পার্থ হাসছে। কিছু একটা চিন্তু করার ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখে মাথা ঝাকাচ্ছে আর হাসছে। এই হাসি সহজ হাসি না। আর্কেমিডিস সাহেব সোনার মুকুট পানিতে ডুবিয়ে বিনা কাপরে দৌড়ানোর সময় যে হাসি হেসেছিলেন সেই হাসি। খাটি বাংলায় বলতে গেলে - আবিষ্কারের হাসি।
কিচ্ছু না, পার্থ বসে বসে গান শুনছিল। সহজ সুরের কঠিন গান। অনেক শব্দের অর্থও সে জানে না। গোলাম আলী সাহেবের ‘ইয়ে দিল, এ পাগল দিল মেরা কিউ বুঝগায়া আউয়ারগি’। গানটা শুনতে শুনতে সুরের মুর্ছনায় চোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথেই বিন্দুর মুখটা মনে ভেসে ওঠলো। ব্যাস ঘটনা এতটুকুই।
বিন্দু হলো পার্থর বাড়ীওয়ালার মেয়ে। এই মেয়েকে চোখ বন্ধ করে দেখার মত কোন কারন নাই। দুই বছর ধরে এই বাড়ীর ছাদের চিলেকোঠায় সে আছে। অনেক ঝক্কিঝামেলা করে ভাড়া নিতে হয়েছিল। কিন্তু বাড়ীওয়ালা ওবায়দুল সাহেব দুই তিন মাস পর থেকেই নিশ্চিন্ত আছেন ব্যাচেলর এই ভাড়াটিয়াকে নিয়ে। ভাড়া দেবার অজুহাতেও সে কোনদিন বাসায় ঢু মারেনি। গুলশানে ওবায়দুল সাহেবের একটা স্বর্ণের দোকান আছে। সেই দোকানে প্রতি মাসের দুই তারিখের মধ্যে পার্থ গিয়ে ভাড়া দিয়ে আসে।
প্রেম টেম নিয়ে পার্থর অনেক কবিতা টবিতা আছে। সে প্রেমের উৎস হলো পরিচিত কোন মেয়েকে নিয়ে তিল থেকে তাল কল্পনা করে কিছু লেখা। কিন্তু এখন কি হলো এই ঘটনাটা? যে মেয়েটার সাথে ভাল করে কোনদিন কথাও হয়নি তাকে এমন করে সে কেন দেখবে?
পার্থ একটা কাগজ নিয়ে লিখলো -
“প্রেম হচ্ছে অসীম অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা হাজার পাওয়ারের বাতি। এই বাতি কারনে অকারনে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে। বাতি জ্বলেছে। এর মধ্যে লেশমাত্র, কনামাত্র সন্দেহ নাই। এক জীবনে জোনাকি পোকার মৃদু আলোকে প্রেম ভেবেছি হাতরে ফিরেছি বহু বার। এবার...”
পার্থ আবার হাসলো। ডট ডট দিয়ে দিয়ে বাকী কাগজটা আস্তে আস্তে ভরতে ভরতে সে চিন্তিত হাসি হাসতেই থাকলো। এই ডট কি বিন্দু’র ডট নাকি চিন্তার ডট?
