তোমাকে বলেছিলাম বৃষ্টি দেবো

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

সাদ আহাম্মেদ
  • ১৫
ক্লাস ছুটি, গরম গরম রুটি।আমি হাসানের গলা চেপে ধরে বললাম, "দোস্ত খুব ক্ষিদা পাইছে।দয়া করে আমাকে একটা বনরুটি আর ৩ টাকা দামের মোটকু একটা কলা খাওয়া"।

হাসান হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "কেন নয় দোস্ত? চল তোকে কলা, রুটি সাথে বিস্কুটও খাওয়াবো"।

আমি মাথা চুলকাই।এইরকম তো হওয়ার কথা না।ঘটনা কি! যাই হোক, হাসানের সাথে ফ্যাকাল্টির বিল্ডিং থেকে বের হয়ে ক্যন্টনমেন্টের রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে তাকে একসময় জিজ্ঞেস করে ফেললাম, "দোস্ত তোর কি কোন হেল্পু লাগবে আমার থেকে?"

হাসান ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে, "দোস্ত ইয়ে মানে তোর পাশের বাড়ির মেয়েটার সাথে আমার আজকাল আসলে ফেসবুকে বিশাল বিশাল চ্যাট হয়।শুনলাম তোদের সাথে নাকি ভালো খাতির।বাসায় টাসায়ও নাকি যাস"।

আমি আমার বিখ্যাত ভূড়িখানা দুলাইতে দুলাইতে বলি, "হে হে।কিন্তু ওই মেয়ে তো আমাকে চায়।আমাকে প্রপোজ করছে দুইদিন আগেই"।

হাসান আমার দিকে আবার ক্যাবলা হাসি দেয়।তারপর বলে, "দোস্ত আমি জানি তুমি যে একটা বিশাল টাইপ লুইস।কিন্তু ওই মেয়ে তো তোর মত লুইস না, সে বুদ্ধিমতি।মেয়ে যে আড়ালে তোকে কমলা তেলাপোকা বইল্যা ডাকে এইটা কি জানিস লুইসরাজ?"

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।কোন একভাবে আমার প্রিয় রঙ কমলা এবং আমার কমলা রঙের একটা জ্যাকেট পড়ে আমি প্রায়ই গলিতে হেটে দাঁড়িয়ে ভাব মারি।এইজন্যই কি আমাকে এত খারাপ একটা নাম দিলো।আমি মুখে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য ফুটিয়ে রেখে বললাম, "ঠিক আছে।কাল তুই আমার ছাদে আসিস বিকাল পাচটায়।তোর সামনেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করবো এতদিন ধরে আমাকে যেইসব প্রেমপত্র দিয়েছিলো সোনাজান, পরাণজান লিখে সেগুলো তবে কি ছিলো?"

হাসান আমার কাধে হাত দিয়ে বলে, "দোস্ত মাইন্ড খাইসনা।নারী জাতি মায়ের জাতি, তারা মনের ভুলে অনেক কিছুই বলে ফেলে।এইজন্য মাইন্ড খাওয়ার বা পান করার কুনু প্রয়োজন নাই।তুই জাস্ট আমাদের একটু সেটিংস করে দিস।বিনিময়ে পাবি পাচ টাকার বন আর ৩ টাকার রুষ্টপুষ্ট কলা সপ্তাহে একদিন।আর একবার সেটিংস করায়ে দিলে তোকে খাওয়াবো মামা হালিম"।

আমি হাসিমুখে হাসানকে বলি, "বিয়ে করায় দিলে কি দিবি দোস্ত?"

হাসান অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে আমাকে বলে, "দোস্ত কি সুন্দর একটা কথা বললি।যদি এইটা করায় দিতে পারিস আমি তোকে দিবো এক বছরের মধ্যে সুন্দর একটা ভাতিজা।এক্কেবারে ম্যান প্রমিজ"।

হাসান সেইদিন আমাকে অবশ্যই আমার প্রিয় রুটি কলা খাওয়াইনি।ওর আত্না এতো টা স্ফীত এখনো হয়নি।তবে পরেরদিন আমি ঠিকই শানুকে ম্যানেজ করে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলাম ওর সাথে দেখা করায় দেবার জন্য।মীরজাফর হাসান শানুকে দেখে ভালোমানুষ মার্কা একটা হাসি দিয়ে প্রথমেই বলেছিলো, "শানু অর্ক আমাকে বলে তুমি নাকি ওকে অনেক প্রেমপত্র দাও। কথাটা কি সত্যি?"

আমি সেদিন কোনরকমে পালিয়ে বেচেছিলাম।পরেরদিন সকালে ক্লাসে যেয়ে আমি আমার আর্কি ড্রইং স্কেল দিয়ে হাসানকে বেদম প্রহার করি।তাকে নামকরণ করি মীরজাফর, ঘষেটি বেগমের ভাতিজা।হাসান আমাকে হাসতে হাসতে বলে, "দোস্ত সিরাজ উদ দৌলা, তোকে জাস্ট শানুর থেকে একটু কাট কইর্যাা দিছি।তোর মত লুইসকে আমি আবার একটু ডরাই কিনা।কবে আবার সত্যি সত্যি তোর মত একটা কমলা তেলাপুকাকে প্রপোজ করিয়া বসে বলা তো যায়না!"

