গত দুই দিন হলো লতার মনটা ভালোনা। শুধু অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে। মামুনের সাথে তার পূর্বের স্মৃতিগুলো ধরে রাখার তেমন কোন ছবি নাই। সেই প্রথম বিবাহিত জীবনের মাত্র একটি বা দুটি ছবি আছে। ছবিগুলো গতকাল ওয়াশ করতে দিয়েছি। মন খারাপের জন্য দুই দিন স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। ছুটির মধ্যে লতার কিছু কাজ মামুনের করে দেওয়ার কথা। মামুন দুই এক দিনের মধ্যে কাজগুলো করে দেবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। লতা সকাল ১১টার সময় বড় মেয়ে মিমকে নিয়ে শহরে যায় এবং বিউটি পাল্লারের কাজ শেষ করে বাড়ীতে ফেরার পথে সাহারা ক্লাবের সামনে মামুনের সাথে দেখা হয়। মামুন বললো কোথায় গিয়েছিলে। লতা বললো বিউটি পাল্লারে। কথাগুলো শুনে মামুন মনের গভীর থেকে একটু গম্ভীর বিচিত্র হাসি দিলো। লতা বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে রান্নার কাজ করতে যায়। নিস্তরঙ্গঁ সূর্যের আলো রান্না ঘরের জানালা ভেদ করে লতার শরীরে এস লাগছিল। দিনের স্বপ্নগুলো কর্মের মাঝে রূপান্তর হচ্ছিল। নিঃসঙ্গঁ ভালোবাসার অতীত দিনগুলো লতার মনকে বেদনায় বিরহ করে তুলছিল। হঠাৎ মোবাইলের রিং টন টন করে বেজে উঠলো। লতা মোবাইল স্কীনে দেখলো ছোট বোন তানির নাম। তানি রিং করেছে। মোবাইল উঠাতেই লতার হাতটি ভার হয়ে উঠলো। কেন যেন দেহের ভেতর বেদনার ঝড় উঠলো। তানির কন্ঠে কান্নার শব্দ দুলাভাইকে কারা যেন গুলি করেছে, তুই তারাতারি হাসপাতালে যা। আকুল বেদনার এক সমুদ্র ঢেউ এসে লতার মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুললো। লতা ছুটে গেলো হাসপাতালের দিকে, সাথে মেয়ে মিম আর জিম। ছয় মাসের শিশু সন্তানটি বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে। হাসপাতালের মর্গে মামুনের মৃত দেহটি পড়ে আছে। লতা নির্বাক নিস্তব্ধ। মেয়ে দুটি বাবার শরীর জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করছে আর বলছে বাবা তুমিতো খুব ভালো মানুষ ওরা তোমাকে হত্যা করলো কেন ? লতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো আর চিৎকার করে বললো তুমিতো আমার দুঃখ সহ্য করতে পারোনা, আমি কাঁদছি আর তুমি চুপ করে আছো, জেগে ওঠো দেখো আমার সাথে তোমার সন্তানরা সবাই কাঁদছে। মানুষের কোলাহল বেদনায় হাসপাতাল ভারি হয়ে উঠেছে। বিপন্ন পৃথিবীর মাঝে লতা যেন একা বধির বাকশক্তিহীন। নিঃশব্দ আকাশ নিস্তব্ধ বাতাস সুখ দুঃখের খেলা করছে। রাতের মধ্যেই মামুনের দাফন সম্পন্ন হয়ে গেলো। লতার বহুদিনের ভালোবাসা মুহুর্তে ইতিহাস হয়ে গেলো। যার হাত ধরে দীর্ঘ জীবনের সংসার বেঁধেছিল সেই মানুষটি আর নেই। নিশি রাত পার হয়ে কালো আঁধার যেন নিশীথ রাতের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সীমাহীন আকাশের বুকে নক্ষত্রগুলো জ্বলচ্ছে। দীর্ঘ দিনের স্মৃতিভরা পরিচিত জানালা ধরে লতা দাঁড়িয়ে আছে। মহা-আতœজগতের এক ক্ষুদ্র অণু পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে। বাস্তবতার রূপান্তরে এক অপরিপূর্ণতা লতাকে বিরহ বেদনায় ব্যাকুল করে তুলেছে। বড় মেয়ে মিম মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো বাবাকে ওরা হত্যা করলো কেন মা ? বাবার তো কোন দোষ ছিল না। তবে শুধু শুধু কেন বাবাকে মরতে হলো। মা বললো এটাই আমাদের সমাজের এক বাস্তব প্রেক্ষাপট। মেয়ে বলল বাবাকে যারা হত্যা করলো তাদের বিচার হবে না ? মা বললো হয়তো হবে হয়তো হবে না। মেয়ে বললো কেউ বিচার না করলেও আমি লেখাপড়া করে বড় আইনজীবী হবো, তারপর আমার বাবার হত্যার বিচার করবো। মা একটু নিঃশব্দ ক্লান্ত কন্ঠে বললো তুমি তো লেখা পড়া শিখে বড় হও মামনি। জিম আর হামীম ঘুমিয়ে আছে। নিঃসঙ্গঁ নগরীর দীর্ঘ বেদনা তাদের শরীরে এসে জমা হচ্ছে নিষ্কান্ত এক অনুভূমির বিরহে। লতাকে জড়িয়ে ধরছে নীল নদীর ব্যথাভরা স্মৃতিগুলো। হৃদয় যেন ভালোবাসার কথা বলতে চায়। উৎফুল্ল মহৎ প্রেমের বাস্তবতায় যেখানে মামুন এসে দাঁড়াতো। আজ সেখানে নৈঃশব্দের রহস্যে মলিন। মিম দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাকে বললো বাবাতো রাজনীতি করতো আর রাজনীতি করার কারণে তাকে জীবন দিতে হলো। বাবা বেঁচে থাকলে আমরা তিন ভাইবোন ভালোভাবে লেখা পড়া করতে পারতাম। আমাদের অন্ন বস্ত্রের তেমন অভাব হতো না। মা করুন বেদনায় মুখ তুলে বললো ওই যে উপরে যিনি বসে আছেন তিনিতো সবাইকেই দেখেন কিন্তু বাবা যে দলের হয়ে রাজনীতি করতো তারাতো এখন ক্ষমতাসীন তারা দেখবে না। মা বললো হয়তো দেখবে, হয়তো দেখবেনা। তাদের মনে সমবেদনা থাকলে হয়তো দেখবে। মিম বললো তাহলে রাজনীতি করতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করবে তাদের সন্তানরা মানুষ হতে পারবেনা। মা বললো তাদেরকে নিজের সামর্থ দিয়ে দুঃখ কষ্টের মধ্যে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন আর সমাজের সংগে যুদ্ধ করে দাঁড়াতে হবে। মিম বললো মা তুমি যদি পাশে থাকো তাহলে অবশ্য মহান আল্লাহ আমাদেরকে জ্ঞান দেবে। আমরা নির্মাণ করতে পারবো নতুন পথ। গভীর রাতের আঁধারে ক্লান্ত পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে। নৈঃশব্দের দীর্ঘ বেদনায় ভাসমান প্রবালের উপর জেগে উঠেছে সৌন্দর্যভারা প্রেমের স্মৃতিটুকু। মামুন হয়তো জেগে উঠবে অনন্ত স্মৃতির বিদগ্ধ প্রেমে। লতাকে ডাকবে প্রিয়তম প্রজ্বলিত আলোর সাথে মিশে। মা মিমকে বললো ঘুমাতে যাও। আগামীকাল সকালে স্কুলে যেতে হবে। মিম বললো চোখে ঘুম আসে মা। একা একাই সে তাকিয়ে থাকে নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করে। অনাহারী মানুষগুলো যেমন দিন আনে দিন খায় মা। আবার কেউ কেউ দিন রাত অভূক্ত অনাহারে থাকে। নির্যাতিত মানুষের