তখন সবে শৈশবের খোলস ছেড়ে কৈশোরের পোশাক পরতে শুরু করে ছিলাম। সব কিছু তখন রঙিন ছিল--কাঁচের রংচংয়ের চুড়ি থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ফুল পর্যন্ত সব আসল মেকি একাকার হয়ে ছিল।
সরল সাদাসিধা তথা কৈশোর বয়সের বোকা একটা ছেলে ! পৃষ্ঠা উল্টে মলাটের ভেতর দেখতে পায় না। তখন তার মনের মাঝে অনাবিল আনন্দ থাকে--নীল বিষাক্ত যন্ত্রণা কোথায় ! তখনও সে শিশুদের মত নীল আকাশের বেলুন ওরা দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। মরা চাঁদের বন ভূমিতেই সে হারিয়ে যেতে চায় ! সবুজের পাতায় পাতায়--কিশলয় চকচক চোখ নিয়ে সে হারিয়ে যেতে চায় তার মন মাখা সৌন্দর্যে।
সে ছিল এক খরা দিনের কথা। বৈশাখের শুরু। ঝড় ঝাপটা--দাঙ্গা বাঁধা মেঘদের ছুটোছুটির সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মধ্যে চমকে ধমকে ওঠা বজ্র বিদ্যুৎ। আর তারই মাঝে দু পশলা বর্ষার ছাঁচ ভেজা মাটির মন মাতানো সোঁদা গন্ধ ! এ গন্ধ কিন্তু বড় মোহময়ী--মনের টান আর মাটির টান এক জাগায় মিশিয়ে দেয়--নিজের দেশ মাটিকে ভালবাসতে শেখায় !
এমনি এক দিনের কথা। এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। টুয়েলভের পরীক্ষা কাছে ছিল,বন্ধুর বাড়িতে একটা বই আনতে গিয়েছিলাম। আর পথেই আবার চলছিল এই ঝড় জলের বিপত্তি। স্ট্রিট লাইট এতক্ষণ যেগুলি জ্বলছিল হঠাৎ গেল নিভে। কাক ভেজা থেকে বাঁচার জন্যে এক অন্ধকার দালান বাড়ির বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। বেশ কিছু সময় আগে সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
মিনিট পনের হয়ে গেল,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছিলাম।
রাস্তায়ও পা বাড়াতে পারছিলাম না,কারণ বৃষ্টি আরও ঝেঁপে আসছিল। হঠাৎ খেয়াল হল,অন্ধকার দালানের ভিতর ঘরগুলিতে কখন যেন আলো জ্বলে গেছে। কিছু মেয়েলি কণ্ঠ কানে আসছিল --সে সঙ্গে হি হি,হা হা,হাসির শব্দ--মাঝে মধ্যে কিছু অস্পষ্ট বার্তালাপ!
আরও কিছু সময় কেটে গেল। বর্ষা তখনও থামে নি--লাগাতার একই ধারায় পড়ে চলেছে। তবু ভিজে হলেও বাড়ি তো ফিরতে হবেই ! বাড়ি পৌঁছাতে হলে আরও প্রায় পনের মিনিট হাঁটতে হবে। বাড়িতে মা,বাবা নিশ্চয় চিন্তা করছেন। বারান্দা থেকে রাস্তায় পা বাড়াব ভাবলাম। ঠিক এমনি সময় খুট,একটা আওয়াজ কানে এলো। আর বারান্দার দিকের একটা জানালা খুলে গেল। এক ঝলক আলো এসে যেন ঝাঁপ দিল বাইরের বারান্দায়। আমি মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়ে ছিলাম। একটা সুরেলা কণ্ঠ আমার কানে এসে বাজলো--বাইরে ভীষণ বর্ষা গো--এখন বাইরে যেও না,ভিজে যাবে !
জানলার দিকে তাকালাম আমি,একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
--ভেতরে এসো--এখন বর্ষা,থামলে যেও। মেয়েটির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছল হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম না--এই মেয়েটি হাসল,নাকি ভিতর থেকে অন্য কোন মেয়ে হাসল !
বারান্দার দিকের দরজা খুলে গেল। আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে মেয়েটি--সে মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী ! ঘরের কম পাওয়ারের আলো ওর মুখে এসে পড়েছে। কাজল আঁকা টানটান চোখ জোড়া--যুগল ভ্রু। কারুকাজ করা শৈল্পিক চোখের পলক- কেশ--কাঁধের দু পাশে ঝুলে আছে কেশ গুচ্ছ বিনুনি। তাতে রজনী গন্ধা বা অন্য কোন সুগন্ধিত সাদা ফুল জড়ানো। হরিণ চোখের দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার চার পাশ ঘিরে মনে হল এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেষ্টনীর সৃষ্টি হয়েছে। আমি স্তব্ধ ও নিশ্চল হয়ে গিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি আমির মধ্যে নেই--কোন স্বপ্নের ঘোরের মাঝে পড়ে আছি!
