আনিস করমজা, বারোয়ানি, লক্ষ্মীপুর আর বায়ুসগারি গ্রামের রনাঙ্গণে হাঁটছে। দূর থেকে তাকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। মিতিল গিয়ে আনিসের পাশে দাঁড়ালো। মিতিলই পাবনার প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা। নদীর ওপারে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের সহযোগীরা কয়েকবার নদী পার হয়ে ডেমরা, হাদল, করমজা, বারোয়ানি, লক্ষ্মীপুর আর বায়ুসগারি গ্রামে ঢুকে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আনিস বললো, সামনে নদী আমাদের এগোতে হবে।
ডিসেম্বর মাস। সারা বাংলাদেশে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।
মানুষের মৃত্যু দেখে আমার ব্যথা লাগে। শরীরটা দুর্বল হয়ে যায়। তারপরেও আবার দেশের মানুষকে ওরা দেশের মানুষের সহযোগিতায় মারছে।
বাংলার মানুষের চোখে অশ্র“ দেখতে দেখতে অনেকটা সয়ে গেছে। উপলব্ধিগুলোর ভেতর নিস্তেজ যন্ত্রণাগুলো কাঁদে।
মৃত্যু দেখে বেদনা বাড়ে আবার ভুলে যাই। ওই নদীর ওপারে শত্র“দের ক্যাম্প। দেশ স্বাধীন হলে একটি ব্রীজ নির্মাণ হবে আমরা স্বাধীনভাবে ওপারে যেতে পারবো।
আনিস ও মিতিল সাথে হেঁটে যাচ্ছে। দিন শেষে রাত্রির চাঁদ আকাশে জেগে উঠছে। জোছনার আলোকধারার ভেতর প্রিয়তমার বাগানে ফুলগুলো হাসছে।
প্রকৃতি যেন বিস্ময় চিন্তাশীল নীলরঙের ভেতর থেকে আমাদের ডাকছে।
মুহূর্তে খবর এলো, ময়না গ্রামকে শত্র“রা রক্তাক্ত করেছে। শহীদনগরে অসংখ্য মানুষকে ওরা হত্যা করেছে।
আনিস বেদনায় ভারাক্রান্ত। হেঁটে যাচ্ছে নদীর দিকে; সেখানে আলোড়িত জলটুকু মর্মরধ্বনিতে রনাঙ্গণের যোদ্ধাদের সাহস যোগাচ্ছে। যোদ্ধারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। চোখের জ্বালা আর হৃদয়ের যন্ত্রণা পাগলের মতো ছুটছে। আমাদের হত্যা করে শত্র“রা আনন্দে উল্লাস করছে।
তীরের সবুজ গাছে পাখিদের আশ্রয় সেখানে ভালোবেসে যুবক যুবতী কুঞ্জবনের উদ্ভাসিত চাঁদ দেখতো।
সেখানে আজ বুলেটের আওয়াজ, মৃত্যুর আর্তনাদ, নবজাতকের করুণ বেদনা ধ্বনি। আনিস বারোয়ানি গ্রামে গিয়ে খবর দিলো, শত্র“রা হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের আক্রমণ করতে পারে তাই আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। পথে অনেক শত্র“। আমাদের দেশের অনেক মানুষ ওদেরকে সাহায্য করছে। মাঝপথে আমরা হেঁটে যাচ্ছি।
আনিস আস্তে আস্তে বারয়ানি গ্রামে পৌঁছে গেলো। মিতিল তার সাথে সারারাত্রি জেগে আছে। সবাই পালাক্রমে ঘুমিয়ে নিল। স্মৃতিময় অতীতগুলো দহনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
উত্তর-পশ্চিমের মাঝামাঝি হাদল গ্রাম। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিন তাদের কোলাহল বাতাসে ভেসে আসতো। আজকে ভোরবেলা থেকে সে কোলাহলে নীরব হয়ে গেছে।
আনিস আর মিতিল সূর্য উঠার পর হাদল গ্রামের দিকে হাঁটতে লাগলো। সারারাত নির্ঘুমে থাকার কারণে মাঝে মাঝে চোখে ঘুম আসছিল। স্কুলের কাছে গিয়ে পৌঁছালাম। দেখলাম, কেউ জীবিত নেই। মেঝেতে চাপ চাপ জমাট রক্ত। শিশু কিশোর আর নারী-পুরুষ গড়াগড়ি শেষে ঘুমিয়ে আছে। মনে হচ্ছে উলঙ্গ যুবতী মেয়ে আর শিশুরা স্বদেশের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় মাথার মগজ পড়ে আছে। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হাত পা ছিঁড়ে ছুটে পড়ে আছে। একটি শিশুর হাতে রক্তাক্ত একটি চিঠি বাতাসে উড়ছে। আনিস চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো।
এখন গভীর রাত, তুমি ফিরে আসোনি বাবা। মা আর আমি জেগে আছি। বিস্কুট কিনে দেওয়ার কথা বলে চলে গেলে আর ফিরে এলে না। শুনেছি তুমি দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছো। আমি আর মা খুব খুশি হয়েছি। দেশ স্বাধীন হলে তুমি পতাকা হাতে ফিরে এসো। অন্তরের বন্ধনে ভালোবাসা নিয়ে আমরা তোমার জন্য জেগে থাকবো। তুমি এসে জাতিকে অধিক সৌরভ দিবে।
সাহসী নবজাতক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে উঠবে তোমার ফিরে আসা দেখে। তোমাকে বুঝে নিতে হবে। তোমার লাল গামছা আর একটি লুঙ্গি আমি যতœ করে রেখেছি। মায়ের কানের দুল আর নোলকটি হারিয়ে গেছে।
তোমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে কয়েকদিন আগে মাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। মা আমার জন্য খাদ্যের সন্ধানে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। শুনেছি স্বাধীনতা বিরোধীরা মাকে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে।
চিঠিটা কিভাবে তোমার কাছে পৌঁছে দেবো বাবা?