রাতে মেজাজ বিলা করে ফেসবুকে বসে ছিলাম।মাঝে মাঝে ব্লগও পড়ছিলাম।হঠাৎ করে একটা সুন্দর নাম চোখে পড়লো ফেসবুকে, অজান্তিকা মায়া।আমি এত্ত সুন্দর একটা নাম দেখে বোধহয় একটু টাশকি খেলাম।প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটা আমার বেশ কিছু ভার্সিটির বন্ধুর পরিচিত।মোটা চশমা পড়া পড়ুয়া টাইপ একটা মেয়ে মনে হলো।তার প্রোফাইলে পছন্দের জিনিসের মধ্যে একশোবার লিখা আছে বৃষ্টি নামটা।আমি খুব একটা রোমান্টিক গোছের কেউ না।তাই বৃষ্টি নিয়ে তেমন আবেগ ভালোবাসা আমার কাজ করেনা।আমি মায়ার প্রোফাইল দেখছিলাম।আমার মনে হলো মেয়েটা বেশ গম্ভীর।আমার সাথে কবে কিভাবে সে ফেসবুকে বন্ধু হলো আমি বুঝতে পারছিলাম না।সাহস করে একটা মেসেজ দিয়ে বললাম, "আপনার নামটা খুব সুন্দর।এটা কি সত্যি আপনার নাম?"

তিনদিন পর রিপ্লাই আসলো, "কেমন আছেন অর্ক?আপনি বোধহয় আমাকে দেখে চিনতে পারেননি।আপনার সাথে ঢাকায় আবির আর সোমার সাথে এক আড্ডায় দেখা হয়েছিলো।আমি চিটাগাং প্রকৌশলে পড়ি কম্পিউটারে। মনে পড়েছে? আর হ্যা, এই নামটা আমার না।আমি ধার নিয়েছি"।

ওর প্রত্যুত্তর পাওয়ার পর সব মনে পড়লো।সেদিন মেয়েটার সাথে আমার ওভাবে কথাও হয়নি।সোমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফ্রি ফ্রি খেতে আমি ক্যান্টিনে চলে এসেছিলাম।এমন না যে সোমা দাওয়াত দিয়েছিলো।কোন এক অদ্ভুত কারণে ক্লাসের মেয়েগুলা আমাকে সহ্য করতে পারতোনা।মেয়েটার নাম কি যে ছিলো মনে পড়ছেনা! এটা মনে আছে, আমি লুইস রাজ সেদিনই তাকে ফেসবুক বন্ধু হবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।

সেদিনের পর থেকে আমার প্রায় সময় মায়ার সাথে গল্প হতো।আমি ওকে মায়া বলে ডাকতাম, যদিও ওর আসল নাম ছিলো মিতু।একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "মায়া তোমার বৃষ্টি এতো ভালো লাগে কেন?"

মায়া বলেছিলো, "আম্মু বলে আমি বৃষ্টির সময় হয়েছিলাম বলে নাকি বৃষ্টি আমার এত ভালো লাগে।আর আমি না বৃষ্টিটা অনুভব করতে পারি।তুমি জানো এটা কিভাবে অনুভব করতে হয়?"

আমি মাথা নাড়ি।তাকে বলি, "তুমি বলো তো কেমন করে?"

মায়া সেদিন আমাকে আর বৃষ্টির কথা বলেনি।ওর জরুরী ফোন এসেছে বলে চলে গিয়েছিলো।এক সপ্তাহ পরে আবার কথা হলো।ও খুব খুশি ছিলো বোধহয় সেদিন।আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আজ বৃষ্টিতে ভিজেছো নাকি?মনে এত রংধনু কোন সে কারণে সখী?"

মায়া আমাকে লিখে জানালো, "জানো অর্ক সবসময় চেয়েছিলাম প্রিয় একজন মানুষ আমার হাতটা ধরে কোন এক বৃষ্টির দিনে কবিতা শুনাবে।আজ সেই স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে।আমার জীবনটা ধন্য হয়েছে বন্ধু"।

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম," তুমি প্রেম করো? ভয়ংকর ব্যাপার।আমি ভেবেছি তুমি এইসব বুঝোইনা!"

মায়া হাসির ইমোটিকন দিয়ে বললো, "আসলেও বুঝিনা।কিন্তু প্রিয় মানুষটা একদিন খুব সুন্দর করে কবিতা দিয়ে বুঝিয়ে দিলো।আমি কখনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনি, কিন্তু ওর আমার দিকে তাকানো, সুন্দর সুন্দর মনটাকে চেপে ধরা কবিতাগুলো আমাকে শুধু ওর দিকে টেনে নিয়ে গেছে।আমার মনে হয় আমি আমার এই জীবনে যতটুকু ভালোবাসা একজনকে দেয়া যায় সবটা ওকে দিয়ে ফেলছি"।
একটু থেমে আবার লিখলো, "ইস তোমাকে কত কথা বলে ফেললাম।ক্লান্ত হয়ে গেলাম।তুমি রাগ করলা এত ভাব ভালোবাসার কথা বললাম দেখে?"
আমি তাকে লিখলাম, "মায়া এত সুন্দর করে কখনো কেউ ভালোবাসার কথা বলেনি।তুমি বললে, আমি জানলাম।ব্যাপারটা যেন খুব কাছে থেকে অনুভব করতে পারছি"।

মায়া আমাকে এর কিছুদিন পর চিটাগাং আসার দাওয়াত দিলো।আমি ঘরকুনো মানুষ, কিভাবে এতদূর যাই বুঝতে পারছিলাম না।তারপর একদিন কাধে ল্যাপটপ নিয়ে রাত সাড়ে এগারোটার তূর্ণা নিশিথার ট্রেনে চেপে বসলাম।যা থাকে ভাগ্যে।মাকে বললাম, ঘুরতে যাচ্ছি বন্ধুদের সাথে।খালার বাসায় থাকবো।

আমার ছোট খালা একটা ভয়ংকর মানুষ।আমি আসব শুনে নিজে আমাকে চিটাগাং রেল স্টেশন থেকে তুলে নিলেন।গাড়িতে গরম গরম পরোটা আর ভাজি ছিলো।আমি হাসিমুখে খালার নির্যাতন সহ্য করলাম।উনি আমাকে ছয়টা পরোটা নিজ হাতে খাওয়ালেন।তারপর বললেন, "আব্বু তুমি এত শুকায় গেছো কেন?"