--কি ঘরের ভিতরে এস--মায়াবী তার স্বর্গীয় ইশারায় হাসির ফুল ফুটিয়ে বলে উঠলো,মনে হল এ যেন কোন স্বর্গীয় সংলাপ আমার কানে ভেসে এলো !
আমি নিজের স্থিরতা ভঙ্গ করলাম। সামনে কোন দেবী বা অপ্সরা যেই হোক তার কথা যেন আমি ফেলতে পারব না। নির্বাক আমি এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে--মেয়েটির পাশ কাটিয়ে আমি সুড়সুড় করে ঘরে প্রবেশ করে গেলাম। মেয়েটি এবার দরজা বন্ধ করে দিল। এবার আমি কি করব ভাবতে পারছিলাম না--ভেতরের ঘর থেকে খিলখিল হাসি আমার কানে এসে আঘাত করল।
--ওই চেয়ারটায় বসো--আমি জল্পনা,তোমার নাম কি ? মেয়েটি নির্দ্বিধায় কথা বলল,আমার মুখ খুলতে ক’মুহূর্ত সময় লেগে গেল। ধীরে বলে উঠলাম,সপ্তক।
--বাঃ,সুন্দর নাম তোমার !
চেয়ারে বসে ছিলাম। মেয়েটি দাঁড়াও,তোমার জন্যে জল আনি,বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পাঁচ,সাত মিনিট সময় পার হয়ে গিয়ে ছিল। এখন আমার কেন যেন সামান্য ভয় ভয় লাগছিল। বাস্তবতা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কোন অলৌকিক ঘটনার কথাও মনে আসছিল। ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার আরও দরজা আছে দেখলাম। আমার কি এ ঘরে বসে থাকা উচিত হচ্ছে ? ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে একটা দরজার দিকে এগোলাম। দরজার ওপারে ঘর থেকে ফিসফাস কথা বার্তা শুনতে পারছিলাম--পুরুষ ও নারী উভয়ের কণ্ঠস্বর। ভয় ও কৌতূহল নিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রাখলাম। কে ওরা ? কি করছে ? দেখলাম স্ত্রী ও পুরুষটির ঠিক মাঝখানে ওপরে ঝুলে আছে এক থোকা কালো আঙুর। ওরা দুজনই সেই থোকা আঙুর থেকে মুখ বাড়িয়ে ঝটপট ছিঁড়ে নিচ্ছে একেক করে আঙুর। কেউ তাতে হাত লাগাচ্ছে না। আঙ্গুর খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছিল যেন ! ওদের পরস্পরের মুখে মুখ ঠেকে যাচ্ছিল--গায়ে গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। মনে হয়েছিল মেয়েটার বাবা,মা হবেন। ওরা হয়তো বর্ষা বাদলের নিভৃত দিনে নিজেদের আনন্দ নিয়ে মেতে আছেন। মেয়েটি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আমি দরজার কাছ থেকে সরে গেলাম।
--কি--দেরী হয়ে গেল আমার ?
আমি কথা না বলে নীরবে শুধু হাসলাম।
--বস না চেয়ারে ! ও এক হাতে আমায় ছুঁয়ে বলে উঠলো,কিশোর শরীর আমার চনমন করে উঠলো,সুন্দর মোলায়েম পুষ্প ছোঁয়ার মত মনে হল।
--এই নাও তোমার চা--
আমি বোকার মত বলে ফেললাম,আমি তো চা খাই না !
--আজকে এই ঠাণ্ডায় একটু না হয় খেলে !
আমি ইতস্তত করছিলাম।
জল্পনা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,প্লীজ চা’টা খেয়ে নাও !
চায়ের কাপ হাতে নিতে গিয়ে আবার মিষ্টি হাতের ছোঁয়া পেলাম। সে সঙ্গে তার গায়ের ও চুলের মিষ্টি সুবাস। বিভ্রাট ঘটল চা’য়ে চুমুক দিতে গিয়ে,গরম চায়ে বড় টান দিয়ে চুমুক দিয়ে ফেলে ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আঁতকে উঠলাম,সম্ভাবনার চে অনেক বেশী গরম পেয়ে আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়ে গেল--শব্দ করে খানখান হয়ে বেশ কিছু টুকরো হয়ে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
আমি আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। জল্পনা আমার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,তুমি বস,তুমি বস।
কাপ ভাঙার শব্দ শুনে দু তিনটে মেয়ে দ্রুত ঘরে এলো। কাপ ভেঙেছে দেখে নিজেদের মধ্যে কিছু সময় হাসাহাসি করল তারপর মেঝে থেকে ভাঙ্গা কাপের টুকরোগুলি সযত্নে খুঁজে,তুলে নিয়ে চলে গেল।
এবার পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল। দেখলাম সেই আঙুর খাওয়া স্ত্রীলোকটি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,জল্পু,এ ছেলেটি কে ? তোমায় না বলেছি আমাকে না বলে তোমার ঘরে কোন দিন কাউকে তুমি ঢুকতে দেবে না ?
