১)
দুদিন হলো বাচ্চটাকে ফেলে গেছে কে যেন।
একেবারে পুরো দুই দুইটি দিন রাস্তায় পড়ে আছে শিশুটি। একলা, নিঃসঙ্গ। ভীত, আতঙ্কিত। কেউ আসেনি তার খোঁজ করতে, কেউ আসেনি তাকে ফিরিয়ে নিতে।
খবরের কাগজের এক লোক অবশ্য এসেছিলো। গোটা কয়েক ছবি তুলে,জন কয়েকের জবানী শুনে চলে গেছে নিজের পথে। রমজান আলী জানে, সেই লোকও আর কখনও ফিরে আসবে না। একটি মসলাদার খবরের দরকার ছিল কেবল তার, অসহায় বাচ্চাটাকে সাহায্য করবার প্রয়োজন ছিল না। এবং ইচ্ছাও নয়।
দশ/এগারো বছরের একটা মেয়ে। দেখলেই বোঝা যায় অসুস্থ। কিভাবে বোঝা যায় জানে না রমজান আলী, কিন্তু বোঝা যায়। মনে হচ্ছে অসুখটা তার খুব বেশী। কেননা আজকে দুটো দিন যাবত একই ভাবে বসে আছে সে। না নড়েছে, না চড়েছে। কেবল ভীত চোখ গুলো এদিক ওদিক অস্থির হয়ে দেখছে। কাউকে খুঁজে চলেছে যেন, কারও আশায় আছে সে। যে আসবে, আর উদ্ধার করে নিয়ে যাবে তাকে এই পরিস্থিতি থেকে।
কাকে খুঁজে চলেছে সে? মা.. ..বাবা.. .. পরিবার?
বেচারী এটাও জানে না যে সেই পরিবারই ফেলে গেছে তাকে যাদের জন্য এত প্রতীা তার। একটা অপ্রয়োজনীয় আর্বজনার মতন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে আস্তাকুঁড়ে। কেননা নিজেদের জীবনে তাকে আর চায় না রক্ত সম্পর্কের মানুষগুলো এখন।
কারা ফেলে গেছে, সেটাও স্পষ্ট মনে আছে রমজান আলীর। বছর ত্রিশেকের এক যুবক, মেয়েটার সাথে চেহারায় অসম্ভব মিল দেখে মনে হয় বুঝি ভাই হবে। সাথে একটু কম বয়সের আরেকটি মেয়ে। হয়তো ভাবী, হয়তো বোন। এখন আর সেটা জানার কোনো উপায় নেই। সেই মানুষ দুজন মিলে একটা হলুদ ক্যাবে করে নিয়ে এসেছে বাচ্চা মেয়েটাকে।
অনেক ভোর তখন। সাড়ে পাঁচটা কি ছয়টা হবে। মাত্র টঙের দোকানটা খুলে দিনের প্রথম লিকার জ্বাল দেবার জন্য স্টোভে কেটলি চাপিয়েছে সে। জ্বেলেছে আগরবাতি, খদ্দের আর্কষনের জন্য কেক বিস্কুটের ঠোঙা গুলো ঝুলিয়ে দিয়েছে হুকের সাথে। সেই খুব ভোরের সময়টাতেই বাচ্চাটাকে নিয়ে হাজির দুজনে। ঘুমন্ত বাচ্চটাকে কোলে করে ফুটপাতে নামিয়ে দিয়ে চোখের পলকে চলে গেলো তারা হলুদ ক্যাবে চেপে। এবং একবার ফিরেও তাকালো না দুজনের কেউ।
বাচ্চাটা কি আসলেই তাদের আপন ,নাকি কোথাও থেকে অপহরণ করে আনা- সেটা তো জানার কোনো উপায় নেই। তবে এটা জেনে গেছে রমজান আলী যে মেয়েটাকে নিতে কেউ আসবে না। দুটো দিনেও যার খোঁজ পড়েনি, তার খোঁজ যে আর কোনো কালেই পড়বে না সেটা নিশ্চিত। ষাট বছরের দীর্ঘ জীবন অন্তত এটুকু অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই দিয়েছে তাকে।
কি হবে মেয়েটার? এভাবেই রাস্তায় পড়ে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরবে?
