আলফু মিয়ার যুদ্ধ জয়

মুক্তির গান (মার্চ ২০২৪)

গাজী তারেক আজিজ
  • 0
  • ৭০
এক.

একটি সংবাদ শোনার অধীর অপেক্ষায় আছে গ্রামবাসী। সকলের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ছেলে বুড়ো সবারই উৎসুক চোখ স্থির হয়ে আছে। কান অত্যন্ত সজাগ। যাকে বলে কান খাড়া করে রাখা। সবার মনোযোগ এক জায়গায়। কেউ নড়াচড়া পর্যন্ত করে না। না জানি কিছু কম জানা হয়ে যায়। কেউই কাউকে ছাড় দিতে চায় না। একটা বাঁশ বেতের মোড়ার ওপর রেডিও রেখে বিবিসি বাংলার খবরে মনোযোগ দেয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই বড়সড় বৃত্তের আদলে গোল হয়ে বসে। পুরুষদের কেউ কেউ মাঝে মধ্যে দূরে গিয়ে হুক্কায় টান দিয়ে শরীর ভাঁপায়। মহিলারা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের শীতের কাপড় মুড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। কিশোর কিশোরীদের ভিতর এক অজানা শংকা বিরাজ করে। এখনো খবর শুরুর অপেক্ষা। এই অপেক্ষা আর টানটান উত্তেজনা যেন বেড়েই চলেছে। আধো আলো আধো ছায়ার খেলা। নির্বিকার মেঘেরা উড়ে চলে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। মেঘেদের কোন যুদ্ধের ভয় নেই।
সময় ঠিক রাত দশটা রেডিওতে বাদ্যের তালে তালে কাউন্টডাউন শুরু হয়। মানুষের অপেক্ষা যেন আরো বাড়িয়ে তোলে রেডিওতে ফ্রিকোয়েন্সি ঠিকঠাক কাজ করছে না। শব্দ ভেঙে ভেঙে আসছে। এক শব্দ বোঝা গেলে অন্য শব্দ বুঝতে পারা যায় না। এই ভাঙা ভাঙা শব্দের সংযোগ ঘটিয়ে এমন একটা সংবাদের অপেক্ষায় থাকে যেন বহুল প্রত্যাশিত। এই শব্দ নির্বিঘ্ন না হওয়ার পিছনে একটাই কারণ থাকে ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া। তারপরও সবাই কোনরকম ভাবে শুনতে চেষ্টা করে। খুব নিরবতা। সুনশান নিরবতা।
এখন শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ আর বুক ধড়ফড়ের শব্দই শুনতে পাচ্ছে। সকলের মাঝে চাপা ক্ষোভ আরো বেড়ে যায় ব্যাটারির চার্জ শেষ হওয়ার বুঝি আর সময় পেল নাহ্। গ্রামের মানুষের সাদামাটা জীবন। পুরো কয়েক বাড়ি মিলিয়ে একটাই রেডিও। সারা দেশের খবর ওই একটা রেডিওই ভরসা। বিবিসি খবর ততক্ষণে নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে। ছেলে মেয়ে আর মহিলারা ঘরে ঢুকে গেছে। পুরুষরা অধীর অপেক্ষার নিরবতা বিসর্জন দিয়ে আলাপচারিতায় মেতে ওঠে৷ কি হয়! কি হয়! একজন একটি কথার সূত্র ধরে তো অন্যজন কেড়ে নিয়ে নিজেই কিছু একটা বলতে চায়। অন্য একজন সেই কথায় পানি ঢেলে দেয়ার মত করে বলে ওঠে
-বুঝছি শেষমেশ আন্ডা নিজের অধিকার আদায় কইরবেল্লাই যুদ্ধ করোন লাইগবো!
আরেকজন বলে ওঠে
-যুদ্ধ!
অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। অন্য একজন বলে -আমরা ছাড়ি দিতান্ন! আইয়োক আন্ডাঅ নামি যামু। জোয়ান বুয়া বেএকে যুদ্ধে যামু। না কি কঅন কাক্কা?
-হ্যাঁ রে বাচি থাইকতে অইলে ত যুদ্ধ কইত্তে অইবো! আইচ্চা বেএকে যঅগোই! অন যাই ঘুমোঅগোই। বেয়ানে উডি চিন্তা করমু।
একজন মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। অন্য একজন কটাক্ষ করার মতো করে বলে
-হুঁ হেতে যাইবো যুদ্ধে, আন্নেঅ হুইনছেন! আঁইঅ বিশ্বাস কইচ্ছি!
যাকে নিয়ে কটাক্ষ সে বলে ওঠে
-দেয়া যাইবো কঅন যুদ্ধে যায়! কঅন হলাই থায়! যে কটাক্ষ করে সে বলে
-দেইকছি ত! কঅন কেইচ্চা! যঅ যঅ বেয়ানে দেএয়া যাইবো!
ফজল বলে ওঠে
-আইচ্ছা কাক্কা বেয়ানে ভোরে উডি হোলা মাইয়া বেডি বেকগুনেরে হেএ হায় হাডাই দিলে কেইচ্ছা অয়!
গফর কাকা বলে ওঠে
-আইচ্ছা দেএয়া যঅক না। অন বেকে যঅ।
বলে গফর কাকা নিজের ঘরে চলে যায়। সবার চোখে মুখে খুব উদ্বেগ উৎকন্ঠা!