চিঠিটা পড়ে মিতিল আর আনিস বেদনায় ক্লান্ত হয়ে পড়লো। দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি এ-এক গভীর প্রেম। পবিত্র মিলনের আগামী ফসল। যেন নতুন বীজ থেকে অঙ্কুরিত হচ্ছে নতুন চারাগাছ। সাহসী নবজাতক তা থেকে খাদ্য গ্রহণ করছে নতুন আলোকিত দিনের সন্ধানে। সেই দৃশ্য দেখার পর আমি আর আনিস ফিরে এলাম বারোয়ানি গ্রামে।
আনিস তার নিজের কাছে চিঠিটা রেখে দিল। চিঠির চারপাশ লাল রক্তে রঙিন হয়ে গেছে। বারোয়ানি গ্রামে থমথমে অবস্থা। কখন যেন মিলিটারী হানা দেবে। দেশের অসংখ্য মানুষ এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে।
সহসা কারা যেন চিৎকার করে বলছে, মিলিটারি! মিলিটারি! পালাও। মানুষ ভয়ে দিকবিদিক ছুটছে। মনে হলো আমাদের বুকের উপর এক বিশাল পাহাড় এসে চাপা দিচ্ছে। পা’দুটি যেন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।
গুলির শব্দে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে। দূর থেকে বুটের শব্দ কর্ণকে ক্লান্ত করে তুলছে। লাল হয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রান্তর। কয়েকটি মেয়ে মানুষ আর শিশুর চিৎকার। মানুষ পালাচ্ছে মিতিল আর আনিস দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বুঝতে পারছেনা। একসময় আর্তচিৎকার আর গুলির শব্দ থেমে গেলো।
আমরা দু’জন বারোয়ানি গ্রামে প্রবেশ করলাম। দেখলাম লাল ফিতে পড়ে একটি কিশোরী ঘুমিয়ে আছে। পাশে দারা মিয়া আর চাঁদ আলীর লাশ পড়ে আছে। খবির উদ্দিনকে ওরা অনেক দূর টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে।
এ-এক হতবিহ্বল যন্ত্রণা। সামনেও পেছনে অন্ধকার। আকাশের চাঁদটি অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। মৃতদেহের ¯ু‘পে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে।
কোন দিকে আগাবো ভেবে পাচ্ছি না। কয়েকটি কুকুর ক্ষুধায় চিৎকার করে ডাকছে। তার মালিককে অচেনা লোক এসে হত্যা করে গেছে। শিশু কিশোর আর নারীর আর্তনাদ। কেউ মা মা কেউ বাবা বাবা বলে ডাকছে।
তারপর নীরব নিস্তব্ধ। মিতিল আর আনিস আকাশের দিকে তাকালো। সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। চারপাশে শুধু অন্ধকার। সামনে নদী, একটি ব্রীজ হলে আমাদের যাতায়াত সহজ হতো। আমরা সহজেই দেশকে মুক্ত করতে পারতাম। নদীর পাশের সবুজ একটি বন। ছোট একটি ঘরে আমরা কয়েকজন থাকি। আর সময় মতো শত্র“দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি । আজকে আক্রমণে আকতার আর সামছুল শহীদ হয়েছে।
মৃত্যুর আগে সামছুল তার মাকে দেখতে চেয়েছিল। আমরা বেঁচে আছি তিনজন। সকালে মঙ্গলগ্রাম, আতাইকুলা, ডেমরা, ফরিদপুর, দিঘুলিয়া থেকে প্রায় ৪৯ জন এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তার মধ্যে দুইজন কিশোর, তিনজন নারী।
গতকাল ছিলাম আমরা সবাই অপরিচিত। শুধু যুদ্ধের জন্য দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে আমাদের সাথে নতুন মুখের চেনা জানা হলো।
আমরা পাঁচজন আর সাতজনে বিভক্ত হয়ে আলাদা জায়গায় অবস্থান নিলাম। শত্র“রা আসলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরবো। রাতের আঁধারে অস্ত্র হাতে করে শত্র“দের সন্ধান করি। মনে হয় অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক হয়ে আমাদের সাথে হাঁটছে। জগৎ যেন এক নিপুণ যোগাযোগের মধ্য দিয়ে আমাদের একে অপরকে পরিচয় করে দিচ্ছে। নদী থেকে মাঝির গান ভেসে আসছে। মৃত্তিকার বুকে ক্লান্ত ফুল ব্যাকুল পিপাসায় ফুটে আছে। প্রজ্জ্বলিত এক নতুন সকালের আহবানে।