হাত পা ঠিকই আছে দেখা যায়, কিন্তু মনে হয়না হাঁটতে জানে বা পারে। একটা জড় বস্তুর মতন পড়ে আছে ফুটপাতের এক কোণে, কাপড়-চোপড়ে পায়খানা-প্রসাব করে ভাসিয়েছে জায়গা। এর মাঝেই বসে আছে, ঘুমাচ্ছে। হাঁটতে পারলে তো অন্তত সরে গিয়ে বসতো। নাকি পায়খানা-প্রসাব যে নোংরা, সেই বোধটাই তার নেই?
হবে হয়তো! কেননা খাওয়ার বোধটাও তার নেই। দুদিন যাবত পেটে কোনো দানা-পানি পড়েনি। গতকাল কে যেন একটা বনরুটি দিয়েছিলো, ছুঁয়েও দেখেনি একবার। ুধা তো লেগেছে অবশ্যই, গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সেটা। কিন্তু কি করে খেতে হয়, সে জ্ঞানটুকুনও নেই হতভাগীর।
ভাবনাটা আবার ফিরে আসে মনে- কি হবে এই মেয়ের? পরনে ভদ্র ঘরের পোশাক, বোঝাই যাচ্ছে পরিবার অবস্থাপন্ন। ফুটফুটে চাঁদের মতন চেহারা। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, বড় বড় আয়ত চোখ। মন দিয়ে তাকালে কেমন যেন করে ওঠে মনের মাঝে।
কারা ফেলে গেলো তাকে, আর কেনই বা ফেলে গেলো? পুলিশে খবর দিলে কি এসে নিয়ে যাবে, বা যাই হোক একটা কিছু গতি করবে?
২)
রমজান আলীর কথা শুনে হেসেই বাঁচে না লতিফা। পেশায় সে দেহপসরিনী, লোকে যাদের পতিতা বলে।
‘তোমার মাথাডা খারাপ হইসে, চাচা মিয়া? পুলিশ আইবো, আর মাইয়ার একটা গতি করবো? তুমি সত্য এইডা মানো?’
কথাটা আরিক অর্থেই সত্যি।
নগরীর সেই অন্ধকার এলাকা এটা, যেখানে তথাকথিত ভদ্র সমাজ তাদের কদর্য মনোবাসনা গুলি পূরণ করতে আসে। দিনের আলোয় এই এলাকা যতটা র্ঘৃন্য “ভদ্রলোকেদের” কাছে, রাতের বেলা ঠিক ততটাই আর্কষনীয়। অথবা বেশি!