জীবনে হাজারও প্রশ্ন খেলা করে, কিন্তু কেউই উত্তর দিতে পারে না। নৈঃশব্দের এক কালো আঁধার জাতিকে ঘিরে ধরেছে। ভন্ড বুদ্ধিজীবী পন্ডিতরা গরীবের রক্ত চুষে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খাচ্ছে। আর গরীবরা দুঃখ কষ্টে মর্মাহত দিন কাঁটাচ্ছে। তাই আমাদের প্রিয় এই দেশ আর প্রিয় শস্যের মাঠ বড়ই অসহায় একা একা হয়ে পড়েছে। নিশীথ রাতে আচ্ছন্নতার ভেতর ধ্বস্ত বাদুড়গুলো উড়ে উড়ে পাকা ঝাপটাচ্ছে। অশ্র“র তটে ধ্বংস আর মৃত্যুরা জীবনের সাথে আলিঙ্গন করছে। ক্ষুদার্ত শরীর থেকে অধর্ম আর অত্যাচার জেগে উঠছে। এমন সময় জিম আর হামিম ঘুমিয়ে আছে। অনন্ত শক্তির উপর বিশ্বশক্তি নির্ভর করে মহাসৃষ্টিজগত ঘুরছে। পরম সত্তার সুমহান সত্তা থেকে আলো আর জ্ঞান দিচ্ছে। আবার স্তরে স্তরে ইহজগত আর পরজগতের অন্ধকার এসে ঢেকে দিচ্ছে এবং বোধের বিবেককে। ভোর হয়ে গেছে আযানের ধ্বনিতে মধুময় হয়ে উঠেছে শহরের প্রান্তর। চেতনায় জাগ্রত হচ্ছে আঁধারের বিবেক। মহান স্রষ্টার স্তুতিমধুর নামে। কিছুক্ষণের মধ্যে হামিম জেগে উঠবে। বাবার মৃত্যুর পর অনেক দিন হামিম ভালো করে ঘুমাতে পারেনি। গভীর রাতে ওর ঘুম ভেঙে গেলে একা একাই বাবাকে খোঁজে। প্রিয় সন্তান এখনো বুঝেনি তার বাবা আর কোন দিন ফিরে আসবে না। প্রত্যাশার নতুন আগামী তাকে আর কেউ বাবার মতো মমতা দিতে পারবেনা। আস্তে আস্তে ভোরের আকাশ ভেদ করে প্রজ্বলন্ত অগ্নিগোলক জেগে উঠছে, নিঃসঙ্গঁ অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত মুছে দিতে। মিম আর জিম সকালের নাস্তা শেষ করে স্কুলে যায়। স্কুলের ক্লাস শেখ করে ফেরার পথে মিম আর জিম এর সহপাটি প্রভা আর মানিকের সাথে দেখা হয়, ওরা দুই ভাইবোন আজ স্কুলে আসতে পারেনি। ওদের মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা তেমন ভালো ব্যবহার করে না। স্নেহের মমতা দেয় না। আজ রাতে সে আবার নতুন বৌ নিয়ে এসেছে। ওরা দুই ভাইবোন এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ওদের সৎ মা যদি ত্যাগী বা মমতাময়ী না হয় তা হলে ওরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। প্রভা আর মানিক বললো তোমরা আমাদেরকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে। মিম আর জিম আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষ্যত্বের অন্তকরণ দিয়ে ভাবতে লাগলো। কত দুর এই পথ কোথায় আমাদের গন্তব্য আর কত দিন পরে আমরা গৌরবের নতুন সকাল দেখবো। জিম বললো আমি আজকে বাড়ি গিয়ে তোমাদের কথা মাকে বলবো। বাড়ি ফিরে মিম আর জিম মাকে কোন কথা বললো না। রাত্রি লেখাপড়া ও খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুই বোন বারান্দার ওপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জিম বললো আপা আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে আমাদের সহপাটি