আমি হাসিমুখে আমার ভূড়িতে হাত বুলিয়ে বললাম, "কে বলেছে?এই দেখো কি সুন্দর আমার ভূড়ি"।
খালা হেসে বলে, "ধূর এইটা কিছু না।আমার বাসা আসছো, তোমাকে এবার আরাম করে খাওয়াবো আব্বু"।
খালামণির দিকে আমি ব্যাক্কল টাইপ হাসি দিয়ে বললাম, "আচ্ছা ঠিক আছে"।

খালামণিকে নেগেটিভ কিছু বলা যাবেনা।বললেই, উনি কান্নাকাটি শুরু করে দিবেন।উনি আমাকে ছোটকাল থেকে পাগলের মত আদর করেন।খালার প্রথম বাচ্চাটা মারা যাওয়ার ঠিক পরপরই আমি জন্ম নিয়েছিলাম।খালা আমাকে প্রথম তিনবছর একদম কাছছাড়া করতেন না।আম্মাও আমাকে খালার কাছে দিয়ে দিয়েছিলেন।খালার আর সন্তান হয়নি।আমি তার একমাত্র সন্তান অনেকটা।প্রতিবছর তিন মাস খালা আমাদের বাসায় থাকেন আর আমাকে বিশাল যন্ত্রণা দেন।এই বুড়া বয়সেও খালা মাঝে মাঝে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।যেদিন চিটাগাং ফিরে আসেন সেদিন কাদতে কাদতে আমাকেও কাদিয়ে ফেলেন।এই একজীবনে এত ভালোবাসা কোথায় রাখবো ঠিক জানিনা।

মায়ার সাথে দেখা করতে গেলাম বিকালবেলা।পাহাড়ের আকাবাকা রাস্তা ধরে যখন ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম আমার তখন ক্ষুধা লেগেছিলো বেশ।ওদের ক্যান্টিনে বসে আমার প্রিয় বনরুটি চা দিয়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলাম।সেসময় হাসিখুশী মায়া আর তার থেকেও হাসিখুশি জাহিদ ওর ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে আবির্ভুত হলো।আমি দুজনের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলাম।বেশ লাগছিলো জুটিটা।আমি আগে খেয়াল করিনি কখনো যে মায়া এতো ছোটখাটো একটা মানুষ।জাহিদও বেশ চিকনা পাতলা একটা ছেলে।আমার অর্ধেক মনে হয়।মায়াকে বললাম, "কেমন আছো?এই কি তোমার সেই বিখ্যাত প্রিয় মানুষটা যার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসো?"
মায়া একটু লজ্জা পেলো মনে হলো।জাহিদের হাত ধরে বললো, "জ্বী হা।কিন্তু তুমি এত পেটুক কেন?এসেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছো?"
আমি লজ্জা লজ্জা হাসি দিয়ে বললাম, "ইয়ে তোমাদের এখানে ঝাকি ঝক্কর খেতে খেতে আসছি তো তাই ক্ষুধাটা জেকে বসলো।তোমরা বসো না।দুইজনকে জোস লাগতাসে জানো"।

আমি খেয়াল করলাম মায়ার দিকে কেন যেন তাকাতে পারছিনা।ওকে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করতে হবে ও কোন পারফিউমটা ব্যাবহার করে।এত সুন্দর গন্ধ আগে তো পাইনি।

জাহিদ আমাকে বেশ ভালো একটা ভূড়িভোজ করালো।তারপর বললো, "আপনি নাকি খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন?"
আমি বেশ ভয় পেলাম।কারণ একথা যদি স্বীকার করি তাহলে নিশ্চিত আমাকে এরা একটা গান গেয়ে শোনাতে বলবে।নিজেকে অপরিচিত একটা জনতার সামনে কা কা করে গান গাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করে হাসিমুখে বললাম, "আরেহ না! এইটা মাঝে মাঝে ভাব মেরে বলি, পুরাই চাপাবাজী।ছোটকালে কি হয়েছিলো, আমাকে আম্মা শখ করে গান শিখিয়েছিলো।দুই তিনমাস গান শিখার পর একদিন গানের টিচার ভেগে গিয়েছিলো।আমার আর গান শেখা হয়নি"।
জাহিদ হাসিমুখে বললো, "কোন সমস্যা নাই।আপনার ভাঙ্গা গলার গানই নাহয় শুনি"।
আমি ঢোক গিলে বললাম," আচ্ছা নেক্সট টাইম যখন আসব চিটাগাং তখন অবশ্যই শুনাবো কথা দিলাম"।
মায়া এসময় বললো, "বুঝলাম।এখন বলো আমাদের দুজনকে কেন তোমার জোস লাগলো?"
আমি হাসিমুখে মায়ার দিকে তাকাই।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, "তোমার সাথে সবাইকেই জোস লাগবে"।

মায়াকে আমার বেশ ভালো লাগতো। এ ব্যাপারটা সেই মুহূর্তটায় টের পাই।নাহ ঠিক ভালোবাসা টাইপ ভালো লাগা নয়।অন্যরকম।বর্ণনা করে বোঝানো যাবেনা।

পরেরদিন মায়াকে ফোন করলাম।ওকে বললাম, "তোমার প্রিয় বৃষ্টি হচ্ছে।আমি জানতাম না এখানে এত সুন্দর বৃষ্টি হয়"।
মায়া খিল খিল করে হাসলো,বললো, "তোমাকে একদিন বলেছিলাম না বৃষ্টি কিভাবে অনুভব করতে হয় শেখাবো।আজ শিখবে?
আমি বললাম, হ্যা শিখবো"।

খালার বাসা থেকে ওদের বাসাটা খুব কাছেই ছিলো।আমি ঠিক ১২ মিনিট পর ওদের বাসায় পৌছে গেলাম। ও আমাকে ওদের ছাদে নিয়ে গেলো।তারপর বললো, "এটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছাদ।এই সুন্দর ছাদে তোমাকে আমন্ত্রণ অর্ক মিয়া।এখন চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির আওয়াজ শোন"।

আমি চোখ বন্ধ করলাম। ঝরঝর বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে পেলাম।আবার যেন মনে হলো কানের কাছে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে।আমি হাত মেলে হাটতে থাকি, নিজেকে খুব পবিত্র মনে হচ্ছিলো।মায়াদের ছাদে অপূর্ব কিছু ফুলের গাছ ছিলো।আমি সেগুলোর গন্ধ নেই চোখ খুলে। বৃষ্টির সময় কি এরা আরো গন্ধ ছড়ায়, আমি জানিনা।আমি হাত দিয়ে গাছের পাতা ছুই, ফুলের গন্ধ নেই।এভাবে কখনো প্রকৃতিকে অনুভব করিনি।একজন মায়া আজকে আমাকে জানান দিলো, পৃথিবীটাকে ভালোবাসা নিয়ে দেখতে হয়, আবেগ দিয়ে অনুভব করতে হয়।এর প্রত্যেকটা উপাদান জল বৃষ্টি সব কিছু ভেতর থেকে দেখতে হয়।তখন বুঝা যাবে পরম করুণাময় কি অসাধারণ মায়া নিয়ে তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

আমি মায়াকে জিজ্ঞেস করি, "মায়া এখন বর্ষাকাল চলছে তাই না? কদম ফুল কোথায় পাওয়া যায় বলো তো?"

মায়া আমাকে কিছু বলেনা। আমি খেয়াল করলাম ও চোখ বন্ধ করে হাত পেতে বৃষ্টির পানি কুড়াচ্ছে। অনেকটা Singing in the Rain এর ক্যাথির মত।ওর সারা শরীর থেকে কি ভয়ংকর সুন্দর গন্ধ আসছে।ওর গাল বেয়ে পানি ঝড়ছে, চুল যেন ঝর্ণাধারা। আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।একটা নিস্তব্ধ পৃথিবী তখন চারদিকে, কেউ নেই সেখানে। শুধু ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সৃষ্টি মায়া।

আমি ওর কাধে টোকা দেই।ও আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "কি?"
আমি জিজ্ঞেস করি, "এমন করে বৃষ্টিকে কি করে অনুভব করো বলো তো?"

ও আবার চোখ বন্ধ করে বলে, "আমি পারি।কেন পারি জানিনা।একটাই শুধু ভয় হয় মাঝে মাঝে জানো।মনে হয় যদি কখনো এই বৃষ্টি না হয়।যদি এই অনুভবগুলো হারিয়ে যায়।আমি তাহলে কি করে বাচবো বলো তো? ভালোবাসার মানুষটাকে কি করে তখন নিজের কথাগুলো বলবো?"

আমি ওর দিকে হাসিমুখে তাকাই।তারপর বলি, "আমি যাই। ঠান্ডায় আমার শরীর কাপছে মায়া"।
মায়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "ইয়াল্লাহ তোমার তো দেখি শরীর সত্যি সত্যি কাপছে।গায়ে জ্বর আছে নাকি?"
আমি বললাম, "না। তা নেই।কিন্তু একটু ঠান্ডা লাগছে"।
মায়া আমার কপালে হাত দিয়ে চোখ কপালে তুলে বললো, "তোমার তো দেখি বিশাল জ্বর ছেলে।নামো নামো এখনই ছাদ থেকে নামো"।

আমার কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছিলো।ধুপধাপ করে সিড়ি দিয়ে নেমে আসছিলাম।মায়া আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে এসে বললো, "তুমি বাসায় আসতে পারতে অর্ক।শরীরটা অন্তত মুছে নেয়ার দরকার ছিলো।আমার খুব লজ্জা লাগছে।তুমি আমাকে বলোনাই কেন যে তোমার জ্বর"।

আমি গাড়িতে উঠে বসে ওকে বলি, "কোন ব্যাপার না"।

ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গাড়িটা চলে যাচ্ছিলো।আমি ড্রাইভার হারুণ ভাইকে গাড়িটা আবার একটু মায়ার কাছে নিয়ে যেতে বললাম।মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে আছে তখনো।ওর কাছে যেয়ে আমি বললাম, "মায়া একটা কথা দেই তোমাকে।যদি কখনো বৃষ্টি হারিয়ে যায় আমি তোমাকে বৃষ্টি এনে দিবো।কিন্তু তুমি কখনো বদলিয়ে যেওনা ঠিক আছে"।
কথাগুলো মায়ার হাত ধরে বলছিলাম।মায়ার মুখ আমার কথা শুনে হা হয়ে গিয়েছিলো।আমি দ্রুত চলে আসি। গাড়িতে উঠার পর হারুণ ভাই কাশতে কাশতে বললেন, "প্রেম ভালোবাসা খুব ডেঞ্জার জিনিস"।