দুই.

গফর কাকা মাতবর শ্রেণির লোক। গ্রামের সালিশ দরবারে যার সরব উপস্থিতি। জন প্রতিনিধি না হয়েও জনগণের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের একজন। নির্বাচনে সবাই তাকে মেম্বার পদে ভোট করার জন্য অনুরোধ করলেও কোন আগ্রহ দেখায় না। গফর কাকা শৌখিন প্রকৃতির লোক। খুব বেশি লেখাপড়ার বহর না থাকলেও জ্ঞানে গরিমায় কম যায় না।
কোন রকম দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়লেও পিতার অকাল মৃত্যুতে বিদ্যা শিক্ষা ওই পর্যন্তই। গ্রামে তার সমান লেখাপড়া করা কেউ না থাকায় সকল বুদ্ধি পরামর্শের জন্য সবাই তার কাছে ধর্ণা দেয়। ছেলে মেয়ের বিয়ে শাদী। লাশের জানাজার আয়োজন। কে অসুস্থ। সবকিছুই যেন তার কাছে খবর পৌঁছে যায়। আসলে সবাই গফর কাকার কাছে নিজের মনের কথা না বললে যেন পেটের ভাত হজম হতে চায় না।
গ্রামে গফর কাকার কথাই যেন আইন। অলিখিত আইন। তিনি যেটা না বলেন সেটা না। আর যেটা হ্যাঁ বলেন সেটা অবধারিত হ্যাঁ। এতে করে একক আধিপত্য বজায় রেখে চললেও কারো কোন অনিষ্ট যেন তার হাতে না হয় সেদিকেও নজর আছে তার। এই যে আইন কানুন তার কথায় চলে সেটারও ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। একবার গ্রামে পুলিশ হানা দিলে গফর কাকার কাছে খবর পৌঁছে যায় মুহূর্তে। তিনিও ধেই ধেই করে হাজির। তার পিছে পিছে জনা বিশ ত্রিশ লোকের উপস্থিতি দেখে পুলিশ ধন্দে পড়ে যায়। বুঝতে পারে গ্রামের মোড়ল কেউ হতে পারে। পুলিশ একটা কৌশল নেয়। গফর কাকাকে মানসিক চাপে রেখে তাদের কাজ সেরে নিবে। কিন্তু গ্রামের সবার মুখে তালা। তাদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র লোক ওই গফর কাকা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট। গফর কাকা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে একনাগাড়ে গ্রাম সম্পর্কে ধারণা দেয়। পুলিশ কোন কিছুতেই মানতে চায় না। তখন গফর কাকা ডানে বামে করে পিছনে তাকানোয় মানুষ বুঝে যায় পরিস্থিতি সুবিধার নয়। তারা গফর কাকা মুখ বিষণ্ন দেখে চিন্তায় পড়ে যায়। ততক্ষণে দুই তিন শ' লোক জড়ো হয়ে গেছে। পুলিশ সবে তিন জন। গফর কাকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ সহচর আলফু মিয়ার চোখাচোখি হতেই যেন হাজার পৃষ্ঠা কথা হয়ে যায়। আলফু মিয়া ডানে বামে তথ্য দিয়ে করণীয় বাতলে দেয়। আর তাতেই কেল্লাফতে!
সকল উপস্থিত গ্রামবাসী কাকার দিকে তাকিয়ে জোরে মুষ্টি কষে হাত উঁচিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। এই অবস্থা দেখে পুলিশ হতচকিত হয়ে গফর কাকার দিকে তাকিয়ে বলে ওদের শান্ত হতে বলেন। আপনার সাথে কথা আছে। সামনে চলেন। গফর কাকা পা বাড়াতেই লোকজন বলাবলি শুরু করে ব্যাপারটা কি?
-মনে অয় খারাপ কিছু আছে।
-আরে রাখ তোর খারাপ কিছু!
-আন্ডা কাক্কার কিছু অইলে পুলিশ হেগুনেরে যাইবেল্লাই দিমু নি!
-আগে দেয়েচ্ছা কি আবস্থা।
দেখে গফর কাকা বিষণ্ন মুখে ম্লান হাসি দিয়ে গ্রামবাসীকে বলে।
-তোন্ডা যেতে যার যার কামে যঅ। আঁর এক্কেনা থানাত যঅন লাইগতেছে।
আলফু মিয়া বলে ওঠে
-কাক্কা কোন খারাপ খবর আছেনি?
-আরে না রে!
আলফু মিয়া ও গ্রামের লোক সকলে বুঝে যায় তাদের গফর কাকা কোন কিছু লুকাতে চাইছে। সবাই নাছোড়বান্দা। কাকার কথায় কেউ বিশ্বাস রাখতে চাইছে না। আসলেই কাকা কিছু লুকাচ্ছে না তো! গ্রামের মানুষ সকলে কাকাকে ভালো করেই চিনে জানে। এতদিন এমন কোন দুঃশ্চিন্তায় তাকে দেখেনি। আজ এমন কি হলো! কাকা যেন মুখ থেকে চিন্তা সরাতে পারছেন না।


