খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যান কমলা । বেলা প্রায় ১২ টা বাজে । আর 
কিছুক্ষণ পরেই হয়ত মেজবান এসে পড়বে । মুক্তিকে আজ দেখতে আসার কথা ! খুব ভাল ঘর । ছেলে একটি নামকরা হাইস্কুলের মাস্টার । মুক্তির বাবাও মাস্টার ছিলেন । তাই মাস্টার পাত্র কমলার খুব পছন্দ ।  আদর যত্নের কোন রকম কমতি থাকা চলবে না । মেয়েদের সুখই কমলার সুখ । তাছাড়া ছোট মেয়ে মুক্তি কমলার সাত রাজার ধন । এই মেয়ে যেমন শান্ত শিষ্ট তেমনি দুরন্ত । বাক পটুতায় ওর সাথে পারে এমন লোক সারা গাঁয়ে একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না । মুক্তির বাবাও খুব সুন্দর করে কথা বলতেন । উনি কথা বলার সময় কমলার মনে হত যেন কবিতা আবৃত্তি করছেন । গর্বে কমলার দু চোখের পানি টলমল করে উঠে ।     
মুক্তির জন্ম একটি ইতিহাস । কমলা যখন মুক্তিযুদ্ধে যান তখন মুক্তি তাঁর পেটে । সময়টা ১৯৭১ সালের মে মাস । শ্বশুর - শাশুড়িকে না বলেই এক ঝড়ের রাতে কমলা স্বামীর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । তাঁর স্বামী মনির উদ্দিন প্রথমে তাঁকে সাথে নিতে চাননি । কিন্তু কমলা নাছোড়বান্দা । দেশ মুক্তির আন্দোলনে তিনি যোগ দিবেনই  । স্বামীর পাশে  থেকেই তিনি লড়বেন শত্রুর বিরুদ্ধে । জীবন যায় যাক । কমলার সে পরওয়া নাই । মনির উদ্দিন তাঁকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছেন । বলেছেন,   
দেখ কমলা, আমি যদি যুদ্ধে শহীদ হই ; তাহলে আমার মেয়ে গুলোকে কে দেখবে ? তাছাড়া তুমি সন্তান সম্ভবা । তোমার যুদ্ধে যেয়ে তেমন একটা লাভ হবে না । তুমি মেয়ে মানুষ । তুমি গেলে বরং আমি একটা বাড়তি টেনশনে থাকব ।   
কমলা সেদিন রাগের সহিত বলেছিল, আপনি অযথাই আমাকে নিতে চাইছেন না । আমরা যুদ্ধে শহীদ হলে আমাদের সন্তানদের দেখার জন্য আল্লাহ আছেন । এই দেশের  কোটি কোটি মানুষ আছেন । দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে তারা মাথায় করে রাখবেন । আমার সন্তানেরা গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, আমাদের মা-বাবা দুজনই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন । আপনি আমাকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না । এই বলে কমলা স্বামীর দু পা জড়িয়ে ধরে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন ।
মনির উদ্দিনের বুক গর্বে এবং অহংকারে ভরে উঠে । তিনি বুঝতে পারেন এ দেশ স্বাধীন হবেই । যে দেশের নারীরা এমন বীরাঙ্গনা ; সে দেশের স্বাধীনতা কেউ রুখতে পারবে না ।   
স্ত্রীকে একটি বারের জন্য বুকে চেপে ধরেন মনির উদ্দিন । তারপর বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারে হারিয়ে যান দুজন ।  
সারারাত পথ চলেন তারা । সদর রাস্তা এড়িয়ে । ক্ষেতের আল, ডোবা, খাল- বিল পেরিয়ে সুবেহ সাদেকের সময় যশোদলপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছেন । কমলার ভাব দেখে মনে হয় একটুও ক্লান্ত হননি তিনি । সোজা চলে যান ট্রেনিং সেশনে । দুটো শুকনা রুটির সাথে এক মগ লবণ পানি । অমৃতের মত মজা করে খেয়েছিলেন কমলা । ক্যাম্পের ডাক সাইটে ক্যাপ্টেন রাহাত । তিনি কমলাকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, 
“এই মেয়েটির চোখে আগুন আছে’’ ।  
 
ট্রেনিং সফলভাবে শেষ করে কমলা স্বামীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার- আলবদরের বিরুদ্ধে । প্রথম প্রথম রাজাকার, আলবদর শব্দগুলো কমলা বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পেরেছিলেন তখন ঘৃণার আগুনে রাজাকারদের পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চাইতেন । 
 
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে যখন বিজয় হাতের মুঠোয় তখনই কমলার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাটি ঘটে । পাক বাহিনীর সাথে এক সম্মুখ সমরে প্রাণ প্রিয় স্বামী মনির উদ্দিন শহীদ হন । স্বামীর লাশ সামনে নিয়ে কমলা একটু কাঁদেননি । দেশের জন্য বিলিয়ে দেওয়া এ রক্তের প্রতিটি ফোঁটা অমর । গর্বে ও অহংকারে কমলার শোক তুলার মত বাতাসে উড়ে বেড়ায় । 
এর দুদিন পরে রাজাকার বাহিনী কমলাকে ধরে নিয়ে যায় । নির্মম নির্যাতনের শিকার হন কমলা । পাশবিক অত্যাচারের পর দুর্বৃত্তরা কমলার একটি পা কেটে নেয় । তাঁকে ফেলে রাখে রাস্তার পাশে । সেদিনের সেই বিভীষিকা আজও কমলাকে তাড়িয়ে বেড়ায় । পরদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কমলাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে অজ্ঞান অবস্থায় । জ্ঞান ফিরেই কমলা প্রসব বেদনা অনুভব করতে পারলেন । শুরু হয় জীবন আর মৃত্যুর খেলা । শত কষ্টের মাঝেও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আনন্দের ঢেউ । কমলাকে সবাই ভাবী বলে ডাকতেন । সকলের প্রিয় কমলা ভাবী আজ জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে । কাটা পা থেকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ কমলাকে অনেক দুর্বল করে ফেলে । সকলেই এক মনে আল্লার নাম জপ করছেন । 
অবশেষে ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তির জন্ম হয় । এর কিছুক্ষণ পরেই রেডিওতে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ প্রচারিত হয় । মুক্তির জন্মের পর স্বাধীনতা অর্জনের খবরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ বাঁধ ভাঙা উল্লাসে মেতে উঠেন । বাংলার আকাশে - বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে বিজয় উল্লাস ।     
০২
রান্না ঘর থেকে কমলা চিৎকার করে ডাকে, এই মুক্তি, এই মুক্তি -------
জী মা । 
তুই রেডি হয়েছিস ?
না মা । আমি রেডি হতে পারুম না । কয়দিন পর পর রেডি অইতে আমার ভালা লাগে না । 
মেয়ের কথা শুনে কমলার খুব রাগ হয় । বলে, আরে ঐ পোড়া মুখী তুই ছেলে হইয়া জন্ম লইতে পারলি না ? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে বলছি । আজ কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজবি । দেখতে যেন পরী পরী লাগে ! 
মার কথা শুনে মুক্তি খিল খিল করে হাসে । আর আনমনে কপালে লাল টিপ পড়ে ।  তাকায় আরশির দিকে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজের চিরচেনা মুখ । মনে মনে বলে, আহা কী অপরূপ ! এরই মধ্যে মুক্তির বান্ধবী ঋতুর গলা শোনা যায় । 
“কি করে মুক্তি আয় তোরে সাজিয়ে দেই” -- বলতে বলতে ঋতু দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে চমকে উঠে ।  
ওমা ! নিজে নিজেই এত সুন্দর সেজেছিস । বর তো তোরে আজই তুলে নিয়ে যাবে দেখছি !  
আকস্মিক মুক্তি ঋতুর পিঠে এক কিল বসিয়ে দেয় । আর বলে, আমার সাথে ফাজলামো করিস ? দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা ! 
ঋতু মুক্তিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ফাজলামো নারে সই, সত্যি বলছি । আজ তোরে খুব সুন্দর লাগছে । 
মুক্তির বুক ছিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে । বলে, সই তুই তো সব জানিস ! আর কতবার সাজতে হবে বলতে পারিস -----? মুক্তি আর বলতে পারে না । কণ্ঠ ধরে আসে । চোখের পানি টলমল করছে । এই বুঝি মুষলধারে বৃষ্টি নামবে । 
ঋতুর মুখে কোন কথা নেই । শুধু প্রাণের সইকে আরও জোরে বুকের সাথে বেঁধে রাখে । কিছুক্ষণ পর দুজনই কিছুটা স্বাভাবিক হয় । মুক্তির চুলের খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ঋতু আবার বলে,
সই, কোন চিন্তা করিস না । আল্লায় চাইলে এবার তোর বিয়ের ফুল ফুটবেই ! আমি তোর জন্য দোয়া ইউনুস পড়ব । দেখবি সাতদিনের মধ্যে তোর বিয়া হইয়া গেছে । একদম রাজপুত্রের মত বর পাবি ।
মুক্তি মুখে কিছুই বলে না । চুপচাপ থাকে । অনেকক্ষণ পর ঋতু আবার বলে, কিরে কথা বলছিস না যে ?