স্মৃতি থেকে পার্থ এক এক করে ঘটনাগুলো ঘেটে দেখছে। প্রতি মাসে দুই এক বারের বেশী কি বিন্দুর সাথে তার দেখা হয়? উম্ম নাহ। গেটের মুখে ছাড়া আর কি কোথাও দেখা হয়েছে? নাহ্ তাও না। প্রথম বছরটা কেটে গেছে গেটে দেখা হওয়া পর্যন্তই। গত কয়েক বার দেখা হওয়ার সময় কেমন আছি / জ্বি ভাল পর্যন্ত কথা হয়েছে।
মেয়েটা ফর্সা, রোগা, নম্র টাইপ। আচ্ছা নম্রটাইপ কেন হবে? একটু বাঁকা হয়ে হাটে বলে কি নম্র টাইপ মনে হচ্ছে? পার্থ প্রথমে ভাবলো বিন্দুকে নিয়ে ভাবা আর আদার ব্যপারীর জাহাজের খবর রাখা একই বিষয়। আদার ব্যপারীর নাকি জাহাজের খবর নিতে হয় না। ঘটনা কিন্তু সত্য না। আদা যদি জাহাজে করে ইমপোর্ট করা হয় তাহলে আদার ব্যপারীর তো জাহাজের খবরাখবর রাখতেই হবে। মাথা কিছুতেই কাজ করছে না। বিন্দুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। পার্থ আবার হাসছে। এর কোন মানে হয়? এই প্রেমের কোন মানে হয়!
ইদানিং একটা চাল হয়েছে। বেশ কিছু সিরিয়াল নাটকে দেখাচ্ছে বাড়ীওয়ালার মেয়ের সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা হচ্ছে, প্রেম হচ্ছে। বাস্তাব যে বড় কঠিন। পার্থ তবু কঠিনকেই ভালোবাসিলো।
জীবনে এই প্রথম পার্থ নিজেকে চরম অসহায় মনে করলো। অযোগ্য, অবহেল্য, তুচ্ছ ছাড়া নিজেকে আর বেশী কিছু মনে হচ্ছে না। ছিঃ এমন করেও প্রেম হয়? বিনা মেঘে বজ্রপাত তাহলে হয়। আজ বিনা মেঘে বজ্রপাত শব্দটাকেও বেশ জ্ঞানগর্ভ কথা মনে হচ্ছে। পার্থর মত এমন অসহায় হয়েই কি কেউ একজন এই শব্দগুলো প্রথম একসাথে ব্যবহার করেছিলেন!
এমন মহূর্তের জন্য নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ কিছু বলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাইরে মানুষের কোন অনুভূতি থাকতে পারে না। পার্থ গান ছাড়লো –
সখী ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল। সে কি কেবল দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ।
আহারে, সেকি কেবলই চোখের জন? সম্পর্ণ বিনা কারনে পার্থর চোখ ছলছল করে ওঠলো। নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। ছিহ্ এ কোন পার্থ? সে মেয়ের নিজস্ব একটা জীবন নিশ্চয়ই আছে। তার জন্য পার্থর এমন কেন লাগবে? বিন্দুর ডান চোখের নীচে একটু কালো দাগ আছে। স্বষ্ট মনে হচ্ছে দাগটাকে। আসলেকি দাগটা আছে? এমনও হতে পারে, সে নিজের মনের অজান্তেই বিন্দুকে খেয়াল করেছে অনেক দিন আগে থেকে। নাহলে এমন স্বষ্ট মূর্তি তৈরী হবার কথা না। অথবা মস্তিস্ক তাকে প্রতারণা করছে। পার্থ তার গালে হাত দিয়ে চোখের পানি আঙ্গুলে নিলো। এবার সেই আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলো। দুঃখের হাসি। একজন সব হারিয়ে ফেলা মানুষের হাসি।
পার্থ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো কুয়াশায় ঢাকা শহর। আচ্ছা ঢাকা শহরে কি সেই কুয়াশা দেখা যায় যে কুয়াশা গাছ বরাবর আটকে থাকে শূন্যে? বিন্দু কোন ক্লাশে পড়ে। ইন্টার অথবা অনার্স র্ফাষ্ঠ ইয়ার? মেয়েটাকি জানে কুয়াশার দুইটা ইংরেজী আছে? সরংঃ হচ্ছে গাছ বরাবর শূন্যে আটকে থাকা কুয়াশা। যার উপরে নিচে কুয়াশা প্রায় নেই বল্লেই চলে। আর ভড়ম হচ্ছে সাধারণ কুয়াশা। আচ্ছা পার্থকি পারে না একদিন গেটে দেখা হলে এই অজুহাতে একটু কথা বলতে মেয়েটার সাথে? কত মানুষ আছে বিনা কারনে মজা করে আড্ডা শুরু করে দিতে পারে। সেকি পারবে? নাহ্ চেষ্টা করার মানে হয় না। যারা মজা করতে পারেনা তারা জোর করে মজা করাটা বড় অশোভণ।
আচ্ছা পৃথিবীতে কি এমন একটাও প্রেম হয়েছে যেখানে নিজেকে একটু বেশী যোগ্য বলে মনে হয়েছে? নিজেকে বেশী যোগ্য মনে করা মানে তো এক ধরনের অহং বোধ। অহং বোধ থেকে কি প্রেমের মত শুদ্ধ বীজ জন্মাতে পারে?