তিন.

সবার পক্ষ থেকে আলফু মিয়া গফর কাকার সঙ্গী হয়। তারা দুইজন অনেকক্ষণ অবধি হেঁটে পুলিশের সাথে নৌকা ঘাটে যায়। তারপর আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা কলের নৌকায় উঠে। নৌকা ছাড়ার ত্রিশ মিনিট পর আরেক ঘাটে ভিড়ে। নেমে পায়ে হেঁটে আরো বিশ মিনিট পর থানায় পৌঁছে। সাথে থাকা পুলিশ সদস্যরা থানার ওসি সাহেবের রুমে নিয়ে যায়। ওসি রুমে নাই। গফর কাকা ও আলফু মিয়ার মুখ শুকিয়ে যায়। উপস্থিত এক পুলিশ কনস্টেবলের কাছে পানি খেতে চাইলে মাটির একটা মগে পানি দেয়া হয়। প্রায় তিন ঘন্টা হতে চললো ওসি সাহেব আসার নাম গন্ধ পর্যন্ত নাই। গফর কাকা যতটা না অস্থির আলফু মিয়া আরো অস্থির হয়ে পড়ে।
-কিরে ভাই আমরারে ইয়েনে কিল্লাই বইয়াই রাইখছেন?
-বইয়েন বইয়েন! এত অস্থির অইয়েন না। স্যার আইলে আরো খাতির যত্ন হাইবেন।
-হিয়েন বুইঝলাম! তোই কঁত্তে আইবো আমনের স্যার?
ততক্ষণে ওসি সাহেব রুমে ঢুঁ দিয়ে পাশের রুমে চলে যায়। গিয়ে যেই তিনজন পুলিশকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিল গফর কাকাকে আনতে তাদের কাছে জানতে চায়
-বল কি খবর?
-স্যার গফর মিয়া অত্যন্ত ভালো মানুষ। তবে...
-তবে কি?
-তারে দিয়া মনে হয় এই কাজ হবে না!
-কেন হবে না?
-মনে হচ্ছে নীতিবান লোক
-নীতিবান হলে তো আরো ভালো। আমাদের কাজ ষোলআনা হবে। শুধু বাগে আনার অপেক্ষা বিড়বিড় করে বলে। যাও ডেকে নিয়ে আসো।
-স্যার সাথের জনকেও আনবো?
-না, শুধু গফর মিয়াকে
গফর মিয়া ওসি সাহেবের চোখে চোখ পড়তেই ওসি সাহেব সালাম দিয়ে বলে ওঠে
-কেমন আছেন গফর সাহেব
-জ্বি স্যার ভালো
-আরে গফর সাহেব স্যার কেন বলছেন। আমরা আছি আপনাদের সেবায়। আমাকে ভাই বলেন। আর বয়সে আমি আপনার ছোট হবো।
-তা বুঝলাম। কিন্তু আমাকে কেন ডেকে এনেছেন?
-আপনার সাথে কথা আছে। আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে আপনাদের। আগে চলেন খাওয়া দাওয়া করি।
-না আমরা বাড়িয়ে গিয়ে খাব। সবাই অপেক্ষায় আছে। চিন্তা করতে পারে।
-আরে ভয়ের কিছু নাই। আমি আপনার ভাইয়ের মতোই তো নাকি? বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-জানেন তো দেশে গন্ডগোল লাগছে?
-খবর আপনি আমাদের থেকে বেশি জানেন স্যার!
-আমরা তো দেশের মানুষের নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে আছি। জানমালের হাফাজত করি।
-জানবো না কেন স্যার।
-আরে গফর সাহেব আপনাকে একটু ভিন্ন ভাবে জানতে হবে। আমি জানাতেই এখানে এনেছি। ভাবলাম ভাই ভাই পরিচিত হবো, কথাও বলবো।
-তা বুঝছি
-বলেন তো কি বুঝছেন?
-দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে।
-উঁম উঁম অঁ অঁ না....। যুদ্ধ নয়। যুদ্ধ নয়। রাস্ট্র বিরোধী কাজ। ওসব করতে দেয়া যাবে না। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে।