কি আর বলব ? আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকত ! তাহলে মায়ের এত কষ্ট হতো না । এই বলে মুক্তি হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে । 
আর ঋতু সান্ত্বনার ভাষা হারিয়ে ফেলে !  
০৩
গ্রামের কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী মহিলা কমলার রান্না ঘরের সামনে ভিড় জমায় । একেক জনের একেক প্রয়োজন । কেউ এসেছে কমলার কাছে সেলাই শিখতে । কেউ সেলোয়ার-কামিজ, শার্ট, প্যান্ট নিতে । আর কেউ বা ডিম কিংবা দুধ কিনতে । অথৈ সাগরে ভাসতে থাকা কমলা এই সব কুচুরিপানায় নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায় ।  
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে যুদ্ধাহত নিরুপায় কমলা জীবিকার তাগিদে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন । কারো করুণা ভিক্ষা করেননি । সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন কিনেছেন । স্থানীয় একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কাটিং, ব্লক, বাটিক ও নকশার কাজ শিখেছেন । এখন গ্রামের মানুষের জামা কাপড়ের কাজ অত্যন্ত সুলভ মূল্যে তিনিই করেন । সংসারের জোয়াল তাঁর একার কাঁধে । দক্ষ মাঝির মত তিনি হাল ধরেন ।
পিঁপড়ের মত কঠোর পরিশ্রম আর মৌমাছির মত সঞ্চয়ী মনোবৃত্তি তাঁকে স্বাবলম্বী করে তুলে । নিজে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন । কিন্তু মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করেছেন । দুজনকে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছেন । এখন মুক্তিকে বিয়ে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিন্ত । সকাল -বিকেল দুবেলা গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়ান । হাঁস মুরগীর খামার করেছেন । চারটি গাভী কিনেছেন । একজন আলোকিত ও সাদা মনের মানুষ হিসাবে তিনি সকলের প্রিয়ভাজন । 
উপস্থিত সকলকেই তিনি বিনয়ের সহিত জানালেন, আজ মুক্তিকে দেখতে আসবে । আপনারা সকলেই দোয়া করবেন । আমার মেয়ের যেন একটি ভাল ছেলের সাথে বিয়ে হয় । 
অশীতিপর বৃদ্ধা জমিলার মা বলল, 
মাগো তুমি দেইখ্যা নিও, মুক্তি রাজরানী অইব ! অমন সুন্দর শিক্ষিত মাইয়্যা এই দুনিয়াত আর একটাও নাই । 
অন্যান্য সকলেই বুড়ীমার কথার সাথে একমত পোষণ করল । কমলা বুড়ীমাকে মেহমানের সাথে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিল । কেউ কাজ শেষে গেল ; আর কেউ গেল না । সারা বাড়ি যেন উৎসবের আমেজে ভরে উঠল । 
০৪
পাশের বাড়ির কয়েকজন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে মেহমানদের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে । পাকা রাস্তা । একটু পর পর রিকশার মিছিল । অপরিচিত লোক দেখলেই তারা চিৎকার করছে । তাদের চিৎকারে রাস্তার পাশে বেঁধে রাখা ছাগলটিও ভ্যা ভ্যা করছে । অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয় । অবসান ঘটে সকলের প্রতীক্ষার । বাচ্চাদের চিৎকার-চেঁচামেচি যেন আর থামতেই চায় না । মুক্তির বুক দুরু দুরু কাঁপতে থাকে । 
কমলা আসরের নামাজ শেষে কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর দরবারে অশ্রু বিগলিত চোখে প্রার্থনা করলেন । বারে বারে স্বামীর কথা মনে হতে লাগল । মনে মনে বললেন, আপনি বেহেশত থেকে মুক্তির মাথায় হাত রেখে একটু দোয়া করে দিন । আপনার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে । আমীন, আমীন ।
উঠানের মাঝখানে মেহমানদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে । বর ও কনে উভয় পক্ষের লোকজন উপস্থিত আছেন । এক পাশের একটি চেয়ার কনের জন্য খালি রাখা হয়েছে ।
লম্বা ঘোমটা পরিহিত মুক্তিকে নিয়ে আসে ঋতু । মুক্তি আস্তে আস্তে সালাম দেয় ; যাতে বেয়াদবি না হয় ! 
