ইস্পাত

বাবা (জুন ২০১২)

আদিব নাবিল
  • ২৮
  • ৮০
এক.
থপ থপ থপ….নরম একটা ভোঁতা শব্দ। হাপরের উঠা-নামার আওয়াজ। গনগনে আগুন উসকে উঠছে নাড়নকাঠির খোঁচায়। গরম হলকা, মাঝে মাঝে চোখে জ্বালা ধরানো ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে উড়ে আসছে আগুনের ফুলকি। চামড়ায় ইষৎ জ্বলুনি। কালিঝুলির মাঝে চাপ ও তাপে আবদ্ধ দুজন মানুষ। একজনের হাত যন্ত্রের মত চলমান, ঘামে তেলতেলে মুখ তামার মুর্তির মত চকচকায়। হাপরের সাথে সাথে ফোলে আর চুপসায় হাতের শীর্ণ পেশী। আরেকজন ঋজু, অচঞ্চল; অথচ ইতস্তত চালচলন।

সময়ের যাঁতাকলে আর প্রকৃতির নিয়মে সঞ্চারণশীল জ্যেষ্ঠ জন একজন কর্মযন্তর পিতা। সন্তান তার সহযোগী। কাজে হাত লাগানোর পাশাপাশি তালিম নেয় সন্তান। অপূর্ণ অপুষ্ট পেশী নিয়ে শক্তির লড়াইয়ে কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখায় তাকে।

-হাতুড়ি তোল বাপধন! আগুনে টকটইক্যা হইয়া গেছে লোহা। বাড়ি দেওয়ার এহনই সময়।’’ বাপ হুংকার দেয়। সন্তান থতমত খেয়ে প্রস্ততিতে বিলম্ব ঘটায়। কষ্টেসৃষ্টে হাতুড়ি তুলতে তুলতে মোক্ষম সময় পার হয়ে যায়।

পিতার হতাশ দৃষ্টির সামনে চিমটায় ধরা লাল হয়ে ওঠা লোহা নীলাভ বনে যায়, ক্রমে ক্রমে আদি কৃষ্ণবর্ণে ফিরে যায়।

ছেলের উপর ওঠা রাগও তেতে থাকা লোহার মত ধীরে ধীরে শান্ত নিরুত্তাপ হয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে সন্তানের দিকে তাকায় শীতলয়মান অগ্নিমূর্তি। অসম্মতি, অনীহার ভদ্রতম রূপ মুখে ফুটে আছে সেখানে। পিতার নজর ছেলের ভাবলেশহীন অবয়ব ভেদ করে। আড়াল থাকে না গোপন ইচ্ছা। পেছনে নজর যায়- এক কোণে সযতনে রাখা পুটলি দৃষ্টি এড়ায় না বাবার। পুত্রের আগ্রহের ধন জীর্ণ বই খাতার প্যাটরা ওটা। অন্তরে অনুভব করে পিতা- পুত্রধনের কাছে কামার ঘরের টুং টাং আওয়াজের চেয়ে বিদ্যালয়ের ঢং ঢং ঘন্টাধ্বনি অনেক মধুর।

-যা, বাপজান। স্কুলে যা। আর কামে আওন লাগতো না। আমি চালাইয়া নিমু।’’ পিতার শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠ কেমন যেন গমগমে শোনায়। কষ্ট এবং স্বস্তির এক অভিনব মিশ্রন।

ছেলে চেয়ে দেখে জমে থাকা টুকরো লোহার স্তুপ। এলোমেলো আকারগুলোকে গ্রহণযোগ্য করার উপরই ওদের ভাত কাপড়। যত নিঁখুত হবে যন্ত্র, যত শাণিত হবে অস্ত্র, ততটাই নিশ্চিত হবে পাতের অন্ন; ভাতের সাথে হয়তো মিলবে পেঁয়াজ লংকার অতিরিক্ত কোন পদ। বাড়তি লোক রাখার সংস্থান নেই বাবার। সে চলে গেলে পুরোপুরিই যন্ত্র হয়ে উঠবে তার আধামানব পিতা। ঠিক তাই, কয়েক মিনিট স্থানু হয়ে থাকা আকরিক লৌহমূর্তি আবার সচল হল। দম দম দমাদম…..কামার ঘর সরগরম আবার!