প্রভা আর মানিকের অবস্থা দেখে আমার অন্তর থেকে অশ্র“ ঝরেছে। ওদের মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, বাবা অন্য মেয়েকে বিবাহ করে এনেছে। ওদের জীবন এখন ভেঙ্গেঁ চুড়ে না যায়। জিম বললো বাবা যদি ভালো হয় তবে বড়ই ভালো ওরা জীবনে দাঁড়াতে পারবে। জিম ক্লান্ত চোখে বললো হামিম ঘুমিয়ে আছে। জেগে উঠলে বাবাকে খুঁজতে থাকবে। ওতো বোঝেনা বাবা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। বাবার মৃত্যুতে বিষাদ দুঃখের এক সাগর আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে এই অথৈই সাগর পাড়ি দেবো। মিম বেদনায় বিষাদ ভরা মুখ আর চোখ উপরের দিকে উঠিয়ে বললো মা যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায় তবে আমরা কি ভাবে এই দুঃখের পথ অতিক্রম করবো। কোথায় হবে আমাদের এই গন্তব্য। জিম বললো মা কখনোই আমাদের ছেড়ে চলে যাবে না। মাকে সাথে নিয়েই আমাদেরকে জীবন সংগ্রামে হেঁটে যেতে হবে। কাজগুলো শুরু থেকে শেষ করতে হবে। সুন্দর বিচিত্র রঙের বাগান সাজিয়ে তুলতে হবে আমাদের উত্তরসূরীদের অপেক্ষাকে নতুন ফুল দিয়ে স্বাগত জানাতে হবে। প্রিয় শস্যের মাঠ আর ফসলের বন্টন দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তন্দ্রাতুন জাতিকে আরো প্রবাহমান করে তুলতে হবে। তারপর মিম আর জিম মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাকে সব কথা খুলে বললো। মা এক নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে বললো মানুষকে তার কর্ম দিয়ে অধিকারগুলো ফিরিয়ে আনতে হয়। পৃথিবীর পুরাতন যন্ত্রণাগুলো সামনে এসে আমাদেরকে আহত করে। যেন নিষ্ঠুর শেকলে বাঁধা আমাদের জীবন। মানুষ সব সময়ই এক নতুন রণক্ষেত্রে হেঁটে যায়। তোমাদের সবাইকে সামনের যুদ্ধে হেঁটে যেতে হবে। জীর্ণ সমাজের অপরাধীদের নিমূল করে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার সঠিক গন্তব্য খুজে নিতে হবে। মস্তিষ্কের বিদ্রোহ দিয়ে নতুন স্বপ্নের উচ্ছাসকে বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। আমাদের অগণিত প্রত্যাশাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তোমাদের বাবার খুনিদেরকে আদালতে দাঁড় করাতে হবে এবং ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করে যেতে হবে। ঘুমহীন আঁধার রাত ক্লান্ত হচ্ছে। ভালোবাসার জানালা দিয়ে মামুন, লতাকে ডাকছে। উষ্ণ পৃথিবীটা ধীরে ধীরে নতুন আলো দিকে হেঁটে যাচ্ছে। শেষ রাতের বসন্ত পাখিরা ভারাক্রান্ত যন্ত্রণায় কোলাহল করছে, আশাহত উৎকীর্ণ অনুভূতি নৈঃশব্দে। লতার চোখ থেকে অনুশোচনার অশ্র“ ঝরে পড়ছে। ক্লান্ত নদীর দুঃখভরা জোয়ারের মতো। হে জন্মভূমি, আর কত দূর, আর কত দূর হেঁটে যাবো। তুমি জেগে ওঠো ন্যায় আর প্রতিবাদের তীক্ষè তরবারির হাতে...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।