এক
বিস্বাদ মন নিয়ে বাস থেকে নামলাম । দুপুরে খাওয়া হয়নি । মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে । কিছুটা পথ হাঁটলেই মেয়ের স্কুল । ক্লাস সিক্সে পড়ে সে । প্রাইমারিতে থাকতে ১ টার মধ্যেই ছুটি হয়ে যেত । ওর বাবা লাঞ্চ আওয়ারে বাসায় নিয়ে যেত । এখন ছুটি হয় ৪ টায় । মেয়েকে স্কুলে আনা নেয়ার দায়িত্বটা কার এই নিয়ে আমাদের স্বামী স্ত্রীর প্রায় ঝগড়া হয় । আজও ঝগড়া হয়েছে ।
খুব দ্রুত লয়ে হাঁটছিলাম , মেয়েটা কখন থেকে বসে আছে । হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে কেউ কিছু বলল। আমার দাঁড়াবার সময় নাই , আমি হাঁটতেই থাকলাম । কিছুক্ষণ পর শব্দটা স্পষ্ট হল “ কেমন আছো পরী ? ” আমি ঘুরে প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মনে হল ভুল দেখছি , ভুল শুনেছি । এও কি সম্ভব ! প্রশ্নকর্তা পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দিল “ তুমি পারমিতা না ? আমাকে চিনতে পেরেছ , আমি অরণ্য।”
আমি শুধু কোনরকম হুম বলতে পারলাম, তারপর ভুলে গেলাম সব - কে আমি; কোথায় আর কেনইবা দাঁড়িয়ে আছি । চারদিক নিস্তব্দ । নিস্তব্দতা ভেঙ্গে অরণ্য বলল কোথায় যাচ্ছিলে অমন ব্যস্ত পায়ে ? আগে কেমন নীরবে হেঁটে যেতে তুমি । আমি বললাম , সামনেই আমার মেয়ের স্কুল , ওর ছুটি হয়েছে সেই ৪ টায় । ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললাম হায় আল্লাহ্ এখন ৫ টা বাজে বলেই হাঁটতে শুরু করলাম । পাশে পাশে অরণ্য ও হাঁটতে থাকল । স্কুলে পৌঁছে জানলাম মেয়ের বাবা ছুটি শেষে নিয়ে গেছে । মেজাজ আমার সপ্তমে চড়লে ও চোখ মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে মোবাইল বের করলাম । কল দিতে যেয়ে দেখলাম সেখানে একটা ম্যাসেজ এসেছে “ তোমার আসতে হবে না , আমার মেয়েকে আমি বাসায় পৌঁছে দিয়েছি।” ম্যাসেজে আমার মেয়ে বলার কারন সকাল বেলার ঝগড়া । আমার হাসি পেয়ে গেল স্বামীর ছেলেমানুষী ম্যাসেজ পড়ে ।
মাথা থেকে মেয়ের চিন্তা যেতেই অরণ্য এসে ভর করল সমস্ত মন জুড়ে । কতদিন যে নিজেকে নিয়ে ভাবিনা, তার ঠিক নেই । সংসার – স্বামী –সন্তান – চাকরি নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি । আজ নিজেকে বড় দীন মনে হচ্ছিল । তাড়াহুড়া করে পরা শাড়িটা বাসে আসতে আসতে ঘেমে লেপটে আছে , চুলগুলো উস্ক শুষ্ক , মুখে কোন প্রসাধনীর প্রলেপ দেওয়া হয়নি । কী ভাবছে আমার সম্পর্কে অরণ্য , এটা ভাবতেই আমি সঙ্কোচে কুঁকড়ে যায় । অরণ্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলে , ১৬ বছর পর দেশে ফিরে দেখলাম সব বদলেছে কিন্তু তুমি এখনো আগের মতই আছো লজ্জাবতী ললনা হয়ে । আমি বললাম, আমাকে দেখে তোমার বুঝি তাই মনে হচ্ছে । তুমি তো জানো না কতটা উচ্চস্বরে কথা বলতে পারি আমি । আমার জানার দরকার ও নাই আমি এখনো তোমাকে কলেজের সেই লাজুকপরী হিসেবেই ভাবতে চাই ।
দুই
সেদিন অরণ্যকে যখন দেখলাম নিজের চোখকে ও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না । একটা সময় ছিল যখন বার বার ওকে দেখতে মন চাইতো কিন্তু দেখার উপায় ছিল না । ওর কণ্ঠস্বর এতো বছর পর ও আমার শরীরে কম্পন তুলেছে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছি । তবে কি বলতে হয় ও এখনও আমার কাছে আগের মত আছে ? তাই বা হয় কি করে সে কত বছর আগের কথা । তখন মাত্র এস এস সি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছি । অরণ্য ছিল বিজ্ঞান বিভাগে আমি মানবিকে । আমাদের দেখা হত লাইব্রেরিতে আর বাংলা ইংরেজি ক্লাসে ।আমি আসলেই ভীষণ লাজুক ছিলাম ।আজ এতো বছর পর দেখা আমি কিছুতেই নিঃসঙ্কোচ হতে পারছিলাম না অথচ কেমন অবলীলায় অরণ্য বলল , তোমাকে দেখার পর আমার কী মনে হচ্ছে জানো ? আমি বললাম কী মনে হচ্ছে? কবিতার লাইন মনে পড়ছে “ হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে / সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে / অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে / সেখানে ছিলাম আমি ; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে / আমি ক্লান্ত প্রাণ এক , চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন / আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন । ”বনলতা সেন নয় , আমাকে শান্তি দিয়েছে লজ্জাবতী পরী রানী পারমিতা । হা হা হা । আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম , তুমি উচ্চস্বরে হাসতে পারো জানতাম না । হাসিতো দূরে থাক তোমার কণ্ঠ তো খুব একটা শুনি নি । আমাদের টুকটাক অনেক কথা হচ্ছিল ছেলে মেয়ে সংসার চাকরি নিয়ে । আমি ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যাচ্ছিলাম পুরানো দিনে ।অরণ্যের কথার ফাকে ফাঁকে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল অরণ্যও হারাচ্ছিল । কতকটা সময় একসাথে কাটালাম ফাস্টফুড সপে তারপর যে যার গন্তব্যে ।
সংসারের নানান কাজে টুকরো টুকরো স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে থাকল। এতদিন মনে হয়েছে বাচ্চা সংসার স্বামী চাকরি সামলানোর পর হাতে সময় কোথায় নিজেকে নিয়ে বিলাসিতা করার ।কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে নিয়ে সময় কাটানোর বিলাসিতা করার লোভ হচ্ছে ।
তিন
গত সপ্তাহ মেয়েকে আনা নেওয়ার দায়িত্ব আমার স্বামী খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে । তবে এক সপ্তাহ আমার সাথে কথা বন্ধ রেখেছে । এই কাজটা সে প্রায় করে , আমার সাথে ঝগড়া করে হেরে যেয়ে কথা বলা বন্ধ করে ।কলেজের সেই লাজুক মেয়েটা কী করে যে এমন ঝগড়াতে হয়ে গেলো সত্যি গবেষণার বিষয় (আমার স্বামীর জন্য !) । যেসব মেয়েরা স্বামীর দোষ বলে বেড়াতে পছন্দ করে আমি কিন্তু মোটেও তাদের দলে নই । তাছাড়া ওর তেমন কোন দোষও নেই । কোন নেশা করে না , পর নারীতে আসক্ত নয়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায় না । হ্যাঁ , একটা দোষ; না ঠিক দোষ বলা যায় না এটাকে , টাকা বানানর নেশা তার আছে । চাকরির পাশাপাশি ছোট খাট ব্যবসা দাড় করার চেষ্টা করছে । এটার জন্য সংসারে সময় দিতে পারে না ।আমি এতো সাহিত্য প্রেমী ছিলাম। কখনো এমন ছেলেকে বিয়ে করবো বলে ভাবিনি যে কিনা সারা জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোন বই-ই পড়ে নি । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার কোন ছেলের সাথে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । হয়তো অরণ্যের দেয়া ব্যথা এর জন্য দায়ী । বাসা থেকে এই ছেলেটাকে পছন্দ করা হল ; চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দুজনে কয়েকমাস পার্ক রেস্তরাঁতে ঘুরলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিয়ে করবো । বিয়ের পর থেকে সংসার আর ক্যারিয়ার গোছাতে গোছাতে কতটা সময় চলে গেছে ফিরে দেখা হয়নি । এখনতো দুই মেয়ের মা । অরণ্যের মুখে জীবনানন্দের কবিতা শুনে খুব কবিতা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে ।বিয়ের পর থেকে আমার বুক সেলফের বইগুলো শোপিস হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
চার
আজ আবারও দুপুরে খাওয়া হয়নি । সব কাজ ৪টার মধ্যে শেষ করে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাব । বাসে উঠবো বলে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে । আমার সাথে ছাতা নেই ; কে জানতো অকটোবার মাসে বৃষ্টি নামবে ! মাথার উপর আঁচল দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম । যখন বাস থেকে নামলাম তখন ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে । ফুটপাথ ধরে হাঁটছি , কেউ একজন মাথায় ছাতা ধরল ; আমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত এক পা পিছনে যেয়ে বললাম, তুমি ! হুম আমি । আগুন্তুক আর কেউ নয় অরণ্য । আমি বললাম তুমি কোথা থেকে এলে ?একমুখ হাসি হেসে বলল আমি প্রতিদিন এ সময় এখানে আসি । আমি বললাম, কেন ? কেন আসি সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ বলে আমার মনে হচ্ছে । আমার মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল একটা কথাই , অরণ্য আমার দেখা পাওয়ার আশায় এখানে আসে। কিন্তু মুখে বললাম আমি কিভাবে আন্দাজ করবো ? অরণ্য কৌতুক করে বলল , তাইতো তুমি কিভাবে জানবে ? আমি প্রতিদিন সেই ফাস্টফুড সপ থেকে কফি খেতে আসি আর মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে বসে থাকি তোমার সাথে হয়তো দেখা হবে ? উত্তর শুনে আমি মুহূর্তে কথা হারিয়ে ফেললাম । ক্ষণকাল পর ধীর স্থির ভাবে বললাম , আমার কাছে কী দরকার তোমার ? “ জানি আমি খুঁজিবে না আজিকে আমারে / তুমি আর ;-- নক্ষত্রের পারে / যদি আমি চ’লে যাই / পৃথিবীর ধুলো মাতি কাঁকরে হারাই / যদি আমি , ---- / আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ ;/ তোমার পায়ের শব্দ গেলো কবে থামি / আমার এ নক্ষত্রের তলে ---/ জানি তবু – নদীর জলের মত পা তোমার চলে; --- / তোমার শরীর আজ ঝরে / রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোন এক ঢেউয়ের উপরে ! / যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাতি কাঁকরে হারাই / যদি আমি চলে যাই / নক্ষত্রের পারে --- / জানি আমি, তুমি আর আসিবেনা খুঁজিতে আমারে ! ” অরণ্যের কবিতা আবৃত্তি শুনে ঘুরে ঘুরে মানুষ আমাদের দেখা শুরু করল । আমি মৃদু ধমকের স্বরে বললাম এটা কি আবৃত্তি করার সময় না যায়গা ?
মেয়ে আর অরণ্যকে নিয়ে সেই ফাস্টফুড সপে বসলাম । আমার মেয়ের সাথে স্বল্প সময়েই ভাব জমিয়ে ফেললো অরণ্য এবং আমার মেয়ে পিজা খেতে পছন্দ করে জেনে পিজা খাওয়ালো । ফেরার সময় বললাম তোমার মেয়েকে নিয়ে এসো একদিন । অরণ্য পাল্টা প্রশ্ন করল কোথায় এখানে নাকি তোমার বাসায় ? আমি বললাম এখানে ।
এর আগের দিনই জেনেছি অরণ্য ১৬ বছর পর দেশে ফিরেছে ওর মেয়েকে বাংলাদেশ দেখাতে ।
পাঁচ
স্বামীর সাথে অনেক দিন ভাব ভালবাসা হয়না । আজ ওর মুখ দেখেই বুঝলাম প্রেমের জন্য প্রস্তুত কিন্তু আমার একটুও ইচ্ছে করছে না । ওর হাত খেলা করছে সমস্ত শরীরে ,আমি মনসংযোগ করতে পাচ্ছি না । বারে বারে অরণ্যের গলার আওয়াজ কানে ভেসে আসছে “ জানি তবু – নদীর জলের মত পা তোমার চলে; --- / তোমার শরীর আজ ঝরে / রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোন এক ঢেউয়ের উপরে ! / যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাতি কাঁকরে হারাই / যদি আমি চলে যাই / নক্ষত্রের পারে --- / জানি আমি, তুমি আর আসিবেনা খুঁজিতে আমারে ! ” স্বামীর গলায় স্পষ্ট বিরক্তি , কী হয়েছে বলত ? শরীর খারাপ লাগছে , অফিসে কি কাজের অনেক চাপ ? কিছুদিনের জন্য ছুটি নাও না । আমি কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না । তাছাড়া আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল ।মাথা থেকে জোর করে অরণ্যকে তাড়াতে চাই , স্বামীকে জাপটে ধরে ঘুমাতে চেষ্টা করি ।
পরদিন আবারও বৃষ্টি । এটা হয়তো শীত নামানো বৃষ্টি , নভেম্বারতো চলেই এলো । বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক অরণ্যকে খুঁজতে লাগলাম , না নেই কোথাও । মেয়েকে নিয়ে তারপরও শেষ আশা ফাস্টফুড সপটাতে গেলাম ; হুম সেখানে তাকে পাওয়া গেলো । ধোঁয়া ওঠা কফি সেই সাথে ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে এক কর্নারে বসে আছে অরণ্য । অনেক বছর আগে ঠিক এভাবেই কলেজ ক্যান্টিনের এক কর্নারে বসতো সে । আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম আর বুঝতে পারতাম সে ও আমাকে দেখছে । আমার মেয়ে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ডাকল, আঙ্কেল । অরণ্য সাথে সাথে সিগারেট ফেলে আমার মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো । আমি বললাম কই মেয়েকে নিয়ে এলে না ? এই বৃষ্টির মধ্যে এলে ওর জ্বর এসে যাবে , এমনিতেই মেয়েটার এদেশের আবহাওয়া সুট করছে না । আমি বললাম কী করে সুট করবে বল মেম সাহেবের মেয়ে যে ! হুম সেটাই অরণ্য সায় দিল । কিছুক্ষণ বসার পর অরণ্য বলল, চল আজ আমার বাসায় যাবে । কথাটা আমার গায়ে লাগলো । আমি বললাম তোমাকে আমার বাসায় যেতে বলি না কারন বাসায় আমার শাশুড়ি থাকেন, উনি আগের দিনের মানুষ; তোমার উপস্থিতি হয়তো ঠিকভাবে নেবেন না । আরে তুমি আমার কাছে জবাবদিহি করছ কেন ? আমার মেয়ে মেমের মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমিতো বাঙ্গালি, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার সমস্যাটা । অরণ্যের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম । আমার মেয়ে বায়না ধরল চল না