ছড়া শুকিয়ে কাঠ। ঘড়া নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে বুড়ো নংমু। পাশের জুম ক্ষেত ফেটে চৌচিড়। বৃদ্ধের মুখের বলিরেখার মত শুকনো জমিতে আঁকাবাকা চির চিহ্ন। বাঙালীর অনাদী কালের ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনাতেই নাকি পানি নেই, উৎসমুখে নানা বাধা পঙ্কিলতা। আকাশের মেঘও মুখ ফিরিয়ে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে উপরে তাকিয়েও তাই কোন সুলক্ষণ মেলে না। খালি পাত্র নিয়েই বুড়ো চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে কুটিরের পথ ধরে।
চিরহরিৎ বনেও শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস। শনশন শব্দে গাছে গাছে হাহাকার। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামে। পিয়াস নিয়েই ঘুমোতে যায় নংমু। ঘরে সামান্য জমানো পানির দু’য়েক ঢোক রাতের খাবারের সাথে মেলে। ঘুমুতে যাবার আগে পাহাড়ের গায়ে বাতাসের মৃদু গর্জনে পরিচিত ভেজা ছোঁয়া মেলে। হয়তো বৃষ্টি আসবে। রাত গভীর না অগভীর টের পায় না। চালার ছিদ্র দিয়ে মুখের উপর পড়া পানির ফোঁটার স্পর্শে জেগে ওঠে। তড়িঘড়ি ঘড়া নিয়ে বের হয়। অনেক পুরণো স্বভাবজাত শারীরিক তৎপরতা। চালের ছনছা বেয়ে পানির ধারা। আহ….শান্তির বৃষ্টি!
ঘড়ায় বৃষ্টির পানি ধরতে মগ্ন বুড়ো। কানে খুব কম শোনে আজকাল, ছোখ দুটো দেখার ক্ষমতা থেকে আন্দাজের উপর বেশী চলে। বৃষ্টির ছাটে নজর এমনিতেও খুব বেশী দূর যাচ্ছে না। এক ঘড়া ভরেছে। আরেক ঘড়া বসাতে বসাতে কোথায় যেন গুর গুর শব্দ বাজে। খুব মৃদু ধুপ ধাপ শব্দে মাথা তোলার আগেই টের পায় ঘড়ার মুখ বরাবর পানির ধারাটি বন্ধ হয়ে গেছে।
মুখ তুলে দেখে ঘরের কালো ছায়াটি নেই। বুক ছলকে ওঠে...আরে.. ওপাশের পাহাড়টি কালো ছায়া হয়ে ঝুলে আছে চোখের সামনে। ওপারের পাহাড় আর তার মাঝখানে ঘরের আড়াল কই? তার পায়ের নীচের মাটিও দ্রুত সরে যাচ্ছে।
ধ্বংসের খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে। সমতলে বন্যায় ভাসে ঘর, নাহলে ক্ষমতাশীলের দাপটে ছাড়তে হয় ছন্নছাড়া বসতি, উঁচু লোকের কাছে যার নাম নোংরা বস্তি। পাহাড়ের খাঁজে নিরূপায় আবাস গড়া ছাড়া পথ কই? বড়লোকের হাত এখানেও চালু। ঘুণ পোকার মত কুড়ে কুড়ে খায় বন পাহাড়। নিপাট পরিপাটি সবুজ পাহাড়ের রন্ধ্রে নিভৃতে পৌঁছে যায় মাটিখোরদের যান্ত্রিক কোদাল।
ঢাল বেয়ে নামতে থাকে বৃদ্ধ, বেঁচে থাকার সহজাত আকূতি! পেছনে পড়ে থাকে মাটিচাপা আধমৃতদের আর্তনাদ। সমতলে কিংবা আশেপাশের টিলার উপরে মজবুত গাঁথুনির ঘরগুলোতে শুরু হয়ে গেছে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিকাশ। প্রাকৃতিক নাকি মানবসৃষ্ট- দুর্যোগের সংজ্ঞা নিরূপণে ব্যস্ত বিজ্ঞজনেরা।
অপাংক্তেয় ভাবনা খেলে কোন অক্ষম বিদগ্ধের মনে- খরা, ঝড়, সাইক্লোন কিংবা অতিবর্ষন, সবটাতেই এই গরীবদেরই মরন। দুর্যোগের অপর নাম দরিদ্রের বিনাশ; ধনীর সাময়িক আয়েশ হানি, ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন রুচিবিলাস।
ভড়ং বাক্সে দেখা যায়, সর্বোচ্চ কক্ষে চলে নীতিনির্ধারণী তাণ্ডব বাহাস। ‘‘….কেউ নেই আক্রান্ত মানুষের পাশে’’- চলে নির্বিচার দোষারোপ। নিজে ওখানে নেই কেন- এই আত্মজিঞ্জাসা নেই কারো মনে!