--না মা,ও ভাল ছেলে--ঝড় বৃষ্টিতে বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিল তাই--জল্পু নিজের স্বপক্ষে কথা বলার চেষ্টা করল।
স্ত্রী লোকটি জল্পুর মা,আমায় ভাল করে নিরীক্ষণ করে নিলেন। তারপর কি মনে হল অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলে উঠলেন,ঠিক আছে,এখন ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে--ওকে যেতে দাও। জল্পুর মা আবার নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা এঁটে দিলেন। আমি চেয়ারের পাশ থেকে আমার বইটা হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বের হব বলে প্রস্তুত হলাম। জল্পনা আমার কাছটাতে এসে বলল,আর একটু বস না,মার কথা তোমার খারাপ লাগছে ?
আমি চুপ করে ছিলাম। জল্পনা হঠাৎ আমার একটা হাত ধরে বলে উঠলো,আমায় খারাপ মেয়ে ভেবো না--আমি নিজেকে বিলোই নি গো !
আমি এবার অবাক চোখে জল্পুর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ওর কথাগুলি ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। ওর মুখটা বড় করুণ লাগছিল। আমার দিকে ও চোখ ফেড়ে তাকিয়ে ছিল। আমিও সে চোখের দিকে না তাকিয়ে পারি নি। পবিত্র,নিষ্পাপ এক সুন্দরী মেয়ে--আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ! আমি অবাক হয়ে গেলাম--ওর চোখ ফেটে বিন্দু বিন্দু জল গাল বেয়ে গড়িয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম না,ও কেন কাঁদছে--কি এমন দুঃখ ওর ?
জল্পনা আমারই বয়সী হবে--বয়সের অনেক মারপ্যাঁচ সেও হয় তো জানে না। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলাম। ওর কাছে আরও ঘন হয়ে গিয়ে বললাম,তুমি কাঁদছ কেন ? জল্পনা একান্ত আপন হয়ে বলে উঠলো,জানো,আমার বাবা নেই--মা ভাল নয়--আমি জানি--কিন্তু আমি—আমি--,ওর গলা ধরে এলো,কান্না ধরা গলায় ও বলে উঠলো,আমি কিন্তু ভাল,সপ্তক ! আমি এখনও ওদের থেকে দূরে থাকি। আমি জীবনে কখনো চাই না ওদের মত হতে--কান্নায় ভেঙে পড়ল জল্পনা।
আমি জল্পুকে ধরে থাকলাম। কান্নায় ভিজে যাওয়া ওর দু চোখ মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,তুমি খুব ভাল মেয়ে,আমি জানি জল্পু ! আবার আমি ওর চোখে চোখ হারালাম।
--জানো,মা বলে আমি বেশী কথা বলি,আমি নাকি পাগল,কিন্তু আমি তো চাই না মার মত নিচে নামতে। এক দিন নিশ্চয় আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবো,কান্না ভরা চোখ নিয়ে জল্পু আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
মনে হচ্ছিল যে এই খানিক সময়ের মাঝে আমি জল্পনাকে ভালবেসে ফেলেছি। এই গভীর ভালবাসার জোড় বুঝি আর কোন দিন খোলার নয় !
এবার জল্পু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,তোমার মা,বাবা নিশ্চয় তোমার জন্যে খুব ভাবছেন—
আমার সম্বিত ফিরল--এবার যেতে হবে।
--আমায় ভুলে যাবে না তো ? জল্পুর কথাগুলি কাতর প্রার্থনার মত শোনাল।
--না,কখনোই না--আমি কালই তোমার কাছে আবার আসবো--
--আমি কিন্তু তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো,সপ্তক !
আমি ধীরে ধীরে বারান্দা পার করে রাস্তায় নেমে এলাম। দেখলাম দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জল্পু ! করুণ মুখে ম্লান হাসি নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে আছে সে।
পর দিন বন্ধু বলে ছিল,ওই দালান বাড়ি নাকি নিষিদ্ধ পল্লীরই এক অংশ। জল্পুর মুখটা খুব,খুব করে মনে পড়ছিল। আমি বিশ্বাস করি যে ও নিষ্পাপ,ও সরল একটি কিশোরী মেয়ে। ওর জন্যে বহুদিন আমি গুমরে মরেছি। অনেক দিন মনে এসেছে যে কেন,কেন জল্পনার মত অসহায় নির্দোষ মেয়েরা হৃদয় থেকে চাইলেও পাকচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না ? বস্তুত এ জন্যে দোষী তো আমরাই,আমাদের সমাজই,আমাদের সমাজ কবে পর্যন্ত মানসিক উদারতা নিয়ে জল্পনার মত মেয়েদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতে পারবে ? পেটের যন্ত্রণা নিবৃত্তির জন্যেই তো দেশের কত মেয়েবৌরা এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় ! এ তো সমাজ তথা দেশের এক আর্থিক ব্যবধানেরই পরিণাম বলতে হবে !
আমিও পারিনি,সমাজের বেড়া জাল ডিঙিয়ে পারিনি,একবার ওর হাত ধরে বলতে,জল্পু ! তুমি আমায় ক্ষমা করো !