা পাকিস্তান পাকিস্তান করে পাগলপ্রায়। যে পতাকা সরাতে তাদের বাবা প্রাণ দিলেন সেই পতাকা তারা এখন গভীর মমতায় লালন করছে তাদের বুকে। ওরা তো আমারও সন্তান! একদিন পাকিস্তানি হায়েনারা একবারও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলিনি বলে আমার দেহের প্রতিটা কোষে খোদাই করে দিয়েছিল অপমানের চিহ্ন; আজ আমারই সন্তানেরা 'পাকিস্তান...পাকিস্তান জিতবেই...পাকিস্তান...পাকিস্তান...!' শোরগলে আকাশ বাতাস ভারি করে তুলেছে; ভাবতে অবাক লাগে এটা একটা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ী। প্রথম বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়ে দিল, আমার ছোটছেলে খুব কষ্ট পেয়েছিল তার স্বাদের পাকিস্তান অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারলো না বলে আর বড় ছেলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল এই ভেবে, তার পাকিস্তান ইচ্ছে করেই বাংলাদেশের কাছে হেরেছে; হায়রে বাংলাদেশ জিতেও জিততে পারলো না! ওগো, তুমি দেখে যাও তোমার সফিক রফিকের স্বাধীনতা! ত্রিশ লক্ষ শহীদ কাদের জন্য জীবন দিল? কেন আমার ফুলের মত মেয়েটা অকালে ঝলসে গেল? এ কোন স্বপ্নের বীজ বুনেছিলাম আমার ধর্ষিত দেহে? ওগো, আমি চাই না এমন স্বাধীনতা। আমাকে ঐ নয়টি মাস ফিরিয়ে দাও, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও তোমাকে...!'
খুব কষ্ট করে শ্বাস নেন হামিদা বেগম। ক্রিকেট খেলা তিনি বোঝেন না, তবে না বুঝলেও এটুকু বোঝেন জীবনে যত ভালো সময়ই আসুক না কেন ঐ নয়টি মাস কিছুতেই ছাড়বেনা তাঁকে, সে চাইলেও পারবেনা ছাড়তে। হামিদা বেগম জানেন, রক্ত কখনো যুক্তির কথা মানে না, উৎফুল্ল মনে সে স্বাধীনতা চায়। তিনি এও মানেন রক্ত কখনো বিকৃত হয় না। 'কিন্তু' ভাবেন তিনি, 'আমার সন্তানেরা ওদের বাবার সন্তান যেমনি গতরে তেমনি চেহারায় অথচ কোথায় যেন একটা স্পষ্ট ব্যবধান থেকে গেছে। ওরা জারজ সন্তান নয় তো!' নিজের অজান্তেই তাঁর সন্তানদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ জাগে। ভয়ে আৎকে ওঠে তাঁর মন।
রাত ১২টা, ১৬-ই ডিসেম্বর। ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। 'ওদের বাবার স্বপ্নের আজ আটত্রিশ বছর পূর্তি হলো। ভেতরে আমার সন্তানেরা, হাততালি আর আনন্দে ফেটে পড়ছে, পাকিস্তান বোধহয় এতক্ষণে বিশ্বকাপ জিতে নিলো।" "পাকিস্তান...পাকিস্তান...ওহ্ মাই পাকিস্তান...!"
...হামিদা বেগম বুকের ক্ষতটা ঢাকবার চেষ্টা করেন।
০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