মায়ার সাথে পরের চার বছর আমার দেখা হয়নি, কথা হয়নি।আমি জানতাম না ও কেমন আছে।আমি আর ফেসবুক ব্যবহার করতাম না। কখনো না।ফোন নম্বরটাও বদলে ফেলেছিলাম।সেইদিন কেউ একজন আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।বৃষ্টিকে ভালোবাসতে, তাকে বুকের মাঝে লালন করতে।কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে বৃষ্টির মধ্যে সেও লুকিয়ে আছে। আমি এখন নিউইয়র্কে বাস করি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ।দেশে ফিরবো দুদিন পর।আপাতত স্মিথ নাইন স্ট্রিটে অপেক্ষায় আছি ট্রেনের।পৃথিবীর দীর্ঘতম হাই ওয়ে সাবস্টেশনে তখন বৃষ্টি হচ্ছে।আমি তাড়াহুড়ো করে G ট্রেনে উঠে বসি।বৃষ্টি হলেই আমার মায়ার কথা মনে পড়ে।ছোট্টখাটো মেয়েটা কি এখনো বৃষ্টিকে সেরকম পবিত্র মন নিয়ে অনুভব করে আমি জানিনা।আমি আমার পকেট থেকে ছোট্ট ডায়েরীটা বের করে লিখতে থাকলাম, "অজান্তিকা মায়া এখন এই ভীনদেশের বৃষ্টির মাঝে নিজের দেশের বর্ষাকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।নাহ! আমাদের মত এত সুন্দর বৃষ্টি এখানে হয়না।বর্ষার বারিধারা এখানে তেমন সুরেলা ধ্বনিও সৃষ্টি করতে পারেনা।তবুও তোমার মত করে আমি অনুভব করার চেষ্টা করি।বেশ ভাল লাগে জানো।সেদিনটায় ফিরে যাই, আমার সবচেয়ে জাদুকরী দিনে"।

এটুকু লিখে ডায়েরীটা বন্ধ করে দেই।আমি জানি এই কথাগুলো কখনো মায়াকে বলা হবেনা, শোনানো হবেনা।তবে এবার ঠিক করেছি দেশে যেয়ে মায়ার সাথে একবার দেখা করবো। কিছু না বলে হুট করে ওর বাসায় চলে যাবো।তবে ওর যদি বিয়ে হয়ে যেয়ে থাকে তাহলে সমস্যা।মেয়েটা কি এখনও তেমনটাই আছে।বড় বড় চোখ দিয়ে সব কিছু তাকিয়ে তাকিয়ে অনুভব করে।

জুন মাসের ২২ তারিখ দেশে ফিরে আসি।আমার খালা আর মা আমাকে দেখে প্রথম যে কথাটা বললেন, "আমাদের ছেলে এত শুকাইলো কেমনে?"
আম্মাদেরকে কে বুঝাবে যে আমার ওজন আরো দুই কেজি বেড়েছে গত তিনমাসে।এক সপ্তাহ আমি বিশাল পেইনের উপর থাকলাম।এই খাওয়া ওই খাওয়া।৬৪ জেলার ৬৪০ রকম খাবার আমাকে গলঃধকরণ করানো হয়েছে।শুধু কান্না করাই বাকি ছিলো।মাঝে একদিন শানুর সাথে দেখা হলো।ওর কোলে কি সুন্দর একটা বাচ্চা, ভয়ংকর ফুটফুটে।শানুকে বললাম, "কেমন আছো?"
শানু খুব আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায় বলে, "ভালো আছি।তুমি ভালো আছো ভাইয়া?"
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।আমার বন্ধু হাসানের কথা খুব মনে পড়ে।আমার এই বন্ধুটা যেদিন আমি নিউইয়র্কে চলে আসছিলাম ভোর চারটা বিশে সে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে ঢুকে আমাকে জড়ায় ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে।আমি ওকে বলি, "দোস্ত কান্না থামা।নাহলে মানুষ ভাববে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড"।
হাসান হাউমাউ করে কাদতে কাদতেই বলে, "দোস্ত তোরে নিয়মিত বনরুটি আর কলা খাওয়াবো।কসম খোদার।তুই যাইস না"।

আমি কোথাও যাইনি।হাসানটা চলে গেলো।আমি নিউইয়র্কে আসার একবছর পর ও বরিশালের লঞ্চডুবীতে মারা গেলো।আমাদের মন্ত্রীসাহেব তখন ভুড়ি দুলিয়ে বলছিলেন, "প্রত্যেক পরিবারকে একটি ছাগল দেয়া হবে।বিশ হাজার টাকা দেয়ার ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে"।
বন্ধু হাসান তুই যেখানে থাকিস ভালো থাকিস।

চিটাগাং আসলাম সপ্তাহ খানেক পর।আমার সাথে খালাও আসলো।খালা বোধহয় একটু সন্দেহ করে ফেলছেন।আসার পথে গাড়িতে বারবার আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, "মেয়েটা কে?"
আমি হাসতে হাসতে বলি, "তোমার পাশের বাড়ির পাচ বছরের যে পিচ্চি মেয়েটা ছিলো সেই মেয়েটা"।