পাহাড় বেয়ে নামছে নংমু। কিন্ত রাহুমুক্তির পথ যেন ফুরোয় না। লম্বা ঢালু পথে হাটতে হাটতে ক্রমেই একজন আইডল হয়ে উঠলেন তিনি। প্রতিবাদী গোষ্ঠীর হাতে মোক্ষম ইস্যু, সংবাদ মাধ্যমের জন্য আদর্শ ফটোগ্রাফ, টিভি চ্যানেলের কাছে শৈল্পিক সাবজেক্ট, পরিকল্পণাবিদগণের আঁকিবুকির ছকে উন্নত জাতের গিনিপিগ।
নেমে আসছে নংমু…..পাহাড়ের ঢালে অবিন্যস্ত সবুজ পটে একটি শীর্ণ মানবদেহ…..এটুকুতেই যেন ফ্রিজ হয়ে গেল দৃশ্যটি। দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ব গতির বিপরীত ক্রিয়ায় সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার গ্রাফ নিচে নামে হুহু করে…..অথচ নংমু স্থির, লেখচিত্রের আনুভূমিক অক্ষে যেন তার অবস্থান! জীবনযাত্রার সূচক তলানীতে ঠেকলেও নংমু কেন আকাশ উচ্চতায়? নংমু কেন নামে না? সে কী জানে না….আকাশচুম্বী শেয়ার বাজার এখন ধুলোতে গড়াগড়ি খায়! ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর কোথায় নেমে গেছে জানে না নংমু? তবু কেন সমতলে সাময়িক জলাবদ্ধতা দেখে সে দোনোমনো! মানবাধিকার, মুদ্রার বিনিময় মূল্য- এগুলোর নিম্নগতির হার কি নংমুর নীচে নেমে আসার প্রতিবন্ধক? নংমুর দ্বিধা কি দারিদ্রসীমার শৃংখল ভাঙার ব্যর্থ চেষ্টার ফল?
আকাশে গুরুগুরু মেঘের গর্জন, অতি বর্ষনে ফের পাহাড়ে কম্পন….এই বুঝি এলো পাহাড়ী ঢল, নাকি আকাশ ভেঙে পড়ে আবার মাটির পাহাড় সমেত!
হাজার মানুষের চিন্তা, সতর্কবাদ, মানবতার আকূতি জনশ্রুতি হয়ে বাজে….তবুও অবনমন বন্ধ করে কেমন যেন অবিচল নংমু, ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সংকুল পথে!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মনির মুকুল
গল্পের প্রথমে নদীর বর্ণনা পড়েই অতি পরিচিত একটি কবিতার লাইনের কথা মনে পড়ে গেল। ভারতের প্রয়াত শক্তিমান ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন- “যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান” এই ছড়ার জবাবে ছড়াকার আবু সালেহ তাঁর ‘বাহাত্তর-পঁচাত্তর ও অন্যান্য প্রসঙ্গের ছড়া’ গ্রন্থে এভাবে লিখেছেন, “পদ্মা এখন নয় বহমান বক্ষে বিশাল চর /কোথায় কীর্তি শেখ মজিবের অন্নদাশঙ্কর”।। .........বরাবরের মতই সুন্দর ও ভাবনা জাগানিয়া লেখনি।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।