আমরা একজন আরেকজনের জীবন নিয়ে আলোচনা করি, সুখ দুঃখের কথা বলি-মা কেমন আছে? বাবা কেমন আছে? ছোট ভাই বোনেরা কি করছে? প্রতিবেশীদের সাথে বহুদিন দেখা হয় না। মা’র ঔষধ লাগবে কিনা জানি না। বাবার পায়ের ব্যথাটা আবার দেখা দিয়েছে কিনা? আমরা কিছুই জানি না।
গতকাল পাবনা শহরে সাধারণ মানুষ আর মিলিটারিদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে।
যুদ্ধ করতে করতে মিলিটারিদের রাইফেলের গুলি শেষ হয়ে গেলে একশত বিশ জনের মতো মিলিটারির মৃত্যু হয়। সত্তরজন ঈশ্বরদীর পথ দিয়ে বাঘা হয়ে রাজশাহীতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
প্রায় সব মিলিটারিই জনগণের হাতে ধরা পড়েছে। জনগণের হাতে থাকা লাঠি, দা, কুড়াল, শরকি, টাঙ্গিসহ যার হাতে যা আছে তাই দিয়ে আক্রমণ করেছে। কেউবা হাত কেটে নিয়ে যাচ্ছে কেউ পা কেটে নিয়ে যাচ্ছে কেউবা কুপিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করছে। সবাই পাগলের মতো ওদেরকে গালাগালি দিচ্ছে বলছে, আমাদের দেশ নিবি? আমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবি? আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিবি?
একদিন না একদিন তোরা ধ্বংস হবি। সেদিন কেউ তোদের সাহায্য করবে না।
পরদিন রাত্রি ঢাকা থেকে মিলিটারি আসা শুরু হলো। নগরবাড়ি ঘাটে রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে মিলিটারিদে বিরুদ্ধে সারাদিন যুদ্ধ হল। সেখানে মিলিটারিরা যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে হত্যা করছে, ধর্ষণ করছে, লুটপাট করছে। আতঙ্কে মানুষ দিকবিদিক ছুটছে।
সাতকোটি মানুষ: কতজনকে ওরা হত্যা করবে। মহেন্দ্রপুরে এক যুবককে হত্যা করেছে রাঘবপুরের মোড়ে এক রিক্সাচালকের লাশ কয়েকদিন ধরে শেয়াল কুকুরে খাচ্ছে। জনশূন্য শহর। সারাক্ষণ মানুষ পালাচ্ছে এক গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। শহরের মানুষ নৌকায় আশ্রয় নিয়েছে। নদী পার হয়ে গ্রামে যাবে।
শহরে আগুন জ্বলছে মাথার উপর কয়েকটা বিমান বোমাবর্ষণ করছে। আমরা মফস্বল শহর সাঁথিয়া থেকে খবর পেলাম। শহরে এখনো আগুন জ্বলছে। শহরে দলের আদর্শ লংঘন করে কিছু সংখ্যক মাওবাদী মিলিটারির সাথে হাত মিলিয়েছে। কুকুর আর শিয়াল শহরে ঘুরছে। মানুষগুলোকে খাদ্য হিসাবে ভোগ করছে।
শিশিরের কান্না থেকে বেদনার অশ্র“ ঝরে পড়ছে। লজ্জায় ঢেকে যাচ্ছে জ্ঞানের দরজা। নৈঃশব্দের পরিত্যাক্ত কোলাহল থেকে মৃতরা আমাদের সাহস দিচ্ছে। তাই আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের পথে হেঁটে যাচ্ছি। মহাকালের ইতিহাস থেকে পৃথিবীর বুকে আরেকটি নাম লেখা হবে সে আমাদের স্বাধীন: বাংলাদেশ। যে মাটি থেকে শান্তি-সৌন্দর্য আর প্রেমের বন্ধনে মানুষ কল্যাণ ছড়াবে। যুদ্ধের সাফল্য থেকে মানুষ সম্মান আর জ্ঞান অর্জন করবে।
মিতিল আর আনিস সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নদীর দিকে হাঁটতে লাগলো। ওপারে মিলিটারি ক্যাম্প।