রাত ভোর হবার আগ পর্যন্ত এখানে বেচা-বিক্রি চলে দেহপসারিনীর শরীরের। ভ্রাম্যমান কুলি-মজুর থেকে শুরু করে ছা পোষা মধ্যবিত্ত আর ধনী লোকের বখাটে কমবয়সী ছেলেরা, শারীরিক আনন্দের খোঁজে সকল প্রকার পুরুষেরই আসা-যাওয়া আছে এই অন্ধকার সড়কে। সদ্য যৌবনা তরুনী থেকে শুরু করে মেলে দশ/এগারো বছরের কিশোরী,মধ্য বয়সী অভিজ্ঞ বেশ্যা থেকে শুরু করে মেলে হিজড়া পর্যন্ত।
খদ্দের আসে, যার যেমন পছন্দ বেছে নিয়ে চলে যায় পছন্দসই কামরায়। আর পুলিশেরা আসে সপ্তাহন্তে একবার কেবল, বখরা উসূল করতে। নিরাপদে ব্যবসা করার জন্য পুলিশকে যে চাঁদা দিতে বাধ্য পতিতার দল, সেটুকু আদায় করাতেই তাদের দ্বায়িত্ব শেষ। তা ব্যতীত এই অন্ধকার গলি নিয়ে মাথা ব্যথা নেই নগরীর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর।
‘এই পাড়ায় পুরুষ মোটে তিন রকম, রমজান আলী। কাস্টুমার, দালাল আর পুলিশ।’ আবার বলে লতিফা। ‘আর তাগো কেউ এই মাইয়ার গতি করবো না কুনোদিন।’
‘এতকাল দেইখেও বুঝলা না, মিয়া! আর কবে বুঝবা?’ বলতে বলতে বেনচে এসে বসে সুরাইয়া। যদিও সে নারী নয়, তবু পাড়ার লোকে যাকে “খালা” বলে সম্বোধন করে। এই খালা ডাক “নারী” হবার সুবাদে নয়, কয়েকটা পতিতা মেয়েদের সর্দার হবার সুবাদে।
সুরাইয়া মধ্যবয়সী হিজড়া এখন, পাড়ার সবচাইতে বড় ঘর চারটে তার। বেশ অনেকগুলো মেয়ে আর হিজড়া নিয়ে জমজমাট ব্যবসা। তবে যৌবনে সে ডাকসাইটে দেহপসারিনী ছিল, আর সেই দেমাগ এখনও রয়ে গেছে তার হাবভাব আর চলনে-বলনে।
হিজড়া সর্দারনীর জন্যে তড়িঘড়ি চা বানায় রমজান আলী। কড়া লিকার, অল্প চিনি, আর অতিরিক্ত দুধ মেশানো এক কাপ চা। রাত অনেক হয়েছে, মেয়েরা কয়েকজন আজ দূরে খ্যাপ মারতে গেছে। তারা না ফেরা পর্যন্ত সুরাইয়া এখানেই বসে থাকবে, জানে সে। মেয়েরা ফিরবে, কড়ায়-গন্ডায় পাওনা বুঝে নিয়ে তবেই ঘরে প্রবেশ করতে দেবে। এর আগে নয় কোনো ভাবেই। বদমেজাজী, নির্দয় মানুষ হিসাবে ভয়ানক দুর্নাম আছে সুরাইয়ার। সকলেই জানে, মাসকাবারি পোষা গুন্ডাও আছে তার কিছু। যন্ত্রণা দায়ক খদ্দের খেকে শুরু করে শত্র“-মিত্র আর পুলিশের ঝামেলা, সমস্তই সামলায় এই গুন্ডার দল।
‘মাইয়াডার কি হইবো কও তো!’ চামচের টুংটাং আওয়াজ তুলে অনিশ্চিত কণ্ঠে শুধায় রমজান আলী। ‘আল্লাহ মাবুদ জানে কার ঘরের মাইয়া। আর ফালাই-ই বা গেসে ক্যান!’
‘এই রকম পাগল-ছাগল পোলাপাইন ঘরে পুষবোই বা ক্যাডা?’ তাচ্ছিল্য নিয়ে জবাব দেয় সুরাইয়া হিজড়া। ‘একে তো মাইয়া, তার উপরে পাগল। কি লাভ এইটরে পুইষে? স্বার্থ না দ্যাখলে বাপ-মায়েও পুছে না, বুঝছো? হাগা-মুতা করতে জানে না, হাঁটে না, কথা কয় না। এইটারে কোন বাপ মায়ে সহ্য করবো?’
‘কিন্তু তাই বইলে মেয়েরে এমনে কেউ ফালায় দেয় নাকি? গায়ে গতরে তো বড় হইতেসে মাইয়া.. ..রাস্তা ভরা লুকজন কতো. ...কে কহন কি করে...’