খালা সিরিয়াসলি আমার কথাটা নিয়েছিলেন বোধ হয়।উনি মাথা নেড়ে চিন্তিত ভঙ্গী নিয়ে বললেন, "ও তো তোকে বিয়ে করবেনা।বয়স হয়নি।তারমধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে প্রায়ই বলে, অর্ক ভাইয়া মোটকু।ওকে কেউ বিয়ে করবেনা।"

আমি হাসি।ভাবতে থাকি মায়ার কথা।সেই বর্ষার পর এখন আরেকটা বর্ষা।মেয়েটা আমাকে চিনবে তো?রাগ করে নাই তো?অনেকে হয়তো ভাবছেন এতো দিন পর কেন তার সাথে যোগাযোগ করবো, কি দরকারটাই বা ছিলো?আসলে কোন দরকার ছিলোনা।তাকে ভয়ংকর ভালো লেগেছিলো এটা বলার জন্যও ঠিক তার কাছে যাচ্ছিনা।সে তা জানে, বেশ ভালোভাবেই জানে।অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। আমি যাচ্ছি , শুধু যাচ্ছি তাকে একটাবার দেখতে।কেমন আছে সে?বিয়ে করেছে জাহিদ নামের সেই হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছেলেটাকে?কেমন চলছে তাদের সংসার?এসবকিছু খুব কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছে।বেশ অনেকদিন ধরে ইচ্ছা হয়েছে।ব্যক্তিগত ব্যস্ততা, পড়াশোনার চাপ সব মিলিয়ে তা হয়ে ওঠেনি।এতদিন পর নিজ দেশে ফিরে ভালো লাগার মানুষটিকে কি একবারো দেখতে মন চাইবে না?

মায়াদের বাড়িটা একটু পুরনো ধাচের, মনে হয় যেন দুশ বছর আগের কারিগররা খুব যত্ন করে এক একটা ইট গেথেছে।আমি ওদের ড্রইংরুমে বসে আছি।একটু পর ওর মা এসে জিজ্ঞেস করলো, "বাবা তুমি মায়ার সাথে দেখা করতে এসেছো?"
আমি মাথা নেড়ে বললাম, "জ্বী।ওর বন্ধু ছিলাম।আমিও প্রকৌশল বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম।ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?এখন থাকেনা এখানে?"

ওর মা হাসলেন।বললেন," না বিয়ে হয়নি।আমার মেয়েটার তো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।তুমি কিছু জানোনা?"

আমার বুকের ভেতর একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।আমি আমতা আমতা করে বললাম, "আমি আসলে দেশে ছিলাম না তিন বছর ধরে।পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য ব্যস্ত ছিলাম।ও কি আছে?"

মায়ার মা মাথা নাড়লেন।বললেন,"একটু বসো"।

আমি অপেক্ষা করতে করতে একসময় মায়া আসলো।ওকে একটা হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসলো ওর মা।আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।মায়া আমার দিকে তাকিয়ে কি লজ্জা পাচ্ছিলো, নাকি ওটা অন্য কিছু ছিলো ওর চেহারায়।কতটা বদলে গেছে মেয়েটা, সেই মায়াবতীর চেহারায় কি ভয়ংকর একটা বিষণ্ণতা।আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "মায়া আমি অর্ক।আমাকে চিনতে পারছো তো?"
মায়া মাথা নাড়ে।আমাকে খুব রুগ্ন কন্ঠে বললো, "কেন পারবোনা বলো?কেমন আছো তুমি?সোমার থেকে শুনেছিলাম তুমি দেশের বাহিরে চলে গেছো"।
আমি মাথা নাড়ি।ওকে বলি, "অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে।তোমার চোখের নিচে ভাজ পড়ে গেছে মায়া"।

মায়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর হেসে দিলো।ঝরঝর করে হাসতে হাসতেই বললো, "অর্ক তুমি এখনো ঠিক ওই আগের মতই আছো।যা ইচ্ছা তাই বলে ফেলো"।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে বলি, "মায়া আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে এভাবে দেখবো।তুমি কি চাচ্ছো আমি এখন চলে যাই?"

মায়া মাথা নাড়লো, "তা কি বলেছি একবারো?আজব তো! যাও বসো ঠিক করে।কতদিন পর আসলা।তোমার সাথে কতকিছু শেয়ার করছি একসময়।কতদিন কত গল্প করছি, বৃষ্টি নিয়ে কত কত অনুভবের কাহিনী বলেছি।আমি আর মা মিলে আজকে মজার পায়েস রান্না করেছি মোষের দুধ দিয়ে।তুমি হবে আমাদের গিনিপিগ আজকে।ঠিক আছে?"

আমি সাগ্রহে আমার সম্মতি জানালাম।তারপর বললাম, "তোমাদের ছাদে কি এখনো সুন্দর সুন্দর গাছগুলো আছে?লাল নীল ফুল হয়?"

মায়া চোখ বড় বড় করে বললো, "হ্যা আছে।বাগানবিলাসটা আরো ফুল দেয় এখন জানো।শুধু কষ্ট একটাই, আমি এখন আর গাছগুলো দেখতে যেতে পারিনা, ছুয়ে দিতে পারিনা।সিড়ি ভাঙ্গতে খুব কষ্ট হয়।মাঝে মাঝে যখন খুব কান্না করি তখন ভাইয়া অথবা আম্মু কোলে করে নিয়ে যায়। আর. . . . . . . ."