ওই ক্যাম্প থেকে ওরা দালালদের সহযোগিতায় গ্রামে গ্রামে অত্যাচার করে। মেয়েদের ধরে নিয়ে আসে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিগুলো রাইফেলের গুলির ভয় দেখিয়ে জোর করে নিয়ে আসে।
আনিস বললো, দুই একদিনের মধ্যে হয়তো আমরা ওদের কে আক্রমণ করবো। আমাদের হাতে আরো কিছু শক্তিশালী অস্ত্র আসলে আমরা আঘাতটা সহজে করতে পারবো। মিলিটারিরাও পরাজিত হবে।
আজ আনিসের ছেলেবেলার কথা মনে পড়েছে। জহুরা বিভা তার প্রিয় বন্ধু ছিল।
জহুরা বিভা এখন কলেজে পড়ে। যুদ্ধের কারণে কোন অচিন গ্রামে বাবা-মার সাথে পালিয়ে আছে জানিনা। বেঁচে আছে কি মরে গেছে কিছুই জানিনা। তার স্মৃতিগুলো মনকে নদীর ঢেউয়ের মতো উথাল-পাতাল করছ্।ে মেঘমালার ভেতর থেকে প্রবাহমান বাতাস এসে আমাকে জহুরা বিভার কথাগুলো বলে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে মেঘের ভেতর থেকে জহুরা বিভা মৃদু হেসে বলছে মৃত্তিকার দিকে তাকাও যেখানে আমার অশ্র“জল ঝরে পড়ছে আর সেই জল থেকে উষ্ণ বীজগুলো নতুন চারাগাছের জন্ম দিচ্ছে। দেশ স্বাধীন হলে আমরা মিলিত হবো। আমাদের নতুন শস্য খামারে আজ দুঃখ আর আনন্দগুলো পৃথক হয়ে গেছে। কিন্তু এ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অবশ্যই আমরা জিতবো।
তখন মধুময় জীবন আর স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দেবো। জীর্ণ কুটিরে জেগে আছে মা। সংগ্রাম আর প্রচন্ড ক্ষুধা বুকে নিয়ে বলছে, তুমি সাহসী হয়ে ওঠো প্রিয়পুত্র। প্রচন্ড ঝড় আর কালোমেঘগুলো ফিরে দাও।
বাংলাদেশের মাটিতে আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিবিসি থেকে দেশের খবর শোনা যাবে। আজকে সারাদেশ থেকে দালালদের সহযোগিতায় অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের শত্র“রা হত্যা করেছে । এই খবর ভেসে আসছে নির্জন প্রকৃতি উষ্ণ আর বাতাস ভেদ করে।
হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ, ভয়াবহ গর্জন প্রকম্পিত মাটি মানুষের চিৎকার ধ্বনি পশুগুলোর মায়ের স্নেহের গভীরে লুকানো শিশুর কান্না। নদীর ওপার থেকে মিলিটারি আর দালালরা আমাদেরকে নিশানা করে এগিয়ে আসছে।
আনিস সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললো। সবাই দেশের জন্য রনাঙ্গণে যুদ্ধ করতে লাগলো। প্রচন্ড যুদ্ধ। সামনে সীমাহীন আকাশ আর বিশাল নদী। মাঝে মাঝে বৃক্ষ-তরুলতায় ঘেরা ছোট-ছোট গ্রাম।
ডেমরা গ্রাম আগুনে জ্বলছে মিতিল আনিসকে বললো, কেন যুদ্ধ করছি? আনিস বললো, মাতৃভূমির জন্য। স্বাধীনতার জন্য। দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য।
ভাবলাম আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক বার দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করেছে। আবার নতুন করে আমরা লড়াই করছি। ভবিষ্যতে আমাদের বংশধররা আগামী নতুন যুদ্ধের জন্য লড়াই করবে। এভাবে শুধু রক্তপাত প্রতিশোধ আর প্রতিরোধ। বিনিময়ে আমাদের উত্তরসূরিরা কী শুধু যুদ্ধই করে যাবে? আমরা আজ যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।
আমাদের ভুলে তারাই আবার আমাদের দেশের মন্ত্রী এম.পি হতে পারে।
আনিস বললো, তাই যদি হয় তবে আমরা লড়াই করছি কেন? যারা
আমাদের দেশ চায় না কিন্তু তারাই যদি বহুবছর পরে পুনরায় দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই যুদ্ধের অর্থ কি হবে? এই স্বাধীনতার অর্থ কি হবে? এই রক্তের মূল্য কে দেবে?
