১.
ভোর না হতেই ফোন। ফোনটি করেছেন আমার মায়ের একমাত্র ভাই- মামা শফিকুর রহমান। এতো সকালে ফোন আসলে কার ভালো লাগে বলুন তো? অন্য কেউ হলে গরম দিয়ে ফোনটা রেখে দিতাম। কিন্তু মামা বলে কথা!
-মামা!
-আবীর! তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস?
-মামা, এখনো তো ভোরই হয়নি ভালোমতো!
-ওহ! তাই তো! দেখ উত্তেজনায় ভুলেই গেছি যে এখনো ঠিকমতো ভোর হয়নি!
-তা কি নিয়ে এতো উত্তেজিত? ভোর না হতেই ভাগ্নেকে স্মরণ করেছেন?
-তোকে বলবো বলেই তো ফোন দিয়েছি! শোন, নতুন একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে! এর জন্য তোকে তিনজন অন্ধকে খুঁজে বের করতে হবে! যাদের বিশেষ প্রতিভা আছে! পারবি না?
-হুম। পারবো। কিন্তু আসল কথাটাই তো বললেন না! কি করবেন অন্ধদের নিয়ে?
-একটা রিয়েলিটি শো করবো! যেখানে অন্ধ প্রতিযোগিদের জন্য অন্ধ বিচারক থাকবে!
-আপনি কি সিরিয়াস?
-তুই কি এখনো এটাকে ফান মনে করছিস?
-আচ্ছা ঠিক আছে। এক সপ্তাহ পর দেখা করবো আপনার সাথে।
২.
আমি এখন মামার অফিসে। আমার সাথে তিনজন অন্ধ লোক।
একজন হলেন- আমাদের থানার ওসি- গোলাম সাহেব।
আরেকজন হলেন- আমাদের এমপি শামীম হাসান।
আর তৃতীয়জন হলেন- আমার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী- জনাব হানিফ আরেফী।
আমার ফোন পেয়ে মামা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন ঘরে। ঢুকেই তার চোখ ছানাবড়া। তিনি বসতে বসতে কুশলাদি পর্ব সেরে নিলেন।
আমি বললাম- মামা, এনেছি।
-কি?
-বলেছিলেন না- যে, তিনজন অন্ধ লোকের সন্ধান দিতে যাদের বিশেষ প্রতিভা আছে?
-কোথায় তারা?
-এই যে আপনার সামনে বসা!
সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে পড়লো। সবার চোখে আগুন। এমন আগুন যে আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবে। মামার মুখ পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। না-জানি আবার এইটার জন্য জেল খাটতে হয়! সবাই এমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেনো আমি হলাম উনাদের শিকার আর তারা হলো হায়েনা।
কিছুক্ষণ পর আমি একটু কাশলাম। আস্তে করে বলে উঠলাম, কেউ রেগে যাবেন না, প্লিজ! প্রথমে আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে তারপর আপনারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন আমাকে।
মামা খেঁকিয়ে উঠলেন। বললেন, তুই কি জানিস কাকে কি বলছিস? তোর মাথা ঠিক আছে?
পুলিশ বলে উঠলেন, থানায় নিয়ে রিমান্ডে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে! এখানে নিয়ে এসে আমাদের সাথে ইয়ার্কি করা হচ্ছে?
এমপি সাহেব বলে উঠলেন, তুমি আমার ছেলের বন্ধু! না-হলে তোমাকে এতক্ষণে বুঝিয়ে ছাড়তাম কে কানা! তোমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে কি মামলা করা যায় সেটা ভেবেই মামলা করবো। পথে বসাবো তোমাদের! অপমান করা হচ্ছে ডেকে এনে?
এমপি সাহেবের পর শুরু করলেন বুদ্ধিজীবী স্যার। তিনি বললেন, সুমু? তুমি যা বলছো তা কি সজ্ঞানে বলছো? তুমি যে তোমাদের গুরুজনদের অসম্মান করছো এটা কি বুঝতে পারছো?
আমি বললাম, স্যার! প্রতিটি রুমে সিসি ক্যামেরা চালু করা আছে। আমরা যদি এইরকম উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলি তাহলে এটা মিডিয়াতেও চলে যেতে পারে। জানেন তো, আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা যায়না!