পার্থ এখন কী করবে? পার্থ আবার মনে মনে হাসছে। সে এখন কি এবং কী এর পার্থক্য নিয়ে ভাবছে। আচ্ছা একদিন হুট করে বিন্দুকে কি বলা যায় বিন্দু কি আর কী এর পার্থক্য জানো? বিন্দু হয়ত বলবে বুঝলাম না। পার্থ তখন বুঝিয়ে বলতে পারে, তুমি কি খাবা? এর উত্তর তুমি দিতে পারো হ্যাঁ বা না। আবার যদি বলি তুমি কী খাবা? তখন হয়ত বলবে ভাত বা রুটি। যার উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেয়া যায় তা হবে ’কি’? আর যার উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেয়া যায়না তা হবে ‘কী’? এই পর্যায়ে এসে আবার মনে হলো, নাহ হলো না। ‘কী’ বুঝাতে গেলে ভাঁড় এর মত কীইইই.. করে দীর্ঘক্ষণ টান দিয়ে বুঝাতে হবে এতে নিজেকে ভাঁড় মনে হবে। সে তো আর গোপাল ভাঁড় না!
আচ্ছা গোপাল ভাঁড় হলেওতো মন্দ হতো না। রাজ দরবারে প্রবেশাধিকার থাকতো আবার রাজাকে নিয়ে মজাও করা যেত। রাজা যদি বলতো, পার্থ তোমার আরা গাধার মধ্যে পার্থক্য কতদূর বলতে পারো? সে রাজার দুই হাদ দূরে দাড়িয়ে মেপে বলতে পারেতা, মহারাজ দুই হাত। পার্থর কী আছে? আচ্ছা এই কী এর বানান কি হবে নাকি কী হবে? পার্থ কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?
প্রেম ও যুদ্ধে নাকি কোন আইন নাই। জিতার জন্য যা খুশি করা যায়। এর নাম মধ্যে তাহলে অপর পক্ষের মতামতের দাম দেয়া হলো কোথায়? ।অচ্ছা এই প্রেম কি তাহলে দুইজন রাজি কিন্তু পরিবার রাজি না এমন প্রেম? পার্থতো তাহলে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। খাটি বাংলায় বলতে গেলে ছাল নাই কুত্তার নাম বাঘা। আচ্ছা এমন আর কী কী আছে? ফকিন্নির পুতের বড়াপিঠা। কই রাজরাণী কই **মারাণী। পার্থ আবার হাসছে। এবার শব্দ করেই হাসছে।
এই প্রথম বাড়ীওয়ালা ওবায়দুল সাহেব পার্থর দড়জায় এসে কড়া নাড়লেন। এত বছরে কোন দিন দরকার পরে নাই। কলে সমস্যা, চুলায় সমস্যা এমন কোন অভিযোগও নাই পার্থর যে করানে হয়ত আসাও হয়না। পার্থ একটু অবাকই হলো, তার রুমে কড়া নারার মত কেউ নাই। একটু ভ্রু কুচকেই সে দড়জা খুলে দিলো -
- আংকেল আপনি! আসুন আসুন..