আমি ওরদিকে তাকিয়ে বলি, "বৃষ্টিতে ভেজা হয়না তাই না?খুব ইচ্ছা করে?"
মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার দিকে একবারও তাকায় না।ওর চোখে পানি জমাট বেধেছে দেখতে পারি।আমি সেদিন রাতেই ঢাকা ফিরে যাবার ট্রেনের টিকেট করেছিলাম।যেতে পারিনি।

পরবর্তী এক সপ্তাহ আমি মায়াদের বাসায় প্রতিদিন গেলাম।ওকে আমার ফটোগ্রাফার সত্তাটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম।আমার মনে হয় আমি খুব সুন্দর ছবি তুলতে পারি।ভিয়েতনামের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আছেন।নাম রারিন্দ্র প্রকর্ষ।তার সাথে একবার নিউইয়র্কের একটা আর্ট গ্যালারীতে দেখা হয়েছিলো।আমি তখন টুকটাক ছবি আকি।তার সাথে পরিচয়ের পর জিজ্ঞেস করলাম, "ছবি কেমন লাগলো আমার?"
রারিন্দ্র আমার দিকে বিষণ্ণ হয়ে তাকিয়ে বললো, "এগুলো শুধু ছবি।শিল্প হয়নি"।
আমি হতাশ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "কখন শিল্প হয় বলো তো?"
রারিন্দ্র তার ভ্রু উচিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বললো, "যখন তুমি একটা স্থিরচিত্রকে জীবন দিতে পারবে ঠিক তখন তা শিল্প হবে"।
এরপর আমি তার শখানেক কাজ দেখলাম এবং একসময় আমার চোখ দিয়ে পানি এসে পড়লো।আমি তাকে বললাম, "আমাকে ছবি আকা শিখাবে?"

মায়াকে আমি এই গল্পটা শুনালাম, রারিন্দ্রর ছবি দেখালাম।মায়ার খুব পছন্দ হলো।একদিন হঠাৎ করে মায়াকে জিজ্ঞেস করলাম, "জাহিদ কেমন আছে মায়া?"
মায়া হেসে বললো, "ভালো আছে তো।ঢাকাতে কোথায় যেন চাকরী করছে।ওর খুব সুন্দর একটা বউ আছে"।
আমি স্বাভবিক গলায় বললাম, "ওকে এখনো চাও তাই না?"
মায়া আমার দিকে দুষ্টু শিশুদের দিকে বড়রা যেভাবে তাকায় সেভাবে তাকালো।তারপর বললো, "এত্ত ভালোবাসা চাওয়া পাওয়ার কথা বলো কেন?এইসব কিছু না।জগত এবং জীবন সবকিছু বাস্তবতা দিয়ে বিচার করবে"।

যেদিন চিটাগাং ছেড়ে চলে আসব সেদিন মায়াকে শেষ বিদায় জানাতে ওর বাসায় গেলাম।আকাশটা খুব মেঘলা ছিলো সেদিন।আমি যখন মায়াদের বাসায় পৌছালাম তখন ঝুম বৃষ্টি নামলো।আমি বেশ কিছুটা ভিজলাম।মায়া তখন ওর ঘরে বসে আছে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে।আমি হঠাৎ করে মায়াকে দেখে অপ্রস্তুত হলাম।ওর চোখ ভরা পানি, কার প্রতি যেন খুব অভিমান।খুব বেশি।আমাকে দেখে বললো, "জানো যেদিন আমার বান্ধবীর মৃত্যুর প্রতিবাদ করে মিছিল করে পায়ে গুলি খেয়েছিলাম সেদিনও এত কষ্ট হয়নি।জানো যেদিন জাহিদ আমার কাছে কাচুমাচু মুখে এসে জানালো আমার সাথে আর থাকতে পারবেনা কারণ আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই সেদিনও এতো কষ্ট হয়নি।আমার খুব কষ্ট হয় তখন যখন বৃষ্টিটা আমি অনুভব করতে পারিনা"।

আমার গলায় তখন কি যেন একটা দলা পেকে আছে।আমি ওকে বললাম, "মায়া বৃষ্টি এত আপন লাগে কেন?"

মায়া চোখ মুছতে মুছতে বললো, "অর্ক আমার পাশে বসো।তোমাকে না বৃষ্টিকে অনুভব করা শিখিয়েছিলাম।ভুলে গেছো?"

আমি মাথা নেড়ে বলি, "নাহ ভুলিনাই।যখন প্রত্যেকটা বৃষ্টির ফোটা আমার গায়ে পড়ছিলো নিজেকে খুব পবিত্র মনে হচ্ছিলো।আমার ভেতরে যে আকাশটা আছে সেই আকাশটা থেকেও বৃষ্টি ঝরেছিলো।ভেতরে যতগুলো কষ্ট ছিলো সব মনে হইয়েছিলো কেউ মুছে দিচ্ছে"।
মায়া অনেক কাদতে থাকলো।আমাকে বললো, "আমার অনেক কষ্ট হয় কেন জানো?বৃষ্টি আমাকে জানান দিয়ে যায় নিজের পঙ্গুত্বের কথা, আমাকে শিখায় কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে নেই, আমাকে কানে কানে বলে কাউকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে নেই।আমার চোখের সামনে এখনো আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীটার লজ্জায় কুকড়ে যাওয়া মৃত দেহটা ভাসে।যে কুকুরটার জন্য আমার বান্ধবীটা আত্নহত্যা করেছিলো সে সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে এখনো ঘুরে বেড়ায়।আমি মানতে পারিনি, প্রতিবাদ করেছিলাম। এই দেখো কি অবস্থা এখন!"