ছেলের বাবা ইয়ার মাতবর মুক্তিকে বসার সদয় অনুমতি দিলেন । মুক্তি বসে কাঁপতে লাগল । আর মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল । গরু - ছাগল কেনা বেচার হাটও যে এর চেয়ে ঢের ভাল ! 
হঠাত মাতবর সাহেব ঋতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাথার কাপড়টা একটু সরিয়ে দে তো বেটি । 
ঋতু অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করল । নিজেই বুদ্ধি করে সকলকে দেখানোর জন্য মুক্তির মুখ খানি একটু তুলে ধরল । 
মাতবর সাহেব সাথে সাথে বলে উঠলেন, বাহ বাহ কী চমৎকার মাইয়্যা ! যেন আসমানের হুর ! কি বেটি, তোমার নাম কি ?
জী আমার নাম মুক্তি ।  
এ তো ডাক নাম , আসল নাম কী ?
সুলতানা রাজিয়া 
বাবার নাম কি ?
শহীদ মনির উদ্দিন মাস্টার । 
যুদ্ধের সময় যশোদলপুর মুক্তি ক্যাম্পে ছিল বুঝি ?
জী যশোদলপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ছিলেন ।  
মাতবর সাহেব একটি ঢোঁক গিললেন । তাকে একটু চিন্তিত মনে হল । এর ফাঁকে ছেলের মামা মাওলানা হুসাইন আলী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
আয়াতুল কুরছি বলতি পারবা বেটি ?
জী বলতে পারব । এই বলে মুক্তি আয়াতুল কুরছি বলা শুরু করতেই মাতবর সাহেব বললেন , থাক থাক আর বলতে হবে না । আচ্ছা তোমার মায়ের নাম কি মুক্তিযোদ্ধা কমলা বিবি ? 
জী হ্যাঁ ! 
মাতবর সাহেব কি যেন ভাবলেন । তাকে অস্থির অস্থির লাগছে । কপালে ঘামের বড় বড় ফোঁটা চিকচিক করছে । সংযত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন । মুক্তি একবার আড় নয়নে ছেলের দিকে তাকাল । খুব হ্যান্ডসাম ! নিতান্ত ভদ্র । মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না । বরও একটু পর পর মুক্তির দিকে তাকাচ্ছে । হঠাত চার চোখের মিলন ঘটে । চোখে চোখে কি যেন কথা হয় ! মুক্তির কাঁপুনি আরও বেড়ে যায় ।  
মাতবর সাহেবকে এখন খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে । কিছুক্ষণ আগের সেই অস্থির অস্থির ভাবটি এখন আর নেই । তিনি অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে বললেন , মা তুমি অহন যাও । আমি তোমার মায়ের লগে একটু কথা বলতি চাই । তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে । এই বলে পকেট থেকে একটি স্বর্ণের আংটি বের করে মুক্তির হাতে পরিয়ে দিলেন । মুক্তি সবাইকে সালাম জানিয়ে ধীর পদক্ষেপে ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল । ঋতু মুক্তির কানে কানে বলল, 
কিরে বর পছন্দ হয়েছে ? দেখে মনে হচ্ছিল তোকে যেন এখনই গিলে খাবে ! বলেই মুখ চেপে হেসে উঠল । কেন জানি মুক্তিরও মন ভাল । সেও সেই হাসিতে যোগ দিল । 
০৫
কমলার মনে আর আনন্দ ধরে না । আজ মুক্তির বিয়ে । আত্মীয়-স্বজনে সারা বাড়ি ভরে গেছে । পাড়া প্রতিবেশিরা সকলেই এসেছে । সবাই যে যার মত করে কাজ করছে । হলদি বাটা, মেন্দী বাটা, মসলা বাটা , সুপারি কাটা, পানি আনা, রান্না - বান্না ইত্যাদি সকল কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে । বরের জন্য তোরণ নির্মাণ করা হচ্ছে । মুক্তিকে সাজানো আর টিপ্পনী কাটার প্রধান দায়িত্বটা ঋতুর উপরই পড়েছে !  ঋতু মুক্তির সাথে তার বাসর ঘরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে । দুজনেই কারণে- অকারণে হেসে উঠছে ! আবার কখনও কখনও  মুক্তির মনের কোণে অদেখা বাবার কাল্পনিক স্মৃতি ঝড় তুলছে !  