দেখলাম, কথাটাতে কাজ হলো। সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। দেখলাম, মামার মুখ অজানা আশঙ্কায় শুকিয়ে গেছে।
আমি আবার শুরু করলাম।
...গত বুধবার আমি রমিজ চাচার দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন বেলা ১২টা মতো বাজবে হয়তো। হঠাত করেই দেখলাম সুলতান ভাইয়ের দোকানে আমাদের ওসি সাহেব তিনজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির। গরম কাল। তারউপর আবার একেবারে দুপুর বেলা। প্রচন্ড গরম পড়ছে। এই গরমে সবাই ঘরে বসে ফ্যানের নিচে বসে আরাম করছে। বাইরে খুব বেশী মানুষ নেই। পাঁচ থেকে দশজন লোক ছিলাম আমারা। যাইহোক, আমি চায়ের দোকান থেকে দেখছিলাম সব। আমি দেখলাম, ওসি সাহেব সুলতান ভাইকে কড়া গলায় দোকান থেকে ডাক দিলেন। হুংকার দিয়ে সাথে আনা সাঙ্গপাঙ্গদের বললেন দোকান ঘর সার্চ করতে। এদিকে সুলতান ভাইয়ের সাথে ওসি সাহেবের বচসা চলছে। ঠিক তখনই আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওসি সাহেব কি সূক্ষ্ম দক্ষতায় সুলতান ভাইয়ের পকেটে একটা সাদা কিছু ঢুকিয়ে দিলেন। সুলতান ভাই টেরও পেলেন না।
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলাম। ওসির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চেহারার রঙ পাল্টানো শুরু হয়েছে। আমি আবারও একটু কাশলাম।
বলতে লাগলাম, এরপর ওসি তার সাঙ্গপাঙ্গদের আদেশ দিলেন সুলতান ভাইয়ের দেহ তল্লাশী করার জন্য। শুরু হলো দেহ তল্লাশী। সাথে সাথে এক পোটলা হেরোইন পেয়েই ওসি চিৎকার করে উঠলেন। শুরু করলেন হুমকি ধামকি। দোকানে বসা লোকগুলো কিছুই বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে শুধু দেখতে লাগলো। এইবার শুরু হলো ওসি সাহেবের আসল খেলা। সুলতান ভাইকে বললেন, ১ লাখ ছাড়! কেউ কিচ্ছু জানবে না। না দিলে বুঝতেই পারছিস...!
এমপি আঙ্কেল ওসির উপর তাড়া মেরে উঠলেন, এতো বড় জোচ্চুরি!
ওসি সাহেব হুঙ্কার মেরে আমাকে বললেন, কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে? কি সব দুই নাম্বারি কথা বলছেন?? যথেষ্ট হয়েছে!
আমি বললাম, ভিডিও আছে। দেখাবো?
এক কথাতেই ওসি মূষড়ে পড়লেন। আর কোনো কথা বললেন না।
আমি এবার আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। বললাম, আঙ্কেল এবার আপনার পালা। এমপি আঙ্কেল ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মানে? আমি যথেষ্ট সুর নরম করে বললাম, ওই যে! ব্যাখ্যা দিচ্ছি তো! আমাদের এই আড়াই কিলো রাস্তা করার জন্য টাকা এসেছে দুইবার। মোট পাঁচ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী এসে ঘুরে যাওয়ার মাস খানেক পরেই রাস্তা আবার আগের মতোই। আপনি খেয়েছেন, দুই কোটি, জেলা সভাপতিকে দিয়েছেন ৫০ লাখ, কাজ করেছেন মাত্র ১ কোটি টাকার, আর বাকীটা আরো যারা আছে তারা ভাগ করে খেয়েছে।
এইটুকু বলে আমি বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। এমপি আঙ্কেলের মুখ ঘামছে। বার বার মুছে ঘামমুক্ত করার চেষ্টা করছেন। দৃশ্যটা খুব ভালো লাগছে। এই মুহুর্তে আমার বুদ্ধিজীবী শিক্ষক বলে উঠলেন, ছিঃ এমপি সাহেব ছিঃ! আপনাকে একজন সজ্জন মানুষ হিসেবেই জানতাম। আর আপনি কিনা...। দুর্নীতি আমাদের সমাজটাকে খেয়ে একেবারে নিঃশ্বেষ করে ফেলছে! মানুষ আপনাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে তাদের উন্নয়নের জন্য! আর আপনারা তাদের জিনিস এইভাবে মেরে খাচ্ছেন...!