-আমাদের কি করার আছে? অস্ত্র নাই গোলা বারুদ নাই!
ক্ষেপে গিয়ে ওসি সাহেব বলে ওঠেন
-রাখেন আপনার অস্ত্র গোলা বারুদ! আপনি কি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?
-না স্যার আমি দেশের হয়ে যুদ্ধ করবো।
-এই তো লাইনে আসছেন! আমি সে কথাই বলতে ডাকছি আপনাকে। আপনি দেশের হয়ে যুদ্ধ করবেন। তবে অস্ত্র দিয়ে নয়। তথ্য দিয়ে। দেশের হয়ে যুদ্ধ করবে সেনাবাহিনী। আপনি তাদের তথ্য সরবরাহ করবেন। আমরা আপনার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী করে দেব।
-কি বলেন স্যার আমরা নারী ও শিশুদের নিয়ে এমনিতেই আতঙ্কিত!
-আরে গফর সাহেব যখন আপনি রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দিবেন। আপনার অনুগত সবাই নিরাপদ থাকবে।
এই কথা বলে ওসি সাহেব একটা গাঁদা বন্দুক আর কিছু কার্তুজ দিয়ে গফর মিয়াকে যেতে বললেন। গফর মিয়া কিছু না বলে আলফু মিয়াকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আলফু মিয়া কিছু না শুনলেও বুঝতে বাকি থাকে না। গফর কাকা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মনে মনে ক্ষোভ ঝাড়ে। কিছু বলে না। ঘাটে এসে নৌকায় চেপে বসে তখনো আলফু মিয়া কিছু বলে না। ভিতরে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা তাদের গ্রামের ঘাটে ভিড়ে। দুইজনই নামে। আবার হাঁটা ধরে।
গফর মিয়া দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর আলফু মিয়ার হাতে বন্দুক দিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে যায়। আলফু মিয়া কাল বিলম্ব না করে বন্দুকে কার্তুজ লোড করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গফর মিয়া কাছে আসতে না আসতেই বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দেয়। মুহুর্তেই গফর মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই নীড়ে ফেরা পাখিদের দল ডানা ঝাপটে ওঠে। দ্বিকবিদিক ছোটাছুটি করে। আলফু মিয়া টেনে গফর মিয়ার লাশ পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়। গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। তার যেন ভার মুক্ত হয়। মন হালকা হয়। এক ধরনের ভয় কাজ করে গ্রামের লোকজন গফর কাকাকে যেভাবে পছন্দ করে। তাদের সকল কাজে গফর কাকাই ভরসা। আজ তাদের কি জবাব দিবে। আর নিজের হাতের বন্দুক দেখে মানুষ কি মনে করবে। যাক যা কিছু ভাবুক না কেন কিছু কথা মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে হবে। কিছু প্রশ্নের জবাব নীরবতা দিয়ে ঢাকতে হবে। কিন্তু তাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে শত্রু বিতাড়িত করে দেশ স্বাধীন করতেই হবে বলে পণ করে আলফু মিয়া। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে সিদ্ধান্ত নেয়। আর গফর কাকাকে হত্যা করেই তার যুদ্ধ শুরু হয়।