 
সারা বাড়িতে ফটকা ও আতশবাজি । কিছুক্ষণ আগেই বরপক্ষ এসে পৌঁছেছে । অল্পক্ষণ পরেই খাওয়া-দাওয়া শুরু হবে । এত সুখের মধ্যেও কমলার মনে বিরহ ব্যথার রাগিনী ।এই মেয়েকে ছাড়া তিনি কিভাবে একা থাকবেন ! স্বামীর পরম প্রিয় মুখ খানি বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে । কমলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন । পরিষ্কার আকাশ । কয়েকটি চিল উড়ছে । বসত ঘরের পাশের আম গাছটায় অনেক গুলো কাক এক সাথে কা কা করছে । সব কিছু ঠিক ঠাক মত শেষ হবে তো ? এই অজানা শংকায় কমলার মন দুরু দুরু করছে ।  এই তো দেখা যায় ছাতা মাথায় কাজি সাহেব আসছেন । সাথে একজন লোক । খুব পরিচিত মনে হচ্ছে । মুক্তি ক্যাম্পের সেই আরমান ভাই না ? লোকটা আরও এগিয়ে আসতেই কমলা একদম নিশ্চিত হলেন । হ্যাঁ মুক্তিযোদ্ধা আরমান ভাই । একটা প্রশান্তির প্রলেপ কমলার সারা মন জুড়ে ।  
একটা ছেলেকে দিয়ে কমলা আরমান সাহেবকে অন্দরে ডেকে পাঠালেন । প্রথম নজরেই আরমান সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, আরে কমলা ভাবী যে !
কমলা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন ! কত বছর পর দেখা ! নিমিষেই তাঁরা ১৯৭১ সালে ফিরে গেলেন । মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তাদের দুজনকেই আবেগ প্রবণ করে তুলল । আরমান সাহেব কমলার কাটা পা টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন । তাঁর চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল । এভাবে কেটে গেল বেশ কিছু যাযাবর সময় । আরমান সাহেব নস্টালজিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসলেন । কমলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাবী, আপনার মেয়ের বিয়ে নাকি ? 
জী আরমান ভাই । সেই মেয়ে । যাকে পেটে ধরে যুদ্ধে গিয়েছিলাম । ও আমার বড় আদরের ।
আরমান সাহেব হক চকিয়ে গেলেন । তাঁর মনের ভিতরে কালবৈশাখীর ঝড় বইছে । কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন । কমলা বুদ্ধিমতী মহিলা । তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন । তাই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছেন আরমান ভাই ? 
জী ভাবী ।  বিষয়টি আপনাকে বলা আমার কর্তব্য মনে করছি । কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে বলতে দিচ্ছে না । 
আপনি বলুন । কোন সংকোচ করবেন না ।
ভাবী, যার ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে ; সেই লোকটি যশোদলপুরের সেই কুখ্যাত রাজাকার ইয়ার । আপনাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের সাথে সেও ছিল । এখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতি করে । অনেক টাকা পয়সার মালিক । ছেলেটি অবশ্য ------- 
থাক ভাই । আর বলতে হবে না । কমলার মাথায় খুন চেপে যায় । সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি ।  
০৬
কমলার জ্ঞান হারানোর সংবাদটি আউলা বাতাসের মত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে । মুক্তি মা মা বলে চিৎকার করছে । কেউ ডাক্তার আনতে গেছে । কেউ মাথায় পানি দিচ্ছে । আর কেউ তালপাতার হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে । বরও হবু শাশুড়ির সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে । ইয়ার মাতবর সাহেব লোকজনদেরকে ভিড় না করার পরামর্শ দিচ্ছেন । আরমান সাহেব কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না । নিজেকে দোষী দোষী মনে করতে লাগলেন । 
প্রায় আধা ঘণ্টা খানেক পরে কমলার জ্ঞান ফিরে আসল । তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন । কিছুক্ষণ পরে আবার চোখ খুললেন । বধূ বেশে মুক্তিকে অপরূপ সুন্দর লাগছে । হাত ধরে মেয়েকে কাছে টানলেন । কি ঝড় বুকের ভিতর বইছে কাউকে বুঝতে দিলেন না । আস্তে আস্তে উঠে বসলেন । অতঃপর অত্যন্ত দৃঢ় অথচ স্বাভাবিক কণ্ঠে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
আপনারা বিয়ে বন্ধ করুন । এ বিয়ে হতে পারে না । এ কথা বলেই তিনি আবার শুয়ে পড়লেন । 
কেউ কিছু বুঝতে পারছে না । কি ব্যাপার কি ব্যাপার বলে একজন আরেক জনের কাছে জানতে চাইছেন । বরের অবস্থা পাগল প্রায় । এ সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারছেন না । মুক্তির দু চোখ বেয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে । 
                                             ***** 
   
  
  
            
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
    
                    
        
        
            
            
                 ১১ নভেম্বর  - ২০১২ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ৫ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী