এক
খুব ছোট্ট কিন্তু সত্য ঘটনা।
আলমারির ভেতর থেকে একটা নেভি ব্লু রঙের সুতি শাড়ী বের করে নিয়ে ছোঁয়া তার স্বামী মাহিনকে জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পেরেছ এটা? মনে করতে পারছ কি?”
কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকলো মাহিন।
বলল, “আমি কি সত্যিই চিনতে পারছি?”
২০০৭ সাল। মার্চ মাসে ছোঁয়া আর মাহিনের বিয়ে হয়েছিল । বিয়ের পর সেটা ছিল ছোঁয়ার প্রথম জন্মদিন, ০৭ আগস্ট ২০০৭ । মাহিন মাস্টার্স পাশ করার পর অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই ওরা বিয়ে করে বসল। মাহিন ছিল নিষ্কণ্টক বেকার আর ছোঁয়া সবে এইচ, এস, সি পাশ করে অনার্স-এ ভর্তি হবে। তখনি ঘটল বিয়ে নামক এই অনিবার্য ঘটনাটি। পরিবার-পরিজন কেউই এই বিয়েতে রাজি ছিল না, বিশেষ করে মাহিনের। সকাল থেকে রাত অনেক কটু কথাও শুনতে হতো ওদের দুজনের, বিশেষ করে ছোঁয়ার। জুলাই এ মাহিনের চাকুরি হয় একটা বেসরকারি ব্যাংকের সেলস ডিপার্টমেন্ট-এ। বেতন খুবই কম, মাত্র ৫,০০০ টাকা। কিন্তু তা বলে তো আর চাকরি না করলে চলে না। ৬ জুলাই জয়েন করল কাজে। ৭ তারিখে সিদ্দেশ্বরীতে একটা বাসায় উঠল সাব-লেট। শর্ত প্রতি মাসের ৩ তারিখের মধ্যে ভাড়া অগ্রিম দিতে হবে। ঐ দিকে প্রেয়সী স্ত্রীর কথাটি কানে ননস্টপ বাজতে থাকে।
“আমাকে একা রেখে কোথাও যেওনা প্লিজ।”
“কথা দিলাম সব সময় সাথে রাখব তোমায়,” মাহিন বলেছিল।
তাই ২০ জুলাই বৌকে নিয়ে ঢাকার বাসায় উঠল।
কয়েক দিনের মাঝেই তারা বেশ গুছিয়ে ফেলল তাদের ছোট্ট সংসার।
এদিকে ছোঁয়ার জন্মদিন ঘনাতে শুরু করল।
দুই
দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট ২০০৭। খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গল মাহিনের। বাসা ভাড়া আর বাজার খরচ করে হাতে আছে মাত্র অল্প কিছু টাকা, ২০০ টাকা । সামনে পুরো মাস আর আজ ছোঁয়ার জন্ম দিনও। কি করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, কিন্তু করতে হবে একটা কিছু। পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় মানুষের জন্যে কিছু করার তাগিদ চিরন্তর। আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করল না। নাশ্তা না করেই খুব সকালে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। শুধুই হাঁটছিল রাস্তায়। রাসেল মাহিনের পুরনো বন্ধু। ওকে কিছু টাকার কথা বলেছিল যদি কাজ হয়। ওর সাথে দেখা হল সকাল ৯ টায়। যেহেতু রাসেল বেকার, তাই ৩৪৫ টাকার বেশি দিতে পারল না।
“উফফ! কি যে করি,” মাহিনের আস্ফালন।
রামপুরা থেকে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে চলে গেল কোন খেয়াল ছাড়াই। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ছেঁড়ার চেষ্টা করছিল।
আচমকা চোখে পরল একটা A4 সাইজের প্রিন্ট করা বিজ্ঞাপনঃ রক্ত ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। যোগাযোগঃ ০১৭১২-৫২৮১৮৭ ।
ঠিক করল রক্ত বিক্রি করবে কারণ কোন উপায় নেই। মাহিন তার প্যান্টের ডান পকেটে রাখা নকিয়া ১১০০ মডেলের মোবাইল ফোনটা বের করেই একটা কল করল। কাকরাইলের একটা প্রাইভেট ক্লিনিক। এক ব্যাগ রক্তের সাধারণ ক্রয়মুল্য এখানে ৫০০ টাকা। রেয়ার হলে একটু বেশি। মাহিনের রক্তের গ্রুপ O (+ve) । খুব আনকমন গ্রুপ নয় বলে তিন ব্যাগ রক্তের দাম ১,৫০০ টাকার বেশি পাওয়া গেল না। মাথাটা কেমন জানি ঝিম-ঝিম করছে রক্ত দেয়ার পর। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুর ১ টায় ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গেল মাহিন।
ছোঁয়াকে দেবার অনেক জিনিসের কথাই মাথায় আসছে। কিন্তু কি নেয়া যায় ভাবছে। যুতসই একটা কিছু হতে হবে।
“উম... শাড়ী নিতে হবে। নীল রঙের শাড়ীতে ছোঁয়াকে লাগে যেন এক পরী।”
ভাবতে ভাবতে মগবাজার আড়ং- এ ঢুকল। কিন্তু চক্ষু চড়কগাছ। অনেক দাম। যেটাই একটু ভালো লাগে সেটাই অনেক দাম। যেটা সব চেয়ে কম দামি সেটা ছিল ৩,৯৯০ টাকা । আর্দ্র চোখ নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হল মাহিনকে।
এরপর মাহিন চলল লক্ষ্যহীন ভাবেই। হঠাৎ চোখ পরল “গ্রামীণ চেক” এর একটা শো-রুম। ঢুকতেই রিসিপশনের ডান দিকের রো-তে রাখা একটা সুতি শাড়ীতে চোখ আটকে গেল। নেভি ব্লু রঙের এই শাড়ীটা যেন ছোঁয়ার জন্যই তৈরি। সরাসরি কাউন্টারে গিয়ে প্যাক করতে বলল। দাম দিতে গিয়ে দেখল দাম ২,০৯৫ টাকা। কিন্তু পকেটে ছিল শুধু ২,০৪৫ টাকা। ক্যাশিয়ারকে ডিসকাউন্ট এর অনুরোধে কোন কাজ হল না। শেষে কোন উপায় না পেয়ে মাহিন তার নোকিয়া ১১০০ মোবাইল ফোনটা জমা রেখে বাকি ৫০ টাকা একদিন পরে দিয়ে যাবে বলে কথা দিল। এতে কিসমত সাহেব, মানে ক্যাশিয়ার সম্মতি দিলেন। অতঃপর মাহিনের মহানন্দে শাড়ী নিয়ে বাসায় ফেরা ।
তিন
দুপুর ৩ টা। মাহিন বাসায় আসতে এত দেরি করেনা কখনও। অনেক বার ফোন করেও মাহিনকে পাওয়া যাচ্ছে না। খুব চিন্তিত ছোঁয়া। মন খারাপ করে খাটের উপরে বসে আছে। খুব দুশ্চিন্তা লাগছে। প্রায় ৪ টায় কলিং বেল বাজল। দরজা খুলতেই ওপাশে মাহিন উকি দিল।
“এত দেরি কেন? কতক্ষন ধরে বসে আছি জানো?”
“একটু কাজে আটকে গিয়েছিলাম তাই,” মাহিন বলল।
“তাহলে ফোন ধরলে না কেন? তুমি কি জানো না কেউ অপেক্ষা করে তোমার জন্য?”