ওবায়দুল সাহেব পার্থকে দেখে কিছুটা ধাক্কার মত খেলেন। রাত তিনটার দিকে ছেলেটা কাঁদছে কেন? চোখে পানি অথচ অনর্গল হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে তিনি দেখতে এলেন। হিসাবতো মিলছে না। তিনি ছেলেটাকে পছন্দ করেন। গলায় মায়া নিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন
- পার্থ হয়েছে কি?
পার্থ কিছু বলার মত খুঁজে পেল না। চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইলো। সে জানে ওবায়দুল সাহেব তাকে একটু পছন্দ করেন। সে কারো পছন্দের জায়গা নষ্ট করবে না।
ওবায়দুল সাহেব কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলেন। কি মনে করে যেন পার্থর মাথায় হাত রেখে চুলটা একটু নেড়েচেড়ে বল্লেন, পার্থ আপনি ঘুমান, সকালে কথা হবে। পার্থ হালকা করে একটু মাথা ঝাকালো। নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। তার চোখ যে ভিজা এই ব্যপারটাও সে খেয়াল করেনি। এমনকি মাঝ রাতে যে সে হাহা করে হেসেছে তাও না। এমনতো পার্থ না! এ কোন পার্থ। এত দূর্বল পার্থতো সে না! এ কোন পার্থ? মা বাবা ছাড়া একটা ছেলে মন্দের সাথে ধাক্কা না খেয়ে, ঠোকা না খেয়ে সহাবসন্থান করে করে বড় হয়েছে। নিজে মন্দ হয়নি। পড়ালেখা বলতে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়েছে তারপর নিজের উদ্দোগে সে ব্যবসা দাড়া করাচ্ছে। বাবা মাঝে মাঝে বলতেন পনোরো থেকে পচিশ এই বয়সটাই ভালো বা মন্দের দিকে নিয়ে যাবার সময়। সে এই পচিশ পর করেছে দুই বছর আগে। প্লাষ্টিকের গৃহস্থালী তৈরী করার একটা কারখানা আছে পার্থের। দিন দিন ব্যবসাটা ভালোই চলছে।
সকাল বেলা একটু আগে আগেই সে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল। পাছে ওবায়দুল সাহেবের সাথে দেখা হয়। ভদ্রলোকের সাথে তার ষ্টেটাসের বিস্তর ফাঁড়াক। এত বড় একজন মানুষের ভালোবাসা নেবার মত ক্ষমতা এখনো পর্থের হয়নি। এই ভালোবাসা জিনিসটা আজব এক চিজ। এর ছাড়া চলেনা আবার এরে সহ্য কারা মত ক্ষমতাও সব মানুষের থাকে না। বেশীরভাগ মানুষেরাই ভালোবার মুখমোখি হতে বিব্রত হয়, পলিয়ে বেড়ায়। সে যেমন ভালবাসাই হোক। দূর থেকে ভালবাসা পাবার সৌভাগ্য সবার হয়না। যাদের হয় তারা বিনা বিব্রতবোধে সেই ভালাবাসার স্বাদ নিতে পারেন। সেই ভালবাসাকে তিল থেকে তাল করে গর্ব করতে পারেন।
কারখানায় এসেই সে কয়েকটা ছাঁচ বাতিল করে নতুন করে ছাঁচ করতে দিল। ছাঁচের নাম বিন্দু। আর বিন্দুর হৃস্বউকার টা ঘুরে এসে একটা বৃত্তের মত হয়েছে। পার্থ যে বৃত্তে বাধা পড়লো সে বৃত্ত সে নিজের কারখানায় প্রতিদিন দেখবে। তবু তার দূর্বলতা দেখিয়ে অন্যের চোখে নিজে ছোট হবার মত কার সে করবে না। আর পার্থ যে বালতি, বদনা ইত্যাদি তৈরী করে তা কোন দিন ওবায়দুল সাহেবের মত বিত্তবান মানুষের ঘরে যাবে না। এই সব প্লাষ্টিকের প্রধান কাষ্টমার হচ্ছে বস্তিবাসী।
কাজী নজরুলের একটা কবিতার লাইন মনে পড়তে পড়তেও পার্থর মনে পড়ছেনা। কবিতাটা অনেকটা এমন -
যে চাঁদ জাগালো সমুদ্রে জোয়ার
সে চাঁদই শুনে নাই সাগরের কূলে কূলে কাঁদা ফুলে ফুলে নিশীদিন
সুরের আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে শুনে নাই তাহা বীণ।
আহারে বিন্দু! নিজে সে কি জানে তারে গত রাত থেকে এখন পর্যন্ত অন্য একটা মনে কতবার পড়েছে? যারে এত মনে করছি সে কি তা একটুও টের পাবে না? টেলিপ্যাথি বলতে কি কিছুই নেই দুনিয়াতে?
