কখনও নিজেই জানি না কতটুকু দুঃখ ধরা থাকে বুকে ! অজান্তে কখনও তা ফেটে পড়ে--অশ্রুময় হয়ে ওঠে দুটি গাল।
জানি না কখন যে আমি কেঁদে ফেলেছি ! হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছি। গাড়ি ধীরে ধীরে চ’লে, চলতে চলতে আবার থেমে যায়। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে থাকি আমার বিদায়ী বোনের মুখ। জানি এমনি হয়, তবু, তবু কেন এমনি বুকের বেদন !
আমরা তিন ভাই, দুই বোন। দু তিন বছরের বয়সের ব্যবধান। ছোটবেলায় খেলার আসর নিজেদের ঘরের ভেতরেই বসতো। বিকেলবেলাটা বাইরে বেরতাম, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলাধুলায় যোগ দিতে।
--আমার মাছ, এই দাদা ! তুই আমার মাছ, চেঁচিয়ে উঠেছিল আমার বোন, তূলিকা, যার ডাক নাম, টুলটুল। চেঁচানোর সময়টুকুর মধ্যেই আমি মাছের টুকরো আধা খেয়ে বাকি আধা যথাস্থানে রেখে দিয়েছি। ভাইবোনরা এক সঙ্গে খেতে বসার মাঝের এ সব ঘটনা।
--মা দেখো, দাদা আমার মাছ খেয়ে--
--না মা, ওই খেয়েছে, ওই দেখো অর্ধেকটা ওর পাতেই আছে, বোনকে কথা না বলতে দিয়ে আমি নালিশ জানিয়ে দিতাম মাকে।
মা বলতেন, কি যে করিস না তোরা ! মা জানতেন থাপিয়ে থুপিয়ে এমনি খেতে আমি ভালোবাসি। তিনি হয়ত ছোট এক টুকরো মাছ বোনের পাতে তুলে দিতেন। টুলটুল আগলে রাখত সে মাছের টুকরো। বোনের পাত থেকে চুরি করে তুলে নেবার মধ্যে মাছের টুকরোর জাগায় অনেক সময় ভাজা, মিষ্টি, অন্য পছন্দ মত খাবারও থাকত।
এছাড়া চুল টানা, অলক্ষ্যে মাথায় খোঁচা মেরে দেওয়া, নানা রকমের নাম ধরে ডাকা, এমনি ধরনের পেছনে লাগায় বোন আমার ওপরে খুব খেপে যেত। ও চীৎকার করত, আমায় মারতে ছুটে আসতো, শেষটায় ছোটাছুটি, লুকোচুরির মত একটা খেলা হয়ে যেত।
আমার পরে ছিল ভাই, সে ছিল গোবেচারা। এই গোবেচারার পরের জন হল টুলটুল। আর বাকী ছোট ভাই বোনের সঙ্গে তেমন জমত না। যত গণ্ডগোল ওই বোন, টুলটুলের সঙ্গে।
--এই আয়, তোর চুল বেঁধে দিই ! আমি বলতাম।
ও বলত, না তুই পারিস না। তবু জোরযার করে, আবার অনেক সময় ভুলিয়ে ভালিয়ে ওর চুলে দুচার গিঁট দিয়ে নিয়ে, বলতাম, আরে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে ! ও শুরুতে চুপ করে গিয়ে আমার কথা মেনে নিয়ে যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াত আমি তখন ওর থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছি। ও কেঁদে কেটে দাদা, দাদা, বলে চীৎকার করে যেত...
পেছনে লাগা যাকে বলে আর কি--প্রয়োজনে আবার ভাব করে নিতাম ওর সঙ্গে। ভালো কথা বলে ওকে দিয়িয়ে পিঠ বা মাথা চুলকিয়ে নিতাম। একেক সময় এমন হত যে ভাই বোনেরা একসঙ্গে বসে গল্প করছি সঙ্গে মা, মাসিরাও রয়েছেন।কথাবার্তার মাঝে টুলটুলের হাতটা আমার পিঠে বা মাথায় ঠেকিয়ে দিলাম, বলতাম, একটু চুলকিয়ে দে না রে, ভীষণ চুলকাচ্ছে ! ও সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক সময় ধরে চুলকাতেই থাকতো। আমি বেশ কিছু সময় পরে হয় তো বলে উঠলাম, কলের গানের (গ্রামোফোনের) পিনটা ভালই চলছে রে ! বোনের তখন হঠাৎ খেয়াল হত, ও এ্যঁ, এ্যঁ, বলে আমায় দুটো চিমটি দিয়ে দিত। আমি জয়ের আনন্দ নিয়ে হেসে সরে যেতাম সেখান থেকে। ভাই বোনের এই খুনসুটি মনোমালিন্যের মাঝে কে জানত এক গভীর স্নেহভালোবাসার শিকড় কবে গেড়ে গেছে মনের অতলে !