চার.

এদিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ রাস্তাঘাট, ব্যাংক বীমা, অফিস আদালত বন্ধ করে দেয়ার। স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই। আলফু মিয়াও যুদ্ধে যায়। এদিকে গফর মিয়া মারা যাওয়ার খবর রটে। সন্দেহের তীর আলফু মিয়ার দিকে। যেহেতু লাশ বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে পাওয়া যায়। দুইজন লোক সকাল সকাল পুলিশের সাথে গেলেও একজন জীবিত আর একজন মৃত। গ্রামের মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না তাদের প্রিয় গফর কাকার মৃত্যু। তাদের কাছে মনে হতে থাকে তারা এক বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়া হারিয়ে ফেলেছে।এখন তাদের পক্ষে কথা বলারও যেন কেউ নেই। আলফু মিয়া নীরব ভূমিকায় থাকে। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর হওয়া স্বত্বেও নীরব থাকায় মানুষের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে থাকে। কিন্তু মুখ খোলে না।
যথারীতি আলফু মিয়া যুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে পাড়ি জমায়। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণের পর সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে গেরিলা কৌশলেও রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। বেশ কয়েকবার অপারেশন সফল ভাবে সম্পন্ন করে। রণাঙ্গনের সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব অর্জন করে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে খুশির আমেজ। ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে পাড়ি জমানো সকল লোকজন দেশে আসতে শুরু করে। আলফু মিয়া বাড়িতে আসে। এদিকে গফর মিয়ার সন্তানরা সামাজিক বিচার বসায় আলফু মিয়ার বিরুদ্ধে। তারা সকলে পিতৃহন্তার বিচার চায়। আলফু মিয়া মুখ খুলতে বাধ্য হয়। গফর মিয়ার মৃত্যু তার হাতে হয়েছে। গফর মিয়াকে সে নিজ হাতে হত্যা করেছে বলে জানায়। আর গফর মিয়া দেশ বিরোধী চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখায়। আলফু মিয়ার এমন উক্তিতে সকলে বিস্ময় প্রকাশ করে। সবাই বলাবলি করতে শুরু করে গফর মিয়া শেষমেশ রাজাকারের খাতায় নাম লেখাইলো! মানুষ কটাক্ষ করতে থাকে গফর মিয়ার ছেলেদের। সামাজিকভাবে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়ে মৃত রাজাকার গফর মিয়ার পরিবার। অনেকটা বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়ে যায়। তাদের হদিস কেউ জানে না। জানে না বললেও ভুল হবে কেউ রাখে না!
দেশের পালাবদল আর সরকার পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে গফর রাজাকারের সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত শক্তিতে পরিণত হয়। আজ সমাজও তাদের কুর্ণিশ করে। সমাজের দরিদ্র অসহায় মানুষের ভরসাস্থল তারা। তাদের কথায় সমাজ উঠে বসে। তাদের মনে পূর্বের সেই ঘটনার জের কাজ করে। এখন তারা আগের যেকোন সময়ের চেয়েও শক্তিশালী। তাদের পরিবারের সকল সদস্যের ভিতর জোর আলোচনা শুরু হয়। কিভাবে পিতৃহত্যার বিচার করা যায়! যেই ভাবা সেই কাজ। তারা একদিন সামাজিক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাদের শক্তিমত্তার জানান দিতে হবে। ভিতরে ভিতরে আলফু মিয়াকে শায়েস্তা করার পণ জেঁকে বসে।