‘কি আর করবো... মাইয়া যদি কোনো রকমে বাইচে যায় তো দশ পুরুষে খাইবো। পাগলী মাইয়া, বছর বছর পেট বান্ধায় দিবো রাস্তাঘাটের লুকে। এর চাইতে মইরা যাক। সেইডাই ভালা।’
‘ফালানের জন্যে এই জায়গাই পাইসিলো হের বাড়ির লোকে. ...’ বিড়বিড় করে রমজান আলী। ‘চোরে সামনে আরও কত্ত কিছু যে দেখাইবো আল্লাহ পাক! ইন্দুরের বাচ্চার লাহান মরবো মানুষের বাড়ির, আর সেইডাও দেখা লাগবো চোরে সামনে।’
যদিও এই বেশ্যা পাড়ায় অনাকাঙ্খিত ভ্রুন আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকাটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, তবু কেন জানি এত বছরেও চোখ সয়ে যায়নি তার। তাছাড়া একটি মৃত ভ্রুন আর দশ/এগারো বছরের একটি মেয়ের মাঝে বিস্তর তফাৎ।
অবশ্য সুরাইয়া এ সবের বুঝবে কি? সে তো জন্ম হিজড়া, ছেলেপুলের জন্য মমতা কি জিনিস সেটা এই সুরাইয়া হিজড়া বুঝবে কি করে? রমজান আলীর নিজের সন্তান আছে একপাল , ছেলেপুলের মায়া সে ভালোই বোঝে।
‘কি করবা কও?’ রমজান আলীর মনোভাবকে পাত্তাই দেয় না পতিতা সর্দারনী। ‘কে নিবো এই পাগলের মুসিবত? মাথা ঠিক থাকলেও একটা কথা আছিলো, পাইলে-পুইষে ধান্দায় লাগায় দিতাম। এইটার হাগা-মুতা কে ঘাঁটবো কও? ধান্দায় লাগবো না, দুইটা পয়সা কামায় দিতে পারবো না। লাভ আছে গ্যাঁটের টাকা দিয়া পাগল পুইষে?.. .. কারও অত্ত ঠ্যাকা লাগে নাই, বুঝলা মিয়া?’
‘তাই বলে মাইয়াডা এমনে পইড়া থাকবো?’
‘পইড়া থাকবো না তো কি করবো? নিবা তুমি, সাথে নিয়া পালতে পারবা নিজের বাড়ি?.. .. পারবা না মিয়া। কেউ পারে না।’
কথা সত্য। ভীষণ রকম সত্য। অগত্যা আর কথা বাড়ায় না রমজান আলী। আসলেই তো! সে কি পারবে এই মেয়েকে তুলে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে? অন্যের দুঃখে দূর থেকে চুকচুক করাটা যতটা সোজা, কাছে গিয়ে সেই দুঃখ দূর করার চেষ্টা করা ততটাই কঠিন।
এই পাড়ায় কম-বেশী সকলেই তো ঘর পোড়া মানুষ।
কেউ চোখ খুলেছে রাস্তায়, বাপ-মা-পরিবারের হদিশ পর্যন্ত জানে না। কেউ ঘর পালানো মেয়ে, কেউ বা স্বামীর সংসার পালানো। কাউকে আবার আপনজনেরাই এসে বিক্রি করে দিয়ে গেছে কোনো “খালার” কাছে। কেউ বা ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে এই অন্ধকার দুনিয়ার ঘাটে, খুঁজে নিয়েছে দালালীর পেশায় রুটি-রুজী। কারও আবার জন্মই হয়েছে এই গলির ইতিহাসের বুকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই সকলের কাহিনীই একই রকম- নির্মম, রূঢ় বাস্তবতা দিয়ে ভরা। না কেউ কখনও তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শণ করেছে, আর না তারাও মমতা প্রর্দশন করতে শিখেছে। জীবনের যুদ্ধে যে কোনো মূল্যে টিকে থাকাটাই কেবল জীবন তাদের।