রবীন্দ্রনাথ তবে কেন লিখলেন -
ডাকবো না ডাকবো না
অমন করে বাইরে থেকে ডাকবো না
পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাবো আনবো ডেকে।
পর্থের মত রবীন্দ্রনাথও কি তবে কাউকে মনে করতেন এমন? তিনিতো পার্থের মত অযোগ্য ছিলেন না। তবু সত্যি প্রেম ছিল বলে তিনিওকি পার্থের মত এতটা হীনমন্য ছিলেন? প্রেম কি তবে মানুষের যোগ্যতাকে এতটা ছোট করে দেয় নিজের কাছে? আচ্ছা বিন্দু যদি কোনদিন এসে তার সামনে বসে দুই হাত ধরে বলে, আপনি বলুন যা বলবেন। আজ আপনার বলার দিন। পার্থ তখন কী বলবে? আচ্ছা এই কী এর বানান কী হবে? কি না কী? উত্তর কি হ্যাঁ না হবে নাকি কিছু একটা হবে?
আচ্ছা বিন্দু জানবেও না তারে একটা মানুষ প্রতিনিয়ত কত কত কত মনে করছে। তার হয়তি বিয়ে হয়ে যাবে। তখন পার্থ বলবে, যে আমারে প্রেম শিখালো সে যেন আজ সুখেই থাকে। কিন্তু বিন্দু কি তাকে প্রেম শিখিয়েছে? সে তো নিজে নিজে শিখেছে। কেমিষ্ট্রিতে একটা শব্দ আছে অনুঘটক। আচ্ছা অনুঘটক আর প্রভাবক কি একই জিনিষ? এর ইংরেজী কি ক্যাটালিষ্ট? এত কনফিউজ্ড হয়ে যাচ্ছে কেন সে? স্মৃতিওকি তবে বিট্রে করছে?
পার্থ আজ বেশ রাত করেই বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরার পথে পুরোটা পথ সে হেটে হেটে আসলো। মাঝে একবার আনমনে হাটতে হাটতে রাস্তার মাঝে চলে এসেছিল। ভাগ্য ভালো কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। শুধু মোটর সাইকেল আরোহী তাকে শুয়ো...বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। বাসায় ঢুকলো সে রাত এগারোটার কিছু পরে। এমনিতে প্রতিদিন ঢুকে রাত নয়টার মধ্যেই। দাড়োয়ান পার্থকে দেখেই জানালো, খালুয় আপনারে দেহা করতে কইছে। ঠিক এমনটা মনে করেই সে আগে থেকেই একটু বিব্রত ছিল। কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বাসায় ঢুকে যদি কোন না কোন ভাবে বিন্দুর সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে পার্থের মুখ ফেকাসে হয়ে যাবে নির্ঘৎ। ঘটনা আন্দাজ করার জন্য পিএইডি ডিগ্রী লাগবে না। হনুফার মা’ও বলে দিতে পারবে, আফনে কি আফারে পছন্দ করেন?