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের পিতা গফর মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদানের উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের অনেক ভূঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ভাড়া করে আনা হয়। গ্রামে প্রবেশ পথের রাস্তার নাম তার পিতার নামে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নামফলকও লাগানো হয়। এদিকে অনেকটা দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলফু মিয়া এসব দেখে ফুঁসতে থাকে। যোগাযোগ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের সাথে। তারাও নিরব ভূমিকায় থাকে। রাজাকার আলফু মিয়ার সন্তানরা তাদের পিতাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করে। কোন এক তদ্বিরবাজের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার হালনাগাদ তালিকায় নাম ওঠাতে সক্ষম হয়। আর সেই তালিকা পুঁজি করে এসব কর্মযজ্ঞ চলে। মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়া দমে যাবার পাত্র নয়! মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ও এসবে খুব একটা পাত্তা দেয় না। উপরন্তু আলফু মিয়াকে রাজাকার সাব্যস্তে যারপরনাই উঠেপড়ে লাগে। আলফু মিয়ার নান কর্তন করে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে করে গফর মিয়ার ছেলেদের মনে আনন্দ আর ধরে না!
আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গফর মিয়ার নামে রাস্তার নামকরণ হবে। অতিউৎসাহীদের কেউ কেউ বলে আজ থেকে এই গ্রামের নাম 'গফর গাঁও' করা হোক। ব্যস! আর যায় কোথায় এক অনুষ্ঠানে একাধিক স্বীকৃতি এ যেন সোনায় সোহাগা ব্যাপার স্যাপার। অনুষ্ঠান শুরুর আর অল্প কিছুক্ষণ বাকী। জাতীয় পর্যায়ের অতিথিরা উপস্থিত হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা গফর মিয়ার নামে গ্রামের প্রধান রাস্তার নাম। মরণোত্তর সম্মাননা পদক। গ্রামের নাম 'গফর গাও' সবই হয়ে যায়। আলফু মিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে। স্থির থাকতে পারে না। অনেকটা অতিথিদের সামনে দৌড়ে এসে মাইক কেড়ে নিয়ে বলতে থাকে আপনারা রাজকারকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলবেন না। গফর মিয়া একজন রাজাকার। আগে থেকে ঠিক করে রাখা লোকজন আলফু মিয়ার গায়ে হাত ওঠায়। জামা ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। জেলে পুরে দেয়। জেলে বসে পত্রিকায় চোখ বোলাতেই একটা খবরের শিরোনামে লাল রঙে লেখা 'বীর মুক্তিযোদ্ধা গফর মিয়ার মরণোত্তর সম্মাননা' রাজাকার আলফু মিয়া জেলে! আলফু মিয়া খবর না পড়ে চিৎকার করে ওঠে। জেলখানার সবাই জড়ো হয়। আলফু মিয়া ভাষা হারিয়ে ফেলে। পত্রিকা নিচে পড়ে যায়। আলফু মিয়ার চোখের পানি টপাটপ নিচে পড়তে থাকে। পতিকার পাতা ভিজতে থাকে.....।

পাঁচ.