রাত হয়েছে। দোকান বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় রমজান আলী। যেখানে পরিবার আছে, নিশ্চিত নিরাপত্তা আছে, আছে শান্তির আশ্রয়। বাড়ির পানে হাঁটে সে মুখ ফিরিয়ে।
এবং রাস্তার ওপরে তখনও একটি অসহায় শিশু পড়েই থাকে একলা। ভীত, ুধার্ত,আতঙ্কিত। কেউ নেই যার এই সুবিশাল পৃথিবীতে।
রমজান আলী তখনও জানে না যে একটু সময় বাদেই তাকে আবার ছুটে আসতে হবে এখানে। শিশুটির তীè চিৎকারে যখন সকলে জড় হবে, সেই ভীড়ের মাঝে সেও হবে একজন।
৩)
দেখেই বোঝা যায়, কুকুরে কামড়ে দিয়েছে।
ফুটপাথ ভরা আধ পাগলা নেড়ি, গত দুদিনে যে কামড়ে দেয়নি সেটাই আশ্চর্য বরং। তবে সমস্যা কুকুরের কামড় না, সমস্যা অন্য কিছু। কুকুর কামড়েছে তো কি হয়েছে, তুলে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেলেই হবে। কিন্তু এই জড় বস্তুর মতন পাগলীকে ডাক্তারখানায় নেবেটা কে?
শুধু পাগল হলেও একটা কথা ছিল, আবার হিংস্রও। এক মেয়ের দালাল সাজ্জাদ ধরতে গেছিলো, আচ্ছা করে কামড়ে দিয়েছে তাকে। পুরো রক্তারক্তি অবস্থা। এইদিকে বন্ধও হচ্ছে না তার চিৎকার। পায়ে কুকুরের কামড় নিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে হারামজাদী।
‘আচ্ছা বিপদ হইছে তো।’ ভীড়ের মাঝে শোনা যায় একটি কণ্ঠ।
‘কার না কার গু, ফালায় গেছে আমাগো গলি.. ..’ আরেকটি কণ্ঠ।
‘থাপড়ায় দাঁত ফালায় দেয়ার দরকার, মাগীর। বালটা মরেও না।’ এবং আরও একটি কণ্ঠ।
গুণগুন চলতেই থাকে, তবে একসময় ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসে সুরাইয়া হিজড়া। পরনের শাড়ি এলোমেলো, চোখ জড়ানো ঘুমে। হিজড়া সুলভ রুক্ষ্ম চেহারা আরও রুক্ষ্ম হয়ে উঠেছে মেজাজ খারাপে।
‘তোরাও আছোস এক্কেরে।’ খেঁকিয়ে ওঠে সে। ‘এই শেষ রাইতে সিনামা শুরু করছে সবাই। এইটারে কুত্তায় কামড়াইছে তো তোগোর এত জ্বলতেসে ক্যান?’
‘খালা দ্যাখেন না কেমনে কামড়াইছে।’ জবাব দেয় লতিফা। ‘পাও ডা শ্যাষ।’
‘দিমু একটা থাপ্পড়!’ আবার খেঁকায় সুরাইয়া। ‘সোজা ঘরে যা, মাগী! এই ছেমড়ির জইন্যে এত পিরিত বাড়ছে ক্যা তোর, হ্যাঁ? এই জইন্যে পুষি তোগো আমি?’
পাল্টা জবাব দেয়ার সাহস হয়না, তবে চলেও যায় না লতিফা। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে রমজান আলীর পাশে। ‘খালায় মানুষ না, চাচা মিয়া। হেয় পাষাণ। লুকে ঠিকই কয়, হেজড়ায় আর কি বুঝবো বাচ্চা পুলাপানের মায়া!’
নিজের ঘরের মেয়ে গুলোকে ধমকে ধমকে ঘরে পুরতে থাকে সুরাইয়া, যেন মুরগীর বাচ্চা তারা কোনো। ‘ঢঙ না কইরে ঘরেত গিয়া ঘুমাও সক্কলে।’ বলে বাকিদের উদ্দেশ্য করে। ‘এই বালটারে নিয়া অস্থির হইয়া লাভ আছে? পাগল-ছাগল জিনিস, একলাই রাস্তায় পইড়া থাইকে মরবো। সরকারের গাড়ি আইসা লাশ তুইল্যা নিবোনে তখন।’
কথা গুলো কমবেশী কেউ-ই মেনে নিতে পারে না, তবে এড়িয়েও যেতে পারে না কেউ। কেননা ভুল কিছু বলেনি সর্দারনী। চেষ্টা তো বেশ কয়েকজন মিলে করেছে, কিন্তু এই মেয়ে কাউকে ধারের কাছে যেতে দিলে তো? কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারছে না তাকে, কাছে গেলেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কামড়ে দিতে আসছে। কথা বার্তা বলা দূরে থাক, কারও কথা বুঝতে পারে কিনা সে- তাই বা কে বলবে? আপাত দৃষ্টিতে মানুষের খোলসে জানোয়ারের মতন একটি শিশু।
লতিফাকে টেনে নিতে ভীড় ঠেলে এগোয় সুরাইয়া হিজড়া।
কয়েক মুহুর্ত বড় বড় চোখ গুলো মেলে তাকে দেখে শিশুটি, চেনার চেষ্টা করে যেন। আর হঠাৎই কি যেন হয়ে যায়, লাফিয়ে এসে সুরাইয়ার পা আঁকড়ে ধরে সে। দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মুখ ঘষতে পায়ের সাথে। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে, গোঁ গোঁ শব্দ করাও বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল বিড়বিড় করে বলছে কি যেন।
খুব ভালো করলে খেয়াল করলে বোঝা যায় যে বাচ্চা মেয়েটি বলছে- ‘মাম্মা. ...মাম্মা. ...মাম্মা।’ বলে যাচ্ছে আর বলেই যাচ্ছে। এই একটা মাত্র শব্দই হয়তো জানা আছে তার, এবং এই একটা মাত্র শব্দের মাধ্যমেই সে প্রকাশ করছে ভয়-ভালোবাসা-কষ্ট-অভিযোগ, আরও না জানি আরও কত সহস্র অনুভব।
‘খালারে মা ডাকতেছে মাইয়াডা!’ ভীড়ের মাঝে ফিসফিসে কণ্ঠ।
‘হেয় তো হেজড়া। হেজড়ারে মা ডাকতে যাবো ক্যান?’ আরেকটি কণ্ঠ।
‘মাইয়ার মায়ের লগে হয়তো চেয়ারায় মিল আছে, তাই মা ভাবতেসে।’ এবং আরেকটি কণ্ঠ।
‘হেজড়া তো হেজড়াই। হেজড়া আবার মা অয় নাকি?’
‘আরে মাইয়াও তো পাগল,,,’
তবে অসুস্থ হোক আর যাই হোক, মেয়েটার সম্বোধন শুনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে সুরাইয়া হিজড়া। স্থির, বিস্মিত। জীবনে অনেক নামেই ডেকেছে তাকে অনেকজন। কেউ ডেকেছে খালা, কেউ বা আবার “্এ্যাই, ওই” দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছে। আর সবচাইকে বেশীবার যে সম্বোধন শুনেছেন, তা হলো “সুরাইয়া হেজড়া”। সেটাই তার নাম। এবং নামের শেষের “হিজড়া” শব্দটাই তার পরিচয়।
কিন্তু মা.. ..
এত মানুষ ডাকতে তাকে কেন মা ডাকছে এই হতভাগী? তাকে কেউ শেখায়নি যে হিজড়াকে মা ডাকা যায় না? হিজড়া তো হিজড়াই। না নারী, না পুরুষ। বিধাতা যাকে মা হিসাবে স্বীকৃতি দেননি, পুরুষালী শরীরে নারীর একটা মন দিয়ে নিষ্ঠুর একটা খেলায় মেতে উঠেছেন- তাকে কেন মা ডাকছে এই শিশু?