অল্প চিন্তার অপরিণত বালক হলেও তারও একটা পরিকল্পনা আছে, আছে নিজস্ব হিসাব। পিতার কামারের হাত যেমন ইস্পাতদৃঢ়, সন্তানের লক্ষ্যও তেমনি অবিচল। সমস্ত পিছুটান ঝেরে ফেলে বিদ্যায়তনের দিকে পা বাড়ায়।

..……..কামারের হাতুড়ি পেটায় অনেক কাঁচা লোহা পাকা হয়, বিদ্যার্থীর একেকটা বইয়ের পাতা ওল্টানোতে লক্ষ্যজয়ের একেকটি সোপান পার হয়। ব্যয় হতে থাকে পিতার জীবনিশক্তি, পাশাপাশি শাণিত হয় সন্তানের জ্ঞানের ঔজ্জ্বল্য। ক্ষয় ও জয়ের এক গল্পে এভাবে কাটে বেশ ক’টি বছর…………

দুই.
গুড় গুড় গুড়….অতি মৃদু একটা শব্দ। বায়ুশীতক যন্ত্রের আওয়াজ। মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান সৌখিন পাখার আলোড়নে শীতল হাওয়ার পরশ। বড়জন শ্যামলা, চর্চিত মুখায়ব; ছোটজনের নরম ফরসা গাল। সাজানো আধুনিক কক্ষে দু’জন আয়েশী মানুষ নিবিষ্ট কাগজের পাতা উল্টানোয়। বড়জনের হাতে বিদেশী পত্রিকা, ছোটজনের হাতে পাঠ্য বই। দারুন উচ্চারনে আবৃত্তি করছে ছেলেটি-
Under a spreading chestnut tree
The village smithy stands;
The smith, a mighty man is he,
With large and sinewy hands;
And the muscles of his brawny arms
Are strong as iron bands.

-ওয়াট ইজ ব্ল্যাকস্মিথ, পাপা?’’ ছেলের জিজ্ঞাসা।
-ব্ল্যাকস্মিথ ইজ আ পারসন…আ ম্যানুয়েল ওয়র্কার হু ক্রিয়েটস অবজেক্টস ফ্রম রট আয়রন ওর স্টিল….” বাবার তড়িৎ উত্তর।
‘‘….কামার….’’ পাশের কক্ষ হতে অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে। ছেলের কানে ঢোকে না, বাবা ঠিকই শোনে।
-তুমি কি ব্ল্যাকস্মিথ? ও নো….তুমি তো ম্যানুয়েল ওয়র্কার নও….ইউ আর আ স্টিল টাইকুন!

ছেলের কথায় স্মিত হাসেন ‘ইসলাম স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর চেয়ারম্যান বাবা। অস্পষ্ট আওয়াজটি যদিও মাথায় গেঁথে গেছে। খচখচানি বাড়ে। মৃদু পায়ে উঠে পড়েন। দরজা ঠেলে শহিদুল ইসলাম তার পিতার রুমে যান।

বিছানার সাথে প্রায় মিশে আছেন বাবা। বেডসাইড টেবিলে ওষুধের স্তুপ। পরিচর্যাকারী কেউ পাশে নেই। কাছে গিয়ে দেখেন বৃদ্ধ পিতার শ্বাস বেড়েছে।….হাপরের মত ওঠানামা করছে কর্মকার বাবার বুক!

এক্ষণি হাসপাতালে নেয়া দরকার। আ্যাম্বুলেন্স ডাকা দরকার। একের পর এক ডায়াল করে যাচ্ছেন। সব প্রতিষ্ঠান কি ঘুমুচ্ছে? দারোয়ান, আয়াকে ডাকতে যাবেন- মনে পড়লো আজ সবাই ছুটিতে! মে দিবসে আজ সকল শ্রমজীবি মানুষ কাজ থেকে বাইরে।

হাতে সময় নেই মোটেই। হতবিহবল হয়ে পড়েন তিনি। মনে পড়ে যায় পুরণো দিনের কথা। কাজ ফেলে অসহায় পিতাকে রেখে বিদ্যালয়ে যাওয়ার দৃশ্য।…থলথলে আরামপ্রিয় নিজ শরীরের দিকে একটা শ্লেষমাখা নজর দিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনের টানে ঝাপিয়ে পড়লেন।

বাবাকে পাঁজাকোলা করে ছুটলেন শহিদ। চালক ছুটিতে, নিজেও গাড়ি চালাতে জানেন না। বাইরে কোন যানবাহন নেই। সাহায্যকারী ডাকার আরো হাজারটি পথ খোলা। পরোয়া করলেন না সেগুলোর।

পা দুটো যেন চাকা হয়ে গেছে শারীরিক পরিশ্রমে অনভ্যস্ত মানুষটির। বৃদ্ধ বাবার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে…..গর্বের দৃষ্টিতে দেখেন তার ছেলের হাতের নরম পেশীগুলো কেমন পাকা লোহা হয়ে উঠেছে। এবার সময়মত সাড়া দিচ্ছে আপাত অসমর্থ ছেলের সক্ষমতা।

সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার সাথে সাথে বিড়বিড় করছে শহিদ….
Toiling,--rejoicing,--sorrowing,
Onwards through life he goes;
Each morning sees some task begin,
Each evening sees it close;
Something attempted, something done,
Has earned a night's repose.