আলফু মিয়া জামিনে মুক্তি পায়। সমাজে সে এখন এক ঘৃণিত ব্যক্তি। যার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। সে কি আর স্বপ্ন দেখায় আগ্রহী হবে? এই সমাজ বাস্তবতা তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আবেগ তাড়িত না হয়ে বাস্তবের মানুষ হতে। আলফু মিয়া স্বাভাবিক মানুষের মতো করে কথা বলে খায় দায়। কিন্তু মনের ভিতর তাড়না অনুভব করে। যেভাবেই হোক এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করার।
ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাকালীন ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতার সাথে যোগাযোগ করে। নেতা সব শুনে আফসোস করে। স্বান্তনা দেয়। নিজস্ব ফান্ড থেকে কিছু অনুদান দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন আর কোন খবর থাকে না। হঠাৎ একটা চিঠি আসে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল থেকে। সেই চিঠি গায়েব হয়ে যায়। আলফু মিয়া সেই খবর জানে না। পরে একদল সাংবাদিক এসে আলফু মিয়ার খোঁজ করে। গ্রামের সেই চক্র অন্য একজন আধা পাগল লোককে আলফু মিয়া সাজিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়৷ এতে সাংবাদিকদের মনে সন্দেহ কাজ করতে থাকে। একজন জাতীয় নেতা আলফু মিয়ার ঠিকানা দিয়ে পাঠায় অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছুই বর্ণনা করতে পারে না। সন্দেহ পোক্ত হয়। সাংবাদিকরাও গ্রাম ঘুরে দেখার কথা বলে থেকে যায়। আর তখনই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়ার খোঁজ পায়।
আলফু মিয়াকে নিয়ে সাংবাদিকরা সেই নেতার কাছে নিয়ে আসে। নেতা নিশ্চিত করার পর টিভি স্টুডিও সাক্ষাৎকার তৈরি হয়। জাতীয় টিভি চ্যানেল ফলাও করে প্রচার করে। আলফু মিয়া রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। পত্রিকার পাতায় আবার শিরোনাম। এবার রাজাকার হিসেবে নয়। 'বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়ার যুদ্ধ জয়' 'গ্লানি থেকে জাতির মুক্তি'। নেতার উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংশোধন ও যাচাই বাছাই করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আলফু মিয়াকে স্বীকৃতি দেয়ার ফলে এবং গফর মিয়ার নাম বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। গফর মিয়ার সন্তানসহ গ্রামের কুচক্রীদের সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। গ্রামের সাধারণ বাসিন্দাদের তোপের মুখে তারা গ্রাম ছেড়ে যায়। আলফু মিয়ার নামে গ্রামের নামকরণ করা হবে। গ্রামের গৌরব আলফু মিয়ার আসল নাম আলফাজ হোসেন। তার নামে গ্রামের নতুন নাম হয় আলফাজ নগর। আজ যেন আলফু মিয়ার বুকের ভেতর যে চাপা কষ্ট যে চেপে থাকা পাথর সরেছে। এখন মৃত্যু হলেও তার আত্মা শান্তি পাবে। একজন রাজাকারকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো ঘৃণ্য যে কাজ চক্রটি করেছে তাদের শাস্তির শপথ নেয় মনে মনে।
মানুষ আলফাজ হোসেন প্রকাশ আলফু মিয়াকে সম্মানিত করেছে। যেখানে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফু মিয়ার যুদ্ধ জয়ের কাহিনী শুনতে উন্মুখ থাকে মানুষ। আর তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাও যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়! একদিকে দেশের জন্য যুদ্ধ! অন্যদিকে জীবন বাস্তবতার কঠিন সংগ্রাম। এক লড়াকু আলফু মিয়াকে চিনিয়েছে নতুন করে। আলিফু মিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।




লেখকঃ
গাজী তারেক আজিজ
গল্পকার
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্প

২৪ নভেম্বর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