কেন? কেন? কেন?
বুদ্ধি হবার পরে জেনেছেন যে জন্মের সাথে সাথেই হিজড়ার দলের কোলে তাকে ফেলে দিয়েছিলো বাড়ির মানুষ। কে বাবা, কে মা কখনও জানা হয়ে ওঠেনি তার। অপরাধ একটাই, হিজড়া হয়ে জন্ম নেয়া। যৌবনে ভালোবেসেছিলেন একজনকে, হিজড়া হবার অপরাধে তাকেও পাওয়া হয়ে ওঠেনি। কম বয়সে বোকার মতন স্বপ্ন দেখতেন- ভালোবাসার পুরুটিকে বিয়ে করবার, সংসার পাতাবার। স্বপ্ন কখনও সত্যি হবে না, জানতেন তাও। তবু বোকার মতন স্বপ্ন দেখতে আর দেখেই যেতেন। যে স্বপ্ন কখনও স্পর্শ করতে পারেনি তার ভালোবাসার পুরুষটিকে।
অসম্পূর্ণ শরীরের আড়ালে তার নারীত্ব ভরা যে মনটা কখনও দেখতে পায়নি কেউ, আজ কিভাবে দেখে নিলো এই মানসিকভঅবে অসুস্থ বাচ্চাটা? কিভাবে? কিভাবে অবলীলায় তাকে “মা” ডেকে বসলো? একজন হিজড়ার জন্যে এই ডাক যে বড় নিষিদ্ধ এক বস্তু!
এবং চরম বিস্ময়ে ল্য করে অন্ধকার গলির মানুষ গুলো.. ...
সুরাইয়া হিজড়া নামক বিগত যৌবনা দেহপসারিনী, পতিতা দলের সর্দারনী, পাড়ার সবচাইতে নিষ্ঠুর-নিমর্ম মানুষটা হু হু করে কাঁদছে ছেলে মানুষের মতন! পৃথিবী যাদের “অসুস্থ” বলে. তেমন একটি শিশুর অদ্ভুত সারল্য যাকে বিনাকারণেই কাঁদিয়ে দিয়েছে।
কিংবা কে জানে.. ..
কারণেই হয়তো!!
পরিশিষ্ট :-
ফুটপাথে ফেলে যাওয়া মেয়েটির নাম মায়া। দু/একটা শব্দ যেগুলো উচ্চারণ করতে পারে সে, নিজের নামটা তাদের মাঝে অন্যতম।
বিস্তর ডাক্তার দেখানো হচ্ছে তাকে, চলছে চিকিৎসা। পুরোপুরি তো সুস্থ হবে না কখনোই, তবে জড় বস্তুর জীবন থেকে অনেকটাই বের হয়ে এসেছে সে। মায়া এখন টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলে জানাতে পারে, রঙ পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুকি করতে পারে, শব্দ করে হাসতে পারে। কাউকে দেখলে কামড়ে দিতে যায় না, গোঁ গোঁ আওয়াজ করেনা, এক কোণায় একা বসে দিন কাটায় না। সুরাইয়ার বড় ইচ্ছা মায়াকে বিশেষ শিশুদের একটি স্কুলে ভর্তি করাবার। আরেকটু সামলে উঠুক মেয়েটা, একদিন নিশ্চয়ই ভর্তির ব্যবস্থা হবে।
ভালো আছে এখন সেই নিষ্পাপ-সরল শিশুটি, মায়া যার নাম।
এবং যার মায়ের নাম সুরাইয়া.. ..
সুরাইয়া হিজড়া।
ভালোবাসার সারল্যে মোড়া ভীষণ সহজ একটি সম্পর্ক তাদের!