আমি মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।ওকে কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ও নিজে থেকে বলে আবার, "জাহিদ যখন চলে যায় তখন অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম জানো।যাকে সবকিছু দিয়ে ভালোবাসলাম যে আমার ওই কঠিন সময়টায় পাশে থাকবে ভেবেছিলাম সে আমার থেকে এমন করে চলে গেলো কেন? আমি বোকার মত ভাবতাম ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।আমাদের গরীব দেশে আল্লাহ সবচেয়ে সুন্দর যে উপহারটা দিয়েছেন আমি সেটা শুধু ওই একজনের সাথে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম।সব শেষ হয়ে গেলো।এই দেখো আবার বৃষ্টি হচ্ছে।আমাকে এখন কেউ বৃষ্টিটাকে ওভাবে দেখাবেনা।কেউ না! আমিও এই বৃষ্টিটা আর ছুয়ে দিতে চাইনা।কোনদিন না!"

আমি ওর কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করলাম।ও কিছু বুঝে উঠার আগে আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম।এরপর ছাদের দিকে ভৌ দৌড়।ও হতভম্ব হয়ে কান্না থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আমি ওকে নিয়ে ছাদে যখন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ও আবার কেদে দিলো।আমি ওকে বললাম, "এখন আকাশের কাদার সময়।তোমার না।তুমি খুব দুষ্টু মেয়ে বুঝলা।বৃষ্টির সাথে অভিমান করার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে"।

মায়া কান্না করা অবস্থায়ই বললো, "আমি কি করবো বলো।আমি তো হাটতে পারিনা"।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "সারাজীবন তোমাকে এমন করে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।কথা দিচ্ছি কক্ষণো ছেড়ে যাবোনা।আমাকে ভালোবাসতে হবেনা।চাইতে হবেনা।শুধু আমার সাথে বৃষ্টিকে অনুভব করতে হবে।আমাকে আরো শেখাতে হবে তুমি কেমন করে এত ভালোবাসা নিয়ে প্রকৃতিটাকে ভোগ করো।শেখাবে?"

মায়া কিছু বলেনা। চোখ বুজে বৃষ্টির পানি তার সারা শরীরে মাখিয়ে কিসের যেন আত্নপ্রশান্তি অনুভব করে।আমি মুগ্ধ হয়ে মায়াবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মগ্নতা উপভোগ করি।একজীবনে এমন ঘোর লাগা সময় আর কে আমায় উপহার দিয়েছিলো?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Faysal Azam অসাধারন একটা গল্প,পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম
আহমেদ সাবের গল্পটার পাঠক নেই সম্ভবতঃ দু কারণে - (১) গল্পটা বড় দেখে অনেকে আগাতে সাহস পান নি আর (২) প্রথম প্যারাটা পড়ে মনে হবে, এটা একটা অপক্ব হাতের রস-রচনা। গল্পের গভীরে যেতে যেতেই বুঝলাম, যারা গল্পটা পড়ন নি, তারা নিজেদের উপর কি বিশাল একটা অবিচার করেছে। ভালবাসার কি সুন্দর প্রকাশ! মায়ার পঙ্গুত্ব মায়াকে জাগতিক দুঃখ দিলেও অর্কের অনুভবে প্রেমের অমরাবতীতে পৌঁছে দিয়েছে। এক কথায় একটা অসাধারণ গল্প। গল্পকারের আরও গল্পের জন্য প্রতীক্ষায় থাকলাম। গল্প-কবিতায় লেখককে স্বাগতম।
প্রিয় আহমেদ সাবের, আমি লিখালিখি করি নিজের জন্য।এই সাইটটা শুধু গল্প লিখালিখির জন্য বলে গল্পটা শেয়ার করা। এবং অবশ্যই আপনাদের মত চমৎকার কিছু পাঠকের জন্য যারা শুধু গল্প পড়েন না, অনুভব করতেও জানেন। পাঠক কম অথবা বেশি হলো তাতে আমার কোনই দ্বিধা নেই। আমি নিয়মিতই লিখালিখি করি তবে ব্লগে। আশা রাখি আপনাদের এখানেও মাঝে মাঝে আমার গল্প শেয়ার করবো। ধন্যবাদ অনেক।
মিলন বনিক রীতিমত মুগ্ধ...সত্যিই অসাধারণ একটা গল্প...প্রিয়তে নিলাম...জীবনের অনেক সুক্ষ অনুভুতিগুলো উঠে এসেছে....শুভ কামনা জানবেন...
প্রিয় ত্রিনয়ন আপনাকেও ধন্যবাদ।
Sisir kumar gain বেশ সুন্দর গল্প,বেশ ভালো লাগল।শুভেচ্ছা রইলো।
আরমান হায়দার বেশ ভাল লাগল। শুভকামনা আপনার জন্য।
প্রিয় আরমান হায়দার, আপনাকেও শুভেচ্ছা।
মোঃ সাইফুল্লাহ চালিয়ে যান । শুভ কামনা রইল
আপনার জন্যও শুভকামনা।
sakil mugdho hoye pore gelam onek romantik ebong bastobotar golpo. Ei golpe bristi upolobdhi hoyeche vhalobasar majhe. Lekhoker kache aro emon lekha pathok hisabe chaitei pari.
প্রিয় পাঠক ধন্যবাদ।
ইউশা হামিদ খাসা গল্প সাদ ভাইয়া !!! চালিয়ে যান । শুভ কামনা রইল বন্ধু !!!

২১ জুলাই - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী