যুগটা এখন অস্থিরতার । বিজ্ঞান উদ্ভাবন করে চলেছে আরাম আয়েস আর ক্ষমতা দখলের মারনাস্ত্র । যা ছিনিয়ে নিচ্ছে কারো জীবন , কারো বা মাথা গোজার ঠাই আবার কারো জাতীয়তা ।অদূর ভবিষ্যতে প্রকৃতি আর বিজ্ঞান হয়তো পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান নেবে । সেটা মানবের জন্য কল্যাণকর হবে কিনা কে জানে। এমন নাস্তিকতার যুগে ধর্মীয় গ্রন্থ আর আচারকে ঠাই করে বেঁচে আছে কিছু মানুষ। এদের মধ্যে একজন ছায়েরা কবির । ছায়েরা আর তার বাবা থাকে সেগুন বাগিচার একটি ২০তলা ভবনের ১৮তলাতে । ২০০০ স্কয়ার ফিটের এই ফ্লাটে দুজন মাত্র প্রাণী আর একটি রোবট থাকে । আজ ভোরে ছায়েরা যখন তার প্রার্থনা শেষ করে শুতে যাবে তখন কেন যেন তার মনে হল পৃথিবীর কোথাও বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটলো । জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখল কেমন ধোয়াটে আবহাওয়া। মনটা কেমন অস্থির লাগতে থাকলো।ভাবল আজ আর ঘুমাতে যাবে না বরং কিছু লেখালেখি করবে ।
এই ফ্লাটের আর এক রুমে প্রার্থনা শেষ করে আবার একটু ঘুমিয়ে নেবেন ভাবলেন বিজ্ঞানী ডঃ আলতামাস কবির, ছায়েরার বাবা । ডঃ আলতামাস কবির ধান নিয়ে গবেষণা করছেন এবং অনেকটা সফল ও হয়েছেন । তিনি অল্প জমিতে অধিক ফলনশীল ধান বীজ আবিস্কার করেছেন যার কারনে বাংলাদেশকে আর চাল আমদানি করতে হয় না । এই চালকে কিভাবে অধিক পুষ্টিকর খাদ্য করা যায় এবং প্রত্যেক পরিবার তার বারান্দাতেই কিভাবে প্রয়োজনীয় ধান উৎপাদন করতে পারেন এটা ই এখন তার গবেষণার বিষয় । এই গবেষণা যদি সফল হয় তবে এক মুঠো ভাতেই একজন মানুষ সব ধরনের পুষ্টি পাবে ।
( ২ )
এদিকে শহরে একটি নতুন ছেলে এসেছে যাকে এ শহরের কেউ চেনে না , নাম তার জিহান । জিহান, ছায়েরাদের ঠিক নিচের ফ্লাটটি ভাড়া নিয়েছে । তার একটি আমেরিকান সিটিজেনশিপ ও বাংলাদেশী সিটিজেনশিপ আছে যা দেখিয়ে সে ফ্লাট ভাড়া নিয়েছে । জিহানের ঘরে খুব বেশি জিনিস নাই । শুধু একটি বিছানা ও একটি অদ্ভুত যন্ত্র এবং কিছু বই যার বেশির ভাগই ছায়েরার লেখা উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই । জিহান এ শহরে এসেছে একটি মিশন নিয়ে যে মিশন অবশ্যয়ই তাকে ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে । জিহানের কিছু কাপড়চোপড় ও খাবার কেনা প্রয়োজন । তাই সে কোন শপিং মল যাবে ভাবছে । আর শপিং মলে গেলে এ শহরের মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে ও জানা হবে ।
( ৩ )
আজ লিফটে জিহানের সাথে ছায়েরার দেখা । ছায়েরা এর আগেও কয়েকবার জিহানকে দেখেছে তবে কথা হয়নি । আজ জিহানই আগে ছায়েরার সাথে পরিচিত হল । বলল এ শহরে আমার আপন বলতে কেউ নেই , আপনারা আসবেন আমার বাসায় । নামার মুহূর্তে বলল , আমি কফিটা ভাল বানায়, একদিন আমার হাতের কফি খেয়ে আমাকে ধন্য করবেন । ছায়েরা স্মিত হাসিতে জিহানকে বিদায় দিলো । ঘরে ফিরে ছায়েরার জিহানকে মনে পড়ছিল। বেশ হ্যান্ডসাম ছেলে একদম অ্যাকশন মুভির নায়কদের মত, কণ্ঠটা ও বেশ পৌরুষদীপ্ত । এমন ছেলেরা যখন তখন মেয়েদের পটিয়ে ফেলে । যদিও ছায়েরার বয়স ২৮ যা পটানোর জন্য উপযুক্ত না । ছেলেরা হরহামেশা ১৪ থেকে ১৮ বয়সের মেয়েদের পটাতে সক্ষম হয়। সে তুলনায় ছায়েরার বয়সটা বেশ বেশি । আর ছায়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়ায় সাথে উপন্যাস লেখে । উপন্যাসিক হিসেবে সে বেশ নাম করেছে । একুশে বই মেলাতে তার বই বিক্রির অবস্থান ২ , ৩ নম্বারে থাকে । সে যেহেতু মিডিয়াকে এড়িয়ে চলে তাই রাস্তা ঘাতে ভক্তরা তাকে চিনতে পারে না । তরুণ সমাজ অ্যাকশন বই না পড়ে রোমান্টিক বই পড়ছে এতে ছায়েরার অবদান অনেকখানি । ছায়েরা সবসময় মনে করে ভালবাসাই একমাত্র কারণ যার জন্য এতো হিংসা হানাহানির মাঝে ও মানব সম্প্রদায় টিকে আছে । ছায়েরা এখনো একা আছে সেটা এ কারনে যে , ওর মানুসিকতার সাথে মেলে এমন কাউকে পায়নি । কাউকে দেখে ভালবাসতে ইচ্ছে হয়নি । এ যুগে সবাই যেখানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে লিভটুগেদার করছে সেখানে ছায়েরা এখনো কুমারি জীবন কাটাচ্ছে মনের মত সঙ্গীর আশায় ।
( ৪ )
আজ ছুটির দিন । বিজ্ঞানী আলতামাস কবির তার গবেষনাগারে কাজ করছেন । আজ দুপুরে তিনি মেয়ের সাথে বসে খাবেন বলে মেয়েকে কথা দিয়েছেন । তাই কাজ গুছিয়ে বাসার দিকে রওনা হবেন ভাবছিলেন এমন সময় মেয়ের ফোন ।
ছায়েরাঃ বাবা , তুমি কি রওনা হয়েছো ?
আলতামাস কবিরঃ এখনই রওনা দেব , মামনি
ছায়েরাঃ তুমি এখন এখন বলতে বলতে ভুলে যাবে আসার কথা । তোমাকে যে বলেছিলাম আমি আজ নিজে রান্না করেছি, সেটা কি তোমার মনে আছে ? আমরা দুজন একসাথে খাবো আর আমি একজন অতিথি কেও দাওয়াত দিয়েছি , এসে দেখবে ।
আলতামাসঃ ওকে , মাই ডিয়ার । এখনই আসছি ।
ছায়েরা আজ দুপুরে খাওয়ার জন্য জিহানকে দাওয়াত দিয়েছে । আজ একটা বিশেষ দিন তাই নিজেই রান্না করবে বলে ভেবেছে । প্রতি বছর এই দিনে সে তার বাবার জন্য বিশেষ কিছু করার চেষ্টা করে । আজই প্রথম বাবা মেয়ের বিশেষ দিনে বাইরের কাউকে দাওয়াত করলো ছায়েরা । এমনিতে গৃহের সব কাজ তাদের কেনা রোবট পিংপং করে । পিংপং কে বানানো হয়েছে এমনভাবে যে গৃহপরিচালিকার কাজ করবে । এরকম রোবট প্রায় সব বাড়িতে দেখা যায় । কোন মানুষকে গৃহপরিচালিকা হিসেবে রাখার খরচ অনেক বেশি ।তাছাড়া সে যদি নির্যাতনের অভিযোগ আনে এবং কোর্টে মামলা করে তবেতো হয়ে গেলো আর কি ! জেল জরিমানা নিশ্চিত , তারচেয়ে বরং রোবট অনেক ভাল।
জিহান সময় মত ছায়েরাদের বাসায় আসলো কিন্তু ছায়েরার বাবা এখনো এসে পৌঁছায়নি । ছায়েরা বলল আমার বাবা আসলে পরে খাবার টেবিলে দেব , আপনার কি খুব বেশি খিদে লেগেছে । আরে না না আপনার বাবা আসলেই আমরা খাবো জিহান বলল ।জিহান দেখল, দেয়ালে একটা ছবিতে হাসিমাখা মুখে তরুণ তরুণী যুগল ও একটি খুকি । যদিও আন্দাজ করা যায় এখানে কে কে তারপর ও জিজ্ঞেস করলো এটা কার কার ছবি? ছায়েরা বলল, আমার মা বাবা আর আমি । জিহান বলল , আপনার মা এখন কোথায় ? আমার মা আমার যখন বয়স ১০ তখন মারা গিয়েছেন । মারা গিয়েছেন ? কিভাবে ? জিহান প্রশ্নটা এমন ভাবে করলো যেন মানুষের মারা যাওয়া টা খুব অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার । আমার মায়ের কান্সার হয়েছিল । তো ? ডাক্তার ছিল না আর ওষুধ ? খুব অবাক হয়ে জিহান জানতে চায়লো । জিহানের কথা শুনে ছায়েরার খুবই অবাক লাগলো । কারণ ডাক্তার ওষুধ দিয়ে কতদিন একজন ক্যান্সারের রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে । উত্তর দেয়া হল না কারণ ডোরবেল বাজছে , ছায়েরা দরজা খুলতে গেলো ।
অনেক গল্প করতে করতে ছায়েরা , ডঃ আলতামাস ও জিহান খাবার খেল । শুধু ছায়েরা না ওর বাবার ও জিহানকে অদ্ভুত মনে হল । ব্যাপারটাকে ওরা সবে আমেরিকা থেকে এসেছে ভেবে উড়িয়ে দিল । বাবা মেয়ে দুজনই জিহান কে প্রতিদিন সন্ধ্যাই চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে রাখল। ছেলেটাকে অদ্ভুত মনে হলেও ভাল লাগার কারণ ছিল , জিহান ছায়েরার লেখা সব বই পড়েছে জেনে । জিহান যাওয়ার আগে বলল আজ একটা বিশেষ দিন বলেছিলেন কিন্তু কেন বিশেষ এটা বলেননি , আমি কি জানতে পারি ? ছায়েরা বলল আজ আমার বাবা মায়ের বিয়ের দিন । বিয়ে ? জিহানের প্রশ্ন শুনে ছায়েরা বলল তো আপনি কি ভেবেছেন , আমার বাবা মা লিভটুগেদের করতেন ? এটা বলে বাবা মেয়ে দুজনে হেসে উঠলো ।
( ৫ )
ছায়েরা চলে যাওয়ার পর জিহানের সেই যন্ত্রটি টিক টিক বেজে উঠলো । একটা সুইচ চাপতেই একটা মধ্যবয়সী লোককে স্ক্রিনে দেখা গেলো ।
লোকটিঃ জিহান , তোমার মিশনের কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে ?
জিহানঃ মহামান্য বিজ্ঞানী , আমি খুব বেশিদূর এগোতে পারিনি , তবে আমি অবশ্যয়ই আমার মিশন শেষ করবো। আমি মানব সম্প্রদায়কে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবো । আমি ছায়েরা ও টার বাবার সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছি এবং অনেকখানি সফল হয়েছি ।
লোকটিঃকিন্তু তুমি ভুলে যেওনা তোমার সময় ৩০ দিন যার ১০ দিন শেষ হয়ে গিয়েছে । তোমার হাতে মাত্র ২০ দিন সময় আছে ।
এ কথা শেষ করেই লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেলো । জিহান ভাবতে থাকলো কি করে ছায়েরার কাছে তার মিশন সম্পর্কে বলবে ? যদি বিশ্বাস না করে । আগে তাই ছায়েরার বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে তারপর সব বলবে । পরের ৫ দিন প্রতি সন্ধ্যা জিহান ছায়েরার সাথে কাটালো । অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা চলল । বিশেষ করে বই নিয়ে । জিহান ছায়েরার মুখে শুনেছে , ওর মা মারা যাওয়ার পর বাবা কখনো অন্য কোন নারীকে জীবনে স্থান দেয়নি । জিহান ভেবে পায়না এরা একজন আরেকজন কে এতো ভাল কিভাবে বাসে । জিহান দেখেছে মায়ের কথা বলতে যেয়ে ছায়েরার চোখ ভিজে যায় । যে মাকে সে ১০ বছর বয়সে হারিয়েছে সেই মার জন্য এতটা বছর এতো ভালবাসা জমিয়ে রেখেছে । জিহান কি ওর মাকে মনে রেখেছে কিংবা বাবা কে জিহান ভাবতে থাকে তবে কি ছায়েরা আর আমার মধ্যে তফাৎ এটাই ? একজন ভালবাসতে পারে আর একজন জানেনা ভালবাসা কি । মায়া মমতা নামক শব্দ জিহানদের অভিধান থেকে নয় শুধু জীবন থেকেও উধাও হয়ে গিয়েছে ।
( ৬ )
ছায়েরা ও তার বাবা টিভিতে রাতের সংবাদ দেখছিলেন । একটা সংবাদ তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করলো । শহর থেকে দূরে একটা নির্জন এলাকায় অদ্ভুত ধরনের মেশিনের ছাপ পাওয়া গেছে । বিজ্ঞানিরা ছাপটা নিয়ে গবেষণা করছেন, তবে কোন ধরনের মেশিন বা যানবাহন এটা নির্দিষ্ট করতে পারছেন না । সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রধান ৩ জন বিজ্ঞানী বলেছেন , তারা ধারনা করছেন অন্য গ্রহ থেকে এই মেশিনে করে কোন প্রাণী এসেছে । খুব শীগ্রহি তারা নিশ্চিত খবর জানাবেন । ছায়েরা আর তার বাবা দুজনের চোখাচোখি হল এবং দুজনই বুঝল মনে মনে তারা একটি সন্দেহই করছে । জিহানের অস্বাভাবিক কথাবার্তা আর সেদিন দাওয়াত দিতে যেয়ে ছায়েরা যে অদ্ভুত যন্ত্র দেখেছিল সব মনে পড়তে থাকলো ।
( ৭ )
জিহান , ছায়েরাদের বাসায় চা খেতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । জানেনা আজ তার জন্য কি অপেক্ষা করছিল । ছায়েরাদের বাসায় যেয়ে দেখল আজ আলতামাস ও ছায়েরা দুজন খুব গম্ভির হয়ে আছে । তাকে কেউই অন্য দিনের মত অভিবাদন জানাল না । অন্য দিন চা আর নাস্তা ছায়েরা নিজে বানিয়ে নিয়ে আসে কিন্তু আজ পিংপং দুপদাপ শব্দে চা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো । তিনজন নিরবে চা নাস্তার দিকে চেয়ে রইল । ছায়েরা নিরবতা ভেঙ্গে নাস্তার প্লেট জিহানের দিকে এগিয়ে দিল । নিন, খেয়ে দেখুন পিংপং কেমন বানিয়েছে । তারপর ডঃ আলতামাস তার মুখ খুললেন । জিহান , তোমার বাসায় কি টিভি আছে? জিহান বলল, না; কিন্তু হটাৎ টিভির কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন ? কোন কি সমস্যা হয়েছে ? ছায়েরা বলল, আপনি আগে খাওয়া শেষ করেন তারপর অন্য কথা হবে । এ কথা শোনার পর জিহানের কেমন যেন দুশ্চিন্তা হতে লাগলো , কি জানতে চাইবে এরা ? সবার খাওয়া শেষ হলে আবার দুপদাপ করে পিংপং এলো এবং টেবিল পরিস্কার করে চলে গেলো । তারপর আবারও নিরবতা । জিহান নিরবতা ভেঙ্গে জানতে চায়লো , আমাকে কি বলতে চেয়েছিলেন ডঃ ? ডঃ নয় ছায়েরাই খুব দৃঢ় কণ্ঠে জানতে চাইলো , আপনি কে ? আর কেন এসেছেন এ শহরে ? জিহান কেমন যেন কেঁপে উঠলো ছায়েরার কণ্ঠ শুনে , নিজেকে সামলে নিয়ে বলল; আপনাদের এর আগে আমি বলেছি এ দেশে আমার মায়ের জন্ম তাই এখানে তার কবর খুঁজতে এসেছি । হ্যাঁ , কিন্তু কথাটা আমরা তখন বিশ্বাস করলেও এখন করতে পারছিনা , ছায়েরা বলল । আপনি কখনো আপনার মা সম্পর্কে কোন কথা বলেন না বরং আমার আর বাবার মায়ের প্রতি ভালবাসা দেখে অবাক হয়েছেন । কারণ আমাদের সময়ে ভালবাসা কি এটা আমরা কখনো জানতে পারিনি জিহান বলল। ছায়েরা আবার ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল , আমাদের সময় বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন ? জিহান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । জিহানের নিরবতা দেখে ডঃ আলতামাস বললেন , শোন ছেলে শহরের কাছে একটি অদ্ভুত মেশিনের ছাপ পাওয়া গেছে , পুলিশ সবখানে তল্লাশি নিচ্ছে গত একমাসের মধ্যে কোন অচেনা মানুষ কোথাও আশ্রয় নিয়েছে কিনা । আমরা চাইলে তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু এতদিন আমাদের সাথে আছো তোমার প্রতি মায়া জন্মে গেছে তাই পুলিশকে জানাইনি । এ এপার্টমেন্টের অন্য সদস্যরা ও তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখছে কিনা কে জানে । তাই আমাদেরকে তোমার সত্যি পরিচয় দাও ।
(৮)
ছায়েরা আর ডঃ আলতামাসের খুব অবাক লাগছে জিহানের কথা ভেবে । এও কি সম্ভব ! জিহান বলেছে , সে একবিংশ শতাব্দীর শেষ বছর থেকে এসেছে যেন দ্বাবিংশ শতকের মানব সম্প্রদায়কে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে । সে এসেছে টাইম মেশিনে করে যার ছাপ সেদিন টিভিতে দেখিয়েছে । ছায়েরা আর ওর বাবার ভাবতে অবাক লাগছে সত্যি কেউ টাইম মেশিন আবিস্কার করেছে । আরও অবাক লাগছে মানুষের জীবনে ভালবাসার কোন স্থান আর নেই জিহানদের সময়ে । ওদের সময়ে অসুখ আর জরাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে তাই মানুষের মৃত্যু ভয় আর নেই কিন্তু ৩০, ৩৫ বছর পেরোতে না পেরোতে মানুষ বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাচ্ছে না , জীবনের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ নেই । তরুণ সমাজ দলে দলে আত্মহত্যা করছে । কোন মনচিকিৎসক তাদেরকে চিকিৎসা দিয়ে আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখতে পারছেনা । জিহান তাই এসেছে এ সময়ের মানুষদের উপর গবেষণা করতে , কিসের টানে মানুষ বেঁচে আছে । ওদের সময়ের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডঃ ল্যাম্ববার্ড জিহান কে পাঠিয়েছে ছায়েরার কাছে । ডঃ ল্যাম্ববার্ড এর মতে মানব সম্প্রদায়কে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ছায়েরাই জিহানকে সাহায্য করতে পারে । ছায়েরা ভেবে পাচ্ছে না ল্যাম্ববার্ড কেন তার কথা বলেছে জিহানকে । ছায়েরার মনে হচ্ছে আরও কোন বিষয় আছে যা জিহান এখনো তাকে বলেনি । জিহানের সাথে কথা বলতে ছায়েরা জিহানের বাসায় যাবে ভাবছে ।
( ৯ )
এদিকে জিহান খুবই চিন্তিত সে আর মাত্র ৫ দিন এখানে থাকতে পারবে । আর ৫ দিনে মিশন সফল হোক না হোক ওকে চলে যেতেই হবে । আরও একটা বিষয় নিয়ে জিহান চিন্তিত এখানকার পুলিশ তাকে খুঁজছে , যদি ধরা পড়ে তবে সব শেষ। জিহানের ডোরবেল বাজছে । ডোরবেল শুনে ভাবল পুলিশ নয়তো ! দরজা খুলতে ছায়েরার চিন্তিত চেহারা দেখল কিন্তু জিহানের মুখে হাসি ফুতে উঠলো । আপনি তাহলে আমাকে সাহায্য করবেন , জিহান বলল।আপনি যা বলেছেন তা যদি সত্যি হয় আর আমার দ্বারা মানব সম্প্রদায়ের উপকার হয় , অবশ্যয়ই আপনাকে সাহায্য করবো । কিছু প্রশ্ন আমার মনে এসেছে আপনি আগে তার জবাব দিন । ডঃ ল্যাম্ববার্ড আমার কাছে কেন পাঠাল ?জিহান বলল , ডঃ ল্যাম্ববার্ড একটা মেশিন আবিস্কার করেন আপনাদের শতকের মধ্যবর্তী সময়ে , তখন যারা এ মেশিনের প্রয়োগের বিরোধিতা করে তাদের মধ্যে আপনি অগ্রগণ্য ছিলেন । তারপর ও এটি আবিস্কারের জন্য ডঃ ল্যাম্ববার্ডকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। আপনি এর বিরোধিতা করে যেসব সমস্যা এর প্রয়োগ ক্ষেত্রে হতে পারে বলেছিলেন তার প্রায় সবই সঠিক ছিল বলে ডঃ ল্যাম্ববার্ড এখন মনে করছেন । কি আবিস্কার করেছিল সে,ছায়েরা জানতে চাইলো ।এমন একটা মেশিন আবিস্কার করে যার মধ্যে মানব ভ্রুনকে রাখলে মেশিনের মধ্যেই ভ্রুন পরিপক্ক হয়ে শিশু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে তার আর মাতৃগর্ভে থাকার প্রয়োজন পড়বে না । আর মায়ের ও ৯ মাস ধরে বেবি ক্যারি করতে হবে না । এ কথা শুনে ছায়েরা দাঁড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়ল । তারপর একটা প্রশ্নই শুধু করলো , কতদিন ধরে এ মেশিনে মানব জন্ম হচ্ছে ? জিহান বলল ২৫ বছর, আর আমিই শেষ মানব যে মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়েছি । এ কথা শুনে ছায়েরা কোন কথা না বলে টলতে টলতে তার বাসায় চলে আসলো । জিহান শুধু বোকার মত তাকিয়ে রইল ।
( ১০ )
জিহানের আর মাত্র ২ দিন বাকি আছে । এ ২ দিনে সে মিশন শেষ করবে আর টাইম মেশিন এসে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে । ছায়েরা আর তার বাবা জিহানকে অনেক সাহায্য করেছে । জিহানকে পুলিশ যেন খুঁজে না পাই তাই নিজের বাসায় জিহানকে লুকিয়ে রেখেছে ,সেই সাথে সমস্যার সমাধান নিয়ে অনেক পরামর্শ দিয়েছে । ছায়েরা আর তার বাবার মতে , একটি ভ্রূণ সৃষ্টি হয় নারী পুরুষের ভালবাসার মাধ্যমে । মাতৃগর্ভে ভ্রূণটি মায়ের শরীর থেকে খাদ্য গ্রহন করে বেড়ে উঠতে থাকে , মায়ের শুধু খাদ্য না তার ভাল মন্দ লাগার অনুভূতি ও ভ্রূণটিকে পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করে । অনেক কষ্ট সহ্য করে পরম মমতায় ৯ মাস অপেক্ষা করে মা তার সন্তানকে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসে । শুধু মা নয় সন্তানটির বাবা , পরিবারের অন্য সদস্যরা ও অপেক্ষা করে শিশুটির জন্মের । এভাবে শিশুটি মায়ের গর্ভে ভালবাসার অনুভূতি অভুভব করতে শেখে । কিন্তু জিহানদের সময়ে মেশিনের মধ্যে শুধু খাদ্য ই সে গ্রহন করে তার মানুসিক বৃদ্ধি ঘটে না । জন্মের পর শিশুটির দায়িত্ব বাবা মা নেয় না , দায়িত্ব নেই বেবি কেয়ার সেন্টার । কারণ জিহানদের সময়ে পরিবার প্রথা নেই । নেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা । সমাজে বিয়ে প্রথা শৃঙ্খলা আনে যা মানব সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে । বিয়ের মাধ্যমে পরিবার সৃষ্টি হয় আর এই পরিবারের ভালবাসা নিয়ে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে শিশু । শিশুর মধ্যে মায়া মমতা ত্যাগ তিতিক্ষার অনুভূতি সৃষ্টি হয় । জীবনটা অনেক আকর্ষণীয় মনে হয় তখন । এখনের সময়ে নারী পুরুষের অবাধ মিলনে নিষেধাজ্ঞা আছে বলেই মিলনের আকর্ষণ এতো বেশি । ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে যে পথের সন্ধান দেয় সেটায় সঠিক পথ । জিহানদের সময়ে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে মানব সম্প্রদায় আজ ধ্বংসের মুখে । প্রকৃতি আর বিজ্ঞানকে যদি পরস্পরের প্রতিদন্ধি হিসেবে দাড় করানো হয় তবে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য । এগুলো ছিল জিহানদের সময়ে আত্মহত্যা করার কারণ , ছায়েরা মনে করে ।
( ১১ )
ডঃ ল্যাম্ববার্ড তার গবেষণা ঘরে বসে আছে । সে সবসময় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে এসেছে । আজ তার ভ্রম ভেঙ্গেছে । সে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে প্রার্থনা করছে , জিহান যেন মিশন শেষ করে ফিরে আসে । আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি । কিছুক্ষনের মধ্যে এ শতাব্দী শেষ হয়ে নতুন শতাব্দী শুরু হবে । তবে জিহান যদি ১০ মিনিটের মধ্যে না আসে তবে কি হবে ডঃ ল্যাম্ববার্ড জানেনা । সময়ের বিপরীতে যেয়ে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার কারনে যে কোন বিপর্যয় ঘটতে পারে এমনকি পৃথিবী ধ্বংস হতেও পারে । চোখ বন্ধ করে আছেন ল্যাম্ববার্ড , তার প্রার্থনা চলছে । এদিকে ঘড়িটে এক এক করে মিনিট শেষ হচ্ছে ১ – ২ – ৩ – ৪ – ৫ – ৬ – ৭ – ৮ -৯ – ১০ । শো শো শব্দে ল্যাম্ববার্ড চোখ খুললেন । জিহান ফিরে এসেছে । নতুন শতকের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে , জিহান আর ডঃ ল্যাম্ববার্ড কোলাকুলি করছে যেন নতুন জন্ম হোল মানব সম্প্রদায়ের এ রকম একটা অনুভূতি নিয়ে ।