আমি একটু বড় করে কাশলাম। দেখলাম, মামা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে। আগের টেনশন আর দেখা যাচ্ছেনা তার চোখেমুখে। এখন তিনি শুধু বিস্মিত হচ্ছেন। হা করে কথা শুনছেন। আমি বললাম, স্যার! এইবার কিন্তু আপনার পালা! একটু মন দিয়ে শুনুন।
স্যার বড় বড় চোখ করে তাকালেন আমার দিকে। আমি বললাম, স্যার! আপনার সেইদিনের টকশোটা কিন্তু দারুণ ছিলো। আপনি প্রায়ই একটা কথা বলেন, দেশকে খুব ভালোবাসেন আপনি। এই দেশকে ভালোবাসতে হলে সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। বিদেশে পড়ে থাকলে চলবে না। দেশের সংস্কৃতিকে নিজের মনে ধারণ করতে হবে, লালণ করতে হবে। কিন্তু আমি আশচর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম, আপনার একজন সন্তানও দেশে বাস করেনা। তারা সবাই ওয়েস্টার্ণ কালচার ফলো করে। স্যার, এই মিথ্যা অভিনয় করে দেশের মানুশের সামনে ভালো সেজে হয়তো হাততালি পান। কিন্তু যারা আপনাদের ভন্ডামি ধরতে পারে তারা আপনাকে চরম ঘৃনা করে। আপনার ব্যাপারে আরো তথ্য আমি জানি। আপনি কিভাবে দেশবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত সভ্য মানুষের ভেক ধরে। আপনি সম্মানিত মানুষ। সেগুলো আমি আপনাকেই বলবো ব্যাক্তিগতভাবে।
৩.
কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই ঝিম ধরে বসে আছে। মামা বসে বসে নখ কামড়াচ্ছেন। আমি মামার দিকে তাকিয়ে বললাম, মামা! আমার ব্যাখ্যা শেষ। এইবার শুনুন এনাদের আমি কেনো কানা বলেছি। এই তিনজনেরই সৃষ্টিকর্তা চোখ দিয়েছেন। সুন্দর একটা মন দিয়েছেন। কিন্তু এরা সবাই দেশবিরোধী কাজে নিয়োজিত। জনবিরোধী কাজে নিয়োজিত। এদের চোখ আছে তবুও এরা অন্ধ। কারন এদের মনের চোখ কানা। মাথার সামনের চোখগুলো শুধুমাত্র এরা পথ দেখার জন্য টিউবলাইট হিসেবে ব্যাবহার করে। এই জন্য এরা যা দেখে সেটা মাথার চোখ হয়ে হৃদয়ের চোখে পৌছায় না। আর যাদের হৃদয়ের চোখ অন্ধ তারা কখনো কোনো ভালো কাজ করতে পারেনা। কারন, তারা মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারেনা। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়- সেটা ধরতে পারেনা। তাদের কাছে শুধু মনে হয়, উনারা যেইটা করছেন সেইটাই সঠিক। আর বাকীরা সব ভুল। অতএব আমি এনাদেরকে অন্ধ বলে কোনো ভুল করিনি। আর এনাদের স্পেশাল প্রতিভা কি জানেন? এনারা অভিনয়ের রাজা। আপনি বুঝতেই পারবেন না কোনটা অভিনয় আর কোনটা বাস্তব। পুলিশ অভিনয় করে আপনাকে জেলের ঘানি টানাবে, চাঁদা আদায় করবে। রাজনৈতিক নেতারা অভিনয় করে ভোট আদায় করবে। আর দেশবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা স্লিপিং পয়জনের মতো আপনার শরীরে এমন কিছু বিষ ঢুকিয়ে দিবে যে কেউ চিন্তাই করবে না- এইটা কি! এনাদেরকে আপনি নির্দ্বিধায় আপনার রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক করতে পারেন। এক কানার বিচার করবে আর এক কানারা। ইন্টারেস্টিং!
কথাগুলো বলে আমি চুপ করে রইলাম। সবাই যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। আমি মনে মনে গান ধরলাম,
এ সব দেখি কানার হাট-বাজার...
২৩ জুন - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