“কানে ধরছি, আর হবে না,” অপরাধ ঢাকার চেষ্টা জনাবের।
শাড়ীর প্যাকেটটা ছোঁয়ার হাতে দিয়ে মাহিন বলল, “শুভ জন্মদিন ছোঁয়া।”
শাড়ীটা পেয়ে খুব খুশি হল ছোঁয়া। কিন্তু তার থেকেও অবাক হল। কারণ, এত টাকা তখন মাহিনের কাছে থাকার কথা না।
“সত্যি করে বল এত টাকা তুমি কোথায় পেয়েছ? না হলে আমি এটা পরবো না।” ছোঁয়ার জেদ।
মাহিন তো বলতেই চায় না। শেষে ছোঁয়া তার মাথার দিব্যি দিল।
“উফ! ঠিক আছে যাও বলছি।” মাহিন পুরো ঘটনা বলল।
ছোঁয়ার চোখে জল। সেই জলে শাড়ীটাও কিছুটা সিক্ত হল। বোধ হয় বুঝার পর থেকে এতটা কান্না কখনও কাঁদেনি। নিজেকে অনেকখানি অপরাধি ভাবলো সে।
অনেক কষ্টে মাহিন তার ছোঁয়াকে শান্ত করল।
ছোঁয়া মাহিনকে বলত মাহিনের জন্য ওর প্রেম প্রতিদিনই দ্বিগুণ হয়।
মাহিন হাসত আর বলত, “আমার ভালবাসা প্রতিদিনই বাড়ে। তবে সেটা ইনফিনিটিভ।”
মাহিন প্রায়ই ওর স্ত্রীকে চিঠি দিত। আজও দিল তবে খুব ছোট্ট একটাঃ
“ইচ্ছে করে বাতাস টাকে
মুঠোয় ভরে তোমায় দিতে,
তোমার খোঁপায় গোলাপ নয় গো
লজ্জাবতীর ফুল দিতে ।”
দুপুরের ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে একটু পরেই ছোঁয়া সেই শাড়ীটা পরল। মাহিন শুধু তাকিয়েই থাকলো। আর যেন নির্বাক হয়েই হাজার কথা বলল। এতটাই মুগ্ধ হল যে চোখে একটু জল চলে আসল।
“তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, দেবে?” ছোঁয়ার প্রশ্ন।
“চাও,” মাহিন আশ্বস্ত করল।
“আমাকে সব সময় এমনি করেই ভালবেসো।”
“না, পারব না।” সহজ জবাব মাহিনের।
“কেন?” কিছুটা অবাক ছোঁয়া।
“কারণ তোমাকে এর থেকেও অনেক বেশি করে ভালবাসব আমি।”
“দুষ্টু,” ছোঁয়া মাহিনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল।
চার
আজ ৭ আগস্ট ২০১২। সকাল থেকেই মাহিনদের বাসায় একটা উৎসব উৎসব ভাব। মাহিন, ছোঁয়া আর তাদের তিন বছরের মেয়ে সারা। দীর্ঘদিন পরে সেই শাড়িটা দেখে মাহিনের আগের দিনের কথা খুব মনে হল আর বলল,
“হ্যাঁ, আমি চিনতে পেরেছি। খুব মনে আছে আমার। এটার কথা মনেই হয় নি কখনও।”
“তাই? কেন?” ছোঁয়া অবাক।
“মনে করবো কি? ভুলতেই তো পারিনি।” আবার বলল মাহিন।
“ইশ! তুমি না এখনও সেইরকম।”
“খোদা করুন, আমি যেন এমনই থাকি, তোমার জন্য পাগল।” মাহিন আবার বলল।
ছোঁয়া মুচকি হেসে চলে গেল। আজ ছোঁয়া সেই শাড়ীটাই পরবে, সাজবে ঐ আগের মত করে।
আজ বিকেলে অনেক মেহমান আসবে ওদের বাসায়। আমিও দাওয়াত পেয়েছি। বেচারা ব্যাস্ত থাকায় আমায় ফোনেই দাওয়াত দিয়েছে। যাবো একটু পরেই। পাঁচ বছরের বেশি দাম্পত্য জীবনের অনেক চরাই-উতঁরাই পেরিয়ে আজ ওরা সবাই এখানে। সময় পেরিয়েছে, কিছুটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে, অনেক কিছুই বদলেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও তাদের দুজনের ভালবাসার এতটুকু ঘাটতি নেই। সেদিন মাহিনের সাথে হঠাৎ দেখা হয়েছিল।
“কি রে কেমন আছিস?” জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“খুব ভালো আছি বন্ধু। কারণ, ছোঁয়াকে দেয়া কথা রাখতে পেরেছি। আর সেই সাথে ভুলে যাইনি আমার দ্বায়িত্বও।” ও বলল।
খুব ভালো লাগল ওর কথা শুনে। প্রার্থনা করি ওরা যেন সবসময় এরকমই থাকে।
ওহহো, আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি চললাম। তা না হলে এক্ষুনি হয়ত মাহিন ফোন করে বসবে।
১৩ জুলাই - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