বাসায় নক করতেই পার্থর হাত পা কাঁপছিল। কিন্তু সে প্রানপন চেষ্টা করছে তার দূর্বলতা ঢাকতে। সে এই পরিবারের কাছে ছোট হবে না। পরাজয়ে যেমন ডরে না বীর তেমন করে দূর্বলতায়ও ডরে না পার্থ। দড়জা খুলেই ওবায়দুল সাহেব বল্লেন, আরে পার্থ আসেন, আসেন।
পার্থকে ওবায়দুল সাহেব আপনি করেই বলেন শুরু থেকে। আজ বোকার মত সে বলে বসলো, আংকেল আমি আপনার ছেলের মত, তুমি করে বলেন। এই ভুলের শুরু। এই ভুল বিপদেরও অংশ। আর বিপদ কখনো একলা আসে না। সে নিশ্চয়ই আরো কোন ভুল করবে। একটু বিব্রত এবং নিজের উপর একটু বিরক্ত হয়ে সে সোয়ায় আটোসাটো হয়ে বসে রইলো। ওবায়দুল সাহেব কি বলবেন তাও খুঁজে পেলেন না। এরপরেও কথাবার্তা বলার জন্যই কিছু একটা বলতে হবে। তিনি ছেলেটাকে পছন্দ করেন। পরিশ্রমী ছেলে। এই বয়সের ছেলেরা যৌবন নষ্ট করে রাজনীতির অন্ধকারে অথবা গলির মুখে। এমন পরিশ্রমী ছেলে থাকলে দেশের উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। এরা নিজেরাই এক একটি মহাথির। ছেলেটার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি একটু হেল্প করলেই হয়ত হবে। ওবায়দুল সাহেব ব্যবসায় যত উন্নতি করেছেন তা ভাগ্যগুনেই করেছেন। এত ভালমন নিয়ে ব্যবসা করে খুব কম মানুষই ঢাকা শহরে বাড়ী গাড়ী করতে পারেন। নির্ভেজাল ব্যবসা করে তিনি তা করেছেন। মেয়ে মানুষ ভাগ্য নিয়ে আসে। ওবায়দুল সাহেবের বিয়ের পর তা প্রথম টের পেলেন। পরে বেশী করে টের পেতে থাকলেন যখন পর পর তিন বার তার তিনটি কন্যা সন্তান হলো। এক একটি কন্যা তার জন্য এক একটি সৌভাগ্যের দড়জা খুলে দিয়েছে। ওবায়দুল সাবেহ কিছুটা বোকার মতই প্রশ্ন করলেন, তারপর আপনার বাবা মা কেমন আছে?
পার্থ একটু হাসলো। আসলে বাসা ভাড়া নেবার সময় সে সরাসরি সব খুলে বলেছিল। এর পর আর তেমন কথাই হয়নি। তাই ওবায়দুল সাহেবেরও তা দোষের কিছু না। পার্থ কিছুটা বিষাদের ভদ্র হাসি হেসেই বল্লো, আংকেল আমার মা আমার জন্মের সময়ই মারা গেছেন আর বাবা মারা গেছেন আমার যখন বারে বছর বয়স তখন। আমার যা আছে সব দূর সম্পর্কের।
ওবায়দুল সাহেব কিছুটা বিব্রত হলেন। ছেলেটাকে নিয়ে একটু গল্পগুজব করে মন খারাপটা দূর করে দিবেন ভেবেছিলেন উল্টা মন খারাপ করে দিলেন।
পার্থ এবার নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করলো, আংকেল আপনারা আছেন কেমন?