এ হেন বোন বড় হল। কালের নিয়মে তার বিয়ের দিন এলো। মন থেকে ওর বিয়েতে জি যান দিয়ে খাটলাম আমি।
মনে আছে সে সময়টা কোন কাজের বা সাহায্যের লোক পাওয়া গেল না। স্থানীয় অতিথি অভ্যাগতরা নিচে শতরঞ্চিতে বসে আছেন। বরযাত্রীদের চেয়ারে, বেঞ্চিতে বসার ব্যবস্থা করতেই হয়। স্থানীয় স্কুল থেকে কিছু চেয়ার বেঞ্চি আনার কথা কিন্তু আনবে কে ? মা-বাবা চিন্তিত, জানি বাকি ভাইবোনদের দিয়ে এ কাজ সম্ভব নয়। অনন্যোপায় হয়ে আমি স্কুলের ঠেলা নিয়ে তাতে চাপালাম বেশ কিছু চেয়ার বেঞ্চি। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল, ভালই হয়ে ছিল, আমায় ঠেলা ঠেলতে কেউ দেখে না ফেলে সে ভয়টা ছিল। ঠেলা ভরার পর ধাক্কা দিয়ে দেখলাম আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলা সামান্য মাত্র নড়ছে। তবু ধাক্কাতে ধাক্কাকে, সমস্ত শক্তিপাত করে ঠেলা নিয়ে পৌঁছে ছিলাম ঘর পর্যন্ত। বোনের জন্যে এটুকু কাজ করতে পারব না ? ব্যাপারটা বাবা মার চোখে পড়ে ছিল, ওঁরা মনে মনে দুঃখ পেয়ে ছিলেন বই কি !
যে সব দিনের কথা বলছি সে সব সময় গ্রাম গঞ্জে এখনকার মত টেন্টহাউজ ছিল না। কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের যোগার যন্তর নিজেদেরই করতে হত।
যাই হোক, বোনের বিয়ে ভালয় ভালয় মিটে গেল। সকালে বিদায়ীর কাজকর্ম চলছিল। বিদায়ী শব্দটা মনকে কেমন ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছিল ! সেই বোনের বিদায়ে পিছু স্মৃতিগুলি মনের ভেতর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছিল। চাই ছিলাম না আমি, তবু দুঃখ বিষাদের ভাবনাগুলি আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল। দেখলাম, বাবা ঘরের এক কোণে বড় গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বোনের কাছে বেশী একটা যাচ্ছিলাম না--ও আমায় দেখলেই খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি প্রচণ্ড ভাবে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। মা তো এক মাস আগে থেকেই কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছিলেন। কিন্তু আমরা পুরুষ জাতি, জানি এত সহজে আমাদের ভেঙে পড়তে নেই। ঘরের বাইরে রাস্তায় দু তিনটে কার দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই বরযাত্রীরা রওনা হবে। বিদায়ী নিয়ম অনুষ্ঠানের পরে আমরা বরযাত্রীদের বিদায় দিতে বাইরে বের হলাম। গাড়িতে সবাই বসে গেল, বোন কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। গাড়ি স্টার্ট দেবে, এবার তো বোনের কাছে যেতেই হয় ! গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। বুকের ভেতরের সমস্ত জমা ব্যথা যেন একবারে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল। দু চারবার শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি। চোখের জল কি ভাবে যেন বাঁধ ভেঙে অঝর ধারায় বেরিয়ে আসছিল ! হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমি গাড়ির সাথে সাথে ছুটছিলাম। তখন আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। মানুষের মনের সমস্ত দ্বার আলগা হয়ে গেলে যেমন এক ভাসান অবস্থার সৃষ্টি হয় আমার তখন ঠিক তেমনি ভাব বিহ্বল অবস্থা ছিল। বোনকে ঘিরে আমার সমস্ত অতীত বেলার স্মৃতি চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মত ভেসে উঠছিল। বাবাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি--সেদিন দেখি কন্যা-বিদায় দিয়ে এসে ঘরের কোণে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে জল আমার হৃদয়কে যেন আরও গলিয়ে দিয়ে গেল।