আম্মু আঙ্কেলের বাসায় যাই । না ; অন্য একদিন তোমাদের দুই বোনকে নিয়েই আঙ্কেলের বাসায় যাব । এখন বৃষ্টি জোরে নেমেছে । অরণ্য বলল এদিকে কি রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে ? আমার মেয়ে বলল,হ্যাঁ আঙ্কেল অনেক পানি জমে । আমার মনে পড়ে যায় এমন বৃষ্টি অন্য একদিন ও নেমেছিল- রাস্তায় হাঁটু পানি , আমি কাকভিজা ভিজে রিক্সা খুঁজছিলাম ; রাস্তায় বখাটে ছেলেরা নানা ধরনের বাজে মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল ; হঠাৎ অরণ্য কোথা থেকে এক রিক্সা নিয়ে আমাকে ডেকে বলল পারমিতা উঠে এসো আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব । আমি কোন কথা না বলে রিক্সায় উঠে পড়লাম । সেই প্রথম অরণ্য আমার নাম ধরে ডাকল । আমার বাসার কিছু দূরে রিক্সা থামিয়ে বলল তুমি রিক্সা নিয়ে চলে যাও আর বাসায় যেয়ে আদা চা খেও তাহলে ঠাণ্ডা লাগবে না । আজও অরণ্য আমার নিষেধ উপেক্ষা করে বৃষ্টিতে ভিজে একটা রিক্সা ডেকে আনল । আমি রিক্সায় উঠার পূর্ব মুহূর্তে অরণ্যের নাম্বার চাইলাম । অরণ্য নাম্বার দিতে দিতে বলল আমার নাম্বার নিচ্ছ সে তো আমার ভাগ্য ।
ছয়
এ‘কদিন প্রতিদিনই অরণ্যের সাথে দেখা হচ্ছে । আমি আজকাল হালকা সাজগোজ করে বাইরে যাওয়া শুরু করেছি । আমার স্বামীতো একদিন বলেই ফেলল , তুমি দেখি দিনে দিনে সুন্দরী হয়ে যাচ্ছ প্রেমে ট্রেমে পড়নি তো? আমি কথাটাকে চাপা দেওয়ার জন্য বললাম, তারমানে আমি এতদিন সুন্দরী ছিলাম না তাই না । তোমারতো আমাকে সুন্দরী মনে হয় না সুন্দরী মনে হয় তোমার অফিসের লিপি কে । আমি আমার ঝগড়ার মধ্যে প্রায় এই লিপি মেয়েটাকে টেনে আনি যদিও জানি লিপির সাথে আমার স্বামীর কোন কিছুই নাই । একবার শুধু আমার সামনে লিপিকে খুব প্রশংসা করেছিল । এরপর থেকে লিপি নামটাকে আমি যত্ন করে মনে রেখে দিয়েছি সময়ে সময়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি ।
এক ছুটির দিনে দুই মেয়ে নিয়ে অরণ্যের বাসা থেকে ঘুরে এলাম । ওর মেয়ে চমৎকার বাংলা বলে , একেবারে বইয়ের ভাষার মত । বুঝতে পারি অরণ্যই শিখিয়েছে । আমাদের কলেজে অরণ্য ছিল কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক , দারুন কবিতা লিখত । তাছাড়া রবীন্দ্র নজরুল জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ওর আবৃত্তি থাকতো। আমি সাহিত্য পাতাতে একবার গল্প লিখেছিলাম। আমার পছন্দ ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর অরণ্যের জীবনানন্দ । একদিন কথায় কথায় অরণ্য জানতে পারে আমি জীবনানন্দের কবিতা পড়িনি । সেই থেকে অরণ্য প্রতিদিন একটা করে কবিতা লিখে আনতো আমার জন্য । লাইব্রেরিতে আমার সাথে যখন কেউ থাকতো না তখন একটা ভাঁজ করা কাগজ আমার পাশে রেখে অরণ্য চলে যেত । এতো কম কথা বলত ও । এভাবে অনেক কবিতা জমেছিল আমার কাছে । আমার এক জন্মদিনে বাবা কারুকাজ করা গয়নার বাক্স দিয়েছিল , আমি সেই গয়নার বাক্সে কবিতা গুলো রাখতাম । আমাকে না জানিয়ে অরণ্য যখন ইউকে তে চলে যায় , কতরাত যে কেঁদেছি সেই কবিতাগুলোর প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে । মানুষের জীবন আসলে কারো জন্য থেমে থাকে না ।
সাত
আরণ্যের না বলে ইউকে চলে যাওয়াটা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে , ও কেন এটা করল ? তখনও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি মাত্র আমাদের রেজাল্ট হয়েছে । অরণ্য ভর্তি হয়েছিল বুয়েট কোচিং এ । অনেকদিন কোন খবর না পেয়ে অরণ্যের কোচিং এ যেয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকেই প্রথম জানলাম ও নাকি ইউকে চলে গিয়েছে । আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল এমন নিষ্ঠুর হয় মানুষ জানালে কি এমন ক্ষতি ছিল ওর । আমি হিসাব করে দেখি আমার সাথে শেষ যেদিন দেখা হয় তার পরদিনই ওর যাওয়ার দিন ছিল , দেখাই যখন করল তবে কেন জানাল না !
প্রতিদিনই ভাবি অরণ্যকে জিজ্ঞেস করবো কেন না জানিয়ে চলে গিয়েছিল । জিজ্ঞেস করার পরিবেশ থাকে না তাই আর জিজ্ঞেস ও করা হয় না । আজ আমরা আমাদের মেয়েদের নিয়ে পার্কে এসেছি । মেয়েরা খেলছে , আমরা দুজন পাশাপাশি বসে আছি । আমি সুযোগ পেয়ে অরণ্যকে বললাম , অনেক বছর ধরে একটা প্রশ্ন তোমাকে করবো বলে জমিয়ে রেখেছি আজ কি সেই প্রশ্নটার জবাব তুমি আমাকে দেবে? অরণ্য রহস্যময় হাসি হেসে বলল আমিও তোমাকে একটা কথা অনেকদিন থেকে বলব বলে আর বলা হয়নি । আমি বললাম তোমার কথা পরে শুনব আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও । তুমি আমাকে না জানিয়ে ইউকে চলে গিয়েছিলে কেন ? অরণ্য বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল , তুমি কি জানতে আমার মা ছিল না । আমি বললাম জানতাম না । আমার মা মারা যায় আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি , মায়ের মৃত্যু শোকে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম, কারো সাথে মিশতাম না ,কথা বলতে ভালো লাগতো না । কলেজে পড়ার সময়ে আমি মায়ের কথা ভুলে থাকতাম বই পড়ে আর কবিতা লিখে ।আমাদের এইচ এস সি রেজাল্টের পর বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আবারও বিয়ে করবেন , আমি ক্ষোভে ফেটে পড়লাম , আমার মায়ের স্থান কেউ নিবে আমি ভাবতেই পারিনি । অরণ্য আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো , আমিও কি বলব বুঝতে পারছিলাম না । অরণ্য আবারও বলা শুরু করল , বাবা আমাকে না জানিয়ে ইউকে যাওয়ার সব কাগজ পত্র রেডি করে ফেললেন। আমি জানতে পারলাম আমি যাওয়ার পরদিনই বাবা বিয়ে করবেন । আমি এতো কষ্ট পেয়েছিলাম মনে হয়েছিল এদেশে আর কোন দিন ফিরব না । তুমি আমার শেষ চিঠিটা পড়েছিলে ? আমি বললাম ওটা কি চিঠি ছিল ? ওটাতো জীবনানন্দের কবিতা ছিল ।
আট
অরণ্যের শেষ চিঠি জীবনানন্দ দাশের ‘ হাজার বর্ষ আগে’ কবিতা “ সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’ল না /কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকাল / আমি বুঝলাম / চকিত হয়ে মাথা নয়ালো সে / কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন --- সপ্রতিভ হয়ে / সাত-দিন আট- দিন ন-দিন দশ-দিন / সপ্রতিভ হয়ে হয়ে --- সপ্রতিভ হয়ে / সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে / অপেক্ষা করে – অপেক্ষা ক’রে / সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’ল না /কারণ আমাদের জীবন পাখিদের মত নয় / যদি হ’ত / সেই মাঘের নীল আকাশে / ( আমি তাকে নিয়ে ) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম / গাঙশালিখের মত আমরা দু’টিতে / আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছি / তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছো / হয়তো হাজার হাজার বছর পরে / মাঘের নীল আকাশে / সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাব / আমাদের মনে হবে / হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম ।” চিঠির প্রতিটা শব্দই আমার মনে আছে । কতবার পড়েছি আর ভেবেছি ও কেন এটা দিল আমাকে ? আমার জীবনে অরণ্য একটা বড় জিজ্ঞাসা বোধক চিহ্ন( ? ) হয়ে ছিল । আমার জীবনতো ভালো মতই চলছিল কেন আবার আমার জীবনে অরণ্য এলো ? আমার সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে, আমি কোন কিছুতেই মনযোগ দিতে পারিনা । স্বামীর সাথে দূরত্ব বেড়েই চলেছে । ভাবলাম অরণ্যকে বলব আর যেন আমার সাথে যোগাযোগ না রাখে । কিন্তু আমি জানতাম না আমার জন্য কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে !
নয়
আজ ছুটির দিন অরণ্যের ফোন পেলাম ওর জন্য কিছু শপিং করে দেওয়ার জন্য । আমি এককথায় রাজী হয়ে গেলাম,ভাবলাম কিছু কথা আজই অরণ্যকে জানাব । অরণ্য বাসায় একা । বাসার সব জিনিসপত্র প্যাকিং করা । আমি খুব বিস্ময় নিয়ে চারিদিক দেখছিলাম । অরণ্যকে ওর মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল আমার ফুফু ওকে ওর দাদার সাথে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছে । আমি বললাম তুমি গেলে না ? আমার একটা কথাতে অরণ্য এতটা রিঅ্যাক্ট করবে ভাবিনি । কেন যাব আমি, বল কেন যাব ? এই ১৬ বছরে একদিনও তিনি আমার সাথে কথা বলেননি । হ্যাঁ , একটা কাজ তিনি করেছেন তার প্রিয়তম স্ত্রীকে দিয়ে আমার খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন । তার স্ত্রী আমাকে নিয়মিত ইউকে তে ফোন করে করতেন , বলতেন আমি নাকি তার নিজের সন্তানের চেয়েও প্রিয় । আরে যে মহিলা আমাকে কোনদিন দেখেই নি ,তার প্রিয় হই কি করে আমি ? এতো দিন আমি এখানে, আমার বাবাতো একদিন আসতে পারতেন আমার বাসায় ? অরণ্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসে না কেন, বলতে পারো ? আমার মা চলে গেলেন, বাবা থেকেও নেই ,সোফিয়াকে কত ভালবেসেছি সেও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে ? আমি অবাক হয়ে বলি সোফিয়া চলে গিয়েছে মানে, তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে ! আমাকে বলনি কেন ?হ্যাঁ , আমাদের ডিভোর্স হয়েছে আরও ১০ বছর আগে । ও তো কোনদিন ভালই বাসেনি । অরণ্য হঠাৎ করেই আমার কোলে মাথা রেখে ধরা গলায় বলতে থাকে “ সে এক বিস্ময় / পৃথিবীতে নাই তাহা –- আকাশেও নাই তার স্থল -- / চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল ! / রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে / তারে আমি পাই নাই ; -- কোন এক মানুষীর মনে / কোন এক মানুষের তরে / যে- জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে !” আমি ভুল করেছি , আমার সমস্ত জীবনটাই ভুলে ভরা । আমি সংসার বেঁধেছিলাম সোফিয়াকে নিয়ে আর যে মানুষীকে সারাজীবন খুঁজেছি সে ছিলে তুমি ।