- আছি পার্থ, বেশ ভালো আছি। তবে কি জানো, বয়স হলে মানুষজন একটু স্মৃতিকাতর হয়ে যায়। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। আশা ছিলো মেয়ে দুইটাকে কাছাকাছি রাখবো। মধ্যবিত্ত টাইপ পরিবারে বিয়ে দিবো। দিয়েও ছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েগুলো সব ভাগ্যবতী। আমার সংসারে যখন এলো বাবাকে সাফল্যের মুখ দেখালো। নিজের সংসারে যখন গেল তখন সাফল্যের বন্যা বহালো। দুই মেয়রে জামাইই এখন ইউরোপে থাকে। সেই দেশের হিসাবেও নাকি এরা বারাবারি রাকম বড়লোক।
এতটুক বলেই ওবায়দুল সাহেব হাসতে থাকলেন। হাসতে হাসতে একটা সময় মনটা খারাপ করলেন। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে চোখ মুছলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বল্লেন, লক্ষীদের দেখা আর আমার হয়না। বাবাকে এরা ফোন দেয় নিয়ম করে। কিন্তু বাবার উপর ঝাপায়ে পড়ার সুখটা বাবাকে দেয় না বহু বছর। কে জানে আমার হয়ত মৃত্যু হবে তিন মেয়ে আমার উপর ঝাপায়ে পড়ছে কল্পনা করতে করতে।
বিন্দু, বিন্দুর মা দুজনেই ওবায়দুল সাহেবের মন খারাপ দেখে ড্রয়িংরুমে এলেন। বিন্দু বিড়ালছানার মত বাবার পায়ের কাছে বসলো কার্পেটে। বিন্দুর মা সোফার হাতলে বসে ওবায়দুল সাহেবকে সান্তনা দেবার ভাঙ্গিতে ধরলেন।
পার্থর খুব ভালো লাগছে। আহারে সুখ দেখেও এত সুখ? নিজের মনের ভিতর চেপে রাখা প্রথম হাজার পাওয়ারের বাতির আলোর ঝলকানির মত প্রেমের ব্যাথার মত সুখটাও এর কাছে ছোট। পার্থের হঠাৎ করেই মনে হলো আচ্ছা বিন্দু এত বড়লোকের মেয়ে না হয়ে একটুকি মধ্যবিত্ত টাইপ পরিবারের মেয়ে হতে পারলো না? অবশ্য এতেই লাভ কি এতিম ছেলের কাছে কে মেয়ে দিবে? কোন ভরসায়ই বা দিবে? হাজবেন্ড ওয়াইফের এক সাথে জীবন কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে বেশ তিক্ত সময় যায়। যখন পরিবারের ছায়া মাথার উপর না থাকলে সম্পর্ক টিকে না।
পার্থকে সেদিন সবার সাথে এক টেবিলে খেয়ে দেয়ে তারপর আসতে হয়েছে। সে চেষ্টা করেছে তার দূর্বলতা ঢাকার জন্য। সে মাথা নীচু করে এমন ভাবে সময়টা কাটালো যেন এ সাধারণ ভদ্রতা। সে বার বার চেয়েছে তার ভিতরে জ্বলে ওঠা হাজার পাওয়ারের প্রেমের বাতিটার সমস্ত আলো যেন তার নিজের অন্তরেই থাকে।
পার্থ এমন করে তার পার্সনালিটি বজায় রেখে সমস্ত সুখের বিরহ সয়েছে আরো পাঁচটি মাস। কাঁটা চামচের ঘাই সয়ে সয়ে কিভাবে মোরব্বা হয় তা পার্থর কলিজা নামের বস্তুটি জানে। সে বহুবার চেয়েছে বাসা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আবার মনে হয়েছে তখন কোন অজুহাতেই তো আর মাসে দুই একদিনও দেখা হবে না! পার্থ তো গলির মুখে দাড়িয়ে থাকা ছেলে না। যে পরিবারটি