….হাসপাতালের আলো দ্রুত নজরের আওতায় চলে আসছে। বুকের হাপর আস্তে আস্তে স্তিমিত হচ্ছে। সন্তানের বুকে নিশ্চিন্তে মাথা এলিয়ে দেন পিতা। ছেলের হৃৎপিণ্ড দমাদম হাতুড়ি পেটাচ্ছে, কম্পমান বুকের ধুপধাপ আওয়াজ আর উত্তাপে….আস্তে আস্তে শীতল হন তিনি।

(কবিতার উদ্ধৃতি Henry Wadsworth Longfellow এর "THE VILLAGE BLACKSMITH" থেকে। শ্রদ্ধা মহান কবিকে)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হাসান মসফিক খুব ভালো লাগলো ........ শুভেচ্ছা
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি onek valo akta golpo porlam.....montao changa hoye gelo........ADIB NABIL apnake suvechha...........
সিয়াম সোহানূর নান্দনিক একটা গল্প পড়লাম। সাবলীল প্রকাশ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা ভাল লাগলো। ধন্যবাদ নাবিল ভাই।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ শেষ দৃশ্যে শীতলতা ------ বড় কঠিন সত্য । গল্প জীবন দর্শনে ভরপুর । অভিনন্দন নাবিল ভাইয়া ।
রোদের ছায়া অসম্ভব ভালো লাগলো............সাথে কবিতাটির ব্যবহার চমত্কার ........মনে হলো কবিতাটিকে ভিত্তি করেই গল্পটি লেখা ..........অনেক অনেক ভালো লাগা আর শুভকামনা থাকলো ......প্রিয়তে নিলাম .......
রনীল আদিব নাবিলের স্টাইলটি বরাবরই ইউনিক, সরাসরি কিছু বলবেননা- কিন্তু দুটো সিটুইএশোন কে পাশাপাশি তুলে ধরে বাকিটা ছেড়ে দেন পাঠকের জন্য. তবে ছেলের সাথে ছোট আলাপটির পর থেকে পিতার রুমে যাওয়ার অংশটিতে কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বলে মনে হল... আমি ঠিক ব্যাক্ষা করতে পারবোনা. জাস্ট অনুভুতির কথাটা তুলে ধরলাম.
প্রিয় রনীল জহির, আপনার মনোযোগী পাঠ সবসময়েই আমাকে প্রায়ই মুগ্ধ করে। ...গল্পের ২য় পর্বে ব্লাকস্মিথ শব্দটির অর্থ বলার সময় পাশের কক্ষ হতে ‘‘...কামার...’’ অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসে। ওটা শহিদ ইসলামের কর্মকার বাবার কন্ঠ, সে কারণেই শহিদের বাবার কক্ষে যাওয়া। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হক ভাই, সবসময় মুগ্ধ করে, না প্রায়ই? :p
সবসময়ই, না প্রায়ই- সত্যিই দ্বিধায় ফেলে দিলেন! মনের দ্বিধাটি দেখুন বেখেয়ালী টাইপিংয়ের মাধ্যমে কিভাবে চলে আসলো। তা ভাই, শুধু মন্তব্য পড়লেই চলবে? গল্পটি পড়েছেন কি? পড়ে থাকলে মনের অভিব্যক্তি কি উহ্যই রাখবেন, ইফতেখার?
ম্যারিনা নাসরিন সীমা আগে একবার কমেন্ট লিখে পোস্ট করার আগেই গায়েব ! তাই আবার এলাম ! মোটের উপর অত্যন্ত আবেগ দিয়ে একটা লেখা তবে গতানুগতিক নয় । আমি মুগ্ধ বিশেষ করে পজেটিভ পরিণতিতে আর লেখা তো বরাবরের মত চমৎকার !
বরাবরের মতই কৃতার্থ, সীমা আপু।
মামুন ম. আজিজ একজন ব্লাক স্মিথ ...স্টিল টাইকুন কেমনে হয়ে উঠল সেটা জানা হলোনা। .আদিব এর লেখা বরাবরই নিঁখূত...বুনটে কোস কমতি নাই। ....ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন .....পাথর্খ্য মূলক চিত্রপট ভাল লেগেছে....ছোটবেলায় পড় কবিতাখানা খুব নষ্টালজিক ।
ব্লাক স্মিথ নিজে স্টিল টাইকুন হয়নি। প্রথম পর্বের শেষ প্যারটি যোগসূত্র উভয় অংশের।আপনার প্রশংসা আমার জন্য বিরাট প্রেরণা, মামুন আজিজ ভাই।

০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