আমার নিয়তি তাই আবারও তোমার কাছে নিয়ে এসেছে । আজ যদি তোমাকে বলি সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে , আসবে তুমি ? ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে যাই । অরণ্যের কদম ফুলের মত চুলগুলো আমার শরীরে সুড়সুড়ি দিতে থাকে । শরীরের কোষগুলো সজাগ হয়ে ওঠে, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি আনমনা হয়ে যাই । তারপর স্লাইড শো এর মত মনের পর্দায় এক এক করে ভেসে ওঠে আমার দুই মেয়ে ও তাদের বাবার ছবি। পরক্ষণেই আমি লৌহ মানবী । অস্ফুট স্বরে প্রায় শোনাই যায় না এমনভাবে বলি কী ছেলেমানুসি শুরু করেছো তুমি ?
দুজনে থমথমে মুখে শপিং শেষ করলাম । ফেরার পথে অরণ্য বলল ৫ তারিখে আমার ফ্লাইট , রিটার্ন টিকিট করা ছিল । ফ্লাইট কয়টায় ? সন্ধ্যা ৬ টা । আমি বললাম আমার একটা কথা রাখ – যাওয়ার আগে বাবার সাথে দেখা কর ,উনি হয়তো তোমার মুখমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না ।
শেষ
আজ ৫ তারিখ । আমি কদিন হল অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি । মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ , স্কুল বন্ধ । সেদিনের পর অরণ্যের সাথে আর দেখা হয়নি । অরণ্য হয়তো আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিল কিন্তু আমি ফোন দিয়ে কী বলব ভেবে পাইনি । ও শেষ পর্যন্ত বাবার সাথে দেখা করল কিনা কে জানে ?
আমার মনের ভিতর সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে , কিছুতেই সিদ্ধান্তে আসতে পারছিনা এয়ারপোর্টে যাব কিনা ।
এখন ৬ টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি । আমি আমার বারান্দার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি সেপথ দিয়েই তো অরণ্য চলে যাবে । বেশ অনুভব করতে পারি এয়ারপোর্টে বার বার অরণ্যের চোখ খুঁজেছে আমায় । ওর মেয়ে হয়তো বলেছে বাবা কেউ কি আসবে , তুমি কাকে খুঁজছো ? অরণ্য আহত গলায় বলেছে কাউকে না মা মনি ।
আমাকে ক্ষমা কর অরণ্য। আমি এখন আর শুধু আমি নই , আমি মা ;আমি স্ত্রী । তোমার মুখোমুখি হয়ে বিদায় জানানোর শক্তি আমার নেই । এইখানে আমার বুকের অভ্যন্তরে কত বাস্প জমে আছে সে আমি জানি আর জানেন আমার ভাগ্যবিধাতা । আমি বাস্পগুলোকে শীতল করতে পারিনা , সেগুলোকে অঝোরে ঝরতে দিতে পারি না । শুধু হাহাকার নিয়ে জপে যেতে থাকি তোমার দেয়া শেষ চিঠির লাইনগুলো “আমাদের জীবন পাখিদের মত নয় / যদি হ’ত / সেই মাঘের নীল আকাশে / ( আমি তাকে নিয়ে ) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম / গাঙশালিখের মত আমরা দু’টিতে / আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছি / তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছো / হয়তো হাজার হাজার বছর পরে / মাঘের নীল আকাশে / সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাব / আমাদের মনে হবে / হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম ।”