তাকে এত সম্মান দিলো সেই পরিবারের কাছে সে কিভাবে নিজেকে দাড় করাবে? প্রেম পবিত্র তা ঠিক আছে। কিন্তু সামাজিকতার মূল্যও কোন কালে কম ছিল না। বিন্দু তাকে অনেক সম্মানের নজরেই দেখে বলে মনে হয়। ইদানিং গেটে দেখা হলেও সহজ ভাবেই বলে, কেমন আছেন আপনি? বিন্দু বলতে পারতো কেমন আছেন। কিন্তু শেষে আবার আপনি যোগ করে বলে কেমন আছেন আপনি? খুব ভাল লাগে পার্থর কাছে।
এমন করে কেটে গেল আরো তিন বছর। বিন্দুর বিয়ে ঠিক হলো। পাত্রটা দেখতে বেশ ভদ্র। চশমা পড়ে। সেই চশমা ভেদ করে চোখের সরলতা পড়া যায়। তিন বছরে বিন্দু প্লাষ্টিকের বেশ নামও হলো। এখন বিন্দু প্লাষ্টিকের আসবাব যে দেশজোড়া তাই না। সেদিন ওবায়দুল সাহেব জোড় করেই ঘরে নিয়ে খেতে বসালেন। বিন্দুদের ঘরে গ্লাস রাখার জারটা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা প্রেডাক্টই নজরে পড়লো বিন্দু প্লাষ্টিকের। বাহ বিন্দু নামটা বেশ ফুটেছে তো বিন্দুদের ঘরের আলোয়! বিন্দু নামের মেয়েটি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে বিন্দু প্লাষ্টিকের জিনিষপত্রগুওলো। বিন্দু সংসারী মেয়ে, লক্ষী মেয়ে সে খেয়াল না করে পারেই না। কিন্তু এই মেয়েটিকি জানে এই প্লাষ্টিকগুলো তারেই উৎসর্গ করা? সে মেয়েটিকি জানে এই প্লাষ্টিক কোম্পানির মুলধর এখন তার বাবার সমস্ত সম্পত্তির চেয়েও বেশী? অথচ সমস্ত কিছু এই মেয়েটির পায়ের নখের যোগ্যও হয়েছে বলে মনে করে না পার্থ। সে আগের মতই আছে। আগের আসবাবপত্রগুলোই তার ঘরে আছে। এলাকার কেউ জানেওনা পার্থ বিন্দু প্লাষ্টিক লিমিটেডের চেয়ারম্যান।
বিন্দুর বিয়ে হয়ে গেল। সে বিন্দুর ভালোমানুষ বরটিকে হিংসা করলো। এ হিংসা পবিত্র হিংসা। এ হিংসা ভালবাসার হিংসা। বিয়ের কয়টি দিন ওবায়দুল সাহেব ছেলের মতই ডিপেন্ড করেছেন পার্থের উপর। সে করেছে সাধ্যমত। বিন্দুকে বিদায় দিয়ে সে মনে মনে সে আবৃত্তি করেছে,
আমি বর দিনু দেবী, তুমি সুখী হবে
মুছে যাবে সর্ব গ্লানি বিপুল গৌরবে।
আর একটা গান সারা রাত বেজে গেল ...
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয়।
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনি মদির চোখে চাহিও।।
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল
লুকাতে সে জল করিও না ছল,
যে প্রিয় নামে ডাকিতে মোরে
সে নাম ধ'রে বারেক ডাকিও।।
তোমার প্রিয় যদি পাশে রয়,
মোরও প্রিয় সে দিন করিও না ভয়,
কহিব তারে আমার প্রিয়ারে
আমার অধিক ভালবাসিও।।
বিরহ-বিধুর মোরে হেরিয়া
ব্যথা যদি পাও যাব সহিয়া,
রব না হ'য়ে প থের কাঁটা
মাগিব এ রব মোরে ভুলিও
***
হে পার্থ, তুমি সুখী হও।
০২ সেপ্টেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