যুদ্ধ চলছে মুখোমুখি। অনেক শত্র“কে খতম করা হয়েছে। আমাদের মাঝ থেকে আকতার, মহসিন, শিহাব, সামাদ, মোকছেদসহ আরও অনেকেই শহীদ হয়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের জন্য বাতেনসহ অনেকেই রাতের খাওয়ার নিয়ে আসবে। অনেকেই প্রতিদিন আমাদের খাদ্য সংগ্রহের কাজে লিপ্ত থাকে।
আনিস বললো, তবে কি আমাদের উত্তরসূরিরা শুধুমাত্র আমাদের ইতিহাস দুঃখ যন্ত্রণাগুলোকে নিয়ে ভাববে। কারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে? কারা আমাদের মা-বাবা ভাই-বোনকে-ধরে নিয়ে গিয়েছিল? কারা আমাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল কারা আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল?
আমি বললাম, হ্যাঁ, শুধু এটাই ভাববে। তারপরও পরাজিত শক্তিধররা আমাদের ইতিহাস মুছে দিতে চাইবে। আমাদের উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করবে। আর এভাবে যুদ্ধ চলতেই থাকবে।
আনিস বললো, তবে কি এতো রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে শুধু শুধু আমরা শহর আর গ্রামে ফিরে যাবো? যারা বেঁচে আছি তারা না হয় ফিরে গেলাম; কিন্তু যারা দেশের জন্য শহীদ হয়েছে তাদের জন্য কারা এসে দাঁড়াবে? যারা আসার কথা বলে ফিরে আসেনি তাদের বংশধররা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
মিতিল বললো এর নামই স্বাধীনতা। এভাবেই স্বাধীনতার জন্ম হয়।
তারপর আমি আবার বললাম, আমাদের সবাইকে নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। নিজের সত্ত্বার ভেতর যে-আঁধার লুকিয়ে আছে তার সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত করতে হবে।
তবে নিজের দেহের ভেতর কল্যাণের আলো জ্বলবে আর জাতি সমৃদ্ধ হবে। তখন উত্তরসুরিরা সত্যিকার স্বাধীনতা পাবে।
আনিস নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রচন্ড গুলির শব্দ। একটি ব্রীজ হলে নদী অতিক্রম করা যেত। ভাবতে ভাবতে শত্র“দের একটি গুলি এসে আনিসের দুটি চোখ ভেদ করে চলে গেলো।
মুহূর্তে আনিস অন্ধকার দেখতে পেলো। পরের দিন স্বদেশের ভূমিতে নতুন সূর্য উঠেছে। কিন্তু আনিস তখন অন্ধ।
এখনো মাঝে মাঝে মিতিল আর আনিস ওই নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়াই। আনিসের হাতে থাকে সেই কিশোরের চিঠি। তার বাবা ফিরে আসলে চিঠিটা পৌঁছে দেবে। ব্রীজটি নির্মাণ হলে একদিন ব্রীজের উপর দিয়ে জহুরা বিভা ফিরে আসবে কিনা জানিনা? দূর প্রতিধ্বনির শব্দ আমার কানে কানে গোপনে বলে দিয়ে যায় রাজাকাররা তোমার জহুরা বিভাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছেÑআমি তখন মনে মনে ভাবি হয়তো জহুরা বিভা বীরঙ্গনার বেশে এই মাটিতে ফিরে আসবে। সেই নদীতে আজো ব্রীজ হয়নি!
তীরে দাঁড়িয়ে আনিস আরও ভাবে, আমরা একটি স্বাধীন ভূখন্ড পেয়েছি। ব্রীজটা তৈরি হলে আমরা হয়তো নতুন করে অর্থনৈতিক মুক্তি পাবো। ওই কিশোরের পিতা বেঁচে থাকলে হয়তো এই ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে এসে দাঁড়াতো আর আমি তার প্রিয় সন্তানের চিঠিটা তার কাছে পৌঁছে দেবো...।
২১ অক্টোবর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৯৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